তলপেটের উপর আলতো করে নিজের হাতটা রেখে চোখ বুঝলাম। তারপর গভীরভাবে হালকা করে নিঃশ্বাস নিলাম। হুম আমি অনুভব করছি! অনুভব করছি আমার ভেতর একটু একটু করে বেড়ে ওঠা আরেকটা সত্তাকে। অনুভব করছি আমার সন্তানকে। অনুভব করছি প্রথম মা হওয়ার উপলব্ধি আর আনন্দকে। শুনেছি প্রথম যেকোনো কিছুর আনন্দ ই আলাদা। আর প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি! সে তো খুব করে নিজেই টের পাচ্ছি । ঠোটের কোণে মুচকি হাসিটা চলে এলো যখন আমার অনাগত বেবিটা তার ছোট্ট পা দুটি দিয়ে আমাকে আঘাত করল। আমি খুব করে সেটা অনুভব করলাম। বলছিলাম আমার মা হওয়ার গল্পকথা! বলছিলাম একজন মা হয়ে ওঠার কথা! বলছি মায়ের কথা! এমন সময় টুনটুন করে ফোনকলটা বেজে উঠলো।
ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে মা বলে উঠলেন ,” ইসু! মা আমার! কেমন আছিস বাবু?”
আমার চোখেমুখে তখন মা হওয়ার অনুভূতি উপচে উপচে পড়ছিল। এ খুশি আটকে রাখতে না পেরে নিজেকে কোনমতে সংযত করে বললাম,” মা! মা! তুমি সেদিন বলেছিলে না! তোমার মা হওয়ার অনুভূতির কথা! কিভাবে আমি তোমাকে লাথি দিতাম,পেটের ভিতর দুষ্টুমি করতাম। বলেছিলেনা চোখ বন্ধ করে পেটের ওপর হাত রেখে অনুভব করতে! হুম মা! আমি অনুভব করলাম মা হতে যাচ্ছি। ” মা ওপাশ থেকে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে উঠলো,” হুম বাবু! তুই ও এমন করতি! তখন না পারতাম শুতে, না পারতাম বসতে। দেখবি তোর বাবুটা তোর মতই হবে।দুষ্ট! ” আমি হেসে দিলাম। মা ও হাসতে লাগলো।
তারপর কান্না থামিয়ে বললো, ” ইসু! ডাক্তার দেখিয়েছিলি? কি বললো? ” আমি মাকে শান্ত করার জন্য বললাম,” মা দেখিয়েছি! আলহামদুলিল্লাহ সব একদম ঠিকঠাক আছে। তোমার পিচ্চি বুড়োটার সাত মাস চলছে।” মা এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর পরামর্শের সুর করে বললো,” শোন! তোকে কিন্তু এখন পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে৷ আর বেবির জন্য বাড়তি খাবার ও খেতে হবে। কারন বাড়তি খাদ্য না পেলে গর্ভপাত, অপরিনত ও মৃতশিশু জন্মগ্রহণ, এছাড়া প্রসবকালীন মৃত্যু ঝুঁকি বেশি থাকে।
তুই ভাত,মাছ,মলা,ঢেলা,মাংস,ডিম, দুধ,ঘন ডাল, সিমের বিচি,গাড় সবুজ ও হলুদ রঙের শাকসবজি, তাজা ফলমূল বেশি খাবি৷ আর জামাইবাবাজিকে বলবি শরীরে (লৌহ) আয়রনের জন্য ভিটামিন “এ” এবং তা শোষিত হওয়ার জন্য ভিটামিন “সি” যুক্ত খাবার বেশি খাওয়াতে! বুঝলি? আর হ্যা! একা একা একদম ভারী কাজ করবিনা কিন্তু এখন। বেবি আর তোর দুজনেরি ক্ষতি হবে। আর নিয়মিত ১৫-২০ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি খাবি। ঠিকাছে?” আমি হেসে দিলাম। মা রেগে গিয়ে বললেন,” হাসছিস যে বড়! হাসার মতো কিছু বলেছি আমি? যত্ন নিতে হবেনা নিজের? তোর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কি আর তা করে? দিনরাত তো খেটে মরিস! এখন অন্তত নিজের খেয়ালটুকু রাখ বাবু!”
আমি হাসিমাখা কন্ঠেই বললাম,” ওহ! মা। তুমি আবার ডাক্তার হয়ে গেলে? এই এক কথা কতবার বলবে! সব মনে আছে মা৷ আর তুমি চিন্তা করোনা তোমার জামাই খুব খেয়াল রাখে আমার। অনেক রাত হয়েছে। তুমি ঘুমোও মা। আমি রাখছি এখন। ” মা অভিমান মাখা কন্ঠে বললো,” কি করবো! চিন্তা হবেনা! মা তো আমি! আচ্ছা খেয়াল রাখিস নিজের। রাখছি। ”
মার সাথে কথা শেষ হলে ফোনটা রেখে বারান্দায় উঁকি দিলাম। আবির আসছে অফিস থেকে। ও রুমে ঢুকতেই আমি এগিয়ে গেলাম। আবির দুর থেকে হাত ইশারা করে বললো,” উহু! আপনি ওখানেই থাকবেন। নড়বেন না৷ ডাক্তার কিন্তু আপনাকে কাজকর্ম বেশি করতে নিষেধ করেছে! মনে আছে?” আমি বললাম,” আরে কিন্তু! তুমি সারাদিন কাজ করে এসেছো। তোমার জিনিসপত্র, খাওয়াদাওয়া? আবির টাইটা গলা থেকে খুলতে খুলতে বললো,” সব আমি পারবো মেডাম! আপনি শুধু নিজের আর আমার বেবিটার খেয়াল রাখুন।” বলে মুচকি হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
আমি একটা সুখের হাসি দিলাম। এমন ভাগ্য কজনার হয়? আজকাল কজন স্বামী তার স্ত্রীর কষ্ট বুঝে! আমি তবে বড় ভাগ্যবতী। আবির ফ্রেশ হয়ে রুমে এলো। বললো,” তুমি খেয়ে নিয়েছো?” আমি জিব কেটে বললাম,” খিদে পেয়েছিলো তাই।” আবির হোহো করে হেসে দিলো৷ তারপর টেবিলের উপর রাখা খাবারের বাটিটা সামনে টেনে নিয়ে বললো,” তো কি হয়ছে? এতে এমন জিব কাটা লাগে নাকি? এখন অনেক বেশি খাবে। ইয়ে চাইলে আমার সাথে ও খেতে পারেন আরেকবার।” আমি মাথা নেড়ে বললাম,” উহু! তুমি খেয়ে নাও। আমি বরং শুই। শরীরটা খারাপ লাগছে।” আবির খেতে খেতে বললো,” তবে শুয়ে পড়ো৷ আমি বাতি নিভিয়ে দিবো।”
আমি শোয়ার জন্য বিছানায় গেলাম। কিন্তু নাহ! শুতে পারছিনা। বসতে গেলাম তাও পারছিনা৷ বেবিটা পেটের ভিতর খুব বেশি নড়াচড়া করছে। তখন মায়ের কথামতো পাশ ফিরে শুলাম আর দুপায়ের মাঝে একটা বালিশ রেখে তার ওপরে পেটের ভরটা রাখলাম। এখন কিছুটা স্বস্তি লাগছে৷ আমার হঠাৎ মায়ের কথা খুব মনে পড়লো। মা ও তো এভাবেই আমার জন্য কষ্ট পেয়েছিলো। আমি যেমন কষ্ট করে কাজ করি আমার বেবিটাকে গর্ভে রেখে। মা ও তো তাই করেছিলো আমাকে নিয়ে।
মা ঠিকি বলেছিলো তিনি আমার মা! চিন্তা তো তিনিই করবেন। চোখবেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। আবির পাশে এসে শুলো। আমাকে কাঁদতে দেখে হকচকিয়ে বললো,” কি হলো ইসু! কাদঁছো কেন? কষ্ট হচ্ছে খুব? ” আমি কান্না চেপে বললাম,” আবির! আমাকে একটু ফোনটা এনে দিবে কষ্ট করে?” আবির ফোন এনে দিলে আমি কাঁপা কাঁপা হাতে দ্রুত ডায়াল করলাম। বারকয়েক রিং হলে ওপাশ থেকে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,” হ্যালো! কি হলো মা? ” আমি শব্দ করে কেঁদে উঠে বললাম,” থ্যাংস মা! সবকিছুর জন্য অনেক অনেক থ্যাংস।” বলেই ফোনটা কেটে আবিরের কোলে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলাম।
আজ আমার সন্তান পৃথিবীতে আসবে৷ একিসাথে আনন্দ, ভয় আর দুশ্চিন্তা হচ্ছে। জীবনে একবার কাছ থেকে ছোটোচাচীর গর্ভপাতকালীন ভয়াভয় সে যন্ত্রণার দৃশ্য দেখেছিলাম৷ দেখেছিলাম সন্তান জন্মদানে মায়ের সে অসহ্য যন্ত্রণা। সে থেকেই ভয়ে কুকড়ে যেতাম এ দিনটার কথা মনে পড়লে। মাকে বলতাম,” ওমা! আমায় তুমি বিয়ে দিয়োনা৷ আমার দ্বারা এতো কষ্ট সহ্য করা হবেনা।” মা তখন মাথায় চাটি মেরে বলতো,” চুপ কর! যখন মা হবি তখন বুঝবি সন্তানের মায়া কি। তখন এমনি সব সয়ে যাবে।”
মা,আবির,বাড়ির সবাই বাইরে দাড়িয়ে আছে অপারেশন থিয়েটারের। আমি অসহ্য যন্ত্রণায় তখন গড়াগড়ি খাচ্ছি হাসপাতালের বেডটায়। ডাক্তাররা নরমালি বেবিটাকে বের করার চেষ্টা করছেন। ওফ! সে যন্ত্রণা! বলার মতো না। আমার মনে পড়লো, মা ও তো এই ঠিক একিভাবে আমায় পৃথিবীতে এনেছিলো৷ এভাবেই তো আমার জন্য প্রসব বেদনা সহ্য করেছিলো। আমি আমার নয়, মায়ের সে অনুভূতি মনে করে চোখ বুজে নিলাম আর যন্ত্রণা কাতর ওই মুহুর্তে মনে মনে বললাম,” থ্যাংস মা!”
জ্ঞান ফিরলে আমি আমার বেবিটাকে দেখলাম সর্বপ্রথম। ওর ছোটো ছোটো হাত- ছোট পা, চোখ,মুখ সবকিছু! সবকিছু আমাকে যেনো অসীম খুশি এনে দিলো। আমি হাত বাড়িয়ে ওকে কোলে নিলাম। তারপর কপালে আলতো করে চুমু দিলাম। বেডের পাশে দাড়ানো মাকে দেখে কেঁদে দিলাম। মুখে বলা হলোনা আর থ্যাংস মা! মা এসে আমার কাধেঁ হাত রেখে মিষ্টি করে হাসলেন। আমি ও সেদিকে চেয়ে কৃতজ্ঞতার হাসিটা দিয়ে দিলাম। এখন আস্তে আস্তে আমার বেবিটা বড় হচ্ছে। ওর কচি কচি হাত পা গুলো প্রসারিত হচ্ছে। কাজ করতে গেলে আবার দৌড়ে আসতে হয় ওর জন্য। তবুও তো বাড়ির সব আমাকেই খেয়াল রাখতে হয়। আর আমার দুষ্ট বাবু আলাইনাটা কেঁদেই যায় সারাক্ষণ। কাছে আসলে একটু থামে। খাওয়াতে গেলে ও খেতে চায়না। ওফ বাবা! এতো বিরক্ত করে মেয়েটা আমার।
শীতের রাত৷ পাশে আবির নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। আলাইনা কেঁদে উঠলো৷ আমার খুব মাথাব্যাথা করছিলো। উঠে আলাইনাকে কোলে নিয়ে বসে রইলাম তবুও। অথচ শরীরে খুব ব্যাথা হচ্ছে। মনে পড়লো মা ও তো এতো ত্যাগ স্বীকার করে ঠিক এভাবেই আমায় বড় করে আজকের ইসু বানিয়েছে। মা ও তো আমার জন্য এমন হাজারো শীতের রাতে নির্ঘুম জেগেছে। চোখবেয়ে জলগুলো একটানা পড়েই যাচ্ছে। আমি আলাইনাকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলাম। বালিশের পাশে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে টেক্সট করলাম,” মা! থ্যাংস। সবকিছুর জন্য অনেক অনেক থ্যাংস। আমাকে বড় করার জন্য,পরিপূর্ণ করার জন্য আর এ সুন্দর পৃথিবীতে আনার জন্য থ্যাংস।”
সমাপ্ত