বিশ্বাস অবিশ্বাস

বিশ্বাস অবিশ্বাস

আমি যার প্রেমে পড়েছিলাম জানতামও না সে একজন নাস্তিক! ময়মনসিংহ হতে ঢাকায় এসে কলেজে প্রবেশ করলাম।সওদা তাসনিম।আমাদের কলেজের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।তাকে দেখলে মনে হয় যেন একটা জ্যোতিষ্ক।তার গায়ের রঙ যেন সাদা নয়,যেন একটা আভা।আমি তার চোখগুলো দেখেই তার প্রেমে পড়েছিলাম।কথায় আছে,”তুমি যার চোখ পছন্দ করবে,মনে করবে যেন তুমি তার আত্মাকেই দেখে নিয়েছ।”আমিও সওদা তাসনিমের বিশুদ্ধ আত্মা দেখে নিয়েছিলাম।

যে মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু তাকে নিয়ে তো আলোচনা হবেই।আমি আমার বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে জানতে পারলাম সওদা নাস্তিক।আমি এর ঘোর প্রতিবাদ জানালাম।তেজের সঙ্গে বলে দিলাম,”আমি এর এক সিকি পয়সা বিশ্বাস করি না।”সবাইকে আমি এটাও বলে দিলাম আমি এর সত্যতা প্রমাণ করে ছাড়বই।

সেদিন বিকেল বেলা ছিলো।সওদা কলেজ প্রাঙ্গণে গাছতলার নিচে একা একা বসে ছিল।সে একটা বই পড়ছিল খুব মনোযোগ সহকারে।সেই অবস্থায় আমি বিনা পরিচয়ে তার কাছে অবোল তবোল কী যে বললাম তার ঠিক নেই।সওদা বই বন্ধ করে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল।তার চোখ যারা দেখেনি তারা বুঝবে না এই দৃষ্টি যে কী।আমি শুরুতেই বলে উঠলাম, “এরা যে বলে আপনি নাস্তিক সেটা কী সত্য?” সওদা বলল,”হুম সত্য!আমি নাস্তিক।” আমার মাথা নিচু হয়ে গেল।আমি বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করেছিলাম যে সওদা কখনোই নাস্তিক হতে পারে না।

সওদা নাস্তিক।আর আমি এদিকে খাটি মুসলমান।এই প্রেম কখনোই বাস্তব হবে না এই ভেবে আমি পাশ কেটে চলে এলাম।আমি তাকে হঠাৎ করে এতকিছু জিজ্ঞেস করলাম সে একবারও জানতে চাইল না আমি কে?আমার নাম কি?শুধুমাত্র উত্তর দিয়ে গেল।আমি বুঝতে পারলাম আমি সওদাকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারব না সৃষ্টিকর্তা আছেন এবং আমি কখনো বোঝাতেও চাই না।সওদার প্রেমের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই হয়তো। প্রায় একমাস আমি সওদার চোখের সামনে আসিনি।তার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি।দূরে থাকলে হয় কি আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে পারবো না।তাকে একটু ভুলে থাকতে পারব।

আজ আমাদের আইসিটি ক্লাস ছেলে-মেয়ে একসাথে নেওয়া হচ্ছে।আমি ছাত্র হিসেবে মোটামুটি। তাই মাঝের বেঞ্চে সবসময় বসি।আসলে স্যাররা পিছনের আর সামনের ছাত্রদের প্রশ্ন করেন বেশি।মাঝের সারির কাউকে প্রশ্ন ধরেনই না।দীর্ঘ একমাস পর আমি সওদাকে দেখলাম।বেণী করাতে তার বয়স অনেক কমে গিয়েছে।রূপ লাবণ্য আরোও সুন্দর করে ফুটে ওঠেছে।সওদা ঠিক আমার সামনের বেঞ্চে বসে।এই প্রথম সে আমার এত কাছে এসেছে।আমার মাথা একদম কাজ করছিল না।কিন্তু তৎক্ষণাৎ স্যার আমাকেই দাড় করালেন এবং আমার কাছেই একটা প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন।আমার মাথা এমনিতেই কাজ করছিল না তাই আমি উত্তরটা পারছিলাম না।কিন্তু আমার মুখ দিয়ে ভুলবশত “সওদা” নামটা বের হয়ে গেল।সারা ক্লাস হাসাহাসি করল।সওদা আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে আমারে দেখছিল।সেবারই প্রথম।তার চোখগুলোর আকর্ষণে আমি তার দিকে তাকাতেই পারছিলাম না।

লজ্জায় আমার মাথা হ্যাট হয়ে গিয়েছিল।আমি ক্যান্টিনের টেবিলে বসে একা একা নাস্তা করছিলাম।এখন আমি ঠিক করলাম আমি আর সওদার সামনেই যাব না কোনোদিন।আমার মতো করে চলব।কিন্তু যা চাই তা পাইনা যা পাই তা চাইনা এরকম একটা অবস্থা হয়ে দাড়াল।সওদা ক্যান্টিনে এলো।খাবার অর্ডার করল এবং খাবার নিয়ে আমার দিকেই আসলো।আমার মুখোমুখি সামনের চেয়ারে বসল।অথচ ক্যান্টিনের সব টেবিল ফাকা।আমি মনে মনে ভাবলাম এইবার আমাকে খেয়েছে।আজ আমার ওসুল উঠাবে।সে কতক্ষণ বসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।তারপর একটা সুন্দর হাসি দিল।সওদা তাসনিমের হাসি তার থেকেও সুন্দর।এবার আমি তার দিকে তাকানোর সুযোগ পেলাম। সওদা তাসনিম আমাকে বলল,”তোমার নাম?” আমি গড়গড় করে বলে দিলাম,”সাদমান সাকিব নীল।” সওদা আরেকবার হাসি দিল,

-আমাকে ভয় পাও?
-আপনাকে আমি ভয় পাব কেন?আমি ভূত বাদে আর কাউকে ভয় পাই না।
-তুমিতো সাহসী ছেলে।ভূত তোমার কী করল?
-আসলে আমি যাকে অবিশ্বাস করি তাকে বেশি ভয় পাই।আমি ভূতে অবিশ্বাসী। তাই ভূত আমাকে ভয় পাওয়ায়।
-তোমার কথায় যুক্তি আছে।আমি তোমাকে তুমি করে বলছি আর তুমি আমাকে আপনি করে বলছ তুমি কি আমার থেকে ছোট?
-না আমি যাদের চিনি না তাদের আপনি করে বলি।
-তুমি তো আমাকে চিনো।আমার নামও জানো।
-হ্যা জানি

-আজ থেকে আমাকে তুমি করে বলবে।
-আপনার নাম “তুমি?”
-হাহাহা!কফি খাবে?
-না আমি চায়ে বিশ্বাসী।
-যেমন?
-আপনি টংয়ে গেলেই চা পাবেন কিন্তু কফি পাবেন না।আমি স্বল্প খরচে বেশি উপভোগ করি।
-আমাদের ক্যান্টিনে কি চা নেই?
-আছে তো।
-চলো তাহলে চা পান করি।
-অবশ্যই।

চায়ের চুমুকে আমাদের আড্ডাটা অনেক জমে গেল।প্রিয় মানুষদের সাথে স্বভাবতই কথা শেষ করতে ইচ্ছে করে না।কিন্তু ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় সওদা তাসনিম আমার কাছ থেকে বিদায় নিল। সেইতো শুরু প্রতিদিন সওদা তাসনিম আমার সাথে ক্যান্টিনে নাস্তা করত।তার সাথে আমার প্রায় ১৭ দিন টানা কথা হচ্ছে।আমি আবার তারিখ সংরক্ষণ ভালো করতে পারি।এসব মনে রাখায় আমি পটু। একদিন সওদা আমাকে জিজ্ঞেস করে বসল,

-তুমি কি জানোনা আমি যে নাস্তিক?
-তুমি মনে হয় ভুলে গেছ যে আমার সাথে তোমার কথাই শুরু হয়েছিল কলেজ প্রাঙ্গণে এই বিষয়ে।
-না জানি।তুমি একবারো আমায় জিজ্ঞেস করোনি আমি কেন নাস্তিক।
-মানুষের একান্ত নিজস্ব ব্যাপারে জানার জন্য আমার কোনো আগ্রহ নেই।
-না এই কলেজে আমার সাথে যে-ই কথা বলে একবার না একবার জিজ্ঞেস করেছেই তুমি কেন নাস্তিক?তারপর আমাকে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করবে।এটা যেনো তাদের একটা অভ্যাস।ধর্ম সম্পর্কে জানে কম জ্ঞান দিতে আসে বেশি।

-আচ্ছা আচ্ছা।
-তোমার এই জিনিসটা আমার খুব পছন্দের।কোনো তর্ক যুদ্ধ করো না যাই বলি তাই মেনে নাও।তোমার নাম্বারটা দাও আজ তোমার সাথে কথা বলবো ফোনে।

আমি নাম্বার দিয়ে দিলাম।আমি বুঝতে পেরেছি সওদা আমাকেও তার সম্প্রদায়ে ঢুকাতে চাইছে। সেদিন রাতেই আমাকে ফোন দিল।শুরুতেই তার সাথে আমার অনেক খেজুরে আলাপ হলো।তারপর সে আমাকে নানা সৃষ্টির বর্ণনা দিয়ে তার ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল। আমি অন্ধকারে যেই ঢিল ছুড়েছিলাম তা ঠিকই হয়েছে।সে আমাকে অনেক বোঝাতে লাগল যে এই দুনিয়ার সবকিছু প্রকৃতির সৃষ্টি। তারপর সে সেগুলোর বৈজ্ঞানির ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল।যখন সে বুঝতে পারল আমি তার কথা কানে নিচ্ছিনা,

-কী হলো সাদমান শুনছো?
-হ্যা আমি তোমার প্রতিটা অক্ষর,শব্দ শুনছি তবে তা উপলব্ধি করছি না।তোমার কথা বলার ধরণ অনেক সুন্দর।
-ধন্যবাদ সাদমান।ডিনার কমপ্লিট?
-হ্যা। তোমার?
-আমারো।

সওদার সাথে আমি টানা একঘন্টা কথা বললাম। আজ কলেজ ক্যান্টিন পুরো ফাকা।কলেজে খুব একটা বেশি মানুষের আনাগোনা নেই।অনেকক্ষণ বসে থেকে ওঠে চলে আসার প্রস্তুতি নিতেই সওদার প্রবেশ।আজ তাকে খুব সুন্দরি লাগছে।তার কপালে শোভা পাচ্ছিল একটি সুন্দর কালো কুচকুচে টিপ।এই ছোট সামান্য একটি টিপ মেয়েদের খুব সুন্দর করে দেয়।আমি দ্বিতীয়বারের মতো সওদার প্রেমে পরে গেলাম।সওদা আমার কাছে একটা প্রস্তাব করল,

-চলো আজ হাফ ক্লাস করি!
-করা যেতে পারে।
-আজ তুমি আমার বাসায় যাবে আমার সাথে।
-তাতেও কোনো আপত্তি নেই।

সওদার বাসা খুব বড়। তার রুমটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।একপাশে তার টেবিল সেখানে ডেক্সটপ রাখা।সে আমাকে তার লেখা ব্লগগুলো দেখাচ্ছিল।তার লেখার ধরণও তার মতোই সুন্দর।কিন্তু প্রতিটা লেখাই নাস্তিকতা নিয়ে তাই পড়তে ভালো লাগছিলো না।তাও কষ্ট করে চালিয়ে নিলাম।তার টেবিলটাও ছিল অনেক সুন্দর।আলমারিটা ছিল তিন পার্টের। সে আমাকে আলমারি খুলে তার ছোটবেলার ছবি দেখাছে।আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-তোমার আম্মু আব্বু কোথাই?
-নেই।
-সরি।
-তোমার সৃষ্টিকর্তা আমার মা-বাবাকে নিয়ে গেছেন।

সওদার প্রতি আমার মায়া খুবই বেড়ে গেল।তখন আমি ভাবলাম সওদাকে আমার মনে কথা জানিয়ে দেই।আবার ভাবলাম এখন বললে সে খারাপ ভাববে আমায়।

-সওদা তাসনিম
-বলো
-কাল তো শুক্রবার।
-হুম
-দেখা করতে পারবে?
-কখন?
-জুমঅার নামাজের পর?
-ঠিক আছে আমি কলেজের গেটে থাকব তুমি সেখান থেকে আমাকে নিয়ে যেয়ো।
-অবশ্যই।

আজ আমার সকালটা খুব ভালো কাটবে মনে হচ্ছে।ভালো কোনো উদ্দেশ্য থাকলে সেদিন খুবই ভালো কাটে।সকাল সকাল উঠেই আমি শেভ করে নিলাম।সওদা আমাকে একদিন বলেছিল আমাকে ক্লিন শেভে অনেক সুন্দর লাগে।নাস্তা করার পূর্বে আমি এক গ্লাস গরম পানি এক চামচ মধুর সাথে মিশিয়ে খাই।তাতে আমার শরীরটা আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠে।আজ মা বাসায় নেউ।তাই নাস্তা আমারই বানাতে হয়েছে।ডিমের ওমলেট আর দুটো রুটি খেয়ে নিলাম।মোটামুটি ভালো একটা নাস্তা হয়েছে।ঘড়িতে দেখলাম দশটা বেজে গেছে।আমি আটটা চল্লিশে সাধারণত পত্রিকা পড়ি।আজ একটু দেরি হয়ে গেল।বাসায় আমি বাদে কেউ পত্রিকা পড়েনা বলে পত্রিকা দড়জার বাইরের শ্যু রেকে পড়ে ছিল।

পত্রিকা নিয়ে আমার খাটে আরাম আয়েশ করে বসলাম।আজ পত্রিকার টপ হেডলাইন ধর্ষণ নিয়ে।বেশিরভাগ সময়ই থাকে।পড়ার ইচ্ছে ছিলো না তাই পাতা উল্টানোর সময় সওদার ছবি চোখে ভাসল।এই নিয়ে ১২ বার।আজ অনেকবার তার কথা মনে পড়ছে।আমি আবার প্রথম পাতায় ফিরে এলাম।এবার আসলে সওদার ছবি আমার চোখে ভাসেনি পত্রিকায় ছেপেছে।আমার সওদা তাসনিম ধর্ষণের পর খুন হয়েছে।তার ছবির নিচে খুব বড় করে লেখা,”সওদা তাসনিম একজন ব্লগার।নাস্তিকতার জের ধরেই তারে হত্যা করা হয়েছে।”

আর পত্রিকা পড়লাম না।গোসল করতে চলে গেলাম।আজানের আগেই আজ আমি মসজিদে উপস্থিত। জিকিরের ফাকে ফাকে আমার চোখে সওদার চেহারাখানি ভাসছিল।আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি তাকে আমার চোখের সামনে না আনতে।তারপরও সে বিনা অনুমতিতে আমার চোখের সামনে কড়া নাড়ছিল।

নামাজ শেষে কলেজ প্রাঙ্গণে গেলাম।আবাহাওয়া আজ অনেকটা ভিন্ন।কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে কলেজের ক্যান্টিনে ঢুকলাম।সেই টেবিলের চেয়ারে বসলাম যেখানে সওদা তাসনিম বসত আমার সাথে।আমার সাথে তার শেষ কথা হয়েছিল তার বাসায়।কানে একটাই বাক্য শুধু আসছিলো,”আমার মা-বাবাকে তোমার সৃষ্টিকর্তা নিয়ে গিয়েছে।” আমার সেই সৃষ্টিকর্তাই আজ সওদা তাসনিমকেও নিয়ে গেলো।এইতো হয়ে গেলো বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের পরিসমাপ্তি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত