ক্যারিয়ার

ক্যারিয়ার

নিশা ভার্সিটিতে যাবার জন্য রেডি হচ্ছে এমন সময় মা বলে উঠলো “আজকে ভার্সিটিতে যেতে হবে না।সন্ধ্যায় তোকে দেখতে আসবে।দুপুরের পর তোর খালা আসবেন।তোকে বাসায় থাকতে বলেছেন”। ” মা আমি কিন্তু তোমাকে বলেছি আমি এখন বিয়ে করবো না।মাত্র থার্ড ইয়ারে পড়ি।পড়াশোনাটা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই মা।আমাকে প্লিয পড়াশোনাটা শেষ করতে দাও”।আর্তনাদ করে মাকে বললো নিশা।

“তোর বাবা মানবে না।সে ছেলেপক্ষকে কথা দিয়ে এসেছে।তারা জানিয়েছে তোকে বিয়ের পর পড়াশোনা করতে দিবে।তোর ছবি দেখে তারা খুব পছন্দ করেছে।তাছাড়া ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে।তাদের কোন চাহিদা নেই,শুধু তোকে ঘরের বউ বানাতে চায়।এমন ছেলে তোর বাবা কিছুতেই হাতছাড়া করবে না।তুই রাজি হয়ে যা মা”। বলে রান্নায় চলে গেলো রাজিয়া সুলতানা। আজ তার অনেক কাজ। মেয়েকে দেখতে এলে মায়ের যে কত কাজ পড়ে সেটা শুধু মায়েরাই জানে।যে কোন ভাবে তারা ছেলেপক্ষকে মুগ্ধ করতে চায়।

নিশা বিছানায় ঝিম মেরে বসে আছে।বিয়েতে রাজি না হয়ে উপায় নেই।বাবার কথার উপর তারা কেউ কথা বলতে পারবে না।বাবার মুখের উপর কিছু বলার সাহস তাদের দুবোনের কারও নেই।কত স্বপ্ন ছিলো তার,পড়াশোনাটা শেষ করে নিজে একটা চাকরি করবে।নিজের পরিবারের হাল ধরবে।বাবার ছেলের শখ ছিলো। কিন্তু তারা দুবোন।সে চেয়েছিলো ছেলে হয়ে বাবার পাশে থাকতে।বিয়ে হয়ে গেলে কি সেটা পারবে?

তার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই।প্রেম জিনিসটা থেকে সে বরাবরই নিজেকে দূরে রেখেছে।তার শুধু একটাই স্বপ্ন ছিলো, নিজের ক্যারিয়ার গড়ার।কিন্তু পরিবারের চাপে নিজের স্বপ্নগুলোকে কবর দিতে হচ্ছে। এসব ভেবে নিশার আজ বড্ড মন খারাপ হচ্ছে।ছোট খালার উপর খুব রাগ হচ্ছে।কেন তার এমন একটা সম্বন্ধ আনতে হবে? নিশার বুক ফেটে কান্না আসছে।

সন্ধ্যায় দেখতে এসে নিশার বিয়ে হয়ে গেলো। এক সপ্তাহ পর রিসিপশন। এই এক সপ্তাহ তার খুব ডিপ্রেশনে কাটলো।সে বিয়েটাতে খুশী হতে পারছিলো না।তার বর আবির খুব ভালো মানুষ। স্বামী হিসেবে অনেক ভালো। কিন্তু বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি।তাই তাদের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব ছিলো। বিয়ের পর সে যখন ভার্সিটিতে ক্লাশ করতে যেতে চাইলো তখন তার শাশুড়ি ব্যাপারটা কোন ভাবেই মেনে নিলো না।নিশা খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো তার অতি শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার বর ও চায়না সে আরও পড়াশোনা করুক।

“কিন্তু তোমারা বলেছিলে বিয়ের পর আমাকে পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে দিবে”।
” দেখো নিশা,বিয়ের আগে অনেক কথাই হয়।পরে সেগুলো সব মানা যায় না।তুমি এখন বাড়ির বউ।বাসায় থাকবে,সংসার করবে আর মা কে হেল্প করবে।আর আমার তো টাকা পয়সার অভাব হবে না যে তোমার চাকরি করা লাগবে “।

” কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিলো আমি নিজে কিছু করবো। অনেক কিছু করার প্ল্যান ছিলো আমার।অনেক স্বপ্ন ছিলো”।
“ছেলেমানুষী করোনা নিশা।যা বলছি শোনো।আমার অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে”। আবির চলে গেলো। নিশার খুব কান্না পাচ্ছে।এমনটা তো সে চায়নি।সে তো নিজের একটা ক্যারিয়ার করতে চেয়েছিলো।সেই চাওয়াটা কি খুব বেশি হয়ে গিয়েছিলো।

দেখতে দেখতে ইদ চলে এলো। নিশার বর আবির তাকে অনেক শপিং করে দিলো।নিজের মায়ের জন্য আড়ং থেকে শাড়ি ও বাবার জন্য পাঞ্জাবী কিনলো।কিন্তু একবারও বললো না,বাবা মা বা ছোট বোনটার জন্য কিছু নাও।নিশার খুবই ইচ্ছা করছিলো মা বাবা বোনের জন্য কিছু কিনতে।কিন্তু আবিরের কাছে সে চাইতে পারবে না।পরিবারের জন্য স্বামীর কাছে চাইতে তার বড় লজ্জা লাগছিলো।না থাক,সে চাইবে না।আবির নিজে থেকে না বললে সে কোনদিন ও চাইবে না।মরে গেলেও না। আবারও তাকে নিজে কিছু করতে না পারার কষ্টটা কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো। এইতো সেদিন মায়ের নাকফুলটা হাড়িয়ে গেলো। বাবা খুব ছোট্ট একটা নাকফুল মা কে বানিয়ে দিলেন।নিশার খুব মন চাইছিলো মা কে একটা ডায়মনন্ডের নাকফুল কিনে দিতে।মা সারাজীবন শুধু তাদেরই দিয়ে এসেছে।কোন দিন নিজের জন্য কিছু কিনেন নি।

কিন্তু ডায়মন্ডের একটা ভালো নাকফুল কিনতে বারো হাজার টাকা লাগবে।এত টাকা তার কাছে নেই।সে জন্য তাকে আবিরের কাছে চাইতে হবে।মার নাকফুল কেনার জন্য এত টাকা চাইলে আবিরের রিয়েকশনটা কি হবে নিশা বুঝতে পারছে না।যদি অন্য কিছু ভেবে বসে? যদি বলে “আমি কেন দিবো?বাবারই তো দায়িত্ব কিনে দেয়ার”। না না এ কথা সে সহ্য করতে পারবে না।তাছাড়া শাশুড়ি বা শশুড়বাড়ির কেউ জানতে পারলে আরও কথা শুনাবে।তারচেয়ে বরং থাক।

নিশা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মেয়ে হয়ে জন্মানোর অনেক গুলো যন্ত্রণার মধ্যে এটা একটা যন্ত্রণা যে,নিজের অনেক কষ্ট গুলো নিজের ভিতর একেবারে দাফন করে দিতে হয়।কাউকে বলে হালকা হবে সে উপায় নেই।কিছু কিছু ব্যাপার এমন থাকে যেগুলো কারও সাথে শেয়ার পর্যন্ত করা যায় না। আজকে যদি তার নিজের ইনকাম থাকতো তাহলে কি তাকে এত কিছু ভাবতে হতো?নিজের মা কে সে চাইলে ও দিতে পারছে না, এই কষ্টটা বুঝার ক্ষমতা কি কারো আছে?প্রত্যেকটা মেয়েরই নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করা দরকার।খুব দরকার।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন মাগরিবের সময় হয়ে গেছে নিশা টের পেলো না।তাড়াতাড়ি নামায শেষ করে রান্নাঘরে গেলো চা পাকোড়া বানাতে।শাশুড়ি নামায শেষ করেই চা পাকোড়া চাইবেন অরনী ঢাকা ভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্রী। তার স্বপ্ন সে কোন ভার্সিটির শিক্ষিকা হবে।পড়াশোনায় সে খুবই ভালো।ক্লাশ টপার। বিকেলে মা বাবার সাথে চা খেতে খেতে গল্প করছে।

” তোর ছোট চাচা তোর জন্য সম্বন্ধ এনেছিলো।আমি মানা করে দিয়েছি।বলেছি মেয়ে আমার পড়াশোনা শেষ করবে,চাকরিতে ঢুকবে তার পর বিয়ে দিবো।”অরনীর মা বললেন। “খুব ভালো করেছ মা।আমি এখন একদমই বিয়ে করবো না।আমি আগে নিজের ক্যারিয়ার গড়বো তারপর বিয়ের ভাবনা “। অরনীর জবাব। অরনীর পড়াশোনার ব্যাপারে তার মা তাকে খুব সাপোর্ট করে।বাবা আনিসুল হক বিয়ের ব্যাপারে দুয়েক বার কিছু বলতে গেলেও অরনীর মায়ের এক ধমকে সে চুপ হয়ে যায়।স্ত্রী কে বড় ভয় পায় সে। কিছুদিন পর অরনীর ছোটফুপু আসে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে।

” আরে খুব ভালো ছেলে বুঝলে।বিসিএস ক্যাডার।ঢাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাট গাড়ি সব আছে।তোমার মেয়ের কপাল বলতে হবে”। “কিন্তু আপা,ছেলের বয়স তো বেশী মনে হচ্ছে”। অরনীর মা ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে বললো।
” আরে পুরুষ মানুষের আবার বয়স আছে নাকি।তাছাড়া হিরার আংটি বাকাও ভালো”।

“এই ছেলে হিরার আংটি হলে আমার মেয়ে ও সোনার আংটি।ঢাকা ভার্সিটির একজন স্টুডেন্ট। তাছাড়া ওকে পড়াশোনা শেষ না করা পর্যন্ত বিয়ে দিবো না।” অরনীর মায়ের জবাব। অরনীর ফুপু কথা গুলো মানতে পারলো না।তার ধারনা মেয়েদের এত লেখাপড়া করা ঠিক না।কই তারা তো অত লেখাপড়া করে নাই।তাতে কি কোন ক্ষতি হইছে নাকি। অরনীর মায়ের উপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে তাদের বাসা থেকে বিদায় নিলো। অরনী তার মাকে নিয়ে খুব গর্ববোধ করে।যেখানে তার বন্ধবীদের মায়েরা থার্ড ইয়ার পার হতে না হতেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়,সেখানে মা তাকে এতো সাপোর্ট করছে ক্যারিয়ারের ব্যাপারে।দেখতে দেখতে অরনী অনার্স মাষ্টার্স শেষ করে।খুব ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হয় তাই ঢাকা ভার্সিটিতেই শিক্ষকতা করার সুযোগ পায়।সুন্দর একটা ক্যারিয়ার সে গড়তে সক্ষম হয়।তার নিজের একটা পরিচয় হয়।

এদিকে তার অন্য সব বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে বাচ্চা পর্যন্ত হয়ে গেছে।ফেসবুকে তাদের আপ্লোড করা ছবি গুলো দেখে সে নিজের বিয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এদিকে মা ও তার জন্য ছেলে খুঁজতে থাকে।কিন্তু ফ্যাকড়া বাধে এখানে যে,তার থেকে যোগ্য ছেলে পাওয়া যাচ্ছে না।যোগ্য যেসব ছেলেদের অরনীর মায়ের পছন্দ হয়,তারা অরনীর বয়স দেখে ভ্রূ কুঁচকায়।

নিজের থেকে বয়সে বড় কোন মেয়েকে তারা বিয়ে করতে চায় না।সবাই বিয়ের জন্য চায় অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে।
ত্রিশার্ধো অরনী আয়নায় নিজেকে দেখে।চেহারার সেই লাবন্যতা নষ্ট হয়ে গেছে।চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। এইতো সেদিন মুখে নানা প্রোডাক্ট মেখে, শাড়ী দিয়ে তলপেটের মেদ ঢাকার আপ্রান চেষ্টা করে ছেলেপক্ষের সামনে গিয়েছিলো। মুখের উপর বয়স বেশী বলে অরনীকে রিজেক্ট করে দিলো। অরনী ভেবে পেলো না, তার যোগ্যতা কোন কাজেই আসছে না বিয়ের ক্ষেত্রে। বিয়ের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য আর অল্প বয়সই যেন আসল বিষয়।

অরনীর চেয়ে বয়সে ছোট কাজিনদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।বিয়ের নিমন্ত্রণ আসে,কিন্তু কারো বিয়েতে সে যায় না।মানুষের সামনে গেলেই তারা কেমন যেন করুনার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।তার কেন বিয়ে হচ্ছে না জানতে চায় আর আহা উহু করে।ব্যাপারটা সে একদম ই সহ্য করতে পারে না। সেই পুতুল খেলার বয়স থেকে প্রতিটি মেয়ে স্বপ্ন দেখে তার নিজের সংসারের।নিজের সংসার ভেবে পুতুলের সংসারটা সাজায়।কল্পনায় সে স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করে।অরনীরও স্বপ্ন ছিলো, কিন্তু তার স্বপ্নটা কেন যেন পুরন হচ্ছে না।একজন নারী ততক্ষন পর্যন্ত পূর্ণতা পায় না যতক্ষন না সে কারো স্ত্রী কারো মা হয়। অরনীর রাতে ঘুম হয় না।সে বুঝে গিয়েছে তার অপ্রাপ্তি গুলো তার ক্যারিয়ার পুরন করতে পারবে না।

সকালে অরনী ক্লাসের জন্য বের হয়েছে।লিফটে উঠেছে এমন সময় দেখলো একজন মহিলা দুই হাতে দুই বাচ্চাকে নিয়ে লিফটের দিকে দৌড়ে আসছে।তাদের আসতে দেখে অরনী লিফটের বাটন টিপে ধরে রাখলো যাতে লিফট বন্ধ হয়ে না যায়। দুই বাচ্চাকে নিয়ে লিফটে ঢুকলো নিশা।এমনিতেই বাচ্চাদের স্কুলের দেরী হয়ে যাচ্ছিলো, তার উপর লিফটটা ধরতে না পারলে আরও দেরি হয়ে যেতো। “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আসলে বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি তো।এদের ঘুম থেকে তুলে রেডি করাতে করাতে জান শেষ হয়ে যায়।তার উপর ওদের বাবা,কোন দিন কিছু খুজে পায় না।আরে পরিচয় ই দিলাম না।আমি নিশা,এই বিল্ডিংয়ে নতুন এসেছি।চারতলার বামপাশের ফ্ল্যাটটা আমাদের”।

” আর ডান পাশের টা আমাদের।”অরনী হেসে জবাব দিলো।”আমি অরনী”।
“জব করেন নাকি আপনি।মানে এত সকাল সকাল বের হচ্ছেন তাই জিজ্ঞেস করলাম”। নিশার প্রশ্ন।
” জ্বি, আমি ঢাকা ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে আছি”।
“বাহ,খুব ভালো। বাসায় আসবেন একদিন”।
“আপনিও আসবেন”।

নিশার খুব কষ্ট হয় যখন সে দেখে কোন মেয়ে নিজে জব করছে।তখন নিজের না পারার কষ্টটা তাজা হয়ে উঠে। কিন্তু যখন সন্তানদের মুখের দিকে তাকায় তখন সব কষ্ট ভুলে যায়।

অরনী দেখলো তার বয়সী একজন মা তার সন্তানদের নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।নিশাকে তার কাছে একজন পরিপূর্ণ নারী মনে হচ্ছে।সার্থক একজন নারী। তার মনে হচ্ছে কেউ যদি তাকে ক্যারিয়ারের বিনিময়ে একটা সংসার,স্বামী আর সন্তান দিতো,সে অনায়াসে ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে দিতো। কি বিচিত্র এই দুনিয়া।কি অদ্ভুত এখানকার মানুষ। একজন যেটা পেয়েছে,অন্য জনের কাছে সেটা স্বপ্ন। সেসব মেয়েরা সত্যিই খুব ভাগ্যবতী যারা সংসার এবং ক্যারিয়ার দুইটিই করতে পেরেছেন। সত্যিই তারা ভাগ্যবতী!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত