জাজ মাল্টিমিডিয়ার এক সিনিয়র ভাই সেদিন খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, “ইরাবতীর সঙ্গে তোর প্রথম আলাপ কোথায়?” আমি বললাম,”ইনবক্সে-” ইনবক্সের কথা শুনেই ভাইয়ের হাসিমুখ ম্লান হয়ে গেল। উদাসকণ্ঠে বলল, “ফেসবুকে ভালোবাসা ভেজাল হয়। তুই একটা আহাম্মক।”
ভাইয়ের কথা শুনে মেজাজ গেল টং হয়ে। সবেগে তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শাণিত কণ্ঠে বললাম, “আজ থেকে মাত্র এক বছর আগে আপনার ছোট বোনের অপারেশন হল। ফেসবুকে পোস্ট দিয়েই একরাতের ভেতর তিন ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দিলাম। সেই রক্ত এখন ওর শরীরে। প্রতি ফোঁটা রক্তই কিন্তু নিখাদ ছিল। এতটুকু ভেজাল নেই!” ভাই আমার উত্তর শুনে ঝিমিয়ে গেল। কাতর গলায় বলল,”এমন সামান্য একটা বিষয় নিয়ে তুই ওর অপারেশনের কথা বলে খোটা দিলি?”
“এইটা খোটা নয় ভাই। আপনার ছোট বোন যেমন একটা রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ, তেমনই ইনবক্সের আলোক-রশ্মি ধরে হেঁটে আসা ইরাবতী নামের মেয়েটাও একটা রক্তমাংসের বাস্তব মানুষ। ক্ষেত্র ভিন্ন হলেও অনুভূতিটা এক।” ভাই আমার মাথা নুইয়ে ইনবক্সের গুরুত্ব মেনে নিতে বাধ্য হল। আশাকরি এই জীবনে আর কখনো ফেসবুক বা ইনবক্স নিয়ে এমন ধারায় হতাশাব্যাঞ্জক কথা বলবে না।
আজকের লেখাটা ইরাবতীকে নিয়ে শুরু হলেও প্রসঙ্গক্রমে এই ইনবক্স ও ফেসবুক নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি। আমার এক লেখক বন্ধু এই ফেসবুকে লেখালেখি শুরু করে এখন দেশের জনপ্রিয় ফিগার। প্রতি মেলায় হাজার হাজার ছেলেমেয়ে তার বই কিনতে আসে। বন্ধু আমার ফেসবুক জিনিসটাকে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পেরেছে। আমি ওর উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। কিন্তু ওর সাফল্যে ঈর্ষাক্রান্ত হয়ে যারা হুটহাট লেখক হবার বাসনায় সকাল-সন্ধ্যা টাইমলাইনে আবর্জনা প্রসব করে, ভেজাল হল তারা। ওদের জন্য সমবেদনা।
একজন মানুষ বছরের পর বছর প্রস্তুতি নিয়ে লেখার জগতে এসেছে সে ফেসবুকে বা জাতীয় দৈনিকে… লেখা প্রকাশের যে মাধ্যমই ব্যবহার করুক, সাফল্য আসবেই। এই ফেসবুকে সাঈদী সাবের চান্দের ছবি দেখেই সেবার আমার এক ভাই লাঠি হাতে রাস্তায় নেমেছিল। “যার ছবি চান্দে, সে কেন ফান্দে” শ্লোগান দিয়ে সাঈদী সাবকে জেল থেকে বের করে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। সাঈদে সাব চান্দেই রয়ে গিয়েছে। ভাই আমার গুল্লি খেয়ে মারা গিয়েছে। পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়েছিল। সেই পত্রিকার কাটিং এখনো আমার বাসায় আছে। এই ভাইটির জন্য অতলান্ত সমবেদনা।
কাঁচা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কেউ ধরে মাছ, কেউ মারে মানুষ। সমস্যা কঞ্চিতে নয়। মানুষের মন ও মগজে। ফেসবুকে পরিচিত অনেকেই মেলায় এসে অবাক হয়। “ভাই আপনাকে খুব রাগী ভাবছিলাম। ইনবক্সে নক দিলে উত্তর দেন না। ভাব নিয়া থাকেন। অথচ বাস্তবে দেখি খুবই সরল ধারার মানুষ। খুব হাসিখুশি।” আমি অবাক হই না৷ অনলাইনে কথা বলা আমি আসলেই অপছন্দ করি৷ কেন করি?
এইরূপ একশটা ছেলেমেয়েকে জানি, যারা জীবনে একবারও পাশের বাসায় বৃদ্ধ মানুষটাকে সালাম দেয় না বাজারের ব্যাগটা টানতে কষ্ট হচ্ছে দেখেও হাতে নিয়ে দুই কদম এগিয়ে দেয় না… আত্মীয় পরিজন কে কোথায় আছে জীবনে খবর নেয় না, অথচ হুদাই ইনবক্সে অচেনা আইডিতে গিয়ে “hi/hlw” করে বেড়ায়। ফেসবুক আমাদের যোগাযোগের মাধ্যমকে সহজ করে দিয়েছে। তারমানে এই না, মানুষের জীবনধারাও সহজ হয়ে গিয়েছে।
কিছু মানুষ মনে করে আজকে যেহেতু রবিবার, তাহসান ভাইয়ের আইডিতে গিয়ে একটা গালি দেই। আজকে যেহেতু রবিবার না, ফ্রেন্ডলিস্টে আলো ছড়ানো বাংলা কলেজের আপুটাকে নক দিয়ে মজা নেই! এই ধারার মানুষেরা খুব বিপদজনক। এদের থেকে দূরে থাকার জন্যই কিছু মানুষ মিথ্যে গাম্ভীর্যের অভিনয় করে! গাম্ভীর্য মিথ্যে হলেও ব্যস্ততার বিষয়টা নিখাদ সত্য। একজন মানুষের হাতে দুইটা মুঠোফোন, একটা ল্যাপটপ, একটা ডেস্কটপ থাকতেই পারে। গান শোনা, মুভি দেখা কিংবা একাডেমিক প্রয়োজনে রাতভর দিনভর নেট-লাইন খোলা রেখে থিসিসের কাজ করতেই পারে। তারমানে এই নয়, সে এখন এভেইলেবল!
প্রথম আলোর বিনোদন বিভাগের এক সিনিয়র ভাইকে ২০১৩ সালে সালাম দিয়েছিলাম আমি। উত্তর পাই নি। খুব রাগ হয়েছিল। উত্তর দিয়েছেন ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। এরপর টুকিটাকি কথা। ২০১৯ মেলায় আমাদের দেখা হল। এখন সে যতটা না আমার ভাই, তারচেয়েও বেশি, বন্ধু। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, রবিবারে আকাশে চাঁদ উঠলেও সে আমারে কল দেয়,”এই দেখ কত্তবড় চাঁদ উঠছে… চল কেয়ারি হাউজের ছাদে বসে মাল খাই-”
রবিবারে চাঁদ না উঠলেও সে আমারে কল দেয়,”ধুর বাল, আজ আকাশে চাঁদ উঠে নাই কেন? চল কেয়ারি হাউজের ছাদে বসে মাল খাই-” মাঝেমধ্যে অবাক বিস্ময়ে ভাবি, এই ইনবক্স এবং টাইমলাইনের আলোক-রেখা ধরেই দিনকে দিন কত জ্ঞানীগুণী মানুষের সাথে পরিচয় হল আর কত কত হাতিঘোড়ার মুখোশ পরা ইঁদুর আর তেলাপোকারা বানের জলে হারিয়ে গেল…