১৯৫৪ সাল, “ওই বাহারি ঘুম থেইকা ওঠ।ছেড়ি দেখ আইজ তোর বিয়া লাগছে”। বড় ফুফুর চিৎকারে চেঁচামেচি শুনে বাহারির ঘুম ভেংগে গেলো।সে হতভম্ব হয়ে লক্ষ্য করলো বাড়িতে সত্যিই বিয়ের আয়োজন চলছে। বাহারির ভালো নাম বাহারুন নেছা।কিন্তু সবাই ছোট করে বাহারিই ডাকে।এত রুপের বাহার যে তার নাম টা একেবারেই মানানসই হয়ে গেছে।এইতো এই বসন্তে দশ ছেড়ে এগারোয় পা রাখলো। এগারো বছরের বাহারি ঠিক বুঝতে পারছিলো না সে তার বিয়ের জন্য আনন্দিত হবে নাকি দুঃখিত হবে।তার বান্ধুবি আছিয়ার বিয়েতে সবাই খুব আনন্দ করেছে।ভালো ভালো খাবার খাওয়া গেছে।
কিন্তু বিয়ের পরেই আছিয়া তার স্বামীর বাড়ি চলে গেছে। বাপের বাড়ি নাইওরে এলে আছিয়া তাকে জানিয়েছে বিয়ের রাতে তার স্বামী তাকে ব্যাথা দিয়েছে।ছোট্ট বাহারির মাথায় এটা কিছুতেই বুঝে আসেনি আছিয়ার স্বামী কেন তাকে ব্যাথা দিয়েছে।কি দোষ করেছিলো আছিয়া।তারপর থেকে সে বিয়ে নিয়ে খানিকটা আশংকা বোধ করে এসেছে। কিন্তু আজ তার বিয়ে।সে বুঝতে পারছে তাকেও আছিয়ার মত সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে।সে খুবই চিন্তিত তার পুতুলগুলো নিয়ে।সেগুলো দিয়ে কি শ্বশুর বাড়ি খেলতে দিবে?
আছিয়ার পুতুল গুলো নাকি ওর শ্বাশুড়ি ফেলে দিয়েছিল।তার গুলো সে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখবে।কেউ দেখতেই পাবে না। পুরো বাড়িতে বিয়ের আয়োজন।রান্না-বান্না চলছে। পাড়ার ভাবী-কাকীরা মিলে বাহারিকে মুখে স্নো,পাউডার মেখে সাজিয়ে দিয়েছে।মা কিছুক্ষণ পর পর এসে বাহারিকে বুকে চেপে ধরে কান্না করছেন।বাহারির কেন জানি কান্না পাচ্ছে না।সাজুগুজু করার পরেও তার ফূর্তি ফূর্তি লাগছে না।কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে!! হাতে পায়ে আলতা পরিয়ে দিয়েছে।কি দারুণ লাগছে তাকে দেখতে! সন্ধ্যার দিকে বাহারির বিয়ে হয়ে গেলে এবং তার পর পরই তাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো বরযাত্রী। সবাইকে ছেড়ে আসতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।কত কাঁদলো,যাবে না বলে বায়না ধরলো।কিন্তু কেউ তার কথা শুনলো না।
জোর করে পালকিতে উঠিয়ে দিলো। শ্বশুর বাড়ি এসে বাহারি তার বরকে প্রথম দেখলো।তার বরের নাম মিনহাজ উদ্দিন। ছোট খাটো দেখতে।গায়ের রঙ ময়লা।বয়স একুশ বাইশ হবে।কেমন যেন উদাস উদাস চেহারা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বাহারির সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গেল তার। “আজকে অনেক রাত হলো।তুমি ঘুমিয়ে পড়।কাল তোমার পুতুল দিয়ে আমরা খেলবো।”, মিনহাজ বললো। ” সত্যিই পুতুল খেলবেন?জানেন আমার বান্ধুবির পুতুল গুলো ওর শ্বাশুড়ি ফেলে দিয়েছিলো।”,বাহারি বিষন্ন মুখে বলল।
“আহারে,চিন্তা করো না।তোমার পুতুল কেউ ফেলে দিবে না।তুমি এখন ঘুমাও।” “আপনিও কি আমাকে ব্যাথা দিবেন?” বাহারি ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো। মিনহাজ অবাক হয়ে গেলো তার কথায়। “কেন ব্যাথা দিবো তোমাকে? কত মিষ্টি একটা মেয়ে তুমি।মিষ্টি মেয়েদের আদর দিতে হয়।ব্যাথা দিতে হয় না।” “আমার বান্ধুবিকে ওর বর ব্যাথা দিয়েছিলো তো তাই জিজ্ঞেস করলাম।” এতক্ষণে মিনহাজ বুঝতে পারলো বাহারি কিসের ব্যাথা বলেছে। হো হো করে হেসে ফেললো। বলল,”না,তুমি আরেকটু বড় হও।” “আরেকটু বড় হলে কি হবে?” বাহারি প্রশ্ন করে। “সেটা না হয় বড় হলেই দেখবে।এখন একটু ঘুমিয়ে যাও।” তারপর দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে।সকালে শাশুড়ির ডাকে ঘুম ভাংগে বাহারির।
“এতো বেলা করে ঘুমালে তো চলবে না।এখন বিয়ে হয়েছে।সংসার করতে হবে।এতো বেলা করে ঘুমালে সংসার করবে কি করে?” বাহারি চোখ কচলে ঘুম দূর করার চেষ্টা করতে থাকে। এর মধ্যেই শাশুড়ি একটা ঝাড়ু হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,”নাও,এখন পুরো উঠান ঝাট দাও।” বাহারি উঠান ঝাট দিতে শুরু করে। তার শাশুড়ি ফুলবানু বারান্দায় বসে বউয়ের উঠান ঝাট দেওয়া দেখে। আজ প্রমাণ হয়ে যাবে বউ লক্ষ্মী নাকি অলক্ষ্মী?। সে উঠানের মাঝখানে কিছু শুকনো মরিচ,পেয়াজ,রসুন,আদা এগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে রেখেছে।
ঝাট দেয়ার সময় বউ যদি সেগুলো তুলে রাখে তাহলে বুঝতে হবে বউ লক্ষ্মী।আর যদি ঝেড়ে ফেলে দেয় তো বুঝতে হবে বউ অলক্ষ্মী। ফুলবানু অধীর আগ্রহে বাহারির ঝাট দেয়া দেখছে।এদিকে বাহারি এমনিতেই ঘুম থেকে উঠার পর খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে।তার চোখে যা আসছে সব সে ময়লা ভেবে ঝাড়ু দিচ্ছে। সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি এখানে তার লক্ষ্মী অলক্ষ্মী যাচাই করার পরীক্ষা চলছে। এত বড় উঠান ঝাট দেয়ার পর বাহারির হাত অবশ হয়ে আসছিলো।তবু সে আশা করেছিলো যে শাশুড়ি খুশি হবেন কিন্তু উল্টা তিনি ওকে অলক্ষ্মী বলে অনেকক্ষণ বকুনি দিয়েছে।সে যে ময়লার সাথে মরিচ,পেয়াজ,আদা এগুলো ফেলে দিতে যাচ্ছিলো।
বাহারি ভাবতে থাকে তার শাশুড়ি যদি আগেই বলে দিত পেয়াজ,মরিচ এগুলো ঝাট দেয়ার সময় পাওয়া গেলে কুড়িয়ে রাখতে। তাহলে সে তো তুলেই রাখতো। সে তো সব ময়লা ভেবে ফেল দিয়েছে।এখন তাকে অলক্ষ্মী বলছে কেন? তার ছোট মাথা শাশুড়ির প্যাচ ধরতে পারে না।। তার শাশুড়ি তাকে দিয়ে গাধার মত কাজ করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এইটুকু শরীরে যে এতটা চাপ সহ্য করতে পারে না এটা ফুল বানুর মাথায় ধরে না। ধান নেয়া,ঢেকি পাড় দেয়া,উঠান ঝাট দেয়া এগুলো তো আছেই। একবার এদিকে ধান নেবার জন্য কিছু লোক নেওয়া হয়েছে।তাদের জন্য আলাদা করা এসব তার শাশুড়ি হাতে ধরিয়ে তাকে দিয়ে করাচ্ছে।
মরিচ,হলুদ বাটতে বাটতে তার কোমল হাতটা একসময় কঠিন হাতে পরিণত হয়ে যায়। এর মধ্যে পান থেকে চুন খসলেই শাশুড়ির গালমন্দ তো আছেই। এত কিছুর মাঝে বাহারির একমাত্র শান্তির জায়গা হচ্ছে মিনহাজ। দেখতে দেখতে তাদের বিয়ের দুই বছর কেটে যায়। দুই বছরে মিনহাজ বাহারির সাথে কোন রকম শারীরিক সম্পর্ক করে নি। সে চেয়েছিল, যতক্ষণ না বাহারি ভালোবাসা জিনিস টা উপলব্ধি করবে,ততদিন সে বাহারির সাথে জোর করে এসব করবে না। দুই বছরে বাহারি তাকে প্রচন্ড ভাবে ভালোবেসে ফেলেছে।এতো কষ্টের মাঝেও বাহারির এই বাড়িতে মন টিকে আছে শুধুমাত্র মিনহাজের কারণে। যে তার সাথে বন্ধুর মত আচরণ করে এসেছে,তার পুতুল খেলার সাথী হয়েছে।
আজকাল মিনহাজ তাকে নিয়ে লেখা কবিতা পড়ে শোনায়।শুনে বাহারির চোখে পানি চলে আসে। বিয়ের দুই বছর পর তাদের বাসর হয়। এবং বছর ঘুরতেই বাহারি একটা ছেলে সন্তানের মা হয়।পরিবারে যেন খুশির বন্যা বয়ে যায়।মিনহাজ শহর থেকে বাচ্চার জন্য জামা,কাপড়,লাল কাপড়ের জুতা এগুলো কিনে আনে। সেই যে বাচ্চা হওয়া শুরু হয়,তারপর থেকে বছরের এ মাথায় ও মাথায় বাচ্চা আসতেই থাকে। এবং বিয়ের পনেরো বছরের মাথায় এই দম্পতি আটজন ছেলে মেয়ের বাবা মা হয়ে যায়। এতগুলো বাচ্চা সামলাতে বাহারির রীতিমত হিমশিম খেতে হয়।সংসার এর কাজ তো আছেই সব।তার উপর বাচ্চাদের দেখা শোনা।
একসময় অবশ্য বাচ্চাদের মাটিতে মুড়ি ছিটিয়ে দিলে অনেক সময় ধরে খেতে থাকে।কিন্তু একজন একটা নিয়ে ব্যস্ত হলে আরেকজন অন্য কিছু নিয়ে চিতকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। দেখতে দেখতে মেয়ে রানুর বয়স বারো হয়ে যায়। তার জন্য সেই নয় বছর থেকেই বিয়ে আসা শুরু করেছে।কিন্তু মিনহাজ রাজি ছিলো না এত ছোট মেয়ে বিয়ে দেবার জন্য। বাহারি নিজেও মিনহাজের সাথে একমত ছিলো। তার কপালে যদি মিনহাজের মত বর না জুটে? এদিকে প্রতিবেশীরা বলাবলি করে মেয়ে আইবুড়ি করে বিয়ে দিতে যেও না।বুড়ো শালিক পোষ মানাতে কষ্ট হয়।ছেলে পক্ষ নিবে না আর পরে।
মেয়ের বয়স তের হতেই ভালো পাত্র দেখে তার বিয়ে দেয়।অন্য ছেলে মেয়েদের একটু বড় হতেই স্কুলে ভর্তি করায়।
মেয়ে বিয়ে দেবার কয়েক মাস পর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলায় বেয়াই বাড়ির আত্মীয়রা এসে উপস্থিত হয়।খবর না দিয়ে চলে আসায় বাহারি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়।চিন্তায় পড়ে যায় কি খাওয়াবে তাদের এদিকে হাট বসবে আরো দুই দিন পর।শ্বাশুড়ির কাছে জানতে চায় মেহমানদের কি খাওয়াবে। “গতবার হাট থেকে যে কই মাছ এনেছিলো সেগুলার মধ্যে কয়েকটা জিইয়ে রাখা আছে।কই মাছের পাতুরি রেধে ফেল আর দুইটা মুরগী জবাই করে আলু দিয়ে রেধে দাও।” “আচ্ছা মা তাই করছি।”
বাহারি শ্বাশুড়ির পরামর্শ মত রান্না করে মেহমানদের খাওয়ায়।কখনো কখনো একা সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না।পরিবারে মুরুব্বি থাকায় এটা একটা সুবিধা।কঠিন কিছু মূহুর্তে এদের কাছ থেকে মূল্যবান পরামর্শ পাওয়া যায়। রাতের খাবার খেয়েই মেহমান চলে যায়। কিছু দিন যেতেই বাহারি খবর পায় রানু পোয়াতি হয়েছে।শুনে বেশ শান্তি পায়।এদিকে তার নিজের পেটেও আবার বাচ্চা এসেছে। তিন মাসের মাথায় রানু বাবার বাড়ি চলে আসে বাচ্চা হবার জন্য। দুই মাসের ব্যবধানে মা ও মেয়ের বাচ্চা হয়। মেয়ের জামাই যেদিন বাহারি কে আতুর ঘরে দেখতে এসেছিলো,সেদিন তো তার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। কি লজ্জা! কি লজ্জা!
মিনহাজ বাহারি কে যত দেখে তত মুগ্ধ হয়।সেই ছোট্ট মেয়েটি সংসারের যাতাকলে আজ কিভাবে একজন সংগ্রামী কঠিন মহিলায় রুপ নিয়েছে মাঝে মাঝে সে যখন বাহারিকে বলে,”আমি মরে গেলে সব একা সামলে নিতে পারবো তো?” বাহারি ছলছল নয়নে উত্তর দেয়,”দেখবেন, আপনার আগে আমারই মরণ হবে।” মিনহাজ হো হো করে হেসে উঠে বলে,” আমি তোমার থেকে গুনে গুনে এগারো বছরের বড়।তোমার মৃত্যুর এগারো বছর আগে আমার মৃত্যু হবে।” কিন্তু মিনহাজের কথাটা সত্যি হয় না।বরং বাহারিই মিনহাজের মৃত্যুর আট বছর আগে হঠাৎ একদিন কাউকে না বলে চলে যায় না ফেরার দেশে। ছেলে মেয়েরা সবাই বড় হয়ে গেছে ততদিনে। শহরে যে যার মত সংসার পেতেছে। নাতি-নাতনীদের মিনহাজ বাহারির গল্প শুনায়।
সেই ছোট্ট বাহারি যার শৈশব কেটেছে মিনহাজের কাছে।যার পুতুল খেলার সংগী ছিলো সে।বলতে বলতে মিনহাজের চোখ ভিজে উঠে। নাতি-নাতনিরা মিনহাজের কষ্ট টুকু বুঝতে না পারলেও এটুকু ঠিকই ধরতে পারে,বাহারি নামে সেই বালিকা,যে তাদের দাদু হয়।দাদা তাকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসে। আচ্ছা বাচ্চারা কি ভালোবাসা বুঝতে পারে? অবশ্যই পারে।কারণ এই পবিত্র জিনিস অনুভব করার জন্য মনটা পবিত্র থাকা লাগে। এই দুনিয়ায় বাচ্চাদের থেকে পবিত্র আর কে আছে?