জানালায় পৃথিবীর মুখ

জানালায় পৃথিবীর মুখ

‘রাজকন্যার আহ্নিক’ লেখকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ পাণ্ডুলিপি থেকে গল্প: জানালায় পৃথিবীর মুখ

 

তোর সাজাপাড়া করতে আর কতক্ষণ লাগবে? একটু পরই তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

এই তো আপা। আর দুই মিনিট। আইতাছি।

সুরমা তাড়া দেয়। ছাদে যাবে বলে সেই কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছে। অথচ শিউলির সাজাপাড়া এখনো শেষ হচ্ছে না। ছাদে যাবার সাজ সজ্জার ঘনঘটা সুরমার চেয়ে শিউলির একটু বেশিই। আর সেটাই স্বাভাবিক। ছাদে যাওয়া সুরমার কাছে পৃথিবী দেখার জানালা হলেও শিউলির কাছে তা অভিসারের ধাপ। যাকে বলে বয়ফ্রেন্ড হান্টিং। ছাদে গিয়ে সে এ বাড়ি ও বাড়ির দারোয়ান আর নিচে পার্ক করে রাখা গাড়ির ড্রাইভারদের সাথে চোখাচোখি করবে। রাস্তার উলটো দিকের এক ফ্ল্যাটের ড্রাইভারের সাথে কিছুদিন ধরেই আকারে ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় হচ্ছে। আরেকটু অগ্রগতি হলেই ফোন নম্বর নেয়ার চেষ্টা করবে। তবে এখনো কথাই হয়নি, এই অনিশ্চয়তায় অন্যদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়াও ঠিক হবে না। বিকেল হলেই তাই শিউলিই সুরমাকে তাড়া দেয়।

আপা, আইজ ছাদে যাইবেন না? চলেন ঘুইরা আসি।

সুরমা মুচকি হাসে। ‘চল যাই। না গেলে তো তোর আবার রাতে ঘুম আসবে না।’

শিউলি লজ্জা পেয়ে একটু আড়ালে যায়।

আপা যে কী কন! আমি ভাবতাছি ছাদে গেলে আপনের ভাল লাগব।

তা তো লাগবেই। আমার ভালো লাগবে। তোর ভালো লাগবে ভেবে আরো বেশি ভালো লাগবে। যা, মাথাটা আঁচড়ে একটু পাউডার মেখে আয়। আমি রেডিই আছি।

সুরমা বোঝে এখনকার কাজের মেয়েদের এইটুকু প্রশ্রয় দিতেই হয়। বিশেষ করে তার অন্তত না দিয়ে উপায়ও নেই। যদিও মা শিউলিকে চোখে চোখে রাখেন, এ সব সুযোগ দিতেই চান না, সুরমা ভাবে – মেয়েটা আনন্দে থাকলেই ভালো। তাড়াতাড়ি চলে যাবে না। পাশের বাড়ির ড্রাইভার কিংবা দারোয়ানের সাথে প্রেম করলে তো সুরমার কোন ক্ষতি নেই। তাহলে বরং সে অন্য কোথাও চলে যেতে চাইবে না। ঘুম ভাঙা থেকে আবারো ঘুমানো পর্যন্ত সবটুকু সময়ই তো মেয়েটার উপর নির্ভর করতে হয়। এইটুকু সুযোগ না দিলে শিউলি যদি কাজ ছেড়ে দেয়! চাইলেই গার্মেন্টসে কাজ জুটিয়ে নিতে পারবে সহজেই। তারচেয়ে শিউলি ছাদে গিয়ে বিকেলে বয়ফ্রেন্ড হান্টিং করুক। তাও মেয়েটা থাকুক।

সুরমা ছাদে যেতে চায় অন্য কারণে। ওই ছাদই তার পৃথিবী দেখার জানালা। এমনিতে বাসা থেকে বের হওয়া হয় না খুব একটা। ঢাকা শহবে তার মতো মানুষের যাওয়ার মতো জায়গা খুব একটা নেই। পদে পদে বিভিন্ন অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়। শিউলির উপর তো নির্ভর করতেই হয়, সেই সাথে হয় মা বাবা না হয় অন্য কেউও থাকতে হয়। এতো বেশি নির্ভরতার এই বন্দি জীবনে ছাদটাকেই সুরমার নিজস্ব সার্বভৌমত্ব মনে হয়। এই ছাদই তার মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলার একমাত্র অবলম্বন। বাকিটা সময় ফ্ল্যাটের চার দেয়ালে বন্দি। মাসে কয়দিন আর বাইরে যাওয়া হয়!

সুরমার এই যে ছাদে বিচরণের স্বাধীনতা, সে জন্য দুইজন মানুষের কাছে অপরিসীম কৃতজ্ঞতা তার। একজন তো অবশ্যই শিউলি, যে তাকে প্রায় প্রতিদিন সেখানে নিয়ে যায়। আরেকজন হচ্ছে বাবা। বাবার জন্যই এ ভাবে ছাদের আসার পথটা সহজ হয়েছে। নইলে হুইল চেয়ার নিয়ে চারতলা থেকে দুই ধাপ সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে ছাদে উঠতো কিভাবে!

হ্যাঁ, মনসুর আলী সাহেব বিষয়টি ডেভেলপারদের সাথে আগেই বোঝাপড়া করে নিয়েছিলেন। মিরপুর ডিওএইচএসের এই ফ্ল্যাটটি যখন বুকিং দেন তখনই বলে নিয়েছেন ওরা যে দাম চাইছে সে দামই তিনি দেবেন তবে লিফটটা ছাদ পর্যন্ত যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। ডেভেলপার কোম্পানীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর অবাক হয়েছিলেন। মনসুর সাহেব তখন সুরমার কথা বুঝিয়ে বলেছেন। মেয়েটা হুইল চেয়ার চলাফেরা করে। নিজের চলাফেরার স্বাধীনতা তেমন নেই। খুব একটা বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পায় না। মাঝে মাঝে ছাদে ঘোরাফেরা করতে পারলে ভালো লাগবে। কোম্পানীর এমডি তাহের সাহেব সজ্জন মানুষ। তিনি রাজি হলেন। কিন্তু মনসুর আলী সাহেব কে সে জন্য দশ লাখ টাকা বেশি দিতে হবে। অগত্যা তাতেই রাজি। সুরমার জীবনে আনন্দের দিন তেমন একটা আসে না। কিন্তু সে দিন সে আনন্দে কেঁদেছে। বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়েছে। দশ লাখ টাকা বেশি দিয়ে হলেও মেয়েকে এইটুকু আনন্দ দিতে পারায় মনসুর সাহেবের চোখেও জল এসেছে কয়েক ফোঁটা। রিটায়ারমেন্টের জমানো টাকার উপর একটু চাপ পড়েছে বৈকি! তাতে কী! তিনি তো জমানো টাকা কবরে নিয়ে যাবেন না। আর বেশি সমস্যা হলে নয়ন আর মেঘনা তো আছেই। বাবা মা কিংবা বোনের প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে ওরা কখনোই কোন কার্পণ্য করবে না।

সেই থেকে মিরপুর ডিওএইচএসের এই ফ্ল্যাটটাই সুরমার পৃথিবীর সিংহ ভাগ। সারাদিন মা রান্নাবান্না আর ঘর সংসার সামলানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। রিটায়ারমেন্টের পর বাবার সময় কাটে বাজার করা আর ইবাদত বন্দেগিতে। সুরমার সময় কাটে আলসেমিতে। টিভি দেখা আর মোবাইল ফোনে ফেইসবুকিং করা ছাড়া তেমন কোন কাজ নেই। বাবা মায়ের সাথে কখনো সখনো ভাইয়ার বাসায় যাওয়া হয়। কখনোবা ভাবী এসে কফি শপে বা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। তবে বড়জোর মাসে দু’ একবার। বাকিটা সময় এই ফ্ল্যাটের চার দেয়ালের নজরদারিতে কাটে। নিজে চলাফেরা করতে না পারলে এর চেয়ে বেশি কীইবা আশা করতে পারে! তবে শিউলি মেয়েটা ভালো। কাজের মেয়ে হলেও সুরমাকে দেখাশুনা করে নিজের বন্ধুর মতো, বোনের মতো। ভাগ্যিস এমন একটা কাজের মেয়ে পাওয়া গেছে!

বাবার অতিরিক্তি দশ লাখ টাকার বদৌলতে লিফট এখন ছাদ অবধি উঠে। হুইল চেয়ার ঠেলে শিউলি তাকে লিফটে চড়ে ছাদে নিয়ে আসে। হুইল চেয়ারে বসেই সুরমা তার চার পাশের পৃথবীটা দেখে। পাশের দালানের ছাদে কয়েকজন মেয়ে খোশগল্প করছে, কারো ছাদে আবার কাজের বুয়ারা দড়ি থেকে শুকনো কাপড় খুলে নিচ্ছে, আরেক ছাদে ফ্ল্যাটের সব মহিলারা একজোট হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কখনোবা চোখ চলে যায় লেকের পাড়ে ছেলে বুড়ো সবার বৈকালিক হাঁটাহাটির দিকে। আহা, যদি সেও ওদের মতো হাঁটতে পারতো! সুরমার দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।

এই সময়টাতে শিউলিও স্বাধীন সময় কাটায়। সুরমা কখনো দেখে, কখনো না দেখার ভান করে। শিউলির এটা বয়ফ্রেন্ড হান্টিংয়ের সময়। পাশের দালানের ড্রাইভারটার সাথে ভাব হয়ে গেলে ভালোই হয়। মেয়েটা আনন্দে থাকলে সুরমারই সুবিধা।

২.
সুরমার ঘুম ভাঙে এগারোটার দিকে। কিংবা আরেকটু আগে ঘুম ভাঙলেও এগারোটা পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে কাটায়। এই নিয়ে মনসুর আলী সাহেবের অনুযোগের শেষ নেই। এতো দেরিতে ঘুম থেকে উঠা স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ, দেরিতে ঘুম থেকে উঠলে সংসারে বরকত হয় না – ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা, সে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে করবেই বা কি? ওর তো সকালে উঠে রেডি হয়ে অফিসে যাওয়া নেই বা অন্য কোন কাজ নেই। ঘুম ভাঙা মানেই বাথরুম সেরে নাস্তা করে টিভির সামনে বসা বা ফোনের স্ক্রীনে ফেইসবুক ব্রাউজিং। রাতে ঘুমই তো আসে ২টার পর। এতো সকালে উঠবে কি করবে আর উঠে হবেই বা কি!

সারাদিনের অনেকটা সময়ই তার ফেইসবুকে কাটে। ফেইসবুক নামের এই জিনিসটি না থাকলে কীভাবে সময় কাটতো কে জানে! ফেইসবুক পূর্ববর্তী সময়টা সুরমার নিতান্তই একঘেয়ে ছিল। এখন সময়টা কেটে যায় ভালোই। ফেইসবুকে ওর বন্ধুতালিকা যে খুব বড় এমনটি নয়। আত্মীয় স্বজনের বাইরে তাদের সূত্রে কারো কারো সাথে যোগ হয়েছে। নিজে থেকে খুব একটা কাউকে ফ্রেন্ডস রিকোয়েস্ট পাঠায় না। তবে কেউ পাঠালে ইনবক্সে একটু আলাপচারিতা করে কিংবা তার দেয়াল দেখে পছন্দ হলে তাকে এড করে। সুরমা গল্প কবিতা লিখে না। তবে খুব সুন্দর কথা দিয়ে স্ট্যাটাস আপডেট দেয়। হয়তো সেগুলো পড়ে পছন্দ করে বা মুগ্ধ হয়ে অপরিচিত কেউ কেউ ফ্রেন্ডস রিকোয়েস্ট পাঠায়। হয়তো নিছক বন্ধুত্বের আকাংখায়। কারো আবার অন্য কোন অভিপ্রায় থাকে। সুরমা জানে ফেইসবুক জুড়েই প্রেডেটরদের বিচরণ। সেও তাই সাবধানী।

সব দেখেশুনে যাদের এড করে তাদের অনেকের কাছ থেকেও ধাক্কা খেতে বেশি সময় লাগে না। ওর প্রোফাইল পিকচারে কখনো ফুলের ছবি, কখনো কোন মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি দেয়া থাকত আগে। কেউ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে এড হলে আলাপচারিতা শুরু করে কয়েকদিন পর ছবি চায়। খুবই সাধারন সে সব আলাপচারিতা। হয়তো কোন স্ট্যাটাস আপডেটের প্রসঙ্গ নিয়ে কিংবা সমসাময়িক অন্য কোন বিষয়ে। কেউ বারবার অনুরোধ করলে সুরমা তাদের হুইল চেয়ারে বসা ছবি পাঠায়। অধিকাংশই তার পর কোন কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করেই তাকে আনফ্রেন্ড করে দেয়, কেউ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়, কেউবা আবার করুণা সম্বলিত উপদেশবাণী পাঠায়। এই সব বন্ধুত্বের প্রতি সুরমার বমি আসে।

বর্তমানে সুরমা প্রোফাইল পিকচারে নিজের হুইল চেয়ারে বসা ছবিটিই দিয়েছে। এখন আর খুব বেশি ফ্রেন্ডস রিকোয়েস্ট আসে না। দু’ একজন অবশ্য তার কথা জানতে চায়। ওর জীবনের গল্প শুনতে চায়। তাদের কাউকে কাউকে মাঝে মাঝে ও সেই গল্প বলে।

গল্পটি চমকপ্রদ তেমন কিছু নয়। খুবই সাদামাটা একটি দূর্ঘটনার গল্প। সুরমার বয়স তখন বারো। সবে ক্লাশ সেভেনে উঠেছে। স্কুলে যাওয়ার পথে ওর রিক্সাকে পেছন থেকে একটা বাস ধাক্কা দেয়। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালে। সেখান থেকে বেঁচে ফিরেছে বটে, কিন্তু মেরুদন্ডের আঘাতের কারণে কোমরের নিচ থেকে অবশ হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়ানো কিংবা হাঁটা চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সেই থেকে তার হুইল চেয়ারে বন্দি জীবন। বাসায় বসে গৃহশিক্ষকের তত্বাবধানে প্রাইভেট ছাত্রী হিসেবে উচ্চমাধ্যমিক অবধি পড়াশুনা হয়েছে। তারপর থেকে পুরোপুরি অবসর জীবন। বাবা আর মাকে নিয়ে সংসার। বেশ কয়েক দফা কাজের মেয়ে বদল হবার পর গত কয়েক বছরে শিউলিও সেই সংসারের অংশ হয়ে উঠেছে। সপ্তাহে একদিন ফিজিও থেরাপিস্ট আসে ব্যায়াম করাতে। নয়ন ভাইয়া তার পরিবার নিয়ে কাছাকাছিই থাকেন। মেঘনা’পু তার বরের সাথে দুবাই। গল্প এইটুকুই। এতেই ফেইসবুকের প্রোসপেক্টিভ ফ্রেন্ডরা যে যার মতো কেটে পড়ে।

তবে এই ছেলেটিকে একটু আলাদা মনে হচ্ছে। ইনবক্সে আলাপচারিতার প্রথম থেকেই ভালো লেগেছে। কখনো প্রগলভ মনে হয়নি। সাবলীল ভাবে কথাবার্তা হয়। রবিনের অভিব্যক্তিতে কখনো আতিশয্য কিংবা করুণার প্রবণতা দেখা যায় না। বলেছে একটি কম্পিউটার ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখায়। চাইলে সুরমাকেও শেখাতে পারে। ইনস্টিটিউটটি খুব বেশি দূরে নয়। মিরপুর বারোতে। চাইলে বাবাই নিয়ে যেতে পারেন গাড়ি করে। সপ্তাহে তিন দিন যেতে হবে। আর যদি তাতেও অসুবিধা হয় তাহলে সে নিজেই বাসায় এসে শেখাতে পারে। তার হাতে অনেক সময়।

রবিনের সাথে যোগাযোগ প্রায় তিন মাস হতে চললো। এই তিন মাসে ওদের অনেক কথা হয়েছে। খুবই সাধারন কথা। নিছক বন্ধুত্বপূর্ণ। রবিনকে কখনো বন্ধু, কখনো নিছক শুভাকাংখী, কখনো আবার বড় ভাইয়ের মতো মনে হয়েছে। কথাবার্তায় একটা মুরুব্বি মুরুব্বি ভাব আছে। তবে সে কখনো সহানুভূতি দেখিয়ে কথা বলে না। বরং সব কিছুকে ইতিবাচক হিসেবে নেয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। আর যাই হোক, এই মানুষটির সাথে অন্তত কথা বলা যায়। কথা মানে ইনবক্সে চ্যাট করা। মেসেঞ্জার কলে দু’ একবার খুব কম সময়ের জন্য কথা হয়েছে। সম্পর্ক যেমনই হোক, নিকটাত্মীয় ছাড়া কোন ছেলের সাথে সুরমা কথা বলুক সেটা রাশেদা বেগম দেখেও না দেখার ভান করলেও মনসুর আলী কিছুতেই মেনে নেবন না। তাই তিনি যখন বাসায় থাকেন না তখনি দু’ এককবার যা কথা হয়েছে। ছেলেটা সব সময়ই তাকে জীবনের সমস্যাগুলো ইতিবাচক ভাবে মোকাবেলা করার সাহস দিয়েছে। সমস্যাই নাকি সম্ভাবনার দরজা। বলেছে, কিছু একটা প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যস্ত থাকার মধ্যেই সুরমার স্বাধীনতা নিহিত। হতে পারে তা কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের কাজ। শিখে ফেললে বাসায় বসেই ফ্রিল্যান্স কাজ করতে পারবে। শুধু সময় কাটানোই নয়, কিছু আয়ও করতে পারবে। তাতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে বহুগুন। প্রয়োজনে রবিনই সব যোগাযোগ করিয়ে দেবে।

সুরমার এতোটা বিশ্বাস হয় না। এও কি সম্ভব? দিনে দিনে তার আত্মবিশ্বাস তলানীতে এসে ঠেকেছিল। রবিনের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না হলেও একটু একটু করে আস্থা রাখতে ইচ্ছে করে। সত্যিই যদি এমন কিছু হতো!

আমার তা হলে নিজের একটা জীবন হবে?

সে রবিনকে কথা দেয় না। বাইরে গিয়ে কম্পিউটার শেখা হবে না সেটা ভালো করেই জানে। মা’র আপত্তি না থাকলেও বাবা রাজি হবেন না। যতটা না নিয়ে যাওয়ার ঝামেলা কিংবা নিরাপত্তা জনিত, তার চেয়ে মনসুর সাহেবের বেশি আশংকা থাকবে মেয়ে যদি কারো সাথে প্রেম করা শুরু করে এই নিয়ে। সুরমার একই সাথে রাগ হয় আবার হাসিও পায়।

আচ্ছা, ধরলাম আমি কারো সাথে প্রেমই করলাম। তাতে উনার অসুবিধা কি? ঊনত্রিশ বছরের কেউ প্রেমে পড়বে এটাই তো স্বাভাবিক। বরং আরো আগেই তো পড়ে। আমার শারীরিক সীমাবদ্ধতা আছে। তাই বলে আমার মনের তো কোন সীমাবদ্ধতা নেই। মন যে কারো প্রেমে পড়তেই পারে। এমন তো না যে আমি কারো বউ যে অন্য কারো সাথে প্রেম করতে পারবো না। কিংবা এমনও নয় যে আমি কারো সাথে পালিয়ে যাচ্ছি। সেটা করতে পারলে তো ভালোই হতো। কিন্তু আমাকে কে নেবে?

এই সব ভাবে বটে। কিন্তু বাবাকে ভয়ও পায়। তাকে যে রবিনের কথা বলবে সে সাহসও করে উঠতে পারেনি। রবিনের কথা বলা মানে অন্য কিছু তো নয়। উনি বাসায় এসে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখাবেন – এইটুকু বলা। কয়েকবার ভেবেছে মা’কে বলবে। মায়ের মনোভাব ইতিবাচক হলে উনাকে দিয়ে বাবাকে বলাবে। শেষ অবধি মায়ের কানে তোলার সাহসও হয়ে উঠেনি। রাশেদা বেগমের রাগও নেহায়েত কম নয়।

সমস্যা অবশ্য আরো একটু আছে। রবিনের সাথে পরিচয় আর আলাপচারিতা শুধু ফেইসবুকেই। কখনো দেখা হয়নি। মানুষটা আসলেই কেমন তা জানার জন্য ফেইসবুকের যোগাযোগ তো যথেষ্ট নয়। এমনকি কোন ফেইক আইডিও হতে পারে। কোন অপরাধী চক্রের সদস্য নয় তো আবার? এখন এমন অনেক গল্পই শোনা যায়। বিষয়টি নিয়ে রিনি ভাবীর সাথে আলাপ হয়। মেঘনা’পুর সাথেও কথা বলা যেতো। কিন্তু সে বসে আছে দুবাইয়ে। তাই রিনি ভাবীই ভরসা। হ্যাঁ, ভাবীই অভয় দেন।

ভয় পাসনে। বাসায় ডাক। আব্বাকে আমি ম্যানেজ করবো। ছেলেটা ভালো হলে বাসায় এসে কম্পিউটার শেখাবে। তোর সময়ও কাটবে। কোন ক্রিমিনাল হলে বাসায় আসতে রাজি হবে না – এটা মনে রাখিস। আর ও যে দিন আসবে সে দিন আমিও থাকবো। নাকি একান্তে কথা বলতে চাস, হা হা হা…?

ভাবী, কী যে বলো না তুমি! উনাকে আমার ভাইয়ের মতো মনে হয়। তাই বলে ভেবো না তুমি আবার আমার নিজের ভাইকে রেখে ফেইসবুকের ভাইয়ের দিকে হেলে পড়বে। হা হা হা…।

এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও সুরমার সেন্স অব হিউমার মরে যায়নি দেখে রিনির ভালো লাগে। আহারে!

৩.
বয়স হওয়ার এই এক সমস্যা। রাতে টয়লেটে যাওয়ার জন্য নিরবচ্ছিন্ন ঘুমানোর সুযোগ নেই। কমপক্ষে দু’বার উঠতেই হবে। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। মনসুর সাহেব টয়লেটে যাওয়ার জন্য বিছানা ছেড়ে দেখেন টেবিল ঘড়িতে রাত ২টা ১০ বাজে। ফিরে এসে আবার বিছানায় যাবেন তখনই দেখেন বেডরুমের দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। হয়তো ঘুমানোর আগে রাশেদা বেগম পুরোপুরি ভেজাননি। তিনি দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখেন সুরমার রুমের দরজার নিচ দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। আজও মেয়েটা এতো রাত অবধি জেগে আছে! কতো করে যে তিনি বলেন। আদর করে বলেন, ধমক দিয়ে বলেন। কিছুতেই কাজ হয় না। দিন দিন কেমন যেন বেয়াড়া হয়ে উঠছে। এতো রাত জেগে ফোনে কারো সাথে কথা বলছে না তো?

মনসুর সাহেব পা টিপে টিপে সুরমার রুমের দিকে যান। না, ফোনালাপের কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না। রুমে ছোট একটা টিভি আর পোর্টেবল ডিভিডি প্লেয়ার আছে। সে রকম কোন শব্দও আসছে না। তবে?
শিউলির মিহি নাক ডাকার শব্দ শোনা যায়। মেয়েটা সুরমার রুমে মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমায়। সারাদিনের কাজকর্ম করে সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে। সুরমা লাইট জ্বালিয়ে রাখলেও ঘুমের ব্যাঘাত হয় না। তবে অদ্ভূত টিউনিং ওদের। রাতে সুরমার বাথরুমে যাবার দরকার হলে কিংবা অন্য কোন কারণে দু’ একবার ডাকলেই শিউলি ধড়ফর করে উঠে যায়।

মনসুর আলী জানেন শিউলি বিছানা পাতে ভেজানো দরজার পাশে আড়াআড়ি ভাবে। কেউ রুমে ঢুকলেই হয় তাকে ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে, না হয় তার গায়ের উপর গিয়েই পড়বে। কিন্তু এতো কিছু ভাবার অবকাশ নেই। রাগে আর কৌতুহলে তার সাবধানতার বাঁধ ভেঙে যায়। হুট করে আলতো ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলতেই কপাট গিয়ে আঘাত করে শিউলির কোমরে। আতঙ্কে মৃদু চিৎকার দিয়ে শিউলি উঠে বসে। সুরমা নিজে নিজে উঠে বসতে পারে না। ও হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল ফোনে সেইভ করা গান শুনছিল। হেডফোনটা তাড়াতাড়ি নামায়। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনজনই বিব্রত। মনসুর সাহেবের রাগ আর বিরক্তির অভিব্যক্তিটা তবুও রয়েই যায়।

এতো রাতে কী করছো? এখনো ঘুমাওনি কেন?

ঘুম আসছে না। গান শুনছিলাম। কী করবো?

ঘুম আসবে কীভাবে? গান শুনলে ঘুম আসবে? একটু দোয়া দরুদ পড়লেও তো পারো। সকাল এগারোটা পর্যন্ত ঘুমালে রাতে ঘুম হবে না এটাই তো স্বাভাবিক। যত্তোসব অলক্ষুনে স্বভাব। কতবার বলেছি রাত জাগলে শরীর খারাপ হয়। জানো না বুঝি? গান শুনতে হলে দিনে শুনতে পারো না। নাকি, আমি আসার আগে ফেইসবুকে কারো সাথে চ্যাট করছিলে?

সুরমা সাধারনত বাবার সাথে বিতর্ক করে না। কিন্তু আজ ওর খুবই মেজাজ খারাপ যায়। আজ কিছু একটা শোনাবেই।

আচ্ছা, বাবা, তুমিতো দেখলে আমি হেডফোন লাগিয়ে রেখেছিলাম। নাকি, দেখোনি। হেড ফোন লাগিয়ে কীভাবে চ্যাট করে? আর জেগে যেহেতু আছিই আমি গান শুনছি না চ্যাট করছি তাতে কী যায় আসে?

কী আসে যায়, মানে? ভদ্রলোকের মেয়েরা রাত আড়াইটার সময় জেগে জেগে ফেইসবুকে চ্যাট করে – শুনেছো এমন? সারা রাত লাইট জ্বালিয়ে রাখলে ইলেক্ট্রিসিটির বিল উঠবে না? বিদ্যুৎ কি ফ্রি পাওয়া যায়?

বাবা, ভদ্রলোকের মেয়ে হতে পারি; কিন্তু আমি আলাদা একজন মানুষ – এটা ভুলে যাচ্ছো কেন? নাকি, পঙ্গু বলে আমাকে তোমাদের পূর্ণাঙ্গ কিংবা আলাদা মানুষ বলে মনে হয় না? আমাকে তোমার বাচ্চা মেয়ে মনে হয়? আমার বয়সে তো মা’র তিন তিনটা ছেলে মেয়ে হয়ে গেছে। সংসার সামলেছে। আমার বয়সে তুমিও তো বাবা হয়েছিলে? কই, তুমি কি তোমার বাবা কে জিজ্ঞেস করে রাত জাগতে? আর আমি ইনকাম করি না বলে বিদ্যুৎ বিলের কথা শুনিয়ে খোটা দিচ্ছো?

অন্য সময় হলে সুরমা নীরবে বাবার রাগ পড়ে যাওয়ার অপেক্ষা করতো। অথবা কষ্টে তার কান্না পেয়ে যেতো। কিন্তু আজ তার চোখ ঠিকরে রাগ বের হচ্ছে। মেয়ের এই মূর্তি দেখে মনসুর সাহেব একটু ভড়কে যান। এই প্রতিক্রিয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি সুরমার মাথার কাছে বসে পড়েন।

মা রে! রাগ করো না। তোমার ভালোর জন্যই তো বলছি।

বাবা, আমি কি ভালো মন্দ একেবারেই বুঝি না ভেবেছো? আমার দিনরাত গুলো কেমন লোনলি কাটে চিন্তা করেছো কখনো?

লোনলি? বলো কী? আমরা সবাই বাসায় আছি না?

তোমরা কচু আছো। তোমার মনে হয় তোমরা আছো। আসলেই কি তাই? পাশে বসে থেকেও মানুষ লোনলি হতে পারে – এটা বোঝার শক্তিই তোমার নেই। আর সেই তুমিই কিনা আমাকে নিয়ে ভাবছো।

মেয়ে বলে কী! পাশে বসে থেকেও মানুষ লোনলি হতে পারে? তার কাছে এই সব কথা হেঁয়ালী মনে হয়। সুরমার এমন মূর্তি মনসুর সাহেব আগে কখনো দেখেননি। শিউলি কখনো দেখেনি তাকে বাবার সাথে এভাবে মুখে মুখে কথা বলতে। সে গুটিশুটি হয়ে বিছানার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

খালু, একটু শরবত বানাইয়া আনি? খাইবেন?

তোর কিছু করতে হবে না। লাইট নিভিয়ে দু’জন ঘুমিয়ে পড়।

সুরমার আপাতত সে রকম কোন ইচ্ছে নেই। বাবার উপর রাগ তার আজ চরমে উঠেছে।

বাবা, তোমাকে আরেকটা কথা বলি। তুমি মেয়েদের রুমে নক না করে ঢুকে পড়ো কেন? এটা কেমন কথা? মেয়েদের প্রাইভেসীর ব্যাপার আছে না?

এটা আবার কেমন কথা? নিজের মেয়ের রুমে নক করে ঢুকবো কেন?

প্রথম কথা হচ্ছে, যতোই তোমার নিজের মেয়ে হই, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসাবে আমার প্রাইভেসীর ব্যাপার আছে। আমি রুমে কী অবস্থায় আছি সেটা তুমি কীভাবে জানবে? এমনও তো হতে পারে যে আমি কাপড় চেইঞ্জ করছি। তাছাড়া এটা তোমার নিজের মেয়ের রুম হলেও এখানে তো আরেকটা মেয়েও ঘুমায়। সেও তো বড়। তার প্রাইভেসী নেই? আর আজই প্রথম নয়। তুমি কখনোই নক করে ঢুকো না। এর পর থেকে নক করে ঢুকবে।

মনসুর আলী বোকা বনে যান। তিনি কখনো এভাবে ভেবে দেখেননি। নিজের মেয়ের রুমে নক করে ঢুকতে হবে? এই জীবনে না জানি আরো কতো কিছু দেখতে হয়! তার তো মনে হয় যতো বড়ই হোক সুরমা তার সেই ছোট্ট মেয়ে। নিজে চলাফেরা করতে পারে না। যদি বাথরুম করাতে হয় তাহলেও তিনি নিয়ে যেতে পারবেন। ছেলেমেয়ে কি কখনো বাবা মায়ের কাছে বড় হয়? তিনি যা কিছু করেন তা মেয়ের নিরাপত্তা আর সুবিধার জন্যই করেন। অন্যদের মতো স্বাবলম্বী হলে কি আর ভাবনার কিছু ছিল? যদি কোন বিপদে পড়ে? যদি নিজের ভালো মন্দ বুঝতে না পারে। এভাবেই তিনি সুরমাকে আগেও বুঝিয়েছেন। সে চুপচাপ শুনেছে। তবে আজ সুযোগ পেয়ে পুরোনো কথার প্রসঙ্গ টেনে আনে।

তুমি সব কিছুতে আমাকে আগলে রাখতে চাও কেন? চাইলেই কি সব পারা যায়? তুমি কি আমাকে রিক্সা এক্সিডেন্ট থেকে আগলে রাখতে পেরেছিলে? সারাক্ষন আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করো কেন? তোমার কী মনে হয়, কারো সাথে পালিয়ে যাবো? ঊনত্রিশ বছর বয়সেও কি আমি নিজের ইচ্ছে মতো চলতে পারবো না? রাত জাগতে পারবো না, সকালে ঘুমাতে পারবো না? ফোনে কারো সাথে কথা বললে আড়ি পেতে শুনবে, ফেইসবুকে কি করলাম সে জন্য খবরদারি করবে। আমাকে কি মনে করো তুমি? আমার পায়ে দাঁড়িয়ে পৃথিবীটা দেখার চেষ্টা করেছো কখনো? আমার পৃথিবীটা কত কঠিন তোমার কোন ধারনাই নেই। এই যে তুমি আমার জন্য এতো কেয়ার করো, আমি জানি তুমি আমার ভালোর জন্যই সব করো, আমার জন্য তোমার শংকা আর উদ্বেগের জন্যই করো। তোমার কী মনে হয় ঊনত্রিশ বছর বয়সেও নিজের ভালো মন্দ কিছুই বুঝতে পারি না? আমি কি কারো সাথে পালিয়ে যাবো বলে তোমার মনে হয়? কে আমাকে নেবে? একটা পঙ্গু মেয়েকে কে নেবে?

সুরমা হঠাৎ করেই ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করে। বাবা মেয়ের বাদানুবাদ শুনে ততোক্ষনে রাশেদা বেগমেরও ঘুম ভেঙে গেছে। তিনিও দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন আগে থেকে সব দেখছিলেন। সুরমার কান্না দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। সুরমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন।

৪.
রাতের বাকিটা সময় মনসুর আলী সাহেব কিংবা রাশেদা বেগম কারুরই ঘুম আসে না। দু’জনই বিছানায় এপাশ ওপাশ করেন। সুরমার দিকটা মনসুর সাহেব বুঝতে পারেন। হয়তো এমনটা হতেই পারে। কিন্তু নিজের কোন ভুল হয়েছে বলে তিনি মনে করেন না। মেয়ের জন্য তো তারা স্বামী স্ত্রী অনেক কিছুই সেক্রিফাইস করেন। এই ফ্ল্যাট কিনে উঠার পরই বুঝতে পেরেছিলেন একটা ভুল হয়ে গেছে। ডিওএইচএসের মেইন রাস্তার পাশে হওয়ায় প্রায় সারারাতই গাড়ি চলাচলের শব্দ শোনা যায়। এমনিতেই তার ঘুম পাতলা। চলমান গাড়ির শব্দ আর হর্ণের কারণে সারা রাতই ঘুমের ব্যাঘাত হয়। কয়েকবার ভেবেছিলেন এই ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে ছোট একটা রাস্তার পাশে অন্য ফ্ল্যাট নেবেন। শান্তিতে ঘুমানো যাবে। সুরমার কথা ভেবে সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়েছেন। ছাদ পর্যন্ত লিফট যায় বলে মেয়েটা দিনে একবার ছাদে গিয়ে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারে। চার পাশের পৃথিবীটা দেখতে পারে। তাই এই ফ্ল্যাট বদলানোর কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলেন। শুধু কি তাই? তাদের দু’জনের জীবনের সবকিছুই তো এখন সুরমাকে ঘিরে আবর্তিত। তাই বলে মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে পারবেন না? প্রয়োজনে খবরদারি করতে পারবেন না, এটা কেমন কথা?

এপাশ ওপাশ করতে করতে রাশেদা বেগমও ভাবনার জগতে বিচরণ করেন। নিজেও মাঝে মাঝে কড়াকড়ি করেন। তবে স্বামীর খবরদারি একটু বেশিই মনে হয়। আহারে, মেয়েটা কত মন খারাপ করেছে!

তুমি মাঝে মাঝে এতো বাড়াবাড়ি না করলেই পারো। ওকে ওর মতো চলতে দিলে কী হয়? সব সময় মনমরা হয়ে থাকে। তার উপর তোমার জন্য একটু নিজের মতো করে নিঃশ্বাসও নিতে পারে না।

ও, এখন শুধু আমার দোষ দেখছো, তাই না? এই তো সেদিন তুমি ওকে খাওয়া নিয়ে খোটা দিলে?

আমি? কবে? কী যা তা বলছো!

সেদিন বললে না কম করে খেতে? বেশি নাকি ভারি হয়ে যাচ্ছে।

সেটা তো বলেছি শিউলির কথা ভেবে। শিউলি ওকে বিছানা থেকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে বসায়, হুইল চেয়ার থেকে বিছানায় উঠায়, কোলে করে টয়লেটে নিয়ে যায়। বেশি ভারি হয়ে গেলে শিউলি পারবে? মেয়েটা যদি চলে যায় তখন সুরমা’র কি হবে? আমরাই বা কী করে সব সামলাবে? তুমি ওকে গোসল করাবে, বাথরুমে নিয়ে যাবে?

দরকার হলে তাই করবো। তাই বলে তুমি ওকে না খেয়ে থাকতে বলবে?

ছি ছি ছি…। আমি ওকে না খেয়ে থাকতে বলেছি? ডায়েট করা আর না খেয়ে থাকা এক জিনিস? আর বাবা হয়ে এত বড় মেয়েকে বাথরুমে নিয়ে যাবে – এটা বলতে তোমার লজ্জা করলো না?

৫.
মা বাবার এই বাদানুবাদ সুরমার কানে যায় না। সেও বিছানায় এপাশ ওপাশ করে। বাবাকে এতো কড়া কথা বলা ঠিক হয়নি। আগে এর চেয়ে বেশি বকা খেয়েও কোন দিন মুখ ফুটে কিছু বলেনি। আজ কেন তাহলে বলতে গেল? ওর জন্য তো উনাদের দেখভাল আর যত্নের কোন কমতি নেই। ওর জন্যই উনাদের জীবনটাও কেমন বদলে গেছে। রাগ আর অভিমানের বদলে তার তখন বাবা মায়ের জন্য কষ্ট হতে থাকে। সেও কি উনাদের পায়ে দাঁড়িয়ে পৃথিবীটা দেখেছে কখনো? সেটাও কি কম কঠিন কিছু?

সুরমার ঘুম আসে ফজরের আজানের পর। চোখ বন্ধ হতেই চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখে। কক্সবাজারে সমুদ্রমুখি একটা হোটেলের ব্যালকনিতে বসে আছে। সামনে সমুদ্রের ঢেউ। সৈকতজুড়ে আবাল বৃদ্ধ বনিতার কোলাহল। পেছন থেকে একজন হুইল চেয়ার ধরে দাঁড়ায়। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে রবিন। সুরমা অবাক হয় না। ওর মনে হয় ওরা একসাথে বেড়াতে এসেছে। রবিন ওর হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

ভাইয়া আর ভাবী যাবে না? ওরা কোথায়? শিউলি যাবে না?

ভাবী আমাদের যেতে বললো। উনারা আসছেন। শিউলিও আসছে উনাদের সাথে। আপাতত আমিই তো্মাকে নিয়ে যাই। এখনি কোন দরকার আছে শিউলির?

না, চলো তাইলে।

বীচে এসে বেশ কিছুটা সময় দু’জন চুপচাপ সময় কাটায়। একজন হুইল চেয়ারে, আরেকজন হাতল ধরে পেছনে দাঁড়িয়ে। খুব একটা কথাবার্তা হয় না। কিছুক্ষন পর হুইল চেয়ারের ব্রেক আটকে রবিন সামনে হাঁটাহাটি শুরু করে। সুরমা হঠাৎ খেয়াল করে রবিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। মনে হয় পা দু’টো ওর নিজের না। অন্য কারো। ওর পা দু’টো কি কৃত্রিম?

অকারণেই সুরমার কান্না পায় হঠাৎ। সে ওড়নায় মুখ ঢাকে।

৬.
প্ল্যানটা নতুন করে সাজাতে হয়েছে। বাবা মাকে বোকা বানানো এতো সহজ না। রিনি ভাবীর সাথে শলাপরামর্শ করে বুদ্ধি বের করতে হয়েছে। রবিন বাসায় এসে ওকে কম্পিউটারের কাজ শেখাক তা সুরমা যতো না চাইছে রিনি চাইছে তারও চেয়ে বেশি। সুরমা কম চাইছে এটা অবশ্য পুরোপুরি ঠিক না। যতোই চাক না কেন, ও আসলে এতোটা সাহসী কিংবা আত্মবিশ্বাসী হতে পারছে না। এও কি সম্ভব! সে আশা নিরাশার দোলচালে থাকে।

রিনি বেশ আশাবাদী। রবিন বাসায় এসে কম্পিউটারের কাজ শেখালে তা সুরমার জীবনে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সময় কাটবে। ওর মনটা ভালো থাকবে। এক সময় হয়তো নিজে কিছু আয়ও করতে পারবে। যদিও প্রয়োজনে সুরমার টাকার অভাব হয় না কখনো। বাবা মা, নয়ন, মেঘনা সবাই নিয়মিতই ওর হাতে টাকা গুঁজে দেয়। রিনিও মাঝে মাঝে দেয়। কিন্তু নিজে আয় করলে মানুষের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। মানুষ আত্মসম্মান অর্জন করে। রিনির বিশ্বাস, কম্পিউটারের কাজটা শিখলে সুরমার জীবন বদলে যাবে।

বাবা মায়ের জন্য গল্পটা বানানো হয়েছে এভাবে…

রবিনের বড় বোন রিনির অফিসে সহকর্মী। সেই সূত্রে সে রবিনকে আগে থেকেই চিনে। রবিন যেহেতু কম্পিউটার ইনস্টিটিউটে কাজ শেখায় তাই ওকে বলেছে সুরমাকে বাসায় এসে শেখাতে। বেতন নিয়ে ভাবতে হবে না। রিনি সেটা নয়নের কাছ থেকে ম্যানেজ করবে।

অনেক ভেবে চিন্তে মনসুর সাহেব মত দেন। তার আগে অবশ্য রিনিকে জেরা করেন যৎসামান্য।

ছেলেটাকে ভালো ভাবে চিনো তো? ওকি ম্যারেড? কোথায় বাসা? ওর বোনকে তুমি কতো দিন ধরে চিনো? আমার পছন্দ না হলে কিন্তু যে কোন সময় বাদ দিয়ে দেবো। ল্যাপটপে কাজ শেখাবে, ড্রয়িংরুমে বসে। আমি বা তোমার আম্মা আশেপাশেই থাকবো।

রিনি আর সুরমা বাবার সব শর্তেই রাজি হয়। অন্য কোন উপায়ও নেই। তিনি যে রাজি হয়েছেন সেটাই বড় কথা।

মূল পরিকল্পনাটা একটু ভিন্ন। আগেই ফেইসবুকে রিনি ভাবীকে রবিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সুরমা। রিনি নিজে দু’ একবার কথা বলে ছেলেটাকে পরখ করে নিয়েছে। তারপর তাকে সমস্ত প্ল্যানটা বুঝিয়ে বলেছে। আগামী বুধবারে তার আসার কথা। সে বিকেলে রিনির অফিসে আসবে। সেখানে দু’জনের মুখোমুখি আলাপ পরিচয় হবে, বিস্তারিত কথা হবে। তারপর একসাথে বাসায় আসবে। সুরমার সাথে যে তার আগে থেকেই যোগাযোগ আছে সেটা ঘুনাক্ষরেও প্রকাশ করা যাবে না। রিনি এটাও বলে রেখেছে যে বাসায় ঢুকেই হয়তো রবিনকে মনসুর সাহেবের জেরা আর সন্দেহের মুখোমুখি হতে হবে। সে যেন সব ধরনের পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত থাকে।

রবিনের কাছে পুরো বিষয়টিই একটি এডভ্যাঞ্চার মনে হচ্ছে। বেশ চ্যালেঞ্জিং। সুরমার প্রতি তার এক ধরনের অপত্য স্নেহ আর মায়া জন্মেছে এই কয়দিনে। হয়তো তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু এই মায়ার তীব্রতায় সে এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চায়। একটা জীবনকে বদলে দিতে পারার চেয়ে বড় আনন্দের বিষয় আর কীইবা হতে পারে!

ওরা তিনজনই আগামী বুধবারের অপেক্ষা করে। তিনজন তিন ভাবে কল্পনা করে – রবিন সুরমার পৃথিবী দেখার নতুন জানালা হবে।

৭.
বুধবারে অন্য দিনের চেয়ে একটু আগেই ঘুম ভাঙে সুরমার। ঘুম ভাঙতেই রাতে দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়। অনেক দিন পর এমন স্বপ্ন। সে রিওয়াইন্ড করে স্বপ্নটা মনে করতে চায়। ছেলেটার চেহারা অনেকটাই রবিনের মতো। তবে রবিন কিনা তা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারে না। অবাক ব্যাপার হলো, তার দু’ পা’ই হাঁটুর নিচ থেকে কাটা। কৃত্রিম পা দু’টো খুলে বসার পর সুরমা বুঝতে পেরেছে ও এমন খুঁড়িয়ে হাঁটছিল কেন।

এই স্বপ্নের বাকিটুকু কাউকেই বলা যাবে না। রিনি ভাবীকেও না। সুরমার আনন্দ হয়, আবার কষ্টও হয়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত