এক টুকরা হাড্ডি

এক টুকরা হাড্ডি

‘ঐ ভাই, আপনে লাইনে দাঁড়ান। লাইন ছাইড়া আগাইতেছেন কেন?’ আমি পেছন ঘুরে তাকালাম, বুঝতে পারলাম কথাটা আমাকেই বলা হয়েছে এবং কথাটা বলেছে ‘না ধুতে ধুতে সাদা রঙ ছাই হয়ে যাওয়া’ পাঞ্জাবি পরা এক মিসকিন। তার হাতে বাজারের ব্যাগ, গালে ছাগলা দাড়ি, মুখে দারিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট।

কুরবানীর মাংসের আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশিদের হকের অংশটুকু ডিস্ট্রিবিউশন করার দায়িত্বটা বাড়ির একমাত্র ছেলে হিশেবে আমার উপরই বর্তায়। আমি অতি বিরস মুখে এই দায়িত্ব পালন করি। বাবা মাংসগুলো পলিথিনে প্যাকেট করে বাজারের ব্যাগে ঢুকিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দেন এবং বলে দেন- কোন পটলাটা কোন বাড়িতে দিতে হবে। আমার মনে হয়-‘কোন বাড়ির জন্য কোন পটলা’-এটা মুখস্থ করার চেয়ে আইন্সটাইনের থিওরী অব রিলেটিভিটি মুখস্থ করা সহজ।

এবারও আমি বাজারের ব্যাগে মাংসের পটলা নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখন যার বাড়িতে মাংস দিতে এসেছি, তিনি এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। তার চালের ব্যবসা, জমিজমার অভাব নেই। প্রত্যেকবার চার পাঁচটা গরু কুরবানী দেন। এইজন্য এই বাড়িতে ফকির মিসকিনদের ভিড়ও বেশি।

আমার পরনে সাধারণ একটা টি-শার্ট, আধোয়া প্যান্ট। অতিরিক্ত গরমের কারণে ঘেমে একাকার। মাথায় উষ্কখুষ্ক চুল, গালে অনেকদিন শেভ না করা দাড়ি এবং হাতে মাংসের পটলা। লাইনে দাঁড়ানো মিসকিনদের সাথে আমার আদতে কোনো অমিল নেই। কাজেই আমাকে লাইনে দাঁড়াতে বলা মিসকিন ভাই যে আমাকে তাদের একজন ভেবে ভুল করেছেন-এতে তার কোনো দোষ নেই।

চক্রবৃদ্ধি হারে ফকির-মিসকিনদের সংখ্যা বাড়ছে। আমি তাদের দূর্গভেদ করে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে পারছি না। মিসকিনদের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়াতে বাড়ির পক্ষের একজন লোক এসে সবাইকে লাইন ঠিক করে দিচ্ছে। লোকটা আমাকে বলল, কি রে ভাই, বলতেছি না লাইনে দাঁড়াইতে! লাইনে না দাঁড়াইলে মাংস দেওন নাই। যান লাইনে যান।

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ইয়ে মানে ভাই- আমি আসলে মাংস নিতে আসি নাই, দিতে উক্ত লোক আমার কথা না শুনেই বলল, গরমের মধ্যে এতো প্যাঁচাল ভাল্লাগে না। লাইনে দাঁড়ান মিয়া। আমার অপিনিয়নের তোয়াক্কা না করে সে নিজেই আমার বাহু ধরে টান দিয়ে আমাকে মিসকিনদের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেলেন। প্রচন্ড ঠ্যালাঠেলি, মাংস এবং ঘামের গন্ধের মিশ্রণ। আমার সামনে ঐ মিসকিন দাঁড়ানো। আমি বললাম, কতক্ষণ ধরে দাঁড়ায়া আছেন? সে বলল, এক ঘন্টার উপ্রে। গরু নাকি কাটা হয় নাই। চিন্তা করেন, দুইটার উপ্রে বাজে। গরু বানাইতে এত সময় লাগে?

লাইনে এবং লাইনের আশেপাশে ছড়ানো ছিটানো অনেক মানুষ। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে মাংস নিতে এসেছে। বৃদ্ধ মিসকিনকে জিজ্ঞেস করলাম, মাংস কেমন উঠাইলেন? পরিমাণ কেমন? দরিদ্র মুখটাতে সে আরো দারিদ্রতার ছাপ এনে বলল, বেশি না। কেউ বেশি দেয় না। আমি তার ব্যাগের দিকে উঁকি দিলাম। মাংস পরিমাণ আমার কাছে যথেষ্ঠই মনে হলো। আমি বললাম, তাও তো অনেক পাইছেন। সে বলল, এইটা আপনের কাছে অনেক লাগে? ঐ যে দেখেন চাইরজন বইসা আছে। তারা এক পরিবার। বাপ-মা-দুই পোলা। সবের হাতে আলদা আলদা বেগ। চাইরজনেই মাংস তুলে। মোটের উপ্রে দশ কেজি মাংস তো তুলবোই।

আমি বললাম, এত মাংস তারা কি করে? খাইতে পারে? না পারে না তো। কিছু খাইবো, বাকিটা বিক্রি কইরা দেয়। আপনের বেগ দেখি, কেমন পাইছেন? আমি হাঁসতে হাঁসতে বললাম, আমি পাইছি ভালোই। বৃদ্ধ মিসকিন মুখ বাঁকা করে বলল, এইটা একটা ভাগ্যের খেলা। কেউ পায় কেউ পায় না। অথচ এইটা কিন্তু আমাগো হক, কি বলেন? অনেকেই আমাগো হক মারে। দেখেন আপনের পিছনে এক মেথর বেটি। হেয় কেন মাংস তুলবো? হেয় কি মুসলমান?

আমি পিছনে তাকালাম। আসলেই আমার পিছনে ‘মেথর’ সম্প্রদায়ের একজন মহিলা। ঘোমটা নাক পর্যন্ত টানা, তবুও কপালের সিঁদুর দেখা যাচ্ছে। আমি মহিলাটাকে বললাম, আপনারাও গরুর মাংস খান? মহিলা যথেষ্ঠ বিরক্ত হয়ে বলল, খাইলে আপনের সমস্যা? আমি থতমত খেয়ে গেলাম। যে কেউ যা খুশী খেতে পারে, যার যা রোচে, আমার কোনো সমস্যা নেই। বৃদ্ধ মিসকিন আমার কাছাকাছি এসে বলল, এই হারামিগুলা সব খায়। গরু, শুয়োর সব।

আমি ইচ্ছা করলেই লাইন ছেড়ে পালাতে পারতাম। কিন্তু আমার থাকতে ভালোই লাগছে। মানুষগুলোকে দেখতে ভালো লাগছে। কত রকম মানুষ, একটা চাহিদা। এক পা খোঁড়া পুরুষ, ছেঁড়া শাড়ী পরা নারী, হাফ প্যান্ট পরা ছোকড়া সবাই চলে এসেছে। শুধু এদিক ওদিক একটু খেয়াল রাখছি, আমাকে আমার পরিচিত কোনো মানুষ দেখে ফেললো কিনা! যদি দেখে আমি মাংস উঠানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি, তাহলে ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।

যাই হোক, এই দাবদাহে মিনিট পনেরো দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি কাঙ্খিত স্থানে এলাম, যেখানে সবাইকে মাংস দেওয়া হচ্ছে। ভেবেছিলাম সেখানে আমার পরিচিত কেউ থাকবে, তার হাতে আমার বাড়ি থেকে আনা মাংসের পটলা দিয়ে সটকে পরবো। ‘অভাগা যেদিকে চায়, পাথার শুকায়ে যায়’ সূত্র মতে, সেখানে আমার পরিচিত কাউকে পেলাম না। তবুও তাদের কাছে আসার পর বললাম, ভাই, আমার বাড়ি এই তিন চার বাড়ি পরেই। আমি আসলে প্রতিবেশি হকের মাংস আপনাদের দিতে ওখানে যারা মাংস দিচ্ছিলো তাদের একজন বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যাগ ফাঁকা করেন, ওতো কথা শুনার টাইম নাই। আরো অনেক লোক বাকি। আমি হতাশ হয়ে ব্যাগ ফাঁকা করলাম, তারা মাংস পুড়ে দিলো। বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি উক্ত মিসকিন, যে লাইনে আমার সামনে ছিলো, সে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, পাইছেন? সে বলল, দুই টুকরা দিসে। তাও এক টুকরা সলিড,এক টুকরা হাড্ডি। খাটাশ বড়লোক। এমুন বড়লোকের মুখে ছেপ। থুঃ বলেই থুহ্‌ শব্দ করে একদলা থুথু রাস্তায় ফেললো।

আমি বাড়িতে এলাম, আম্মুর মাংসের ব্যাগ দেখে বলল, কিরে? তুই কি মাংস দিস নাই? মাংসের পরিমাণ তো যেমন দিছিলাম, ওমনই আছে। আমি মুচকি হেঁসে বললাম, উহু, যেমন দিছিলা তেমন নাই। দুই টুকরা বেশি আছে। এক টুকরা সলিড, এক টুকরা হাড্ডি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত