তিন্নি হনন

তিন্নি হনন

তিন্নি আত্মহত্যা করেছে, এই খবর পেয়ে আমার কান্না করা উচিত ছিল। কিন্তু আমি কাঁদতে পারি নি। আমার মনে পড়ে গেল পুরনো কথা। তিন্নি প্রায়ই জানতে চাইত,’আমি চলে গেলে তুই কি করবি?’

‘কিছুই করব না।’
‘কান্না করবি না আমার কথা ভেবে?’
‘না।’
‘কেন?’
‘তুই অনেক আগেই খরচের খাতায় নাম তুলে ফেলেছিস। তোকে নিয়ে কান্না করে লাভ কি?’

তিন্নি রাগ করত না। আহত চোখে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। মনে মনে হয়ত ভাবত, আমি পাষাণ। কিন্তু তিন্নির ভাবনাটা সত্যি ছিল না। আমি ওর জন্যে অনেক কেঁদেছি। গোপনে অনেক চোখের জল ফেলেছি। তিন্নি ছিল একজন রূপ উপজীবিনী। দেহ ভাঙিয়ে টাকা ইনকাম করত। আশ্চর্য, আমার হাত কাঁপছে! লিখতে কষ্ট হচ্ছে। অথচ তিন্নি নিজেই বলেছিল, ‘আমি মারা গেলে তুই সুন্দর একটা গল্প পাবি। লেখকদের জীবনে নানা জাতের মানুষের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। আমি তোর জীবনে একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা!’

তিন্নির সাথে আমার পরিচয় কলেজে পড়ার সময়। আমরা একই সেকশনে ছিলাম। আমি লিখতাম কবিতা, তিন্নি করত অভিনয়। মঞ্চ নাটক করত। টিভিসিতে সাইড ক্যারেক্টার পেত। ইচ্ছে ছিল একদিন খুব বড় স্টার হবে। তিন্নির আগুনের মতো রূপ ছিল। কিন্তু বুদ্ধি ততটা পাকা ছিল না। কেউ সামান্য একটু প্রশংসা করলেই গলে যেত। মিডিয়া জগতে ব্রেইন ওয়াশ করার মত অনেক রকম থেরাপী আছে। সবচেয়ে কমন একটা থেরাপী হল,”সৌন্দর্যই শক্তি!” তিন্নিকে এই থেরাপী দিয়েই প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। প্রথম দিকে এই নিয়ে তিন্নির সাথে আমার খুব ঝগড়া হত। তিন্নি বলত,’সৌন্দর্যই শক্তি!’

আমি বলতাম,’ভুল চিন্তা।’ ‘তুই বিশ্বাস করিস না?’ ‘উহু।’ ‘চল তোকে প্রমাণ দিয়ে দেখাচ্ছি।’ ‘কিভাবে প্রমাণ দিবি?’ ‘আমরা দুজন একটা লোকাল বাসে উঠব। কন্ডাক্টর যখন ভাড়া নিতে আসে, বলব টাকা নেই। তুইও বলবি, আমিও বলব।’ ‘তাতে কি হবে?’ ‘কন্ডাক্টর তোকে একটা রাম ধমক দিবে। কিন্তু আমাকে ধমক দিবে না। বরং আমার দিকে তাকিয়ে মধুর করে হেসে বলবে, ভাড়া লাগব না আফা।’

তিন্নির কথা শোনে আমার খুব রাগ হত। করুণাও হত। করুণা হত, কারণ আমি ওদের পরিবারের ভেতরের খবরটা জানতাম। তিন্নির বাবা ছিলেন সামান্য একজন সিকিউরিটি গার্ড। অল্পই বেতন পেতেন। কিন্তু মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে হঠাৎ একদিন একটা এক্সিডেন্ট হল। বাবা পঙ্গু হয়ে গেলেন। ছোট ছোট তিনটা ভাই বোনকে নিয়ে তিন্নি পড়ল অথৈ জলে। এই সময় সে পড়ালেখা বাদ দিয়ে পুরাদমে মিডিয়ায় নেমে গেল। বোকা একটা মেয়েকে একেবারে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেল ওরা। ফলাফল যা কাম্য তাই হয়েছে।

কিন্তু এইসব হচ্ছে বাইরের খবর। এই জন্যে তিন্নি সুইসাইড করে নি। সে সুইসাইড করেছে অন্য করণে। মিডিয়া পাড়ায় দীর্ঘ দিন ঘুরাঘুরি করেও কিছুতেই সে ভালো রুল পাচ্ছিল না। উপরন্তু, বিভিন্ন ক্লাবে, ঘরোয়া পার্টিতে ডাক পড়ত দাদাবাবুদের আমোদ গতিশীল করতে। তিন্নিকে যেতে হত। না গেলে টাকা আসবে কোথা থেকে? টাকা না পেলে খাবে কি? ভাই বোনদের পড়ালেখা চলবে কীভাবে?

ততদিনে তিন্নি স্টার হবার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছে। কেবল একটা পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছে। না, হচ্ছে না। তিন্নিকে নিয়ে গল্প লিখার ক্ষমতা বিধাতা আমাকে দেয় নি। নিজের লিখা পড়ে নিজেরই হাসি পাচ্ছে। অথচ কি বিচিত্র খেলায়ই না নিয়তি এই মেয়েটাকে নিয়ে খেলল! তিন্নির ছোট বোন মায়া ইদানীং পড়ালেখা শেষ করে একটা ভালো জব করছে। সে তিন্নিকে খুব ঘৃণা করত। তিন্নিকে একদিন ‘বাজারে কুত্তি’ বলে গালি দিয়েছে।

তিন্নির ছোট ভাই আশিক কলেজে পড়ে। আশিকের বন্ধুরা ইন্টারনেট থেকে কিছু ক্লিপ্স নামায়। সেখানে একটা মেয়ে দেখতে নাকি হুবুহু তিন্নির মতো। আড়ালে আশিকের বন্ধুরা এই নিয়ে হাসাহাসি করে। পরশুদিন তিন্নি এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। ‘চলে যাচ্ছি নূর, ভালো থাকিস। এই জীবনে আর হয়ত দেখা হবে না। যদি অন্য একটা জীবন থাকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব, যেন সেই জীবনেও তোর মত একটা বন্ধু পাই।’

আমি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, ‘কোথায় যাবি?’ তিন্নি কোন জবাব দেয় নি। কাতর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। আমি চাইলেই তিন্নিকে ফেরাতে পারতাম। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে পারতাম। কিন্তু আমার ইচ্ছে হয় নি। কেন ইচ্ছে হয় নি, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটা জীবন কেটে যাবে। কিছু কিছু মানুষের জীবন বড় বেশি আনন্দময়। কিছু কিছু মানুষে জীবন বড় কষ্টের ও গ্লানিময়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত