পড়াশুনা, খেলাধুলা, ঝোপে জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ানো– প্রভৃতির ভেতর দিয়ে হাসিব যখন শৈশব এবং কৈশোরের দিনগুলো কাটিয়েছে তখন তার গ্রাম বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত ছিলোনা। পশ্চিমে সূর্য ডুবে যাওয়ার পর চারদিকে আঁধার নেমে এলে কুপি, হ্যারিকেন, টর্চ কিংবা মোমবাতির সাহায্যে মানুষ তাদের রাতের কাজগুলো সারতো।
সেসব দিন এখন অতীত হয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। এই যে এখন গ্রামের বাড়ির ড্রয়িং রুমে বিদ্যুতের আলোর নিচে বসে আছে-আগে তা কল্পনাতেও আসেনি। আসবেই বা কিভাবে? এভাবে ভাবার মতো কোন ভিত্তি তো ছিলো না। মানুষ যেন ধরেই নিয়েছিলো আমৃত্যু তাদেরকে কুপি কিংবা হ্যারিকেন জ্বেলে কাটিয়ে দিতে হবে। কল্পনাতীত কিছু কাজ তবু ঘটে যায়। আর এমন না ঘটলে মানবজীবন একেঘেঁয়ে ঠেকতো। মানুষ হাঁপিয়ে উঠতো জীবনের একমুখী পরিচালনায়।
হাসিবের মন আলগোছে চলে যায় ফেলে আসা দিনে। সে এবং তার ভাই যখন গ্রামের স্কুলে পড়তো তখন দু’ভাই হ্যারিকেন মাঝখানে নিয়ে বসতো। আর তারা এতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো কেননা তখন আর কোন বিকল্প উপায় ছিলোনা। যারা তুলনামূলক একটু অবস্থাপন্ন তাদের যে গতি, যারা দিন আনে দিন খায় তাদেরও ঐ কুপি কিংবা হারিকেন। সংখ্যায় তারতম্য থাকতো-এই যা।
দু’ভাই শব্দ করে কবিতা বা সমাজ বা বিজ্ঞান বা অন্য কোন বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতো। আর এতে করে একটা সম্মিলিত ধ্বনির সৃষ্টি হতো। সময়ের স্রোতে ভেসে সে ভাই এখন অনেক দূরে। তিনি তার নিজের মতো করে সংসার করছেন, চাকরি করছেন এক শহরে। আর হাসিব নিজে সেটেলড হয়েছে আরেক শহরে।
একটু আবেগতাড়িত হয়ে ছেলে তূর্যকে এ বিষয়টা জানালে সে বলে-‘উফ! কিভাবে যে তোমরা পড়তে, আমি হলে পড়তামই না।’
– এ জন্যই হয়তো তুমি তখন জন্মাওনি। তুমি হয়তো অনুভব করতে পারবে না আমরা কিভাবে সে দিনগুলো কাটিয়েছি।
– ছেলের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই বসে বসে বাবার অতীত নিয়ে ভাববে। ফেসবুকে ব্যস্ত থাকা হাসিবের স্ত্রী মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই বাবা ছেলের কথার মাঝখানে ঢুকে পড়ে।
– তুমিও বুঝবে না তাহমিনা। তুমি আজন্ম শহরে থাকছো। এখন যদিও মনে হয় যে অনেক কঠিন ছিলো, তবু যেন সেসময়টিই ভালো ছিলো।
– তাহলে আর গ্রাম ছাড়লে কেন?সারাজীবন এখানে থাকলেই পারতে।
– তা-ই মনে হয় ভালো হতো, কি বলো তূর্য? ছেলের মনোযোগ আকর্ষণ করে স্ত্রীর কথার উত্তর দেয় হাসিব।
তূর্য কিছু না বলায় কথা এখানেই না থামিয়ে তারা রাতের খাবার খেতে চলে যায়।
গ্রামের বাড়িতে পাঁচদিন থাকার ইচ্ছে নিয়ে আসার পর আজ দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হচ্ছে। সহজ ছিলো না এই পরিকল্পনা করা।অনেক হিসেব নিকেষ করে, পিচ্ছিল বাঁশে বানরের বেয়ে উঠার পাটিগণিতের অংকটির মতো এগিয়ে পিছিয়ে এই সময় বের করতে হয়েছে। আগে যেমন দুই ঈদে নিয়মিত আসা হতো, এখন তেমন হয় না। আসলে আগে যেভাবে টান পড়ে যেতো, এখন সে টানও উবে গেছে যেন। অফিসের চেয়ারে বসে কম্পিউটার, ফাইল প্রভৃতিতে ডুবে থাকা, বাসায় ফিরে রাতে কিংবা ছুটির দিনগুলোতেও সাংসারিক নানা কাজের ঝামেলা, সামাজিকতা রক্ষা করতে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত– এসবের ফাঁক গলে বাড়ির কথা,শৈশব কৈশোরের স্মৃতি মনে আসার সুযোগ কোথায়? না, মনে পড়ে না। বর্তমানের সাথে তাল মেলাতে অবস্থা এমনিতেই টালমাটাল হয়ে যায়। তো, নিজের ছুটি পাওয়া, ছেলের স্কুল বন্ধের অপেক্ষা করা সহ আরো নানাবিধ কারণে বাড়িতে আসার সময় বের করা– তা-ও কিছুদিন থাকার উদ্দেশ্যে, সত্যিই কঠিন।
জীবন ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর অবস্থার দিকে ধাবমান। এর মধ্যে অন্যতম হলো অফিসের ব্যস্ততা। যে অবস্থানে এখন হাসিব আছে তা তৈরি করার পথটা এতো সহজ ছিলো না। কর্পোরেট জগতের পিচ্ছিল পথে হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যেতে হয়। সেখান থেকে তোলার মতো কেউ থাকে না। বরং পড়ে থাকতে দেখে সহকর্মীগণ আনন্দিত হয়। পারলে দাঁত কেলিয়ে হেসে মনে মনে বলে ,তুমি পড়ে থাকো ,দেখি এ সুযোগে আমি একটু সামনে যেতে পারি কিনা।তাই উঠে দাঁড়াতে হয় নিজের শক্তিতেই। নিজেকে প্রমাণ করতে হয় উপযুক্ত কর্মী হিসেবে। অনেকসময় শুধু কাজ দিয়েই হয় না, বসের মন যোগানোর দক্ষতারও পরিচয় দিতে হয়। হাসিবকেও এমত নানান অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আসতে হয়েছে। আর এ অবস্থান ধরে রাখার জন্যও প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যেতে হয়।
এতকিছুর মাঝে ডুবে থাকতে থাকতে শরীর মন এমনিতেই ক্লান্ত থাকে। ক্লান্তির হাত ধরে আসে ঘুম। ঘুমের অতলে চলে গেলে কখনো হয়তো গ্রাম এসে দেখা দেয়। মনের গভীরে গ্রামের গোপন স্পর্শ রয়ে গেছে।তাই হয়তো এভাবে এসে দেখা দেয়। তবে খুবই ক্ষণস্থায়ী এ দর্শন। এর বাইরে গ্রাম নিয়ে, গ্রামের মাঠ-ঘাট, হাট নিয়ে ভাবালুতায় আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। যে জগৎটা অনেক পেছনে ফেলে এসেছে তার আলো বাতাস অপরিচিত হয়ে গেছে অনেকটাই।
বিকালে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বাজারের দিকে হাঁটতে থাকা মানুষদের দেখে হাসিবের মনে হলো অনেকদিন ধরে হাটে যাওয়া হয় না। অথচ ছোটবেলায় বাবার সাথে হাটবারে বাজারে যাওয়া প্রায় নিয়মিতই হতো। আগে বড় ভাইকে নিয়ে গেলেও সে ক্লাস নাইনে উঠে গেলে বাবার সাথে বাজারে যেতে গড়িমসি করতো। তাই পরে হাসিবকেই সঙ্গী করেছিলেন। বাবা তাকে এ কারণেই সাথে নিয়ে যেতেন যে, কেনাকাটা শেষ করে বাজারের ব্যাগসহ তাকে একটি রিকশায় উঠিয়ে দিলে তিনি অন্যন্য কাজ শেষ করে কিংবা কাছের মানুষদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে পরে বাড়িতে ফিরতে পারতেন। সেসব দিন এখন কেবল স্মৃতি হয়েই আছে। এ রাস্তায় এখন আর রিকশাও চলেনা। সিএনজি চালিত অটোরিকশার কারণে এর প্রয়োজনীয়তাও হয়তো ফুরিয়ে গেছে।
সমবয়সী অনেককে বাজারে যেতে দেখে এবং তাদের কাছে সেখানের গল্প শুনে তারও বাজারে যেতে ইচ্ছা হতো। কিন্তু হাটবারে বাবার সাথে যাওয়া ছাড়া সুযোগ ছিলোনা। আর গেলেও বাবা তাকে হাতছাড়া করতেন না। তাই তাদের মতো তার কোন গল্প তৈরি হতোনা।ফলে অতৃপ্তিবোধ সবসময়েই লেগে থাকতো।অবশ্য হাই স্কুলে উঠার পর এ সমস্যা আর থাকেনি। কেননা তখন স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজনেই বাজার পার হতে হতো।পরেবড় হয়ে গেলে এগুলো মনে পড়লে নিজে নিজে হেসেছে।
তখনকার স্মৃতিগুলোকে একটু ছুঁয়ে দেখতে, ছেলেকেও এর কিছুটা স্পর্শ দিতে তূর্যকে নিয়ে বাজারে যায় হাসিব। শহরে বেড়ে উঠা ছেলেটা দেখুক তার বাবার ছেলেবেলার স্মৃতিমাখা কিছু জায়গা। মুখে যা-ই শুনেছে, স্বচক্ষে দেখলে হয়তো তার মনেও একটা আবেদন তৈরি হতে পারে। যদিও কখনোই তা তার বাবার মতো হবে না। তাকে কখনো টানবেনা এসব।
বাজারে পৌঁছে হাসিব প্রথমেই যায় মাছবাজারের দিকে। কিন্তু কোথায় মাছওয়ালারা? তারা যে এখানে নেই! এখানে বরং কিছু দোকান দেখা যাচ্ছে।একজনকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে দেয় মাছের বাজার দক্ষিণদিকে চলে গেছে। তূর্যকে নিয়ে এসে প্রথমেই একটা ধাক্কা খেল যেন। কি আর করা। একজায়গায় তো আর সবকিছু স্থির হয়ে বসে থাকবেনা। তাই আর না দাঁড়িয়ে থেকে সে নতুন মাছবাজারের দিকেই হাঁটে।
পাকা করে এ জায়গাটা তৈরি করা হয়েছে। উপরে আছে টিনের শেড। ফলে আগের মতো আর খোলা জায়গায় মাছের ঝুড়ি নিয়ে বসতে হয় না। বাবার সাথে কয়েকবার বাজারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তূর্য বলে,‘তুমি যে রকম বলেছিলে এটাতো সেরকম নয়। তুমি যেখান থেকে মাছ কিনো ঐটার মতোই অনেকটা।’
– ঠিকই বলেছো। আমিও এ স্থানটা আগে দেখিনি।
এতো কিছু কখন ঘটলো? হাসিব ভাবে, তাহলে তো দীর্ঘদিন ধরে আমার এদিকে আসা হয় না।বছরখানেক আগে বাড়িতে সর্বশেষ আসলেও একদিন থেকেই ফিরে গিয়েছিলো।তখন বাজারে আসার প্রয়োজন পড়েনি।কতকিছু যে কেবল স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। বাবার সাথে এসে আর কোনদিন এখানে মাছ কেনা হবে না। সে শহরের বাজার থেকে মাছ কেনে অথবা কোন সুপার মল থেকে ফ্রোজেন মাছ কিনে। তার বাবা এসবের সাথে পরিচিত ছিলেন না যেমন চিনেছে তুর্য। সে যখন বড় হবে তখন হয়তো আরো নতুন অনেককিছু আসবে।
কিছু সময় এখানে দাাঁড়িয়ে হাসিব তূর্যকে নিয়ে অন্যদিকে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে দেখে লতিফ মিয়ার দোকান উঠে গেছে।লতিফ মিয়ার দোকানের পিঁয়াজু অনেক সুস্বাদু ছিলো। বাজার শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাবা মাঝে মাঝে কিনে দিতেন। রোগে ভোগে মারা যাওয়ার পর তার ছেলেরা কিছুদিন দোকান চালিয়েছিলো। পরে তাদের মধ্যে বিবাদ লেগে যাওয়ায় দোকান বন্ধ হয়ে যায়।
হাসিব আরো দেখে বাজারের পাশে যে নালাটা ছিলো সেটা ভরাট করে একটি মার্কেট হয়েছে। ঘুরে ঘুরে সে আরো পরিবর্তন দেখতে পায়। পুরাতন অনেক কিছুই নাই যা তার ছেলেবেলার সময়ের সাথে জড়িত-তূর্যকে মুখে মুখে সেসবের বর্ণনা দিয়েছে কেবল-বিপরীতে নতুন অনেক কিছু হয়েছে যা মানুষের সুবিধা বাড়িয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। যেসব কেনাকাটার জন্য আগে উপজেলা সদরে যেতে হতো এখন এ বাজারেই এরকম কিছু দোকান হয়ে যাওয়ায় গ্রামের লোকজন এখান থেকেই কিনতে পারে।
হাসিব হঠাৎ শুনতে পায় কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। কাছে গেলে দেখতে পায়– আলতাফ। একটি দোকানে বসে তাকে ডেকেছে। ‘ভিতরে আয়। এটা আমারই দোকান।’-আলতাফ কথার সাথে সাথে হাত নাড়িয়েও ইঙ্গিত দিচ্ছে ভেতরে যাওয়ার।
আলতাফ হাসিবের স্কুল জীবনের সহপাঠী। তারা যখস্কুলে পড়া থামিয়ে দেয়ার হার এখনের চেয়ে অনেকবেশি ছিলো।আলতাফও এ দলভুক্ত। পড়লে হয়তো সে আরো এগুতে পারতো। কিন্তু ক্লাস সেভেন শেষ করে আর স্কুলমুখী হয়নি। যদিও পরিবারের চাওয়া ছিলো সে আরো পড়ুক কিন্তু নিজেরই অনীহার কারণে তার পড়ার চাকা থেমে যায়। হাসিব দোকান দেয়ার ইতিহাস জানতে চাইলে সে আক্ষেপই ঝরে পড়ে তার কন্ঠে– পড়াশোনা করলে আর এই বাজারে দোকানদারী করা লাগতো না। তোর মতোই হয়তো বাহিরে কোন জায়গায় থাকতাম।
– পড়ার তো সুযোগ আছিলো।
– কপাল বন্ধু, সবই কপাল। কপালে দোকানদারী আছিলো তাই নানা ঘাটের জল খাইয়্যা অবশেষে দোকান লইয়্যা বইলাম।
আলতাফ চা আনায়। আর তূর্যের জন্য আনায় জুস। অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় দুই বন্ধুর মধ্যে আলাপ জমে উঠে। অনেক দিন পর দেখা হলে যেমন হয় তাদের কথাবার্তায়ও তেমন অতীত উঠে আসে। একপর্যায়ে হাসিব বলে,‘আজকে বাজারে ঘুইর্যা দেখলাম আগের অনেককিছুই নাই। বেশ পরিবর্তন এসেছে।’
– বাজার তো বাজার । মানুষের কত পরিবর্তন অইছে।
– এইটা আমিও অনুভব করলাম। কালকে বিকালে গ্রামে কিছুসময় ঘুরছিলাম। অনেকের সাথে দেখা অইলো। আজকেও কিছু পরিচিত মানুষ পাইলাম। কথা কইয়্যা টের পাইলাম আগে যেভাবে আন্তরিকভাবে কথা কইতো অনেকেই সেভাবে কথা কয়না। কেমন জানি একটু দূরে দূরে থাকে।
–কিছুদিন থাকতে পারলে আরো কতো কিছু দেখতে পারতি।
এভাবে কথা হয়তো আরো এগুতো । তূর্য একা বসে উসখুস করছিলো– বাবা আর তার বন্ধুর কথাবার্তার অনেক কিছুই সে ধরতে পারছিলো না, কতক্ষণ আর নীরব শ্রোতা হয়ে থাকা যায়– তাই উঠে যেতে হলো।
বাড়ি আসার তৃতীয় দিনে তূর্যকে নিয়ে নদীর পাড়ে বেড়াতে গিয়ে হাসিব তাকে নদীর গল্প বলে। গ্রাম ছেড়ে দেয়ার পর এ নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। সে জলের সাথে অনেক গল্পও ভেসে চলে গেছে। তাই সবকিছু বলা হয় না ছেলেকে। ভেসে যাওয়া গল্প থেকে যেগুলো স্মরণে আসে তূর্য কেবল সেগুলো শুনে বাবার মুখ থেকে। তূর্য তার দাদার মাছ ধরার কাহিনী শুনে। খুব ভালো করে জাল উড়াতে পারতেন তিনি। নিতান্তই শখের বশে মাছ ধরে নিশ্চয় অনেক আনন্দ পেতেন। সুযোগ পেলে জাল নিয়ে বের হয়ে যেতেন আর সহকারি হিসেবে নিতেন তার বাবাকে।সে হয়তো বিশ্বাস করতে পারেনা বাবা তার দাদার সাথে মাছ ধরেছেন এ নদীতে। তাই চোখে বিস্ময় নিয়ে বলে– তুমি জাল উড়াতে পারতে বাবা?
– না তূর্য , এ কাজটি শেখা হয়নি। আব্বার সাথে থেকে কেবল মাছ রাখার ঝাঁকি বহন করেছি।
শিখলেও কি হতো? এখন কি হাসিব নামতো মাছ ধরতে ?আর তূর্য তার সাথে সাথে হেঁটে জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে ঝাঁপিতে রাখতো? না, তা হতো না, নিশ্চিতই। কেননা সে দিনগুলোকে পেছনে ফেলে সে এখন পুরোপুরি শহরের বাসিন্দা আর তার ছেলে শহরে জন্মে সেখানেই বড় হচ্ছে।
এরপর তূর্যকে খেলার মাঠের গল্প বললেও তা আর পূর্ণতা পায় না কেননা মাঠ বলতে নদীর পারের বালুময় যে জায়গাটা ছিলো সেখানটা তাদের ফুটবল খেলার সময়ের মতো আর নেই। ঠিকাদারের পাল্লায় পড়ে এখানকার মাটি চলে গেছে শহরে কিংবা কোন রাস্তা নির্মাণের কাজে বা অন্য কোন কাজে। তাই কোন ভিত্তি না পেয়ে গল্পও বেশি এগোয় না।
হাঁটতে হাঁটতে হাসিব ভাবে কত পরিবর্তন হয়ে গেছে তার গ্রামের। তার ছোটবেলার গ্রামের সাথে একে মেলানো কঠিন। পরিবর্তন হবেই। সময় চলতে চলতে কতকিছু পাল্টে ফেলে। সে যে গ্রামের জন্য নস্টালজিয়ায় ভুগছে, তার বাবার ছোটবেলায় হয়তো গ্রাম এরকম ছিলোনা। তখন পরিবর্তন হয়তো এতো দ্রুত হয়নি। ভবিষ্যতে হয়তো আরো কতো পরিবর্তন আসবে। তাই মনে ব্যাথা লাগলেও এ পরিবর্তনকে মেনে না নেয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে ছেলেকে তার স্মৃতিমাখা কিছু জায়গা দেখাবে বলে যে উৎসাহ নিয়ে বেরিয়েছিলো তাতে ভাটা পড়ে। ফলে হাঁটার গতি মন্থর হয়ে আসে। আরেকটু এগিয়ে পরিষ্কার জায়গা পেয়ে তূর্যকে নিয়ে বসে পড়ে তাকে বলে– কেমন লাগছে গ্রাম দেখে?
– গ্রাম তো গ্রামই। দেখার কি আছে?
হাসিব আর কিছু বলে না। সে যে আবেগ নিয়ে ছেলেকে এতো গল্প শোনালো, কিছু জায়গা দেখালো তা তার মনে রেখাপাত করেছে বলে মনে হচ্ছে না। নিজের ছেলেবেলাকে ছেলের সামনে কিছুটা হলেও দৃশ্যমান করার যে আকাঙ্খা হাসিবের মনেক্রিয়াশীল ছিলো তা ঝিমিয়ে আসে।
‘বসবো কি আরো কিছুক্ষণ’-হাসিব ভাবে। এই যে উন্মুক্ত জায়গায় ঘাসের উপর বসে আছে ব্যস্ত নগর-জীবনে সে সুযোগ কই? সবুজের ছোঁয়া পেতে হলে রীতিমতো আয়োজন করে প্রকৃতির কাছে যেতে হয়। আর এখানে কত সহজভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে সবুজ; গাছ-গাছালি,বাঁশঝাড় যেন নিজেদের উজার করে সবুজ ঢেলে দিচ্ছে। এরাইতো আপন ছিলো একসময়। তূর্য এ সবুজ দেখে বড় হচ্ছে না– এসব থেকে সে অনেক দূরে। আলোঝলোমলো শহরে সে হয়তো অনেক রঙিন আলোর খেলা দেখে কিন্ত এ অবারিত, নির্মল রং দেখেনা।
কিছু সময় নির্বাক থাকার পর হাসিব আবার তূর্যকে বলে– তুমি এখন যা দেখছো তা কি ড্রয়িং খাতায় আঁকতে পারবে?
– পারবো হয়তো। চেষ্টা করে দেখতে হবে।
আর্টের যেসব কলা তূর্য স্কুলে শিখেছে, সে হয়তো সেগুলোর প্রয়োগে গ্রামের একটি ছবি এঁকে ফেলবে। তার বন্ধুরা হয়তো মুগ্ধ হবে সে ছবি দেখে। কিন্তু সে কি আসলে একটি কল্প-গ্রামই আঁকবেনা? যে গ্রামে সে থাকেনা, যে গ্রামকে সে ভালো করে দেখেইনি , যেখানে আসার তার কোন প্রয়োজনই হয়তো পড়বেনা,তা কতটুকু গভীর অনুভূতি থেকে সে তুলে আনতে পারবে? এসব ভেবে হাসিবের মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। বসে থাকতে আর ভালো লাগেনা বলে বাড়ির দিকে এগোয়।
‘বাড়িতে আসার শখ কি মিটতেছে?’-বিকেলে চা খেতে খেতে তাহমিনা হাসিবকে বলে। এ কথায় যে একটু খোঁচা আছে তা বোঝার জন্য মাথা খাটাতে হয় না। হাসিব এ কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারতো পাল্টা খোঁচা দিতে। কিন্তু তারও যে মনটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই বলে–‘কি আর বলবো? কেমন একটা শূন্যতা টের পাচ্ছি যেন।’
– কী রকম সেটা?
এর জবাবে কি বলা যায় হাসিব তা নিয়ে ভাবে।তার এ শূন্যতা কি তাহমিনা বুঝবে? কিভাবেই বা সে বোঝাবে গ্রামে কাটানো ছেলেবেলার রঙিন দিনগুলো হারিয়ে যাওয়ার ফলে তার হৃদয়ে যে গভীর হাহাকার জেগেছে এবার বাড়িতে এসে তার যন্ত্রণা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তবু বলে– ‘আমার ছেলেবেলাটা হারিয়ে গেছে।’
– ছেলেবেলা বাঁধা থাকবে নাকি। তুমিও তো আর খোকাটি নেই।
– সে ঠিক আছে। কিন্তু সবকিছু যে এভাবে পাল্টে যাবে, আমার ভালোলাগার অনেককিছু যে এভাবে নষ্ট হয়ে গেছে তা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
– তুমি যেভাবে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছো, এখন দেখি এখানেই থাকতে হবে। আমি তো হাঁপিয়ে উঠেছি। লাকড়ি দিয়ে রান্নাবান্না করে তিনদিনেই চেহারার যা অবস্থা হয়েছে।
হাসিব কিছু বলে না। চায়ের কাপটা রেখে চুপ করে বসে থাকে।
তাহলে কি একেবারে নিখাদ ছিলো হাসিবের গ্রামে থাকার সময়টা? জমির আইল নিয়ে কথাকাটাকাটি কি শেষপর্যন্ত মারামারি পর্যন্ত গড়ায়নি? খেতে গরু ঢুকে জমির ফসল খেয়েছে বলে নূরুদ্দীন চাচাকে কি বকেনি রশিদ চাচা? মসজিদের ইমাম সাহেবের বেতন দেয়া নিয়ে কি শুক্রবারে জুমার নামাজের পর ঝগড়া লাগেনি? স্মৃতির পাতা ঘাটতে থাকলে এমন অনেক কিছুই চলে আসবে যেগুলো সুখকর নয়। কিন্তু হাসিবের মন এখন সেদিকে যাচ্ছেনা।
হাসিব ভাবে– তূর্য কি কখনো গ্রামে আসতে চাইবে? গ্রাম কি কখনো তাকে টানবে? হয়তো টানতে পারে কখনো, তবে না টানার সম্ভাবনাই বেশি। তার তো অন্তত কিছু স্মৃতি আছে যা এখনো মনে দোলা দেয়। তূর্যর তো কিছু নেই,সে কেন আসবে? তার বাবা যদি গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যেতেন– তাহলে কেমন হতো? সে কি তাহলে ভালোলাগার টানে এভাবে ছুটে আসতো বাড়িতে? হয়তো আসতোনা। বাড়ির ভিটেটা তাহলে দিনে দিনে পতিত হয়ে যেত। ভবিষ্যতে যে এরকম হয়ে যাবেনা তার কোন নিশ্চিতি দেয়া যায়না। কেননা তূর্য ভবিষ্যতে যা করবে, সবকিছুই শহর কেন্দ্রিক করার চিন্তা করবে। তার ভাইয়ের সন্তানেরাও বাড়িতে স্থায়ী হয়ে আসতে চাইবে না।
রাতে ঘুমানোর জন্য বিছানায় এলেও তার মাথায় এসব ভাবনা ঘুরে ঘুরে আসে। এর আগে কখনো এভাবে সে ভাবেনি। এ তিনদিনের অভিজ্ঞতা তাকে এসব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। মাথায় এগুলো যতো ঘুরতে থাকে মন ততো ভারী হতে থাকে। সময়ের সাথে রচে যাওয়া এই দূরত্বকে কমিয়ে আনার মতো কোন সুযোগও সে খুঁজে পায় না। বাড়িতে আসার জন্য মন যেভাবে ভালোলাগায় স্ফীত হয়েছিলো তা যেন এসব ভাবনার ফেরে পড়ে সংকোচিত হয়ে আসে। নিজেকে তাই বলে– কী হবে আর দুদিন থেকে? আমি যেমন গ্রামকে ছেড়ে চলে গেছি, আমার প্রিয় গ্রামটিও আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে হয়তো আসা হবে কিন্তু বিযুক্ততার অনুভবটি থেকেই যাবে।
হাসিব চোখ বন্ধ করে ভাবনায় নিমজ্জিত হয়েছিলো। চোখ খুলে তাহমিনাকে ডাকে– কি, জেগে আছো?
– হুম ,বলো।
হাসিব কোন ভূমিকা না নিয়েই বলে– সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবকিছু গুছিয়ে ফেলো। দুপুরের দিকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিবো।
হাসিব হঠাৎ করে এভাবে বলাতে তাহমিনা আশ্চর্য হয়। আরো তো দুদিন থাকার কথা। সে কিছু বলতে চাইলে হাসিব নিরৎসাহিত করে– এখন ঘুমিয়ে পড়ো। সকাল সকাল উঠতে হবে।