দ্বিধার সংঘাত

দ্বিধার সংঘাত

ব্যক্তিগত জীবনে নিজেরা কতটা সুখী হতে পেরেছিল সেকথা জানা যায়নি। তবে অন্যের সুখের পথে ওরা যে অন্তরায় ছিল, সেকথা নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কচে বলা যায়। জীবনের এই সত্যটুকু গ্রহণ করাতে ছিল ওদের জোর আপত্তি! ওদের অন্তরের অন্দর মহল ছিল মুখোশের আবরণে ঢাকা! বাহির থেকে যদিও সেই আবরণ স্পষ্ট, তথাপি সেই আবরণ উন্মোচন করা ছিল দূরহ! অদ্ভুত এক মোহের জালে পাশের মানুষ-জনকে আচ্ছন্ন করে, বিমোহিত করে রাখাটা ছিল ওদের বড়ো ধরণের স্বার্থকতা।

মাঝে মাঝে সুমাইয়ার প্রবল ইচ্ছে হয় নিজেকে শেষ করে দিতে, কিন্তু পারেনা। যেমনি ভাবে শেষ করার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ঠিক তেমনি ভাবেই ঝট করে ইচ্ছেটা মাথা থেকে ঝরে পড়ে। ঝরে পড়ে বললেই কি সবটা ধুয়ে মুছে নিঃশ্বেস হয়ে যায়? যায় না। আর যায় না বলেই, চেতন-অবচেতনে ছায়া হয়ে গাঢ় দগদগা ক্ষত হয়ে রয়ে যায় বুকের গভীরে।

খুব সাধারণ ঘটনা। প্রত্যহ ঘটে চলেছে কোনো না কোনো ঘরে। কারো না কারো জীবনে। লিখতে গেলে, পড়তে গেলে, বুকের পাঁজর ব্যথায় টনটন করে ওঠে। মনটা ভার হয়ে যায়। নিঃশ্বাস বুকে চেপে দীর্ঘ হয়ে ওঠে!

ভালোমন্দ বোঝার বয়স তখনও হয়নি। হয়নি গভীর ভাবে কোনো কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা। কত আর বয়স হবে? চৌদ্দ বা পনেরো। বয়সটাই এমন! এ বয়সে থাকেনা বিচার, বুদ্ধির ক্ষমতা। থাকেনা কোনো কিছু গভীর ভাবে উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। এ বয়সে নিষেধ, বারণ শব্দগুলো ভীষণভাবে বিরক্তিকর, ব্যাকডেটেড! সব কিছু পিছনে ফেলে এই সময়ে আবেগ, মোহ কাজ করে বেশি। ভুলের মাত্রাটাও থাকে কিঞ্চিত বেশি। ফলে— উচ্ছ্বাস, উচ্ছ্বলতা আর বয়সের মোহে পড়ে কোনো রকম বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই সুমাইয়া নিয়ে ফেলে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত। করে ফেলে মারাত্মক ভুল!
বিয়ে-সংসার-স্বামী শব্দগুলোর অর্থ তখনও অজানা। তবুও মোহের বসে, স্কুল পালিয়ে, সুমাইয়া পারি দেয় অজনার উদ্দেশ্যে, ফরহাদের হাত ধরে!

ফরহাদ দেখতে সুদর্শন। শিক্ষাগত যোগ্যতা কতটুকু জানা যায়নি। তবে, সমাজে যে জিনিসটার কদর সব থেকে বেশি, যার জোরে ধরাকে সরা জ্ঞান করা যায়, সেই অর্থ ছিল যথেষ্ট পরিমানে। দেখতে মন্দ না হলেও স্বভাব, চরিত্রের দিক থেকে ছিল, বদখিজ আর বেদম আকারের ইতর গোছের। বদ-ই যদি না হবে, তবে কি কচি মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়ে কেউ সংসার-সংসার খেলনা খেলে?

ফরহাদের সাথে সুমাইয়ার পরিচয় কাকতালিয় নয়। বরং নিয়তিরই সুদূর প্রসারি কোনো ইঙ্গিত। সুমাইয়ার স্কুলের সামনে ফরহাদের বাবা, ঝগু শেখের কনফেকশনারির দোকান। স্কুল, কলেজের ছেলে-মেয়েরা এই দোকানে মাছির মতো ভিড় করে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে। এই ভিড় ঠেলে সব দিক সামাল দিয়ে উঠতে পারেনা ঝগু শেখ। যদিও দুজন কর্মচারি আছে, তবুও টিফিন থেকে স্কুল ছুটির সময় পর্যন্ত ছেলেকে জোর করে ক্যাশে বসিয়ে রাখে। প্রথম, প্রথম যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে ফরহাদ শেখের ঠিক সময়ে দোকানে আসতে। কারণ, ঘুম আর ইয়ার-দোস্তদের আড্ডা ছেড়ে আসাটা সত্যিই কষ্টকর। সেই সাথে লজ্জা জনকও ইয়ার-দোস্তদের চোখে।

দু’চার দিন যেতে না যেতেই সব কষ্ট, সব লজ্জা নিমিষেই উবে যায় দোকানে আসা তন্বীবালাদের দেখে! ছেলের কাজে মন বসেছে এই ভাবানায় মনে মনে সুখী হয় ঝগু শেখ। বাবা যাই বুঝুক-জানুক না কেনো, ফরহাদের মন অন্যদিকে, অন্যধ্যানে! ফরহাদ উসখুস করতে থাকে আশ্বিনের নেড়ি কুকুরের মতো, কিভাবে ভাব জমানো যায় এদের কারো একজনের সাথে।

অবুঝ কচি-কচি মনে সবে রঙের ঘোর লাগতে শুরু করেছে, সেই রঙের উপর আরো একটু রঙ চড়িয়ে নিজের মতো করে ছবি এঁকে দিয়ে অল্পদিনেই ভাব জমিয়ে ফেলে ফরহাদ, সুমাইয়ার সাথে। এবং কাক-পক্ষী কিছু জানার আগেই উড়াল দেয় ফরহাদ, সুমাইয়াকে নিয়ে।

চৈত্রের রোদ চিরচির করে বাড়তে থাকে, সেই সাথে বেলাও পড়তে থাকে। স্কুল ছুটির দু’ঘন্টা অতিবাহিত হলেও সুমাইয়ার ঘরে ফেরার সময় হয়নি, না ঘরে ফেরেনি– এই নিয়ে সুমাইয়ার মা জুলেখা বেগম দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। আরও অনেকটা বেলা চলে যায়, তবু মেয়ে বাড়ি ফিরছেনা দেখে পাড়া-প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধব সবার কাছে খোঁজ শুরু করেন তিনি।

কারো কাছে কোনো খবর না পেয়ে চৈত্রের পড়ন্ত বিকেল বেয়ে নামা ফ্যাকাশে সন্ধ্যায়, বাবা হাফিজ মিয়া উপস্থিত হন থানায়। থানার ডিউটি অফিসার সব শুনে, জিডি ফাইল করে খোঁজ শুরু করেন সুমাইয়ার।বেশি সময় লাগে না প্রথমেই আসেন স্কুলের সামনের দোকান, কনফেকশোনারি-গুলোতে। আর তাতেই রহস্য যেন কিছুটা খোলসা হতে শুরু করে এবং ঝগু শেখকে ধরে নিয়ে এলো থানায়।

ঝগু শেখ সত্যিই কিছু জানে না তার ছেলের এই তেলেসমাতি কাণ্ড সম্পর্কে। পুলিশ যখন তার বাড়ি গেল, তখন বিস্ফারিত দু’চোখে তাকিয়ে অভাবনীয় ভাবে অবাক হয়েছে সে।
সারাদিন কাজের মধ্যে থাকার ফলে ঝগু শেখ খেয়াল করলেও খোঁজ করেনি ছেলের। ভেবেছে ইয়ার-দোস্তদের সাথে আড্ডা দেবার নিমিত্তে না বলেই চলে গেছে। কিন্তু ঘটনা অন্য। থানায় বসে নিজের মনে নিজেকে কোচলে ছেলের চৌদ্দগুষ্টিকে ধুয়ে তুলো ধুনা করে দিচ্ছে। ভাবছে কোন পাপে এই কুলাঙ্গার কে দুনিয়ায় আনল, ওরা বাপ-মায়ে মিলে। ঘুণাক্ষরেও যদি টের পেত এমনতর হাড়-মাশ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেবে, তাহলে জন্মের পর পরই ওকে মেরে ফেলত নিজ হাতে কোনো না কোনো ভাবে।

ঝগু শেখের স্ত্রী শমেলা পর পর দুটো মৃত কন্যা সন্তান প্রসবের পর, তৃতীয় বার সন্তান সম্ভবা হলে, নিজের এবং আত্মীয়-পরিজনের দোয়া, মানতের ফল এই সন্তান ফরহাদ। ঝগু শেখ নিজেও কী কম মানত করেছিল এই সন্তানের জন্য? কিন্তু দিনের পর দিন ছেলের এহেন দৈরাত্য সহ্য করতে হবে ভাবেনি বিন্দু পরিমানও। থানার লকআপে বসে ঝগু শেখ নিজের দোষ-ত্রুটি খুঁজে দেখার চেষ্টা করে। ভাবে পুলিশের হাতে তুলে দিলে এই সমস্যার সমাধান হতো। পরক্ষণে ভাবতে থাকে, পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া সব চেষ্টায় তো করেছে, করছে! আর পুলিশের হাতে ছেলেকে তুলে দেবে কি, বরং বছরঅন্তে দু’এক বার থানা থেকে তো ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে হয়েছে! থানায় অনেক জেরার মুখে পুলিশ যখন কোনো তথ্য পেলোনা তার কাছ থেকে, তখন তারই দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ছেলের বন্ধুদের থানায় ধরে নিয়ে এলো পুলিশ।

ঝগু শেখের মতো ফরহাদের ইয়ার-দোস্তরাও বোশেখের রুদ্র বিজলী চমকানোর মতো চমকে, আকাশ থেকে ধুপ করে মাটিতে পড়েছে! কারণ তারাও তাদের বন্ধুটির খবর জানেনা। শুবু জানেনা বললে ভুল বলা হয় বরং বেশ কিছুদিন যাবত তারা, তাদের বন্ধুর টিকিটিও দেখতে পায়নি। কাজের গতিবিধি আরও জানেনা। আর যদিও বা কিছু জানত, তবে তা আর বলতো না। কারণ প্রতিবারের মতো এবার নারীঘটিত ব্যাপার ঘটলেও, এবার এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে গ্রামের ধনাঢ্য এবং সন্মানীয় ব্যক্তি ফয়েজ মিয়ার কন্যা।
উদ্বিগ্ন আর উৎকণ্ঠার মাঝে কোনো খবর ছাড়ায় কেটে গেল একটি রাত। চারিদিকে অসহনীয় থমথমে ভাব। একটা খবরের আশায় দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পথের দিকে তাকিয়ে বুক বাঁধে ফয়েজ মিয়া ও তার পরিবার-পরিজন। এভাবে কেটে যায় মাস তিনেক। সবাই যখন ভাবতে শুরু করেছে ও আর ফিরবে না, এমনি এক মন মরা দিনে গোধূলির আলো ম্লান হয়ে আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে শীর্ণ শরীরে ওর আবির্ভাব। পৈশাচিক অত্যাচারে চেহারা এতটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে যা বলার মতো না! দুর্বল অসুস্থ শরীরে সে কিভাবে বাড়ি অব্দি এলো, সে কথা এখন থাক।

এমন খবর চাপা থাকার নয়। ফয়েজ মিয়া না চাইতেও দ্রুত জানাজানি হয়ে যায় সুমাইয়ার ফেরার খবর! খবর যেন বাতাসের আগে দৌড়ায়। দল বেঁধে গ্রামের মানুষজন আসতে থাকে। কেউ আসে প্রকৃত বন্ধুর মতো সমবেদনা জানাতে আবার কেউ, কেউ আসে নিছক তামাশা ভেবে সুমাইয়ার ঘরে ফেরার ঘটনা উপভোগ করতে। মানুষের অন্তরের বিষ কৌতূহল কোনো ভাবে নিবৃত করা যায় না। একটা ইস্যু পেলেই হলো, অন্যের দুঃখ কষ্টের কথা না ভেবে নির্লজ্জের মতো নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের এই নির্লজ্জ, নির্বুদ্ধিতার তীব্র দংশনে কত জীবন যে বিপন্ন হয়, কত মন যে আহত হয়, সে সব খবর জেনেও জানতে চায়না কিছু।

সঠিকভাবে কিছু বলতে না পারলেও ডাক্তারের পরামর্শে অত্যধিক সেবা, শ্রশ্রুষার ফলে ক’দিনের মধ্যে শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে বেশ খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠে সুমাইয়া। মানসিক ভয়ের ছাপ তখনও তার চোখে মুখে সুস্পষ্ট। বাবা-মা বাড়ির লোকজন সর্বক্ষণ তার পাশে ছায়ার মতো থাকলেও চারপাশের বিরূপ আবহাওয়ায় সুমাইয়া মানসিকভাবে আরও দুর্বল ও অসহায় বোধ করতে থাকে। যারা কখনও কোনো দিন মিয়া বাড়ি সম্পর্কে কোনো ধরনের কটু কথা বলতে সাহস দেখায়নি, আজ তারাই মিয়া বাড়ি নিয়ে ঠুনকো, হাস্যম্পদ মূলক কথা রটিয়ে বেড়াচ্ছে পাড়া থেকে হাট-বাজার সর্বত্র। মিয়া বাড়ির সবাই বুঝতে পারে এইসব কোমলতা বিবর্জিত নিষ্ঠুর মানুষের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সহজ নয়। ওরা সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে দেবে না সুমাইয়াকে। এই সব দেখে শুনে মেয়েকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন ফয়েজ মিয়া। গ্রামের এইসব অতি উৎসাহী, হৃদয়হীন মানুষদের আচরণ দেখে, ছেলের এই দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্তির পথ বাতলে দিলেন, বাবা– জামাল মিয়া। বয়স্ক জামাল মিয়া ছেলেকে বললেন, ‘শোন বাবা, এখানে থাকলে আমার একমাত্র নাতিনের বাঁচা কষ্ট হয়ে যাবে। যত তাড়াতাড়ি পারো একটা কিছু ব্যবস্থা করো। নতুবা অন্যত্র চলে যাবার চিন্তা করো।’
কন্যার নির্বিঘ্ন জীবনের পথ খুঁজতে যে টুকুন দ্বিধা-সংকোচ ছিল ফয়েজ মিয়ার, বাবা জামাল মিয়া সন্তানের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সে সমস্যার সমাধান করে দিলেন।
ঝুট ঝামেলাহীন সংসার জামাল মিয়ার। দুই মেয়ে এক ছেলে। মেয়েরা বিয়ের পর শশুড় বাড়িতে থাকে। মেয়েদের সংসারে সুখ উপচে উপচে পড়ছে। ছেলের সংসারেই বা সুখের ঘাটতি ছিল কোথায়? সব যেন স্বপ্নের মতো ঘটে গেল। বংশের একমাত্র প্রদীপ নাতনি কে নিয়ে কত‌ই‌ না স্বপ্ন ছিল তাদের। কিন্তু কোথা থেকে হাঁ করে ধেয়ে আসা কালো মেঘ নিমিষে সব স্বপ্ন ছায়ায় ভরিয়ে দিলো। বিছানায় শুয়ে এই সমস্ত সাত-পাঁচ ভাবনায় বিভোর যখন জামাল মিয়া, তখন ছেলে ঢাকায় যাবার বিষয়টা নিয়ে পাকাপাকি আলোচনা করবার জন্য বাবার ঘরে প্রবেশ করে।

চলে যাব বললেই তো আর যাওয়া যায় না। সংসারে হাজার রকমের দায়-দায়িত্ব থাকে। সেগুলো নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে বাবা ছেলে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যায় অতীতে– কি নির্মল-নির্ভার দিন ছিল তাদের! সবে পা পেয়েছে সুমাইয়া। ধরে ধরে এক’পা, দু’পা করে হাঁটে আর থপাস, থপাস করে পড়ে। ব্যথা পাক আর নাইপাক পড়ার সাথে সাথে জুড়ে দেয় সেকি কান্না! সঙ্গে সঙ্গে ক্রন্দনরত নাতনিকে কোলে তুলে নিতেন দাদা, জামাল মিয়া। নাতনির কান্না থামাতে কপট ছল করে মেঝেতে ধুপ-ধাপ দু’চারটা বারি মারতেন লাঠি দিয়ে, আর নাতনিকে সোহাগ করতে করতে বলতেন,”ওরে সামান্য ইট-বালির মেঝে, তুই তো ভারী দুষ্টু, আমার নাতনিকে তুই ব্যথা দিস!” কি বুঝত ওই জানত, তবে ওর কান্না নিমেষে উধাও হয়ে যেত, আর ও, খলখল করে হেসে উঠত। এমনতর কত শত স্মৃতি উঁকি দেয় ওদের মানসপটে। তখন সুমাইয়ার বয়স-তিন, সাড়ে তিন বছর। মাছ খেতে গিয়ে মাছের কাঁটা বিঁধে যায় গলায়। নানী, দাদীর আমলের ঘরোয়া টোটকা পদ্ধতিতে গলার কাঁটা নামানোর চেষ্টা করেন মা আর দাদী দুজন মিলে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। একে তো কচি বাচ্চা তার উপর মুঠো মুঠো শুকনো ভাত গিলতে গেলে লাভের লাভ কিছুই হলো না বরং কাঁটা গলায় আরও এঁটেসেঁটে বিঁধে রইল। এনিয়ে বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে গেল। সুমাইয়া চোখের মণি বড়ো বড়ো করে ভয়ে সিটে হয়ে রইল। তৎক্ষনাৎ সুমাইয়াকে হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলো। সে যাত্রায় মাছের কাঁটা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল। শুধু মুক্তি নয় তার থেকে বেশি কিছু ঘটল, নাতনি বড়ো না হওয়া পর্যন্ত মিয়া বাড়িতে মাছ খাওয়ার নিয়ে বিধি-নিষেধ জারি হয়ে গেল!

এমনই সব ছোটখাট বিষয় নিয়ে দাদা অনেকটা বাড়াবাড়িই শুরু করে দিলেন! সামান্য বিষয় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি না করাই ভালো। এ কথা যতবার বোঝাতে গিয়েছে বাবাকে, ততবারই ছেলেকে বকা-বাদ্য করে থামিয়ে দিয়েছেন জামাল মিয়া। তোলা তোলা করে যে মেয়েকে মানুষ করা হয়েছে, সেই মেয়ের নির্বুদ্ধিতার জন্য আজ সে প্রবঞ্চনার শিকার। এই সব কথা ভাবতে গিয়ে, বাবা-ছেলের চোখ ভিজে যায়। দাদী আর সুমাইয়ার মা এই ঘটনায় মুষড়ে পড়লেও চোখে পানি আসতে দেয় না কারো সামনে।

ঢাকা শহরে থাকার জন্য প্রথমে বাড়ি ঠিক করতে হবে। ফয়েজ মিয়াকে ঢাকা শহরে কে বাড়ি ভাড়া দেবে? আর ফয়েজ মিয়াই বা কতটা জানে এই ভিড়-ভাট্টার শহরে বাড়ি ভাড়া, স্কুল কলেজ সংক্রান্ত বিষয়ে। সব ঠিক হয়েও যেন ঠিক হলো না কিছু। ফয়েজ মিয়া ঘোরতর সংকটে পড়ে গেলেন। এমন সময় তার বাল্যবন্ধু রইস উদ্দিন গ্রামে এলেন দুদিনের ছুটিতে।

রইস আর ফয়েজ দুই বন্ধু। যেন বন্ধুঅন্ত প্রাণ। দুজনে বড়ো হয়েছে কুমিল্লার বাতাকান্দি গ্রামের মুক্ত পরিবেশে। কুমিল্লাতে শিক্ষাজীবন শেষ করে রইস উদ্দিন চলে যান ঢাকা চাকরি করতে। আর ফয়েজ মিয়া থেকে যান গ্রামে। পেশা হিসেবে বেছে নেন শিক্ষকতা। যোগ দেন স্কুলে গণিতের শিক্ষক হিসেবে। শহরের ধূলো-বালির জটিল জীবন থেকে গ্রামের মুক্ত বাতাস, গাছ গাছালির আলো-ছায়ায় ঘেরা জীবন বরাবরই ভালো লাগে ফয়েজ মিয়ার। তাছাড়া গ্রামের এই বিশাল সম্পত্তিও দেখভাল করতে হয় তাকে। তাই আর শহরের পথে তাকে পা বাড়াতে হয়নি। কিন্তু আজ সেই প্রিয় গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে শহরে, সন্তানের মঙ্গল কামনা করে। সন্তানের থেকে বড়ো আর কিছু নাই দুনিয়াতে!
বন্ধুকে এই সময় গ্রামে তার পাশে পাবে ফয়েজ মিয়া সেকথা কল্পনাতেও ভাবেননি। বন্ধুর কাছে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা শুনে প্রচণ্ড আহত হন রইস উদ্দিন। বন্ধুর বিপদে যদি বন্ধু হাত না বাড়ায়, পাশে না থাকে তবে আর কে থাকবে? রইস উদ্দিন বন্ধুকে আশ্বস্ত করে, বাড়ি দেখা থেকে শুরু করে সব ঠিক করে বন্ধু কে খবর পাঠালেন, ঢাকা আসার জন্য।
বন্ধুর খবর পেয়ে বিন্দু পরিমান দেরী না করে সপরিপারে ঢাকার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় মিয়া পরিবার। যাবার সময় একজন কেয়ারটেকার ঠিক করে ঘরবাড়ি, জমিজিরাত দেখাশোনার দাযিত্ব দিয়ে গেলেন ফয়েজ মিয়া। মনের নিভৃতে সব দুঃখ-কষ্টকে অবদমিত রেখে বন্ধুর ঠিক করা ফ্লাট বাড়িতে গিয়ে উঠল মিয়া পরিবার। ইট-বালি, রড-সিমেন্টের এই শহরের বদ্ধ ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসে সবার। টুকরো টুকরো হাজারও স্মৃতি পেছনে ফেলে জোর চেষ্টা চলে ভালো থাকার, মানিয়ে নেওয়ার।

বছরের মাঝে ঢাকা আসার ফলে মেয়েকে আর স্কুলে ভর্তি করালেন না ফয়েজ মিয়া। সুমাইয়া এখন শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিক ভাবে কিছুটা বিষণ্ন। পুরনো গ্লানি এখনও যেন তাকে ভিতরে ভিতরে খেয়ে চলেছে। এই অল্প বয়সে মেয়ের জীবনে যা ঘটে গেল আর যে অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে জমা হলো, তা থেকে এত সহজে মুক্তি পাওয়া যায় না, তার জন্য দরকার একটু সময়ের। তাই তো ফয়েজ মিয়া, মেয়েকে সময় দিলেন নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে একটু থিতু হয়ে বসার জন্য।

ভাঙ্গা বছরটা পার করে বন্ধু রইসের সহযোগিতায় মেয়েকে নতুন স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। মেয়েকে ভর্তি করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। কারণ মেয়ে স্কুলে যাতায়াত না করলেও, বাসায় মেয়েকে নিয়ম করে পড়িয়েছন তিনি। পড়ালেখার সাথে সাথে এ ক’মাসে সুমাইয়াও অতীতের ভুল করা লজ্জা, গ্লানি, অপমানের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে বেশ গুছিয়ে উঠেছে। সে আর পেছন ফিরে তাকাতে চায়না। যে ভুল জীবনের শুরুতে করেছে সেই ভুলকে পেছনে ফেলে সামনে এগোতে হবে তাকে। লড়তে হবে সমাজে বেড়ে ওঠা, ওই সব জানোয়ারদের সাথে। তার এই পথ চলায় তাকে সব সময় সাহায্য করেছে তার বাড়ির আপনজনরা। নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ সব কিছুকে আপন করে একবুক দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুমাইয়া।

অতীত গ্লানি থেকে নিজেকে নির্ভার করতে পেরেছে সুমাইয়া। এই বন্ধুর পথ চলতে চলতে কখন যে বাবা-মেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে, টের পায়নি ওরা! বাবার সহযোগিতায় সুমাইয়া স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ সব জায়গাতে সমাদ্রিত হয়েছে তার মেধা, প্রঙ্গা আর বুদ্ধির জোরে। সময় দ্রুত ধাবমান।সব কিছু পেছনে ফেলে নিজ লয়ে সামনে এগোনোই তার ধর্ম। যথা সময়ে সুমাইয়া ভর্তি হয় স্কুলে। স্কুলের প্রথম দিন মিয়া বাড়ির সবাই উন্মুখ হয়ে রইল এই ভেবে যে ‘সুমাইয়া নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে তো নতুন পরিবেশের সাথে? ‘ স্কুল ছুটির ক্ষণকাল পূর্বে মেয়ের স্কুলের সামনে ফয়েজ মিয়া দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু তার বিষণ্ন ভাবনায় যেন কিছুটা আলোর ছটা এসে পড়ল। ফয়েজ মিয়া দেখলেন, সুমাইয়া স্কুল গেট থেকে বের হচ্ছে সচ্ছন্দে সাবলীল ভঙ্গিতে এক সহপাঠির হাত ধরে।

সেদিনের পর থেকে মিয়া বাড়ির সদস্যদের আর দুঃশ্চিন্তা করতে হয়নি। ধীরে ধীরে স্কুলের শিক্ষক ও বন্ধুদের প্রিয়মুখ হয়ে উঠেছে সুমাইয়া। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, আবৃতি ও ছবিআঁকাতে ওর সাফল্য, অনেক বন্ধু, সহপাঠিদের কাছে ঈর্ষানীয় হয়ে রইল। বহুদিন পর উজ্জ্বল আলোর ছটা, মিয়া বাড়ির সদস্যদের মনকে আলোকিত করেছে। ওরা ফিরে পেতে শুরু করেছে ওদের হারানো স্বপ্ন, হারানো বিশ্বাস।
স্কুল, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সুমাইয়া ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। ভর্তি হওয়া নিয়ে শুরুতে কিছুটা আপত্তি করলেও পরবর্তীতে আর কোন আপত্তি করেন নি ফয়েজ মিয়া। কারণ, ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসে সুমাইয়া। ওর রঙ তুলির প্রতিটি আঁচড়ে প্রকাশ পায় মানব মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা যত অব্যক্ত কথা! ছবি আঁকা সুমাইয়ার প্যাশন হয়ে দাঁড়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ওর নাম ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। শুধু দেশ নয়, বিদেশের আর্ট এক্সিবিশনে অংশ নিয়ে দেশের হয়ে অর্জন করেছে গোল্ড। মেয়ের সাফল্যে বাবা আজ গর্বিত। মনে মনে ভাবেন, তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সে-সময়ে। সময়ের সাথে বয়ে চলায় জীবনের ধর্ম। থামা মানেই পরাজিত হওয়া। জীবন অনেকটা বহমান নদীর মতো। আবার কখনও সখনও জীবন বৃক্ষের মতো, যতই ঝড়-ঝঞ্ঝা আসুক নিজেকে বিলানোতেই তাদের সুখ। তেমনি শত গঞ্জনা সয়ে মনস্তাপের আগুনে পুড়ে অন্যের সুখের কারণ হয়ে ওঠা-ই জীবনের স্বার্থকতা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করতেই সুমাইয়া চাকরি পেয়ে যায় শিল্পকলা একাডেমিতে। এর মাঝে চলে ছেলে দেখা। মেয়ে দেখতে অসুন্দর না হলেও নতুন করে ভিতরে ভিতরে সংকুচিত হতে থাকেন বাবা, ফয়েজ মিয়া। কিন্তু না, অতীত বাঁধা হলো না সুমাইয়ার নতুন জীবনের পথে।

সুমাইয়া-মিজানের নতুন সংসার। মিজান দেখতে যথেষ্ট সুন্দর। আর চাকরি করে বেশ ভালো। দু’জনের চাকরি তার উপর ফয়েজ মিয়া দিয়েছেন দু’হাত ভরে। দাম্পত্য জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে চায় সুমাইয়া। নিজেকে উজার করে দিতে নেই তার কার্পণ্য। এক জীবনে ভুলের খেসারত দিতে হয়েছে তাকে চরম ভাবে। কি পৈশাচিক অত্যাচার করেছে ফরহাদ শেখ। একজন বিকৃত রুচির মানুষই পারে এমন করতে। এসব ভাবলে ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে সুমাইয়ার। ডাক্তার যখন কিছু বলতে পারল না, তখন সবাই ধরেই নিয়েছিল সুমাইয়ার গর্ভে হয়তো কোনো ভ্রুণের বংশ বিস্তার হয়েছে। সমাজের কথা মতো তবু রক্ষা পেয়েছে মেয়েটা ‘কোনো সন্তান তো হয়নি!’ সত্যিই সুমাইয়া রক্ষা পেয়েছিল, নরকের কীটদের সাথে থাকার ফলে তার গর্ভে কোনো ভ্রুণ বাসা বাঁধতে পারেনি। ফরহাদকে বিশ্বাস করে ঠকেছে, আজ তাই মিজানকে অবিশ্বাস করে ঠকতে চায় না সুমাইয়া। ভালোবাসতে চায় মিজান কে। লতাগুম্লের মতো জড়িয়ে জীবনের শেষ পর্যন্ত পারি দিতে চায়।

প্রতি পলে জীবন রঙ বদলায়। মেয়ের সংসারের সুখ দেখে ফয়েজ মিয়া সিদ্ধান্ত নেন গ্রামে ফিরে যাবেন। তার সিদ্ধান্তের কথা বাবা কে জানালে উনি সম্মতি দিয়ে বলেন, “যত কিছুর আয়োজন ছিল, ওই নাতনির জন্য। ওর সুখই আমাদের সুখ। আমাদের আর আলাদা করে পাওয়ার কিছু নেই। আজ যখন আমার নাতনি সুখের মুখ দেখেছে, আল্লাহ ওর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন, তখন শেষ বেলাটা বাপ-দাদার ভিটেতেই কাটাই। তুমি যত দ্রুত সম্ভব তোমার অফিস আর এদিক-কার কাজ গুটিয়ে নাও।”

বাবার সম্মতি পেয়ে ছেলের মনটা আনন্দে ভরে উঠল। আহ! সেই গ্রাম। যেখানে শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে কেটেছে তার জীবনের অর্ধেকেও বেশি সময়। সেই গ্রামে আবারও ফিরে যাবে। সেই মাঠ, সেই ধানের আইল, সেই পুকুর– কল্পনাতে সব ভেসে ওঠে চোখের সামনে। বাড়ি ফিরে যাবে সেই আনন্দে বউ-শাশুড়ি তাদের জিনিস-পত্র গোছগাছ, বাঁধাবাধি শুরু করে দিলেন। ফয়েজ মিয়াও বসে রইলেন না, পরের দিনই চাকুরির ইস্তফা লেখা কাগজ জমা দিলেন অফিসে।

বন্ধু রইস উদ্দিন শুধু বাড়ি আর স্কুলের ব্যবস্থা করে দিয়ে ক্ষান্ত হননি। বরং তার বন্ধুটির জন্য তারই অফিসে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অর্থের অভাব যদিও ছিলনা মিয়া পরিবারের তবুও ঠুঁটো জগন্নাথের মতো কিছু না করে বসে থাকাটাও পছন্দ হচ্ছিল না ফয়েজের। তাই বন্ধুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে বন্ধু যে ফার্মে কাজ করে ওখানেই চাকরিতে জয়েন করেন।

সবই আগের মতো আছে। তবু বাবা চলে যাবার পর থেকেই সুমাইয়ার ঢাকা শহর ফাঁকা ফাঁকা লাগে! বুকের মধ্যে থেকে থেকেই হু হু করে ওঠে! দু’চোখ জলে ভিজে যায়। সেই সাথে আরও একটা বিষয় লক্ষ করল সুমাইয়া, বাবা-মা চলে যাবার সময় কাজে সাহায্য সহযোগিতা করলেও মিজানের মনের কোন পরিবর্তন হয়নি! অবাক হয়েছে তবে প্রশ্ন করেনি কোনো।

বছর ঘুরতে গেল ওদের বিবাহিত জীবনের। বাচ্চার জন্য মিজানের তেমন কোনো আকুলতা দেখতে পায় না সুমাইয়া। বরং এড়িয়ে চলে বাচ্চার বিষয়টা। মাঝে মধ্যে সময় পেলেই মিজানের অফিসে যায় সুমাইয়া। মিজান কখনও সুমাইয়ার অফিসে গিয়েছে বলে মনে পড়ে না। এই এক বছরে মিজানের তিন তিনটি পি এ-কে দেখল সুমাইয়া। এরা প্রত্যেকেই সুন্দরী, স্মার্ট। পিএ-র ক্ষেত্রে এই গুণ দুটোকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি। কেনো এরা বেশিদিন চাকরি করে না, সে কথা না জানলেও সুমাইয়ার জানতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি বর্তমান মেয়েটা বেশ গায়ে পড়া। আগ বাড়িয়ে কথা বলে আর কথা বলার সময় গায়ে ঢলে পড়ে ইচ্ছে করে। তার চাহনির মধ্যেও কেমন একটা রহস্য খেলা করে। এদের কাউকেই কখনও সুমাইয়া সন্দেহের চোখে দেখেনি। কারণ মিজানের স্কুল, কলেজ সহ জানা শোনা অনেক বন্ধু-বান্ধবী-ই প্রতি নিয়ত ওদের বাসায় বেড়াতে, গল্প করতে আসে। আবার কখনও কাজের চাপে অধিক রাত হলে মেয়ে বন্ধুরাও মিজান কে নামিয়ে দিয়ে যায় বাসার গেটে। কখনও বেসামাল কোনো কিছু চোখে পড়েনি। তাই সন্দেহ করেনি। আর এ কারণে মিজানের উপর তার ভক্তি শ্রদ্ধা বেড়ে গেছিল দ্বিগুণ পরিমাণে। কিন্তু আজ অসিফের ফাঁকা ঘরে এমন দৃশ্য দেখবে তা কখনও কল্পনাতেও করেনি! এ কি ঝড়ের পূর্বাভাস! নাকি মিজান সম্পর্কে অন্য কোনো আলামতের ঈঙ্গিত দিচ্ছে নিয়তি! তবে কি মিজান, সুমাইয়ার অনুপস্থিতে তার বাসাতে এমন অনৈতিক কাজ করেছে? আর ভাবতে পারে না সুমাইয়া। মাথা ঘুরে যায়!

বাবা-মা নেই বলে যে ছেলেকে বাবা-মায়ের আদর, ভালোবাসা দিয়েছেন ফয়েজ দম্পতি, সেই ছেলেও শেষ মেষ ফরহাদের দোসর হলো! কি করবে সুমাইয়া? বাবা’কে কি জানাবে? না, না, যা দেখেছে সব ভুল দেখেছে। মন থেকে মুছে ফেলতে চায় সব কিছু। কিন্তু পারে না। অধিক রাতে মিজান ঘরে ফিরলে তাকে সরাসরি প্রশ্ন করে সুমাইয়া,“মেয়েটা কে? কী সম্পর্ক তোমার সাথে?” সুমাইয়া ভাবে হয়তো উত্তর দেবে না তো, কেউ হয় না। যা দেখেছ, ভুল দেখেছ! কিন্তু না এক সেকেন্ডও সময় নেয় না মিজান উত্তর দিতে। বরং বলে, –”তোমার আগের জীবনে তুমি কোথায় কার সাথে ফষ্টিনষ্টি করেছ , এখনও একই কাজ করছ কি না তা নিয়ে আমার যেমন মাথা ব্যথা নেই, তেমনি আমার জীবন নিয়ে মাথা ঘামাতে এসো না।” পাল্টা সুমাইয়া বলে,–”মাথা তো ঘামাতেই হবে, বিয়ে যখন করেছ আমাকে।” আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল– অমনি মিজান, বলে ওঠে, ” তোমাদের মেয়েদের ওই এক ফ্যাচড়, ফ্যাচড় স্বভাব। কাজের কোনো কাজ নেই। জানে শুধু স্বামী নামক বস্তুটির কাজে খবরদাড়ি করতে! সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে, নাক গলাতে আসবে না আমার ব্যাপারে।”

ভাবতে থাকে তবে এতদিন ওকি ভুলের স্বর্গে বাস করছিল? পৃথুলা এই পৃথিবীর অগণন মানুষের ভিড়ে বাবার পড়ে মিজান-কেই বেশি আপন মনে হয়েছিল। আজ মিজানের উন্নাসিক আচরণ দেখে, এক ঝটকায় সে ভুল ভেঙ্গে গেল। সত্যিই মানব মনের জটিল অন্ধিসন্ধির খবর পাওয়া দুষ্কর! এক লহমায় ওর সমস্ত ভালোলাগা-ভালোবাসা অবিশ্বাসের অনলে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভষ্মিভূত করেদিল মিজান।

সুমাইয়ার শূন্যতা পূরণ হবার নয়। সব শূন্যতা পূরণও হয় না। সেদিনের দেখা সব কিছু ভুলতে চায় ও। মনে পড়ে যায় বিয়ের পরের দিনগুলোর কথা। এখন আর তখনকার দুই- মিজান’কে এক বৃত্তে জড়ো করতে গিয়ে , মিজানের ফাঁদ পাতা ভালোবাসার কাছ থেকে ছিটকে পড়ে সুমাইয়া।

একই বৃত্তে আবদ্ধ থেকেও দু’জন মানুষ হয়ে যায় সম্পূর্ণ আলাদা। এখন ওরা একে ওপরের থেকে গা বাঁচিয়ে চলে। অতীতের গ্লানি থেকে বেরিয়ে বুকের গহীনে জমা কষ্টগুলোকে ঝেরে ফেলে তিল তিল করে নিজেকে সাজিয়ে ছিল মিজানের রঙে। বারবার সমাজ আঙ্গুল তোলে সুমাইয়ার দিকে। ও কী একাই দোষী? ফরহাদ, মিজানদের কী কোনো দোষ নেই? সমাজ কেনো আঙ্গুল তোলে না তাদের দিকে? কেনো ভৎসনা করে সুমাইয়াকে প্রতিবার? কেনই বা প্রতারিত হতে হয় সুমাইয়াদের?

ওর একাকিত্ব কেউ দেখে না। দেখে ওর বেহায়াপনা, বেলাল্লাপনা! সেদিনও গ্রামের অতি উৎসাহী মানুষজন বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়ায় সব দোষ দিয়েছিল ওকে। মেয়ে মানুষের দুঃসাহস নিয়ে রটেছিল অনেক মুখোরচক গল্প। এমন বলা হয়েছিল, ওর কারণেই ফরহাদ একাজ করতে বাধ্য হয়েছিল।
ফরহাদের সাথে থাকার দিনগুলো বড়ো বিভীষিকাময়। দংশন করে বারবার। সুমাইয়াকে নিয়ে পালিয়ে যাবার পরও ধড়িবাজ ফরহাদ নিজেকে সুধরাতে পারে না। বরং আরও বেশি করে অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে। সমাজে হেন জঘন্য কাজ নেই যা ফরহাদের দ্বারা করা সম্ভব নয়! হাত বদল হতে হতে সুমাইয়া কি ভাবে পুলিশের হাতে এলো, সেকথা সুমাইয়া নিজেও জানে না। যখন ওর জ্ঞান ফেরে, তখন ও মিয়া বাড়ির খাঠে শুয়ে।

ধরা পড়ে দীর্ঘদিন জেলে ছিল ফরহাদ শেখ। জেল থেকে কবে, কখন ছাড়া পেয়েছে, কি করছে না করছে তার ইতিবৃত্তান্ত মিয়া বাড়ির কেউ জানে না। মিজানের প্রতি আর কোনো মোহ, টান অনুভব করে না সুমাইয়া। সংসার শুধুই একটা শব্দ হয়ে সেঁটে রইল নুন ছাড়া তরকারির মতো সুমাইয়ার জীবনে। সব কথা জানানোর পর ওর বাবা বলেছিল, “তোমাকে আমি সে ভাবেই মানুষ করেছি, একা পথ চলা শিখিয়েছি। তোমাকে কষ্ট পেতে শেখায় নি। তুমি ওখান থেকে বেরিয়ে এসো।”

ছোট বেলা থেকেই সমাজের কর্দজ অলি গলি চেনা হয়েগেছিল সুমাইয়ার। ইচ্ছে করলেই পারত অন্য কারো সাথে নিজের জীবন’কে জড়াতে। কিন্তু ওর রুচিতে বেঁধেছিল একটা জীবন নিয়ে বারবার কাঁটাছেড়া করতে। কতগুলো কষ্টপাওয়া মুখ ভেসে ওঠে ওর মানসপটে। প্রবল ইচ্ছে করে ফরহাদ, মিজানদের মতো মানুষদের কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি দিয়ে শিক্ষা দিতে। কিন্তু শাস্তি দিতেও ঘেন্না করে। ওর ঘেন্না এই সমাজের প্রতিও। তাল, ছন্দহীন জীবনে ছাড়েনা এই বাসা এই সংসার। ও চলে গেলে আরও একজন আসবে ওর জায়গায়। বাবা কে তাই বলেছিল, “সবখানেতেই একা লড়াই করতে হবে বাবা। এখানে থেকে সেই লড়াইটা যত সহজ হবে, এই বৃত্ত থেকে বের হলে লড়াইটা আরও কঠিন করে তুলবে এই সমাজ।”

মিসেস ফারদিনের মতো মানুষের জন্য বড্ড মায়া হয় সুমাইয়ার। এরা সুখ বোঝে, শান্তি বোঝে না। দু’বেলা কিল-ঘুষি খেয়ে স্বামীর মুখে দু’খানা সোহাগের কথা শুনে নিজেদেরকে খুব বেশি ভাগ্যবতী, স্বামীর গরবিনী স্ত্রী ভাবে নিজেদের কে! এরা বোঝেনা নিজস্বতা কি জিনিস। মাঝে মাঝে তাই টক্কর লাগে সুমাইয়ার সথে মিসেস ফারদিনের। যিনি নিজের নামের থেকে স্বামীর বিশেষণ জুড়ে দেওয়া নামটাকে বেশি পছন্দ করেন। এই তো সেদিন ড্রইং রুমে বসে বলছিলেন, ” আমি ঠিক তোমাদের সম্পর্কটা বুঝিনা, বুঝলা সুমাই! উনি সুমাইয়াকে, সুমাই বলে ডাকেন। ডাকটা ভালোও লাগে সুমাইয়ার। বুঝছো একই বাসায় থাকো অথচ বলো তোমাদের কোনো সম্পর্ক নাই। এইডা কেমন কথা কও তো! উনার এই জগাখিচুরি ভাষা শুনে সুমাইয়া বেশ মজা পায়। সুমাইয়া বলে– মিসেস ফারদিন তোমার ব্যাপারটাও আমি বুঝিনা, বুঝছো। দেখো, তোমার বাপ-মায়ের আকিকা দেওয়া একটা সুন্দর নাম আছে। সেই নাম বাদ দিয়ে, মিসেস ফারদিন নামে অভ্যস্থ হলে কী ভাবে?

– এইডা কেমন কথা বল্লা তুমি!

– ঠিকই তো বললাম। মানুষ অভ্যাস আর স্বভাবের দাস। তুমি যেমন সমাজের স্ট্যাটাস মেনটেন করা নামে অভ্যস্থ। তেমনি আমারও অভ্যাস হয়ে গেছে একই ছাদের নীচে থেকে নিজেরা নিজেদের মতো করে থাকা। মিসেস ফারদিন কি বুঝল না বুঝল তা সেই ভালো বলতে পারবে। তবে, সে যে বেশ খানিকটা রেগে গেছে তা বোঝা গেল। একা একা কটকট করতে করতে গডগড করে হেঁটে গিয়ে, ধরাম করে খোলা দরজার পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলে।

মিসেস ফারদিনের মতো মানুষদের কাছে সুখের অনুসঙ্গ আলাদা। এরা শত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করে, স্বামীর অসৎ উপায়ে রোজগার করা টাকায় নিজেদের সাজিয়ে সোসাইটিতে দাম কিনে নিজেদের মেকি সুখের আবহে সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসে।

শুধু মিসেস ফারদিন নয় আরও অনেকেই সুমাইয়ার দোষ দেখে, বাড়াবাড়ি দেখে। এতে অবশ্য সুমাইয়ার কোন ভাবান্তর হয় না। চলতে ফিরতে এতবার এসব কথা শুনতে হয় যে এগুলোকে ও আর পাত্তা দেয় না। ও ব্যস্ত থাকে নিজেকে নিয়ে, নিজের সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত