ডায়েরির শেষ পাতা

ডায়েরির শেষ পাতা

গতকাল ৫৫ বছর বয়সী একজন ভদ্রলোক আত্মহত্যা করেছেন। তদন্তের জন্য আমাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। উনার লেখা ডায়েরিটা পড়ার পর এই প্রথমবার আমি কোনো কেসের একমাত্র এভিডেন্স গায়েব করে দিতে চাচ্ছি। একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে কাজটা আমার ঠিক না হলেও একজন বাবার লেখা এই ডায়েরিটা যে আমাকে গায়েব করতেই হবে।

আমি আজ দেড় মাস হলো বদলি হয়ে সিলেটে এসেছি। এর আগে ঢাকাতেই ছিলাম। ভালোভাবে স্যাটেলও হয়ে গিয়েছিলাম সেখানে। কিন্তু আমার সততাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যার ফলস্বরূপ আমাকে বদলি হয়ে এখানে আসতে হয়েছে। ঢাকা থেকে তাছরিন তাছফিকে নিয়ে এতক্ষণে হয়তো স্টেশন এসে পৌছে গেছে। তাছরিন আমার স্ত্রী। আর আমার একমাত্র আদরের মেয়ের নাম তাছফি। প্রেম করেই আমাদের বিয়েটা হয়েছে। তাছরিনের খুব ইচ্ছে ছিলো আমাদের প্রথম একটা মেয়ে সন্তান হবে। আমিও যে সেটা চাইতাম তা ওর কাছে কোনদিন প্রকাশ করিনি। তাছফির জন্মের আগেই তাছরিন আমাদের মেয়ের নামটা ঠিক করে রেখেছিল। তাইতো মেয়েটাকে কেন্দ্র করেই আমাদের দুটো জীবন ওর চারদিকে সারাক্ষণ ঘুরতে থাকে।

এখানে আসার পর দেড় মাসে মোটামুটি সবকিছু ঠিক করে নিয়েছি তাদেরকেও এখানে নিয়ে আসার জন্য। এই কেসের কিছু কাজের জন্য আমি ওদেরকে আনতে যেতে পারিনি তাই ড্রাইবারকে পাঠিয়েছি। ওরা সোজা বাসায় চলে যাবে, আজ রাতের আগে ওদের সাথে আমার দেখা হবে না। ওদেরকে দেখার জন্য আমার মন ছটফট করছে। দেড় মাস ওদের থেকে দূরে থাকায় মনে হচ্ছে যেন কয়েক বছর চলে গেছে ওদের দুজনকে দেখি না। তাই দ্রুত কাজ শেষ করে রাত প্রায় নয়টার দিকে পুলিশ স্টেশন থেকে বের হয়ে বাসায় চলে এলাম।

তাছরিনের হাতে জাদু আছে বলতে হবে। পুরো অগুছালো বাসাটা কয়েক ঘণ্টায় ও এমনভাবে গুছিয়ে নিয়েছে যে ভিতরে ঢুকে চিনতেই পারছিলাম না এটা আমার বাসা। তাছফি ঘুমিয়ে পড়েছে। ইউনিফর্মটা খোলে ফ্রেশ হওয়ার পর তাছরিনের সাথে গল্প করতে করতে রাতের খাবারটা খেতে লাগলাম। গল্প মানে শুধুই মেয়ের গল্প। তাছফির দিন কীভাবে গেলো, বাবার কথা ওর মনে পড়েছে কি না, ট্রেনের জার্নিটা কেমন উপভোগ করলো এগুলোই। হঠাৎ যেন তাছরিনের হাসিখুশি মুখটা কেমন ঘোলাটে হয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে কিন্তু কিছুই বলছে না। আমি আর জিজ্ঞেস না করে খাবারটা শেষ করে হাত ধোয়ে নিচ্ছি। তখন ও কিছু একটা বলে উঠলো।

-যদি আমাদের মেয়েটাও একদিন আমাদের সাথে এরকম কিছু করে? আমার বুকটা ধঁক করে উঠলো। কী বলছে তাছরিন এসব!
-কী বলছো এসব! কী করবে মেয়েটা আমাদের সাথে? কী হয়েছে তোমার বলো আমাকে?
-ডায়েরিটা আমি পড়ে নিয়েছি। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো আমি কোন ডায়েরিটার কথা বলছি। তাছরিন কেঁদে ফেললো। কাঁদবারই কথা। ডায়েরিটা পড়ার পর গতকাল রাতে আমিও কেঁদেছিলাম। ওকে জড়িয়ে ধরলাম। আমারও চোখ থেকে জল পড়ছে।

-না, আমাদের মেয়েটা আমাদের সাথে এরকম কিছু করবে না। তুমি শান্ত হও তাছরিন। কান্না থামাও।
-কেন থামাবো? তুমি কি কাঁদছো না? তোমার চোখ থেকেও তো জল পড়ছে। তাহলে আমি কেন থামাবো?

তাছরিন এবার কান্নাটা বাড়িয়ে দিল। কোনোভাবে ওকে শান্ত করে নিয়ে রুমে চলে এলাম। তাছরিন অনেক ক্লান্ত, সারাদিন অনেক কাজ করেছে। তাই ও বিছানায় আসার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাছফিও ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় মা মেয়েকে কী অপরূপ লাগছে তা বলে বুঝানো সম্ভব না। দুজনের চেহারা প্রায় এক। বিয়ের পর তাছরিনকে বলতাম আমাদের যদি মেয়ে হয় তাহলে মেয়েটার চেহারা ওর মতোই হবে। কিন্তু সে তা মানতো না। ও বলতো মেয়ে হলে ওর চেহারা আমার মতো হবে। এ বিষয় নিয়ে আমি বেশি কথা বললে তো তাছরিন আমার সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতো। শেষমেশ আমার কথাই সত্যি হলো। দুটো চেহারার মাঝে যেন অমিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কথা ভাবতে ভাবতেই আমার ডায়েরিটার কথা মনে হলো। হ্যা, ঠিক এরকম কিছু তো ঐ ডায়েরিটাতেই লেখা ছিলো। এক এক করে ডায়েরির পাতাগুলো যেন আমার চোখের সামনে বাস্তব চিত্র হয়ে ভেসে উঠতে লাগলো।

ডায়েরি- “মেঘলা আমার একমাত্র মেয়ে। দেখতে দেখতে মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। আর সেটা আমি বুঝতে পারলাম যেদিন সে বললো ওর ভালোমন্দ নাকি ও নিজেই বুঝে নিতে পারে। এইতো সেদিনের কথা, বাবার বুকে না ঘুমালে মেয়েটার ঘুম’ই আসতো না। বাবা খাইয়ে না দিলে তার খাওয়া হতো না। সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ এতো বড় হয়ে গেলো। আয়নার দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম আমারও চুল-দাড়ি প্রায় সাদা হয়ে গেছে। আমিও তো অনেকটা বুড়ো হয়ে এসেছি। সেই পুরনো আমি আর এই আমি’তে যে কতোটা তফাৎ তা শুধু এই দুই চোখ জানে। মেয়েটা দেখতে অবিকল ওর মায়ের মতো হয়েছে। যখন ওর মায়ের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল তখন ওর মা দেখতে ঠিক ওর মতো ছিলো।

মেঘলার জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। ওর মায়ের নামও ছিলো মেঘলা। আমাদের মেয়েটার জন্মের আগে যখন সে মেঘলার মধ্যে বেড়ে উঠছিলো তখন একদিন মেঘলা আমাকে বলেছিলো, “যদি আমাদের সন্তানের জন্মের সময় আমি মারা যাই আর ও যদি মেয়ে হয় তাহলে তুমি ওর নাম ‘মেঘলা’ রেখো। তুমি ওর মাঝেই আমাকে খুঁজে নিবে। আমার অভাবটা তুমি তখন বুঝতে পারবে না।” সেদিনের কথাগুলো যে একদিন সত্যি হয়ে আসবে তা সেদিন আমি বুঝতে পারিনি। ঐ কথাগুলো আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। আজ যদি ও থাকতো তাহলে অনেক খুশি হতো দেখে যে নিজের মেয়েটা দেখতে ঠিক ওর নিজের মতো হয়েছে। হয়তো মেয়েটাকে আমার থেকেও ভালো বুঝতে পারতো। বাবার কাছে মেয়েটা আজ বড় হয়ে গেছে কিন্তু মায়ের কাছে যে কোনো সন্তান’ই বড় হয় না।

“মেঘলা, হ্যা আমি তোমাকে আমাদের মেয়ের মধ্যে দেখতে পাই কিন্তু তোমার অভাবটা যে দিন দিন অনেক ভারী হয়ে আসছে। তোমাকে আজ আমার অনেক দরকার। তুমি কি পারবে না আজ আমার পাশে এসে দাঁড়াতে? অনেক অসহায় হয়ে পড়েছি আমি। তোমার কথা অনেক বেশি মনে পড়ছে আজ।”

জানি আমার কথাগুলো আজ মেঘলা শুনতে পারবে না। যদি শুনতে পারতো তাহলে আমার ডাকে ও না এসে থাকতে পারতো না। সকল বাঁধা ভেঙে আমার ডাকে চলে আসতো যেভাবে ২৫ বছর আগে নিজের সবকিছু রেখে আমার কাছে চলে এসেছিলো। সেই দিনগুলো আজও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দিনগুলো আমার কাছে কখনো অতীত মনে হয় না। প্রতি রাতেই আমি এসব মনে করতে করতে নির্ঘুম কাটিয়ে দেই।

আমাদের বাড়ি ছিলো ভারতের বর্ডারের পাশে। তখনকার বর্ডার বলতে এরকম কাঁটাতার ছিলো না। মাঝেমধ্যে বিএসএফের টহল পড়লেও বাংলাদেশের মানুষ যেকোনো কাজে নির্বিঘ্নেই এপার ওপার আসা যাওয়া করতো। আমাদের গ্রামে একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিলো, কিন্তু কোনো কলেজ ছিলো না। একটাই কলেজ সেটা ছিলো গ্রাম থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। তাই আমাদের গ্রামে যারা কলেজে লেখাপড়া করতো তারা বর্ডার পার হয়ে কাছেই ভারতের একটা কলেজে ভর্তি হয়ে নিতো। আমিও মাধ্যমিক পাশ করে সেখানে ভর্তি হয়েছিলাম। ঐ কলেজে পড়লেখার সুবাদে আমার মেঘলার সাথে দেখা হয়েছিল। প্রথম দেখাতেই মেঘলাকে আমার পছন্দ হয়ে যায়। আর সেটা আমি ওকে অনেক বার বলেছিলাম। কিন্তু মেঘলা আমাকে পাত্তাই দিতো না। আমিও ওর পিছু ছাড়ি নি। প্রতিদিন কলেজে যেতাম মেঘলাকে দেখার জন্য।

ওকে বিরক্ত করতাম। মেঘলা মাঝেমধ্যে এতোটাই বিরক্ত হতো যে আমাকে গালাগাল দেওয়া শুরু করে দিতো। এর কিছুদিন পর বর্ডারে ২৪ ঘণ্টা বিএসএফের টহল বসানো হলো।প্রায় ১৮ দিন এপারের কোনো মানুষ বর্ডার পার হয়ে ওপারে যেতে পারে নি। আমারও এই কিছুদিন আর কলেজে যাওয়া হলো না। মেঘলাকে দেখার জন্য আমার মন অনেক ছটফট করছিল। আমি ভেবেছিলাম মেঘলা হয়তো আমি না যাওয়াতেই খুশি ছিলো। কিন্তু আমার ভাবনা যে ভুল ছিলো সেটা আমি ১৮ দিন পর কলেজে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম। মেঘলা প্রতিদিনই আমার অপেক্ষা করতো। এই কিছুদিন আমি কলেজে না যাওয়ায় সে বুঝতে পেরেছিলো যে সেও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। সেদিন আমরা দুজন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সারাদিন গল্প করতে করতে কাটিয়ে দিয়েছিলাম।

একে অপরকে অনেক বেশি ভালোবাসতাম। এভাবেই কলেজের দুই বছর চলে গিয়েছিলো। পরিক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর কয়েকদিন মেঘলার সাথে আমার দেখা হয় নি। বর্ডারের ওপারে আমার একটা ভালো বন্ধু ছিলো। ওকে নিয়ে একদিন মেঘলার সাথে দেখা করার জন্য মেঘলা যে গ্রামে থাকতো সেখানে চলে গেলাম। আর গিয়ে যেটা জানতে পেরেছিলাম সেটা জানার পর সেদিন আমি অনেক বেশি কেঁদেছিলাম। মেঘলার পরিবার মেঘলাকে নিয়ে সেখান থেকে কলকাতা চলে গিয়েছিলো। অনেক বেশি কষ্ট হয়েছিল আমার। আমি কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছিলাম না। সেখানে একজনের থেকে জানতে পেরেছিলাম মেঘলার বাবা ওকে কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করানোর জন্যই এ কাজটা করেছেন। অনেক বেশি ভালোবাসতাম ওকে। মেঘলাকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেই পারতাম না।

তাই আমিও হাল ছাড়ি নি। আমার একজন মামা কলকাতায় থাকতেন। আমি উনার কাছে চলে গিয়েছিলাম। আর যে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেঘলা ভর্তি হওয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলো আমিও সেখানে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রথম যেদিন সেখানে মেঘলা আমাকে দেখতে পায় সেদিন ও আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক বেশি কান্না করছিলো। আমি তখন ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন সে আমাকে কিছু না বলে আমাকে ছেড়ে এখানে চলে আসলো। সে বলেছিলো আমার কথা নাকি ও ওর মা বাবাকে বলেছিলো। প্রথমত আমি বাংলাদেশি, আর দ্বিতীয়ত আমি মুসলিম। তাই ওর বাবা মা ওকে বলে দিয়েছিলেন সেটা কিছুতেই সম্ভব নয় যেটা ও চায়। তাই ও এখানে চলে আসার আগে আমাকে কিছু জানায় নি।

সবকিছু ভুলে সেখানে আমাদের নতুন জীবন শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক বছর আমাদের অনেক ভালো গিয়েছিলো। আমাদের সম্পর্কটা আরো গভীর হয়ে উঠেছিলো। এরপর আবার আমাদের সেই এক’ই পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়েছিলো। পড়ালেখা শেষ করার পর আমাকে দেশে ফিরতে হবে আর এদিকে মেঘলার বাবা মা কিছুতেই আমাকে মেনে নিচ্ছিলেন না। তারা ওর বিয়ে ওর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। মেঘলাকে আমি অনেক জোর করেছিলাম আমার সাথে চলে আসার জন্য। কিন্তু ও বলেছিলো তার বাবা মাকে সে কষ্ট দিতে পারবে না।

মেঘলার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো সেটাই করতাম যেটা মেঘলা করছিলো। ও ছিলো ওর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। অনেক আদরে তারা মেঘলাকে বড় করেছিলেন। মনে অনেক আশা নিয়ে তারা মেঘলাকে এতদূর লেখাপড়াও করিয়েছিলেন। মেঘলা আমার সাথে চলে আসলে হয়তো ওর বাবা মা অনেক ভেঙে পড়তেন আর সেটা ভেবেই আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম মেঘলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবো। আর তা’ই করেছিলাম।

মামার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বাস টার্মিনালে আসলাম তখন দেখতে পারলাম মেঘলা আগে থেকেই সেখানে বসে আছে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মেঘলাকে জিজ্ঞেস করার পর ও বলেছিলো সেদিন সে আমাকে রেখে এখানে চলে এসেছিলো ঠিক’ই কিন্তু আজ সে আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। ও আমার সাথে যাওয়ার জন্য ওর বাবা মাকে ছেড়ে চলে এসেছিলো। আমিও ওকে ফিরিয়ে দিতে পারি নি। মেঘলাকে নিয়ে সেদিন চলে এসেছিলাম। ও আমাদের বিয়ের আগে নিজের ইচ্ছেতেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছিল। মেঘলাকে এতোটা আপন করে পাওয়ায় আমি নিজেকে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান কেউ মনে করতাম। মেঘলা আমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতো।

কয়েক মাসের মধ্যে আমার একটা সরকারি চাকরি হয়। আমার পোস্টিং হয়েছিলো ঢাকায়। তাই মেঘলাকে সিলেটে রেখেই আমাকে ঢাকায় চলে যেতে হয়েছিলো। চাকরিতে আমার ছুটি অনেক কম ছিলো। তবে যেটুকু পেতাম তা সিলেটে এসে মেঘলার সাথে কাটাতাম। আমাদের সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ৩ বছর হয়ে গেলেও আমরা কোনো সন্তানের মুখ দেখতে পারলাম না। এ নিয়ে আমার থেকেও বেশি চিন্তা করতো মেঘলা। আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছিলাম, যদি উপরওয়ালা চান তাহলে একদিন না একদিন আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে কেউ আমাদের ঘরে আলো হয়ে আসবে। আর সেটা সত্যি হয়েছিলো আমাদের বিয়ের ঠিক পাঁচ বছর পর। মেঘলা অনেক বেশি খুশি ছিলো। আমিও যে কতটা খুশি ছিলাম সেটা বলে বুঝানো যাবে না। ওর জন্মের আগেই আমরা দুজন ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে নিয়েছিলাম।

নতুন করে আমাদের ঘর সাজানোর স্বপ্ন দেখতো মেঘলা। ওর যেন প্রতীক্ষার প্রহর যাচ্ছিলো না। যখন সময়টা এসেছিলো তখন দুর্ভাগ্যবশত আমি মেঘলার কাছে থাকতে পারি নি। আমাকে কাজের জন্য এর এক সপ্তাহ আগেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিলো। চট্টগ্রামে যাওয়ার পনেরো দিনের মাথায় সিলেট থেকে আমার কাছে একটা চিঠি আসে। আমাকে শীঘ্রই চলে আসতে বলা হয়েছিল। আমি সেদিন রাতেই সেখান থেকে সোজা সিলেটে চলে এসেছিলাম। সে দিনটা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন যা আজ পর্যন্ত আমার চোখের জল ফেলায়। সেদিনের চিৎকার করা আর্তনাদের আওয়াজ আজও আমার কানে বাজে। মেয়েটাকে আমার জন্য রেখে মেঘলা চিরতরে আমাকে ছেড়ে চলে যায়।

সেদিন জানতে পেরেছিলাম যে ডাক্তাররা বলেছিলেন মা আর বাচ্চার মধ্যে যেকোনো একজনকে বাঁচানো সম্ভব হবে। আর মেঘলার ইচ্ছেতেই বাচ্চাকে বাঁচানো হয়। নিজের মেয়েকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য মেঘলা নিজেই পৃথিবীর আলো হতে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিলো। সেদিন থেকে এই মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে বাঁচতে শুরু করেছিলাম। কোনদিন ওকে মায়ের অভাব বুঝতে দেই নি। প্রতিদিন রাতে ও আমার বুকের উপর ঘুমিয়ে পড়তো। আমি জেগে থাকতাম, ঘুমোলে যদি আমি এদিক ওদিক হই আর মেয়েটার ঘুম ভেঙে যায় তাই। ছোটবেলায় মেয়েটা বড্ড জেদ করতো বাবার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটবে বলে।

আমি আমার সব কাজ ফেলে রেখে মেয়েটার ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো পূরণ করতাম। ওর যখন চার বছর বয়স আমি তখন আমার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ওকে আরো বেশি সময় দিতে লাগলাম। নিজের হাতেই ওকে খাইয়ে দিতাম। পড়ালেখা থেকে শুরু করে ওর সব কাজেই আমি বাবা হয়ে একজন বন্ধুর মতো ওকে সাহায্য করতাম। কাঁদতে দিই নি মেয়েটাকে কোনদিন। এভাবে মাথায় করে রেখে মেয়েটাকে এতো বড় করেছি। যখন ও ভার্সিটিতে ভর্তি হলো তখন কেমন যেন বাবার থেকে ওর দূরত্ব বেড়ে যেতে লাগলো। নিজের কাজ ও নিজেই করতে পারতো। আমার ওকে আর সাহায্য করতে হতো না। আমি আরো একবার কেঁদেছিলাম, যেদিন প্রথম আমার মেয়েটা ওর নিজের হাতেই খাবার খেয়ে নিয়েছিল। সেদিন আমি কিছুই খেতে পারি নি। কারণ মেয়েকে খাইয়ে না দিয়ে এর আগে নিজে কোনদিন খাই নি। ওর পরিবর্তনগুলো আমি মেনে নিয়েছিলাম।

কিন্তু সে ওর এমন একটা সিদ্ধান্তের কথা একদিন আমাকে জানালো যা আমি মেনে নিতে পারলাম না। ও এমন একটা ছেলেকে পছন্দ করলো যে ছেলেটাকে আমি দুই চোখে দেখতে পারতাম না। আমি জেনেশুনে এমন একটা ছেলের সাথে আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারি না যে ছেলেটা নেশার সাথে জড়িত। তাই আমি ওকে বলেও দিয়েছিলাম যে এই একটা জিনিস যেন ও আমার কাছে আর না চায়। হ্যা, ও আমার কাছে আর চায় নি। কিন্তু আজ সকালেই আমার জন্য একটা চিঠি রেখে ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। চিঠিতে লেখা ছিলো “বাবা, চলে গেলাম। আর কোনদিন ফিরবো না। নিজের সুখ আমি নিজেই খুঁজে নিলাম। ভালো থাকবো ওর সাথে। তুমি আর আমার কথা মনে করে কষ্ট পেয়ো না। ধরে নিও তোমার মেয়ে মারা গেছে। ভালো থেকো বাবা।”

ওর মা মারা যাওয়ার পর আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ ছিলো এই মেয়েটা। আজ যখন মেয়েটাও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে তখন আর বাঁচার কোনো ইচ্ছে নেই। আজ কেন জানি মনে পড়ছে সেই বাবার কথা, যার কাছ থেকে একদিন আমি উনার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছিলাম। সেদিন বুঝতে পারিনি ঠিকই কিন্তু আজ বুঝতে পারছি একজন বাবার জন্য মেয়েকে হারানোর ব্যথা কতোটা প্রখর হয়।

এই ডায়েরিটা যে প্রথমে পড়বে তার কাছে আমার অনুরোধ- আমি মারা যাওয়ার পর ডায়েরিটা যেন পুলিশের হাতে না দেওয়া হয়। আমি চাই না আমার কলিজার টুকরো মেয়েটাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে হয়রানি করুক। এটা একজন বাবার অনুরোধ। আমার জীবন যখন ফুরিয়ে এসেছে ঠিক তখন এই ডায়েরির পাতাগুলোও শেষ হয়ে এসেছে। আর মাত্র একটি পাতা বাকি আছে। আর এই শেষ পাতায় একজন বাবা হিসেবে প্রতিটা মেয়ের জন্য কিছু লিখতে চাই।

___শেষ পাতাঃ

প্রিয় কন্যা,
তোমাকে সবাই যে চোখেই দেখুক না কেন তোমার বাবার চোখে তুমি একজন রাজকন্যা। একবার উনার অন্তরে আঁকা ছবিগুলো দেখে নিও। দেখবে সেখানে অনেক রঙিন স্বপ্ন আঁকা আছে। আর প্রতিটা স্বপ্নই তোমাকে কেন্দ্র করে আঁকা। উনি যা মুখে বলতে পারেন না তুমি তা শুনে নিও। যদি তুমি শুনার চেষ্টা করো তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শব্দগুলো তুমি শুনে নিতে পারবে। তুমি তোমার ভালোমন্দ উনার হাতে ছেড়ে দিও, কারণ তিনি এমন কেউ যাকে পৃথিবীতে সব থেকে বেশি বিশ্বাস করা যায়। তিনি বাবা, তিনি একটি শহর। যেখানে মেঘ হয় তোমার প্রয়োজনে, বৃষ্টি হয় তোমার প্রয়োজনে। এই শহরে তিনি অন্য কাউকে ঢুকতে দেন না। এটা তিনি নিজ হাতে তৈরি করেন একমাত্র তোমার জন্য। যদি কখনো উনার কোনো সিদ্ধান্তের উপর তুমি নারাজ থাকো তাহলে কখনো উনার সাথে এমন কোনো আচরণ করো না যা তিনি সহ্য করতে পারবেন না।

বরং খোঁজ নিয়ে দেখো। দেখতে পারবে এই সিদ্ধান্তগুলো উনি নিয়েছেন তোমাকে সর্বোচ্চ ভালো রাখার জন্য। তিনি বাবা, তিনি কখনো উনার মেয়ের ক্ষেত্রে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন না যা তোমার ক্ষতি করবে। তিনি বাবা, তিনি কখনোই চাইবেন না তুমি অসূখী হও। আমি তোমাকে জোর দিয়ে বলতে পারি, যদি কোনদিন তোমাকে ভালো রাখার জন্য উনার জীবন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে তাহলে তিনি নিজের জীবন নিয়ে দুবার ভাববেন না। একবার উনাকে উনার মতো করে বুঝে নিও। একবার উনাকে জড়িয়ে ধরে বলে দিও, “বাবা ভালোবাসি তোমাকে।” দেখবে উনি উনার হৃদয় খোলে তোমাকে উপহার দিয়ে দেবেন। আর তোমার ছোট ছোট চাওয়া তো অনেক তুচ্ছ।

একজন বাবা হিসেবে তোমার কাছে আমার অনুরোধ, কিছু চাওয়ার থাকলে সেটা বাবার কাছে মন থেকে চেয়ে নিও। উনি দিয়ে দেবেন। আর যদি না দেন তাহলে বুঝে নিও তুমি ভুল পথে এগুচ্ছো। হাসিমুখে বাবার সিদ্ধান্তগুলোকে সম্মান করে তা মেনে নিও। তুমি হয়ে যাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেয়ে। ভালো থেকো, বাবাকে ভালো রেখো। ইতি, মেঘলার বাবা।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত