হঠাৎ চাচী এসে খাবারের টেবিলের সামনে দাড়ালো।আমরা সবাই খাবারের টেবিলে।মা,বাবা,তুলি,আমি,দাদী। মা বললেন তুলি তুই ওঠ।তোর চাচীকে বসতে দে।মিলি বসো চেয়ারটায়। খেতে খেতেই হঠাৎ চাচী বলে উঠলো আপা একটা কথা বলার ছিলো। মা জবাব দিলেন বলো কি বলতে চাও? আপা আমি প্রেগন্যান্ট। চাচীর কথা শুনে মায়ের হাত থেকে ভাতের নলাটুক পড়ে গেলো। আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে চাচীর দিকে তাকিয়ে আছি। এটা সম্ভব নয়।কখনোই সম্ভব নয় কারণ দুবছর আগে চাচা মারা গিয়েছেন। কি বলছো তুমি এসব?তোমার মাথা ঠিক আছে তো?
আমি যতেষ্ট স্বাভাবিক ভাবেই বলছি আপা।আমার মাথাও ঠিক আছে। তাহলে আমাদের বুঝিয়ে বলো কীভাবে তুমি প্রেগন্যান্ট হতে পারো?যার স্বামী বেঁচে নেই সে কীভাবে প্রেগন্যান্ট হতে পারে তা আমার বুঝে আসছে না! যেভাবে আপনি প্রেগন্যান্ট হয়েছিলেন।যেভাবে আর দশজন নারী প্রেগন্যান্ট হয়। আরো স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে আমার প্রেগন্যান্সির জন্যে ভাইজান দায়ী। চরমভাবে অবাক হয়ে সবার মাথাগুলো বাবার মুখের দিকে ফিরে গেলো।নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বাবা খাবার খাচ্ছেন।চাচীর কথায় বাবার মনে বোধয় কোনো ভাবান্তর ঘটে নি।
তুলির বাবা শুনছো? মিলি যা বলছে তা কি সত্যি? ভাতের নলা মুখে নিয়ে কেউ নিশ্চই মিথ্যে বলবে না তাই না?বাবা উত্তর দিলেন। চেয়ার থেকে উঠে এসে ঠাস করে বাবার গালে চড় মেরে দিলেন দাদি। দাদির হাত থেকে ভাতের কণা গুলো ছোপ ছোপ বাবার গালে বসে গেছে।দাঁতে দাঁত চেপে দাদি বললেন মালাউনের বাচ্চা তোর নিজের বউ কি মরে গিয়েছিলো?বাচ্চাদের সামনে কিছু বলতেও আমার মুখে বাঁধছে।কি পাপটা করেছি এত বড় অলক্ষুণে কথা আমার শুনতে হলো।
আশ্চর্য বাবা এখনও ভাত খাচ্ছেন।বেশ তৃপ্তি নিয়েই খাচ্ছেন।কি সুন্দর মাছের কাটা বেছে বেছে ভাতের সাথে মিশিয়ে গোগ্রাসে খাচ্ছেন।যেনো এরকম মারাত্মক কথাগুলো প্রতিদিন শুনতে শুনতে বাবা অভ্যস্থ। মা ওঠে চলে গেলেন ভেতরের রুমে।দাদীও ছি ছি করতে করতে গেলেন তার রুমে।তুলি আর আমি বসে নিশ্চুপে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি।
হাত ধুয়ে বাবা তুলিকে বললেন মা রে আমাকে হাত মোছার তোয়ালে টা দিবি? তুলি বেশ বিচ্চিরি ভাবে বাবার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। বাবা প্রতিউত্তরে একটা মলিন হাসি দিলেন।আমি তড়িঘড়ি করে বাবাকে তোয়ালেটা বাড়িয়ে দিলাম।সাথে একটা পান বানিয়ে আনলাম বাবার জন্যে। পানটা হাতে নিতে নিতে মুচকি হেসে বাবা বললেন বুঝলি মিহির ভাত খাওয়ার পর তোর বানানো এই পানটা না খেলে আমার খাবারের তৃপ্তিটা পরিপূর্ণতা পায় না।তোর দাদী আবার দেখতে পান নি তো।দেখতে পেলে তোকে আবার বকবেন।আমার জীবনে ভয়ে ঐ পানের বাটায় কখনো হাত দিতে পারি নি।তুই বাপের ব্যাটা পেরেছিস হা হা হা।
এককাপ চা যদি তুলি বানিয়ে দিতো রে তবেই দিনটা পরিপূর্ণ হয়ে যেতো।এগুলো আমার কাছে শুধুই দৈনন্দিন নিয়ম নয়।এগুলো একেকটা ভালোবাসার অাস্তরণ।তিলে তিলে আমি তৈরি করেছি। হঠাৎ বাবা বললেন মিহির ছাদে যাবি?শেষবারের মতন আমার প্রিয় ফুলগাছের চারাগুলো একটু ছুয়ে দেখবো। শেষবারের মতন বলছেন কেনো আব্বু? তোর কি মনে হয় এতবড় একটা ঘটনার পরেও এ বাড়িতে আমার জায়গা হবে? বাবার কথাটার জবাব দিতে পারি নি।চুপচাপ সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছি।ছাদে উঠেই বাবা বেতের চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলেন। আমি নিচে বসে পড়লাম। একটু পর খেয়াল করলাম বাবা কাঁদছেন।
জানিস মিহির?যখন তুলির জন্ম হলো আমার খুশির বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিলো।কারণ তার গর্ভে থাকাকালীন পুরো সময়টাতেই আমি তোর মায়ের সাথে বাকবিতণ্ডা করতাম আমার প্রথম সন্তানটা মেয়ে হয়ে জন্মাবে।কিন্তু তোর মা কিছুতেই মানতে চাইতো না।সবশেষে আমার ইচ্ছেটাই স্রষ্টা সত্যি করলেন।ফুটফুটে একটা মেয়ে জন্ম নিলো। আমি তার নাম দিয়েছি তুলি।কিন্তু আজ আমাকে সেই মেয়ে মুখ বাকিয়ে চলে গেলো।বিশ্বাসের দেওয়ালে খুব অল্পতেই আঘাত লেগে যায়।ঠুনকো বিশ্বাসে জীবন চলে না। পৃথিবীতে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে বিশ্বাসটুকু মজবুত থাকতে হয়।কিন্তু আজ আমার বিশ্বাসের স্থানে অবিশ্বাস জয় পেয়েছে রে।কি দুর্ভাগা কপাল নিয়ে জন্ম নিয়েছি।
জানি না কোনো এক অদ্ভুত স্নেহের টানে বাবার চোখের পানিটুক দুহাতে মুছে দিলাম।বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। একটুপর দুজনেই নিচে নেমে এলাম।
নিচে নামতেই দেখি মা নিজের সামনে দুটো ব্যাগ নিয়ে বসে আছেন।বাবার সাথে চোখাচোখি হতেই মা বললেন আমার সামনে দুটো ব্যাগ গোছানো আছে।এ বাড়িতে হয় আমি থাকবো নয়তো তুমি থাকবে।সিদ্ধান্তটা তোমার।
বাবা নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে সদর দরজার দিকে হাটতে লাগলেন।আমি এগিয়ে যেতেই মা পেছন থেকে বললেন খবরদার মিহির।ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও থমকে দাড়ালাম। পুরো একটা রাত মাথায় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে এপাশ ওপাশ করেছি।পরিবার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না চাচীর ব্যাপারে।ঘটনা যদি সমাজ জানতে পারে তাহলে বেঁচে থাকাটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে।
আম্বিয়া ভাবছেন তার স্বামী এরকম একটা কাজ করেছে তা আমরা কেউ জানতেও পারলাম না?গত একবছরে এমন কোনো দিন তো ছিলো না যেখানে তুলির বাবা একা এ বাসায় ছিলো।প্রচন্ড রাগের মাথায় লোকটার সাথে এরকম করাটা কি ঠিক হলো?আম্বিয়া বেগমের চোখে আর কোনো পানি অবশিষ্ট নেই।প্রচন্ড ক্লান্তিতে চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে।
পরদিন আম্বিয়া বেগম আর তার শ্বাশুড়ী মিলে মিলির এবরশান করালেন।এছাড়া আর কোনো উপায় তাদের হাতে নেই।তারা ভাবছেন অতি শিঘ্রই মিলিকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হবে।স্বামী বিহীন একটা সুন্দরী বউ সারা জীবন এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়।তার সন্তানরা নাহয় এখানেই থাকবে। ঠিক একসপ্তাহ পর মিহিরের কাছে সদর হাসপাতাল থেকে ফোন এলো।হ্যালো মিহির বলছেন? জ্বি বলছি। মাহমুদুর রহমান আপনার কি হন? জ্বি আমার বাবা। অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আপনার বাবা স্ট্রোক করে মারা গিয়েছেন।আপনি সদর হাসপাতালে চলে আসুন।
মিহির দৌড়াচ্ছে।প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে।শুধু ডাক্তারের বাক্যটিকে মিথ্যে প্রমাণ করার জন্যে। বাবার লাশ দেখে কাঁদতে কাঁদতে মিহির বললো ডাক্তার সাহেব উনি আমার বাবা নন।আমার বাবা কখনো অবেলায় ঘুমান না।আপনি আমার বাবা কোথায় আছেন দয়া করে বলুন। আমরা এই চিঠিটা আপনার বাবার পকেটে পেয়েছি।আমরা খুলি নি চিঠিটা।শুধু উপরের এই নম্বরে ফোন দিয়েছি।নিন আপনার চিঠি আর রিসেপশন থেকে ডেথ সার্টিফিকেট টা সংগ্রহ করুন। তারপর লাশটা বাইরে নিয়ে যান।
আমার মিহির, আমার সকাল থেকেই খুব খারাপ লাগছিলো।পঞ্চাশোর্ধ বয়সে নিশ্চই তোর আব্বুকে কেউ চাকরি দিবে না।কারো কাছে যাবার ইচ্ছেটাও নেই কারণ কয়দিনই বা থাকতে পারবো?কোনো না কোনো সময় তারা জিজ্ঞেস করতো ই আমার কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা।গত তিনদিন ধরে কিছুই খেতে পাই নি।জমিদারের ছেলে তিনদিন ধরে উপোশ ব্যাপারটা কতই না হাস্যকর তাই না?কেমন যেনো অরুচিও চলে এসেছে।এই বয়সে কেউ যদি তোর স্ত্রী সন্তানদের সামনে তোকে ধর্ষক বলে নিশ্চই তোর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হতো না।যদি তুই সত্যিকার ওরকম কিছু করে না থাকিস।আমার বেলায় তা হয়েছে।
আমি ওরকম কিছুই করি নি।আমার একটা মেয়ে আছে তোর চাচীর বয়সী। কাজটা করতে নিশ্চই বিবেকে বাঁধবে।সবচেয়ে অবাক হয়েছি কখন জানিস? যখন তোর মা তোর চাচীকে সন্দেহ না করে আমাকে সন্দেহ করলো।এর জন্যেই কি পঁচিশ বছর ভালোবাসা দিয়ে তোর মাকে আগলে রেখেছিলাম?তুই ভাবছিস চাচী তাহলে মিথ্যা বলেছে?তোর চাচী সত্য বলেছে কিন্তু মিথ্যে বলেছে আমাকে জড়িয়ে।কাজটা কে করেছে আমি জানি।স্রষ্টা তাদের বিচার করবেন।হয়তো একদিন তুই ও জানতে পারবি।আমার গোলাপের চারায় নতুন গোলাপের অপেক্ষা করিস।অপেক্ষা কর বাবা।নিজেকে দমিয়ে রাখিস।যে পরিবার আমাকে বিশ্বাস করতে পারে নি সে পরিবারে যেনো আমার লাশের গন্ধ এবং মৃত্যুর খবর না পৌঁছায়।
ইতি
তোর বাবা
মিহির বাবার লাশ দাফন করলো বাড়ী থেকে অনেক দূরে।কেউ জানবেনা তার বাবা কোথায়।অবিশ্বাসীদের তা জানার অধিকার নেই। যেদিন বাবার গাছে গোলাপ ফুটলো সেদিন মিহিরদের কেয়ারটেকার মামুন সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেলো।একই দিনে মারা গেলো তার চাচী।মিহির ভাবছে কি তার চাচীর রুচি!অতই যদি ইচ্ছে ছিলো তবে অবিবাহিত রয়ে গিয়েছিলো কেনো? স্রষ্টা তার মৃত বাবার ইচ্ছেটুক কি পূরণ করলেন তাহলে?কতই না অদ্ভুত প্রকৃতির বিচার!