আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। ফুপাতো ভাইয়ের বিয়ে। বড় ফুপুর ছোট ছেলের বিয়ে। তায় আবার মন্ত্রীর ভাগ্নির সাথে। এই বউ আসা উপলক্ষে আমার ফুপু আম্মাকে হায়ার করে তার বাড়ি নিয়ে গেলেন। জানালার পর্দা, ঘরের রঙ এর সাথে মিলিয়ে। কাঁচের ডাইনিং টেবিল। ড্রয়িংরুমে বড় ফ্লাওয়ার ভাস। প্রতিদিন কেনাকাটা আর সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় পিঠা বানানো। আধোঘুম আধো জাগরণে আমরা হাত বাড়াই। দেখি আম্মা পাশে নেই। চোখ ডলতে ডলতে রান্নাঘরে এসে দেখি। আম্মা নকশীকাটা পিঠা তেলে ভেজে রাখছেন। নয়তো নতুন বৌয়ের নাশতার জন্য ভেজিটেবল রোল বানিয়ে ডিপে উঠাচ্ছেন।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে গেলো। সেদিন ছিলো গায়ে হলুদ। আমরা ছোটরা শাড়ি পরে হাতে মেহেদি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আব্বার পরনে একটা মেরুন পাঞ্জাবী। সবাই মজা করছে আমি দৌড়ে এসে। আব্বাকে জড়িয়ে ধরতেই আব্বার পাঞ্জাবীতে মেহেদি লেগে গেলো। আম্মা এসেই আমার কান মুচড়ে হাত ধুইয়ে দিলেন। আর আমি যে দিন দিন কতো বেয়াড়া হচ্ছি সে ব্যাপারে উনার কোনো সন্দেহ নেই সেটাও শত শত বার বললেন।
রাতে ঘুমাতে সেদিন অনেক দেরি হয়ে গেলো। পরদিন সন্ধ্যায় বউ নিয়ে ফিরলাম। চাইনিজ চেহারার ভাবি আমার ভাইয়ার চে আধ হাত লম্বা। দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে বাসর ঘরে ঢুকলেন। আমার ফুপু সবাইকে একে একে ডেকে বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আব্বু একটা আংটি দিয়ে ভাবির মুখ দেখলেন। বড় আম্মাও তাই।
এমন সময় কে যেনো চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আমরা বড়দের ঠেলেঠুলে কোনোমতে ভেতরে ঢুকলাম। আমার বড় ফুপু মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদছেন। কি হয়েছে? বিশাল সর্বনাশ! মন্ত্রীর ভাগ্নিকে ফুপুর বাপের বাড়ি থেকে কেউ সোনার চেইন দেয়নি। কাল মন্ত্রী যদি আসে, তিনি কি করে তার সামনে মুখ দেখাবেন !
আব্বা আম্মুর মুখের দিকে তাকালেন। আম্মা কিছু না বলে আমার গলা থেকে চেন খুলে আব্বুর হাতে দিলেন। আব্বু বললেন “আমার মেয়েদের সামনে আমি ছোটো হয়ে যাবো।” তুমি অন্য ব্যাবস্থা করো। আম্মা লেদার খুলে শুধু যাওয়ার ভাড়া রেখে সব টাকা আব্বুর হাতে দিলেন। আব্বু চুপচাপ আমাকে সাথে নিয়ে একটা সোনার চেন কিনে আনলেন।
রিক্সায় আমি আর আব্বু আসছি। আমি বারে বারে ফ্রকের হাতায় চোখ মুছছি। আব্বু বললেন “কাঁদছো কেনো আদর! ” আমি ভয়ে কিছু বলিনা । আম্মা বলেছেন এই কথা আব্বু জেনে ফেললে কষ্ট পাবেন। আব্বু যতো জোড় করেন আমি ততোই কাঁদি। একসময় আব্বু বললেন ” ভয় পাচ্ছো? মা বকবে! ভয় কি, আমি আছি না ! ” আমি ভয়ে ভয়ে বলি আম্মাকে বলবেনা তো?
” – না বলবো না।”
তুমি যে ভাবির চেন কিনেছো। সেখানে তোমার পাঞ্জাবী আর আমাদের পরী জামা কেনার টাকা আছে। কাল অনুষ্ঠানে পরার জন্য আম্মা কিনতে চেয়েছিলেন। সব বাচ্চারা একরকমের জামা পড়ার কথা। মন্ত্রী মশাই আসবেন আর আমরা দুধারে দাঁড়িয়ে ফুল ছিটাবো।
আব্বু একবার আমার দিকে তাকালেন। তারপররিক্সাওয়ালা কে বললেন। “রিক্সা ঘোরাও।” সেই রাতেই আব্বু দোকানে চেন ফেরত দিয়ে ভাবির জন্য সোনার দুল নিলেন। বাকি টাকা দিয়ে দোকান খুঁজে খুঁজে আমাদের দু’বোনের জন্য পরী জামা কিনলেন। ফেরার সময় আমি জামার প্যাকেটটা বুকে জড়িয়ে বাসায় ফিরলাম। আমার আম্মা ফুপুর হাতে সোনার দুল দিয়ে কোনোমতে ঠাণ্ডা করলেন। রাতে ঘুমের মাঝে শুনছি আম্মা বলছেন ” তোমার পাঞ্জাবী? ” আব্বু কিছু বলেছিলেন কি না মনে নেই।
পরদিন রিসিপশনে সবাই ছেলেরা পাঞ্জাবী পরেছে। আব্বু শুধু শার্ট প্যান্ট। আমি ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দূর থেকে দেখছি নক্সাদার পাঞ্জাবীর ভিড়ে সহজেই আব্বুকে চেনা যাচ্ছে শার্ট প্যান্টে। “মন্ত্রী এসেছেন মন্ত্রী এসেছেন।” আমরা সবাই ফুলের পাঁপড়ি ছিটাচ্ছি।
আব্বু নাকি আম্মাকে বলেছিলেন ” নিতু দেখো। আমি সোনার চেনের বদলে, আমার মেয়েদের খুশি কিনেছি।” সেদিনের সেই দুল হয়তো হাজারো উপহারের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছে। মন্ত্রীর ভাগ্নি ভাবি হয়তো জানেনই না এই দুলের পেছনে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের কতোটুকু “হাসি আনন্দ বেদনা” লুকিয়ে আছে।
আব্বু আমার মন হৃদয় জানে, শুধু আমাদের খুশি কিনতে তুমি কতো ত্যাগ স্বীকার করেছো। তোমার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি, প্রথম সমুদ্রে নেমেছি প্রথম স্কুলে গিয়েছি। কলেজে গিয়েছি। এখন হয়তো আরো সামনে যাবো। আব্বু তুমি পাশে বা দূরে থাকলেও তোমার অদৃশ্য হাত আমায় ধরে থাকে। আর সেই হাত যেনো বলে। ভয় কি? আমি আছি না?