বলদ

বলদ

প্রিতীর সাথে আমি ছোটবেলায় এক্কাদোক্কা খেলতাম। দুই ঝুঁটি বাঁধা প্রিতী খেলায় খুব পাকা না হলেও দুষ্টুমিতে খুব পাকা ছিলো। হেরে গেলেই কেঁদে কেটে নালিশ করতো। তার জন্য বাসায় মার ও গালি ছিলো আমার জন্য অবধারিত।

একদিন কি একটা নিয়ে খেলায় গণ্ডগোল লেগেছে। আমি আব্বার হাত ধরে বাজার থেকে ফিরছি। প্রিতী দৌড়ে এসে আমার হাতে কামড়ে ধরলো। আমি সইতে না পেরে। আমি ওর গালে খামছি দিলাম। খামচি দেয়ার অপরাধে আমি মার খেলাম। তখনো কাউকে বলিনি আমার হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে। হাতের ব্যাথা আর আম্মার মারের অপমানে আমার জ্বর এসে গেলো। এক সময় দুজনেই বড় হয়ে গেলাম। একই কলেজে একসাথে পড়ি। ফ্রক ছেড়ে প্রিতী কামিজ ধরলো, সাথে বাহারি ওড়না। চমৎকার লাগতো ওকে। প্রায়ই কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলি।

পৃথিবীর পুরানো নিয়ম অনুযায়ী মেয়েদের মুখ নাকি সব সময় চলে! প্রিতী ও নিয়মের বাইরে না নারী ঐতিহ্য বজায় রাখতে প্রিতী ননস্টপ কথা বলতো। ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নেবার জন্য বাদাম নয় আচার খেতো। আমি এর নাম দিয়েছি জাবর কাটা। আমরা প্রায়ই একসাথে বাসায় ফিরি। প্রিতী মাথা দুলাতে দুলাতে গল্প করতে করতে হাঁটে। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি। একদিন টিস্যুতে নাক চেপে হাঁচি দিতে দিতে প্রিতী বললো ” এই তোদের বাসায় গল্পের বই আছে না? ”

– আছে তো! তুই পড়বি? ” হুম মনে করে নিয়ে আসবি, আমি যে নাম বলে দেবো সেটাই। মাতবরি করতে পারবি না। ” আমি ভয়ে ভয়ে বলি যে বই চাইবি, সেটা যদি না থাকে।  থাকবে, আমি না থাকা বই চাইবো না। ”

একদিন ও চাইলো “ঝিন্দের বন্দী” আমি এনে দিলাম। দুইদিন পরে ফেরত দিলো। এরপরে “রবিনসন ক্রুশো” আমি সেটাও এনে দিলাম। একদিন চাইলো “মেম সাহেব” এই বইটা বাসায় থাকার কথা না। তবুও আনমনে শেলফ এর দিকে চেয়ে দেখি “মেম সাহেব” ছাতা মাথায় আমার দিকেই যেনো চেয়ে আছে। আমি বইটি তখনই প্রিতীদের বাসায় দিয়ে এলাম। প্রিতী যেনো তৈড়িই ছিলো। বইটা দেয়ার সময় আমার হাতে হাত লেগে গেলো প্রিতীর। ও চমকে তাকিয়ে বইটা নিয়ে দৌড়ে বাসায় চলে গেলো।

এইচএসসি পরীক্ষা শেষ। নানান জায়গায় পরীক্ষা দিচ্ছি। আমি প্রিতী দুজনেই। ও একদিন রাস্তায় আমাকে ডেকে মেম সাহেব বইটা ফিরিয়ে দিয়ে গেলো। বইটা থেকে প্রিতীর গায়ের গন্ধ আসছে। মিষ্টি নরম একটা গন্ধ। কি মনে করে আমি বইটা খুললাম। দেখি দুটো তাজা গোলাপের পাঁপড়ি। সাথে একটা চিরকুট, তাতে লেখা “একটা ছেলে মনের আঙিনাতে ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে। বন পাহাড়ির ঝরনা খুঁজে, একলা জলে ভেজে সেই ছেলে টা আমায় ছুঁয়ে ফেলে ।”

আমি সারারাত চিরকুট টা গালে চেপে ধরে রাখলাম। পরদিন ছিলো ঢাকা ভার্সিটির ফলাফল। আমি চান্স পেয়ে গেলাম। ভর্তি হলাম কাংখীত আঙিনায়। ক্লাস করি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই। চিরকুটের কথা আর ভুলি না। আমরা চার ব্যাচমেট সবসময় একসাথে থাকতাম। আমি, ইমন, আবির আর স্বর্ণা। স্বর্ণার প্রেমিক চিটাগাং ভার্সিটিতে, ওর তাই সব সময় মন খারাপ থাকে।

আমি ওকে দেখলেই সুর করে গাই। “চড়ুই পাখি বারোটা, ডিম পেরেছে তেরো’টা একটা ডিম নষ্ট, চড়ুই পাখির কষ্ট । বিবিএ শেষ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি অখণ্ড অবসর। রাতে ভাত খাচ্ছি। আম্মা এলেন বাবুন একটা কথা ছিলো। “বলেন আম্মা! ” আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাই। “প্রিতী অনেক বড় হয়েছে! ” আম্মা একটু কেশে বলেন। আমি কিছু বলিনা। “মেয়ে দেখতেও সুন্দর, এই বাড়ির বৌ হবার সব যোগ্যতাই ওর আছে। তুই কি বলিস?”

– আমি কি বলবো, তোমার যা মত, তুমি তাই করবে।

পরদিন প্রিতী কে দেখি রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে। আমায় দেখেই মাথায় ঘোমটা দিয়ে দিলো। অদ্ভুত এক লজ্জা এসে আমায় ঘিরে ধরলো। মাথা নিচু করে আমি বাসায় ফিরে এলাম। একদিন শুনি আম্মা প্রিতী কে আংটি পরিয়ে এসেছেন। এর মাঝে বিয়ের বাজার চলছে জোর কদমে। আমার রেজাল্ট হয়েছে। খুব ভালো করেছি আমি। সেদিন বাসায় বিয়ের শাড়ির কি রঙ হবে এই নিয়ে তর্ক হচ্ছিলো। ছোটভাই এসেছেন কুমিল্লা থেকে। ছোটভাই আমার দু’বছরের বড়। ভালো চাকরি পেয়েছেন। কুমিল্লায় ট্রেনিং চলছিলো। এখন একেবারে ঢাকায় পোষ্টিং।

এর সাতদিন পরে প্রিতী আমাদের বাড়ি বৌ হয়ে আসে। তবে আমার না ছোট ভাইয়ের। আমি এতো অবাক কখনোই হইনি। আমাদের বোন নেই প্রিতী কে যেনো আমি নিজের বোন ভাবি , আর কখনো ঝগড়া না করি। আম্মা আমাকে কড়া করে বলে দিয়েছেন। আমি মাথা নিচু করে সব শুনে যাই। এরপরে সংসারে খুব দ্রুত পরিবর্তন এলো। বড় দুই ভাই আলাদা হয়ে অন্য বাসায় চলে গেলো। আমি এমবিএ ভর্তি হলাম না। ইচ্ছে করে না। প্রায় রাতেই প্রিতী আর ছোট ভাইয়ের ঝগড়া শুনি। ছোট ভাই চাপা গলায় বলে।

– আমার নিজের ভাই কোথায় ফেলবো বলো?

– তাই বলে সারাজীবন ঘাড়ের উপরে নিয়ে রাখতে হবে? আম্মা আজকাল বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। আম্মার সব কাজ আমি নিজ হাতে করি। বিছানা থেকেই আম্মা চেঁচান “এই সংসারে তুই আর কতো বলদের খাটবি! কে তোর এই খাটনির দাম দেবে? ” আমি এক মনে আম্মার ভেজা কাপড় মেলতে থাকি। এমন সময়ে প্রিতী আসে। আমার হাতে দুটো পাঁচশ টাকার নোট আর বাজারের লিষ্ট ধরিয়ে দিতে । আমি প্রিতীর কামড় খাওয়া হাতটাই বাড়িয়ে দেই। কখনো চোখ তুলে ওর খামচি খাওয়া গাল টা দেখি না। ফাঁকা রাস্তায় আনমনে একলা হাঁটি আর ভাবি। আমি আসলেই আস্ত একটা “বলদ।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত