“আমি মা হতে চাই।”কথাটা শোনামাত্র রায়হান চমকে তাকায় সোহানার দিকে।খুব মনে পড়ে রায়হানের,তাদের একমাত্র ছেলে রিহানের মৃত্যুর পর সোহানা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলো।এমনিতেও রিহানের জন্মের কিছুদিন পর জরায়ু ক্যান্সারের কারণে ওর জরায়ুটা অপারেশন করে ফেলে দেয়া হয়।যার ফলে আর মা হওয়া তারপক্ষে সম্ভব নয়। রিহান’ই ছিল সোহানার সবকিছু।ছেলেটাও ছিল মা ভক্ত।মা ছাড়া কিচ্ছু বুঝতোনা।অফিস থেকে ফিরে রায়হান মা-ছেলের নানারকম পাগলামো দেখে হাসতো শুধু।রিহান ওর মাকে ডেকে বলতো,”আম্মু..আম্মু..ভালোবাসি
-“কতোগুলা বাবা?”সোহানাও জিগ্যেস করতো।
-“এই..এত্তোগুলা “দুই হাত দু দিকে নিয়ে দেখাতো আর ওমনিই রায়হান ডেকে বলতো,”আর আমাকে বুঝি ভালোবাসোনা রিহান “এটা বলে রায়হান ও মন খারাপের ভান করতো।
রিহানের কানে কানে সোহানা বলতো,”দেখো,দেখো,আব্বু তো মন খারাপ করেছে,এবার কি হবে?” রিহান দৌড়ে ওর বাবার কাছে এসে বলতো,”বাবা..বাবা..ভালোবাসি..” রায়হান তখন আরেকটু মন খারাপের ভান করে বলতো,”কতোগুলা? “বলার সাথে সাথে রিহান গুনতে শুরু করে দিতো।ঠিক তখনি রায়হান ছেলেকে জড়িয়ে ধরতো।সোহানা এসে বলতো,”আরে..আরে..আমি বাদ গেলাম যে।”রায়হান তখন দুজনকেই জড়িয়ে ধরতো।আজ সেসব মনে করে রায়হানের বাম পাশটা কেমন চিনচিন ব্যথা করতে লাগলো!এই তো কিছুদিন আগেও রিহান সারা ঘর দৌড়াতো, চোর-পুলিশ খেলা,..আরো কতো কি!রিহানের ঘরভর্তি খেলনা।এখনো সোহানা খেলনার গাড়ি,বিমান এসব কিনে রাখে রুমে।ঐ রুমটায় সোহানা কাউকেই ঢুকতে দেয়না।এমনকি রায়হানকেও না।
কি হয়েছিলো সেদিন?প্লে ‘তে ভর্তি করেছিলো দুজন মিলে। সবসময় সোহানাই রিহানকে স্কুলে নিয়ে আসা-যাওয়া করতো।কিন্তু সেদিন সকালে সোহানার মাইগ্রেনের ব্যথা থাকায় রায়হান নিয়ে যায় স্কুলে।সেখানে হঠাৎ করেই রায়হানের এক কলেজ বন্ধুর সাথে দেখা।আর কি?গল্পগুজব.. এরপর চা খেতে চায়ের স্টলে যায়।স্কুলও ছুটি হয়।তারপর!!
-ডাক্তার আমার ছেলেকে বাঁচান প্লিজ..ও ছাড়া..
-Mr. Rayhan please calm down..we try to our best efforts to recover your son…
-”আমার ছেলেকে প্লিজ বাঁচান,নতুবা আমি..”রায়হান এর কান্না দেখে আশে-পাশের সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়।
সোহানা আসে।মৃত ছেলের লাশ দেখে হঠাৎ একটা চিৎকার দেয় শুধু।এরপর!!একেব ারে চুপ হয়ে যায় সোহানা।ওকে কাঁদতে বললেও কাঁদেনা,হাসি তো অনেক আগেই মরে গেছে।ওর ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাস..সবকিছু ছেলের মৃত্যুর সাথে সাথে হারিয়ে গেছে। রায়হানকে সোহানা কিছু বলেনি।কিন্তু রায়হান বারবার নিজেকে দোষী ভেবে ধিক্কার দিতে থাকে।
“কেন আমি চা খেতে গেলাম?কেন খেয়াল করলামনা, স্কুল ছুটি হয়েছে!কেন ছিলামনা গেটের পাশে দাঁড়িয়ে?যদি থাকতাম,তবে কি আমার ছেলে আমাকে খুঁজতে একা একা রাস্তা পার হতে যেতো!যদি আমি সেখানে থাকতাম,তবে তো আমার ছেলে গাড়ির নিচে পড়তোনা কেন হলো এমন!!”রায়হান এসব ভেবে নিজেকে আর সামাল দিতে পারেনা। বিষাদ আর তিক্ততায় ওর মন ভরে যায়।চোখে হাজারো জলকণা গড়িয়ে পড়ে,তবে সেটা সবার অগোচরে।
যে ঘরটা একটা সময় আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত,সে ঘরে আজ কবরের মতো নিস্তব্ধতা। রোজ রায়হান অফিসে যায়,চুপচাপ খেয়ে উঠে।কিন্তু তবুও একরাশ দুঃখ চারপাশের পরিবেশটাকে সবসময়ই ভার করে রাখে!
এরপর অনেকদিন যায়।এমনকি রায়হান সোহানাকে বাচ্চা দত্তক নেয়ার কথাও বলেছিল।সোহানা সেদিন অনেক কথা শুনিয়েছিল রায়হানকে।
-“লজ্জা করেনা?রিহান থাকতেও তুমি আরেকটা বাচ্চা দত্তক নিতে বলো!!”রায়হান আর কিছু বলতে পারেনি সোহানাকে। “থাক নিজের মতো করে।” আর আজ কি শুনছে রায়হান! “কি হলো!! চুপ করে আছো কেন?আমি মা হতে চাই রায়হান।”সোহানা রায়হানের হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়,মিনতি ঝরে পড়ে তার কথায়,”আমি আবার সেই আগের মতোন “মা”ডাকটা শুনতে চাই।দেখো ওনার কোলে আমাদের রিহান,কেমন শুকিয়ে আছে মুখটা..”রায়হান তাকিয়ে দেখে সত্যিই একজন বৃদ্ধার কোলে ৩-৪বছরের একটা বাচ্চা ছেলে,এতোক্ষণ সে খেয়াল করেনি।চেহারাটা এতো মায়াবী.. দেখলেই আদর করতে মন চাইবে যে কারো।আর সোহানা তো..এই জন্যই বুঝি সোহানা ওকে ফোন দিয়ে অফিস থেকে আজিমপুর কবরস্থানে আসতে বলেছে! অবাকই হয়েছিল সে।সোহানা বাসায় না বলে আজিমপুরে মায়ের মন বলে কথা।
-“কি হলো?কথা বলছোনা কেন?রায়হান আমি সত্যিই আবার মা হতে চাই।”এই বলে মহিলার কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে সোহানা নিজের কোলে নিয়ে আবারো বলতে থাকে,”দেখো,ও আমার রিহানের মতো দেখতে।ও যে আমার রিহান।জানো?ওর বাবা-মা দুজনই কিছুদিন আগে মারা গেছে।যেভাবে আমাদের রিহানকে কেড়ে নিয়েছে কার এক্সিডেন্ট,ঠিক সেভাবেই.. “এই বলে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদতে থাকে সোহানা।” রায়হান সোহানা আর বাচ্চাটাকে দেখে,আরেকবার তাকায় দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধার দিকে।দীর্ঘশ্বাসটা চাপা দিয়ে এবার বলে,”সোহানা প্লিজ কেঁদোনা,ছেলেটাকে দিয়ে দাও,দেখো ওনি দাঁড়িয়ে আছেন !”
-দিয়ে দিবো মানে!!প্লিজ,রায়হান।
তুমি ওর মুখ থেকে ‘বাবা’শুনতে না চাও,অন্তত আমাকে “মা” শোনা থেকে বঞ্চিত করোনা।” রায়হান এবার কথা বলে বৃদ্ধার সাথে।জানতে পারে,ছেলেটার নাম “শান্ত”।যদিও ওনি দিয়েছেন সেটা। “কিছুদিন আগে যশোর যাবো বলে যে বাসে উঠি,সেই বাসে ছেলেটাসহ ওর বাবা-মাও উঠে। সেদিন বাসে ছেলেটা আমাকে “নানু” বলে সম্বোধন করেছিল এবং আমার কোলে বসেছিল।নানুর মতোই দেখতে ছিলাম কিনা..হঠাৎ বাসটা ১টা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে।দেখি সামনে কিছু একটা..তারপর জ্ঞান যখন ফিরে,দেখি হাসাপাতালে আছি।ছেলেটা “মা, মা” বলে কান্না করছিল।ওর হাতে পায়ে,মাথার রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ। খুবই খারাপ অবস্থা।আমাকে দেখে ঐ অবস্থাতেই”নানু” বলে ডেকে উঠে।যার কারণে রেখে আসতে পারিনি।তারপর থেকে”মহিলা আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন।
“আমি আর কয়দিন বাঁচবো বাবা?কিন্তু ছেলেটার যে কি হবে..”রায়হানের চোখ ভিজে আসে।সোহানা তখনো শান্ত নামের ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে আছে।রায়হান বলে,”আমার স্ত্রীকে দেখছেন!ওর এই উচ্ছ্বাস একদিন হারিয়ে গিয়েছিল।শান্তকে দেখে আজ আবার সেই উচ্ছ্বাস, মমতাময়ী মায়ের মন আবার ফিরে এসেছে ।জানেন?আমাদের ও একটা ছেলে ছিলো,বছর দুয়েক আগে ওকে আমাদের দিয়ে দিননা”আকুতি ঝরে পড়ে রায়হানের গলা দিয়ে।সে ও বুঝি কেঁদে ফেলবে।আজ যেভাবেই হোক,বাচ্চাটাকে চাই।কতোদিন পর সোহানার সুখি সুখি চেহারা দেখছে।আর বাচ্চাটা!হুবহু রিহানের মতো!আবার বুঝি ‘বাবা’ ডাক শুনতে পাবে সে। আর সোহানা “মা”!কিন্তু ভদ্রমহিলা চুপ।
-প্লিজ,আন্টি,আপনি আমার মায়ের বয়সী।সন্তানের এই অনুরোধটুকু ফিরিয়ে দিবেননা প্লিজ। কিছু ভাবলেন বৃদ্ধা। তারপর বললেন,”ঠিক আছে বাবা।এমনিতেও সংসারে এই বাচ্চাটা নিয়ে গিয়ে ছেলের বউয়ের কম কথা শুনতে হয়নি।নিয়ে যাও বাবা..”এরপর তিনি বাচ্চাটার মাথায় হাত রেখে কপালে চুমো খেলেন।তারপর সোহানাকে বলেন,”ছেলেটা অনেকদিন মায়ের আদর পায়না।তুমি তাকে মায়ের পূর্ণ আদর দিয়ো মা।”এই বলে চলে গেলেন ভদ্রমহিলা। সোহানা কৃতজ্ঞ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
-কি হলো?তাকিয়ে দেখছো কি?চলো,আমাদের ছেলেকে নিয়ে এবার ঘরে ফিরি।
-আমাদের ছেলে,তাইনা?
-হ্যাঁ, ও আমাদের ছেলে।
রায়হান বাচ্চাটা এবার নিজের কোলে নেয়।”কিরে?তুই তো আমাদের ই ছেলে।” কপালে চুমো খেয়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে রায়হান।লক্ষ্মী ছেলের মতো বাচ্চাটাও কাঁধে মাথা রাখে।সোহানা রায়হানকে বলে,”দেখো,আমাদের ঘর আবার আগের মতো হয়ে যাবে।” রায়হান সোহানার হাতে একটা আলতো চাপ দিয়ে বলে, “অবশ্যই সোহানা।এবার তবে চলো,শান্তকে নিয়ে বাসায় যাই..”
-“শান্ত!শান্ত কে?ওর নাম রিহান।খবরদার ওকে তুমি “শান্ত”বলবেনা।”সোহানা রেগে গিয়ে রায়হানের কোল থেকে ছুঁ মেরে ওকে নিজের কোলে নেয়। “স্যরি সোহানা,ও আমাদের রিহান’ই তো।এমনি বলেছি,দেখতে কতোটা রেগে যাও।রাগলে যা লাগে.. ”
-চুপ করো।চলো..!
২দিন পর-
-কি হলো?মন খারাপ করে বসে আছো যে?
-দেখোনা,রিহান আমাকে এখনো ‘মা’ বলে -দেখোনা,রিহান আমাকে এখনো ‘মা’ বলে ডাকছেনা।
-তাই!দাঁড়াও দেখছি,রিহান বা বা,মামনিকে নাকি “মা”ডাকোনা দেখ ো তো “মা ” কতো কষ্ট পাচ্ছে রিহান আঙুল খাচ্ছে চুপচাপ।
-দেখলে,রিহান আমাকে মা ডাকেনা।সোহানা কাঁদতে থাকে।হঠাৎ রিহানও কাঁদতে থাকে।কাঁদতে কাঁদতে এবার সে “মা” ডেকে উঠে।সোহানা আর রায়হান দুজনেই তাকায় রিহানের দিকে।সোহানা দৌড়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।”কাঁদিস না বাবা,মা তোর সাথে রাগ করেনিতো রিহানও এবার মাকে ছোট্ট হাত দিয়ে “মা” বলে কাঁদতে থাকে।সোহানা রিহানের চোখে মুখে চুমো দিতে থাকে।
“আমার ছেলে। আরো ডাক বাবা..কতোদিন মা ডাক শুনিনা “রিহানও ‘মা’ বলে ডাকতে থাকে!ঠিক সেই আগের মতো রায়হান শার্টের উল্টো হাতা দিয়ে চোখ মুছে সেখান থেকে সরে যায়।মা-ছেলের এমন সুখের মুহূর্ত সে নষ্ট করতে চায়না।রায়হান শুনতে পাচ্ছে তখনো সোহানা রিহানকে বলছে,”আরো ‘মা’ বলে ডাক বাবা,যতো পারিস।আজ আমার শূন্য বুক পূর্ণ করলি তুই।মা বলে ডাক।”রিহানও ”মা” বলে ডেকে যাচ্ছে। মা-ছেলের ভালোবাসাটা এতোই গভীর আর আত্মার সম্পর্ক যে, পৃথিবীর কোনো সম্পর্কই সে সম্পর্কের অর্ধেকটাও ছুঁতে পারেনা!!