ফেরা

ফেরা

বড় ভাইয়ের সাথে সামান্য কারণে বিরোধের জের ধরে সাদেক শহরে চলে যেতে মনস্থির করে। গ্রামে তার সংসার বেশ ভালোভাবেই চলছিল। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া জমিও পেয়েছে বেশ। যা দিয়ে তার দুই মেয়েকে লালনপালনসহ সংসারের যাবতীয় কাজ চলে। সাদেক ছোট হওয়ার কারণে বড় ভাই কাশেম বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করে। কিন্তু এতো কিছু করার পরও সাদেক গ্রামে থাকতে অার রাজি হলো না। কারণ, তার বড় ভাই কাশেমের সাথে নানা কারণে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে।

সাদেক তার স্ত্রীকে বলে,’চলো কাল অামরা ঢাকা চলে যাই।’

সাদেকের স্ত্রী কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে বলে,’ এমন কী হয়েছে, যার কারণে ঢাকা যেতে হবে?’

সাদেক তার মেজাজটা শান্ত করে বলে,’ যেতে বলেছি যাবে, এতো কথা কীসের!’

সাদেকের স্ত্রী মর্জিনা তার স্বামীর স্বভাব সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত অাছে। তাই অার কিছু বলে না। একটু থেমে মর্জিনা বলে,’ ঢাকা যাবে বুঝলাম, তা সেখানে গিয়ে কী করবে? থাকবে কোথায়?’

সাদেক একটু শান্ত গলায় বলে,’ঢাকায় অামার এক বন্ধু অাছে, নিশ্চয়ই ও একটা ব্যবস্থা করে দেবে। কোথায় থাকবো? অার কাজ! অাগে যাই তারপর দেখা যাবো কী করি।’

মর্জিনা কথাটা শুনে অাশ্বস্ত হতে পারে না। তার মনে সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে। একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অাশঙ্কা তাকে বিমূঢ় করে তোলে।

ঢাকা শহরে সাদেক বেশ কবার এসেছিল। অনেক অাগে। তাই সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণাও ছিল। রাস্তা পার হতে একটু একটু সমস্যা হয়। রাস্তা পারাপার হতে জেব্রাক্রসিং অার ওভারব্রিজ সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয় সাদেক মর্জিনাকে। সাঁইসাঁই করে গাড়ি যাচ্ছে। ফোন করে সাদেক তার বন্ধু নোমানককে তাদের অাসার কথা জানিয়েছে ঢাকা অাসার অাগেই।

সাদেক মর্জিনাকে বলে,’বুঝলে, ঢাকার রাস্তা পার হতে গেলে চোখ-কান খুলে রাখতে হয়। অার সবসময় দেখেশুনে চলাচল করতে হয়। এক কদম ফেলতে তিনবার ভাবতে হয়।’

মর্জিনা,’ হুঁ।’ বলে মাথা নাড়ে।

মর্জিনা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকে। কী করবে বুঝতে পারে না। তাদেরর দুই মেয়ে অাশা অার বিন্তিকে শহরে অানতে চেয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে ছোট মেয়ে বিন্তিকেই নিয়ে অাসতে হলো। অার অাশাকে রেখে এসেছে ওর নানাবাড়ি। অাশার বয়স সাত বছর। একটি কেজি স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে ওকে। অার বিন্তির বয়স চার বছরের কাছাকাছি। অাশাকে রেখে তার নানাবাড়ি রেখে বিন্তিকেই শেষ পর্যন্ত নিয়ে অাসতে হয়েছে।

ঢাকায় এসে সাদেক তার বন্ধু নোমানের দেখা পেলো। কিন্তু ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে অনেকটা বদলে গেছে। নোমান কী কাজ করে সাদেক তাও জানে না। কিন্তু পোশাক-অাশাকে সাহেবী ভাব এসেছে।

সাদেকের সাথে দেখার হবার পর নোমান হাসিমুখে বলল,’কেমন অাছিস দোস্ত? গাড়িতে অাসতে কোন অসুবিধা হয় নাই তো?’

সাদেক মৃদুস্বরে বলে,’ না রে, তোর ভাবির অসুবিধা হতে পারে।’

নোমান হাসতে হাসতে বলে,’ যাহোক, চল অাগে খেয়ে নেই। কিছু তো খাসনি মনে হচ্ছে। মুখ দেখি অামসত্ব বানিয়ে ফেলেছিস।’

রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে ওরা। উদ্দ্যেশ্য; হোটেল। পেছনে মর্জিনা বিন্তিকে নিয়ে হাঁটছে। হাতে ছোট্ট একটা ব্রিফকেস। প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়। মর্জিনার দম যেনো বন্ধ হয়ে অাসতে চায়। তবু নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। হাঁটছে সাদেক অার নোমানের সঙ্গী হয়ে।

নোমান হাতের সিগারেট টানতে টানতে বলে,’ তো ভাবি ভালো অাছেন তো? সেই যে অাপনাদের বিয়ের সময় গেছিলাম। তারপর অার যাওয়া হয়নি। বাপ-মা মারা গেলো, ভাবলাস গ্রামে থেকে অার কী করবো! তাই ঢাকার দিকে উড়াল দিলাম,ফুড়ুত!

কথাটা শুনে মর্জিনার সহানুভূতি জেগেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে নোমানের কথা বলার ধরন পরিবর্তন দেখে, সে বিস্মিত হয়।

নোমান গর্বের সাথে বলে,’জানেন ভাবি এখন টাকা উড়াই অার পাখি ধরি। পাখি ধরি অার টাকা উড়াই।’

মর্জিনা খানিক চুপ করে থেকে বলে,’ বুঝলাম না।’

সাদেক তখন বলে,’থাক অার বুঝতে হবে না। ও কি অার অাগের মতো অাছে! পুরাই চেঞ্জ।’

নোমান বলে,’দোস্ত চেঞ্জ না হলে এ দুনিয়ায় কেউ টিকতে পারে না। কুত্তা-বিড়ালের মতো বেঁচে কী লাভ! না অাছে কোন সুখ না অাছে কোন শান্তি। খালি হাউকাউ করে কি জীবন চলে। তাই চেঞ্জ হওয়া দরকার।’

হঠাৎ বিন্তি কান্না শুরু করে দেয়। হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে,’ অামি খাবো, অামি খাবো।’

মর্জিনা জিজ্ঞাস করে, ‘কি খাবি? বিন্তির কোন উত্তর নেই।
অাবার চিৎকার বিন্তির চিৎকার,’অামি খাবো, অামি খাবো।’

সাদেক অার নোমান দুজনেই বিন্তিকে জিজ্ঞেস করলো। কোন লাভ হলো না। কোনমতেই কান্না থামছে না। বিন্তি নতুন করে চিৎকার শুরু , ‘ অামি অাপুর কাছে যাবো। অামি অাপুর কাছে যাবো।’

সাদেক নোমানকে বলে,’ দোস্ত তাড়াতাড়ি চল। অামাদের দুজনের প্রচুর ভুখ লাগছে। ‘

কিছুক্ষণ হাঁটার পর এক হোটেলের কাছে এসে পড়ে তারা।

নোমান বলে,’এইতো এসে পড়েছি। অামরা সুযোগ পেলে এই হোটলেই অাসি। খাওয়া-দাওয়া করি। হোটেল মালিক বেশ সজ্জন ব্যক্তি। অামাদের অনেক খাতির করে। হোটেলের নামটা দেখেছিস, অামার প্রিয় বাংলা খাবার হোটেল। বল, দোস্ত কী খাবি?’

সাদেক বলে,’দাঁড়া। অাগে তোর ভাবিকে জিজ্ঞেস করি।’

সাদেক মর্জিনাকে,’বলো কী খাবে জলদি বলো।’

মর্জিনা সহজ উত্তর ,’ভাত খাবো।’

‘ভাতের সাতে অার কী কী খাবে?’

‘ভাতের সাথে মাছ অার ডাল।’

সাদেক বলে,’ ঠিক অাছে।’

অর্ডার করার পর খাবার এসে হাজির। তিনজনে খাবার খেয়ে ওঠে। বিলটা নোমানই দেয়। যদিও সাদেক বারবার অাপত্তি করেছিল। কিন্তু নোমানের জয় হয়। ইতোমধ্যে বিন্তি ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর জন্যেও নোমান কেক, পাউরুটি, চিপস অার জুস কিনে নেয়। সাদেক বিস্মিত। অার ভাবে, এতো পরিবর্তন নোমানের! মুখ ফুটে বলতে পারে না কিছুই । কীভাবে কী হলো তার!

সাদেক চিন্তিত হয়ে বলে,’ দোস্ত অামরা থাকবো কোথায়? কিছু কি ঠিক করেছিস? অার কী কাজ করবো কিছু কি ঠিক করছিস?’

নোমান বলে,’ অারে ওসব নিয়া তুই চিন্তা করিস না। অামি অাছি কীসের জন্যে! অাগে খেয়ে নে, তারপর কথা হবে।’

স্যাঁতসেঁতে এক ঘিঞ্জির ভেতর দিয়ে ওরা হাঁটতে থাকে। ঘিঞ্জি পেরিয়ে ছোটখাটো এক গলির সামনে দাঁড়ায়। এবং সেখানে এক বাসায় নক করে নোমান। একটা অাধাপাকা বাসা। ইটের তৈরি দেয়াল। উপরের অংশ টিনশেডের। অাশপাশ থেকে উৎকট গন্ধ অাসছে। বাসার পেছনেই ময়লা ফেলার পুকুর। মর্জিনার দম বন্ধ হবার জোগার।

নোমান ছোট্ট একটা রুম দেখিয়ে বলে,’কষ্ট করে কিছুদিন থাক তারপর না হয় ভালো বাসায় ওঠা যাবে।’

সাদেক বলে,’অামার জন্যে যা করলি। নিজের ভাই থাকলেও তা করতো না।’

নোমান অারেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে,’ বাদ দে তো এসব কথা। অাগে ফ্রেশ হ। পরে দেখা হবে। অামি তোদের পাশের রুমেই থাকি।’ কিছু লাগলে বলবি। অসুবিধা হলেও বলবি। মনে থাকে যেনো।’

সাদেক শুধু,’ হুঁ।’ সূচক মাথা নাড়ে।

রাতের বেলা নানারকম চিন্তাভাবনা সাদেকের মাথায় খেলা করে। নোমানের এতো পয়সা থাকা সত্ত্বেও কেন সে এমন জায়গায় থাকে!

মর্জিনার চোখে ঘুম নেই। তাই একটু নড়েচড়ে বসে। ৬০ ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে রুমে। রুমের পরিবেশ কেমন যেনো লাল দেখাচ্ছে। মর্জিনার কাছে মনে হচ্ছে দোজখের চুল্লি।
মর্জিনা সাদেককে বলে,’ এ তুমি কোথায় এলে! এখানে কি মানুষ থাকে!’

সাদেক একটু নরম সুরেই বলে,’ এ ছাড়া তো অার উপায় নেই।’

মর্জিনা বলে,’ চলো অামরা কালকেই বাড়ি চলে যাই।’ সাদেক খুব রেগে যায়।

অার বলে,’ বাড়ি! তুই বাড়ি গিয়ে কী করবি! বাড়ি বাড়িতে তোর কে থাকে?’

মর্জিনা চুপ মেরে যায়। অার কিছু বলে না। রাতে দুজনের কারোর ঠিকমতো ঘুম হলো না। মর্জিনা ঘুম থেকে উঠেই দেখলো, নোমান হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে হাজির। দুপুরের খাবার খেয়ে নোমান অার সাদিক বেরিয়ে যায়। মর্জিনা কোনোকিছু জিজ্ঞেস করার ফুরসত পায়নি।

ইতোমধ্যে দুএকজন মহিলা এসে মর্জিনার সাথে করে গেছে । নানা রকম গালগল্প। নানান কিসিমের মানুষ দেখে এখন সে বিস্মিত হচ্ছে। এরকম অনুভূতি একটু অাগেও ছিলো না।

রাতে বাসায় ফেরে সাদেক। মুখ বিষণ্ণ। চোখ লাল। মর্জিনা হাত-মুখ ধুয়ে অাসতে বলে সাদেককে। সাদেক কোনোকিছু না বলে সটান শুয়ে পড়ে বিছানায়। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে এরকম রুটিন চলছিল। মর্জিনাও কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ, ইতোমধ্যে সাদেক অনেক কিছু কিনে এনেছে মর্জিনা বিন্তির জন্যে। একদিন রাতে মর্জিনা দেখলো, সাদেকের হাতে দশ হাজার টাকার একটা বাণ্ডিল।

মর্জিনা সাহস নিয়ে জিজ্ঞেস করে,’ টাকাগুলো কার?’

সাদেক গম্ভীর হয়ে বলে,’ কেন? অামার।’

‘তা এতো টাকা কীভাবে পেলে?’

‘কাজ করি টাকা পাই। তাছাড়া টাকা কে দেবে?’

‘অামি তো সেটাই জানতে চাচ্ছি, কী এমন কাজ করো?’

‘অারেকদিন বলবো। একটু ঘুমাতে দাও তো। রাতবিরাতে তোমার ডিস্টার্ব করার স্বভাবটা গেলো না।’ সাদেক পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।

সময় চলতে থাকে। সাদেক নোমানের সাথে প্রায়ই মদ্যপান করে। খারাপ মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে। একদিন টের পায় মর্জিনা। মর্জিনা সাদেককে এ বিষয়ে অাকারে ইঙ্গিতে বলেছে। কোন কাজ হয়নি।

সেদিন সাদেক বাসায় ছিল না। নোমান এসে মর্জিনাকে নানাভাবে বিরক্ত করে। টাকার লোভ দেখায় একবার কাছে পাবার জন্যে। কেউ জানবে না প্রতিশ্রুতি দেয় নোমান
মদ্যপ অবস্থায় নোমান বলে,’তুমিও খুশি অামিও খুশি। দিল খোল দিলসে বোল।’

মর্জিনা ঘরের দরজা খুলে দৌড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে অাসে। রাগে দুঃখে লজ্জায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কয়েকজন মহিলা এসে ভিড় জমায়। তারা দাঁড়িয়ে সব দেখে। নোমান সুযোগ বুঝে পালিয়ে গা ঢাকা দেয়।

কয়েকমাস পর পুলিশ হানা দেয় সাদেকের বাসায়। তারা সাদেককে পায় না। সাদেকের নামে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। নোমানকে পুলিশ তারা হাতেনাতে ধরেছে। দিনশেষে গভীর রাতে ঘরে ফেরে সাদেক। দ্রুত তৈরি হতে বলে মর্জিনাকে।

মর্জিনা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,’কী হয়েছে? কোথায় যাবে তুমি?’

সাদেকের ভয়ার্ত কণ্ঠ,’ যখন তখন পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যেতে পারে অামাকে। তাড়াতাড়ি করো।’ মর্জিনার কণ্ঠেও উদ্বিগ্নতা,’কেন কী হয়েছে?’

সাদেক বলে,’ইয়াবার ব্যবসায় ফেঁসে গেছি। ঐ শালার নোমাইন্যা নিজে সারেন্ডার করে অামার ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়েছে। শুয়োরের বাচ্চা একটা অকৃতজ্ঞ ।’

মর্জিনা সবকিছু অান্দাজ করতে পারে। তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাও মনে করে সে। সে ভাবে সেই ঘটনার জের ধরেই নোমানের এই চক্রান্ত।

মর্জিনা দ্রুত ব্রিফকেসে কাপড়-চোপড় ভরে নেয়। সাথে ঘুমন্ত বিন্তি। সিএনজি করে তারা চলে অাসে মহাখালি বাস স্ট্যান্ডে। বাসও পেয়ে যায় তারা। সাদেককে বাড়ি ফিরতে হবে। টাঙ্গাইলের সেই চিরচেনা গ্রামে; পাঁচঘরা গ্রামে। তার মধ্যে পাপ-পূন্যের অনুতাপ নেই। অাছে কেবল বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত