অমানুষ

অমানুষ

আজ থেকে বছর পাঁচেক আগের কথা।সংসারের কাজ নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলাম।একটা মেয়ে পেলে ভাল হতো। আমাদের বাড়িতে এক কাঠমিস্ত্রী কাজ করছিল। ওর গ্রাম থেকে একটি বার বছরের মেয়ে নিয়ে আসে।মেয়েটার মুখটা ভারি মিষ্টি। বড় বড় চোখ তাতে পানি টলমল করছিল। আমি হেসে বললাম নাম কি তোমার?ও কোনো কথা বললো না।এর আগে কোনো বাড়িতে থেকেছো?না সূচক মাথা নাড়লো। আমি আদর করে বললাম ভয় পেয়ো না সোনা,এখানে তুমি অনেক ভাল থাকবা। এবার ও মুখ খুললো, আমার নাম সুফিয়া,তোমাকে কি বলে ডাকবো?

গ্রামের অনেকে আমার ছোট মা বলে ডাকে,তুমিও তাই বলবা।মেয়েটা মাথা নেড়ে সায় দিলো। তারপর থেকে আমার বাড়িতে থাকে।দুইজন মিলে মিশে কাজ করি। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম পড়াশোনা করবি?স্কুলে ভর্তি করে দিব? ও সোজা বলে দিল, স্কুলে ভর্তি হব না।তোমার কাছে পড়বো। প্রতি সন্ধ্যায় ওকে পড়াতাম।অনেক চেষ্টায় নাম সই,ছোট ছোট বানান শেখে।

সুফিয়া কাজে যোগ দেয়ার পরের মাসেই ওর মাকে একটা গরু কিনে দিই,আর বলি গরুটা তোমার কাছে বড়ো হোক, সুফিয়ার বিয়ের সময় কাজে লাগবে। তিন বছর আমার বাড়িতে ভালোভাবে থাকলো। হঠাৎ একদিন ওর মা এসে বলল, বুবু সুফিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে, নিয়ে যাব।

আমি অবাক হয়ে বললাম এত ছোট মেয়ে বিয়ে দিবা? বুবু ছেলেটা খুব ভাল গ্রামে ছয় বিঘা জমি আর বাজারে একটা দোকান আছে। জিগ্যেস করলাম কোন দাবি দাওয়া নেই? আছে বুবু ছেলে শুধু একটা মোটরসাইকেল চাই, আর কিছু না। গরু বিক্রি করে আর কিছু টাকা দিলে মোটরসাইকেল হয়ে যাবে। ভালো করে খোঁজ খবর নিও।যে একবার যৌতুক চাই সে কিন্তু বারবার চাই।

সুফিয়ার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়েতে ছিলাম ভালই মনে হলো। দুই মাস পর সুফিয়া আমার সাথে দেখা করতে আসলো, খুব খুশি দেখাচ্ছে,বললো ছোট মা খুব ভালো আছি। এর কিছুদিন পর ওর মা এসে বললো, বুবু আপনি ঠিকই বলেছিলেন। ওরা আবার টাকা চাচ্ছে। আমি গরীব বিধবা কোথা থেকে দেবো? এর ছয়মাস পর ওর মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, বুবু সুফিয়া আর নেই। আমি হতবাক, কিভাবে মারা গেছে? খুন করেছে বুবু।

তারপর ওর মা যা বললো, আমার মাথা ঘুরে উঠল। যৌতুকের জন্য সুফিয়াকে খুব চাপ দিচ্ছিলো।সুফিয়ার একই কথা আমার মা আর এক টাকাও দিতে পারবে না। ওর শশুড়বাড়ির পিছনে জঙ্গলের মধ্যে ওর পাষণ্ড স্বামী গলায় গজাল পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছে। পেরেক ঢুকানোর পরও সুফিয়া বেঁচেছিলো,ওর গোঙানি শুনে গ্রামের লোকজন উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। তখনও ওর জ্ঞান ছিল, কিন্তু কথা বলতে পারছিলো না।

ও ইশারায় খাতা কলম দেখাচ্ছিলো।হয়তোবা কে ওর এই অবস্থা করেছে তার নাম লিখতে চাচ্ছিলো।কিন্তু কেউ ওর ইশারা বুঝতে পারিনি। পরে এক ডাক্তার বুঝতে পেরেছিল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। খাতা কলম দিতে দিতে সুফিয়া শেষ। আমার জীবনে এই রকম ভাবে খুন করার কথা শুনিনি। আমি ওর মাকে বললাম ওর স্বামী নিশ্চয়ই জেলে? হ্যাঁ বুবু পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। এর বেশ কিছুদিন পর ওর মা’র সাথে আবার আমার দেখা হয়।জিগ্যেস করলাম ঐ অমানুষটার ফাঁসি যাবৎজীবন জেল কিছু হয়েছে?

ওর মা কাঁদতে কাঁদতে বললো সাক্ষী প্রমাণের অভাবে আর টাকর জোরে জামিন হয়ে গেছে। আমি গরীব মানুষ কেস চালাবো কিভাবে? এখন শুনেছি বিয়ে করে বউ নিয়ে আছে। আমি হতভম্ব, একটা মেয়েকে খুন করে, কি সুন্দর ভাবে বিয়ে করে, ঘর সংসার করছে। কতখানি অমানুষ! আর সুফিয়ার মা কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে বিচার চাইছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত