সকাল সকাল কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাংলো। দরজা খুলে দেখি কেউ নেই। আসে পাশে তাকালাম। কারো দুষ্টুমি ভেবে যেইনা দরজাটা লাগাতে যাবো, চোখ পড়লো নিচের দিকে। তাকিয়ে দেখলাম বেশ মাঝারি আকারের একটা বক্স। খুব সুন্দর করে বাধাই করা। হাতে নিলাম, লেখা ছিল ‘শুধু তোমার জন্য তামান্না ‘।
চোখ কপালে উঠলো। কারন এই শহরে কেউ আমায় এই নামে জানেনা। আর আমাকে পার্সেল করে কিছু পাঠানোর বিশেষ কারো কথা আমার মাথায় আসছেনা। আমার বিয়ে হল আজ ১ বছর। আমার স্বামি এতই হিসাবি একটা মানুষ যে বাসর ঘরেও আমাকে ১ টাকার একটা চকলেট উপহার করেনি। তারপর আজ অব্দির কথা নাহয় বাদই দিলাম। তাই আমার স্বামি আমাকে কিছু পাঠাবে, তাও আবার পার্সেল করে যখন সে কাজের সূত্রে শহরের বাইরে আছে তা হতেই পারেনা ! তাই সেই চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিতে বেশি সময় অপচয় করিনি। খানিকটা দ্বীধা নিয়েই বক্সটা নিয়ে দরজা আটকালাম।
আমার ঘুম পুরো হয়নি, তাই আবার ঘুমাতে চলে গেলাম। বক্সের প্রতি কোন কৌতুহলই আমার ছিলনা। কারন বরাবরই আমি এমন স্বভাবের । কোন কিছুর প্রতি অতিরিক্ত কৌতুহল আমার কাজ করেনা । অতঃপর ২ ঘন্টা পর ঘুম ভাংলো। ফ্রেস হয়ে, নাস্তা খেয়ে যখন দুপুরের মেনু নিয়ে ভাবতে যাবো তখন বক্সের কথা মনে পড়লো। বক্সটি না খোলে জানা যাবেনা ঠিক এর ভেতর কি বা কে এটা পাঠালো তাই রেপিং পেপার গুলো খোলতে লাগলাম। প্রথমেই দেখলাম খুব সুন্দর করে রেপিং করা আরেকটা সরু ডাইরি বা কোন বই টাইপের মত মনে হল কিছু আছে। রেপিং খুললাম, বেড়িয়ে এলো একটা বেশ বড় আকারের ডাইরি। ডাইরির গায়ে লেখা “তামান্নার ডাইরি, ‘মহোদয়ার অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করা নিষেধ ” লেখাটা দেখে মুখে হাসি চলে আসলো। পুরো ডাইরি উলটে ১ম পৃষ্টায় লেখা ছাড়া আর কিছুই লেখা পাইনি।
১ম পৃষ্টায় সুন্দর করে ছোট করে দুলাইনের একটি ছন্দ লেখা ” তামান্না, চোখ যেন তোমার মায়ার বাঁধন স্নেহের জলে ঢাকা, আমার দেহের প্রতিটি অংগে তোমার ছবিই আঁকা ” বাহ! বেশতো! আমার দুচোখের আজ পর্যন্ত অনেক প্রশংসা শুনেছি, কিন্তু আজকের মত এমন প্রশংসা জীবনেও শুনিনি। ডাইরি পাশে রেখে আরো একটা ডাইরি পেলাম। তবে এটা বেশ মোটা। স্টিলের রিং এর মত গোল গোল চাকার মত কাঠামো দিয়ে বাধাই করা। এই ডাইরি ক্রমান্বয়ে খুলতে লাগলাম, যতই খুলতে লাগলাম অবাক হলাম। যেমন
১ম পাতায় এক পাশে লেখা ছিল “আজ তোমায় প্রথম দেখলাম। আচ্ছা তুমি কি জানো! কাজল কালো চোখে তোমায় লাগে বেশ? ” সাথে ২২ টা কাজল। আচ্ছা ২২টা কাজল কেন! আমার বয়স ২২ বলে! সে কিকরে জানলো আমার বয়স কত! এমন অনেক প্রশ্ন মাথায় ভর করলো। একি! আমিতো কৌতুহলি নই! তবে এখন কেন কৌতুহলি হয়ে যাচ্ছি! ধ্যাত, আমি বরং চুপচাপ দেখতে থাকি আরও কি কি আছে ডাইরিতে। ২য় পৃষ্টায় “আচ্ছা, তুমি টিপ কেন পড়না৷! তুমি কি জানো একটা ক্ষুদ্র টিপ তোমার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিবে? ” সাথে কালো লাল নীল হরেক রকম টিপের একটি বক্স
৩য় পাতায় “অবশ্য তোমার গোলাপি ঠোঁট কোন লিপ্সটিক ছাড়াই মাশাল্লাহ । তবু তুমিকি জানো! এই লিপ্সটিকগুলি রঙধনুর রঙের মত তোমার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিবে? ” সাথে ১০টি হরেক রকম লিপ্সটিক। ৪র্থ পাতায় “আচ্ছা তোমার হিজাবে এত পিন দাও,এগুলো শেষ হয়না! তাই তোমার জন্য ” সাথে হিজাব বাঁধার পিনের জন্য ১০ টি বক্স। ৫ম পাতায় ” আজ তোমাকে সবার আরালে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে দেখলাম। সামনে গিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে পারিনি। তাই তোমার জন্য ” সাথে ৫ টি রোমাল। ৬ষ্ঠ পাতায় ” আজ তোমার হাতে চুড়ি পড়তে দেখলাম, আমি চাই তুমি প্রতিদিন পড়ো ” সাথে ৫ ডজন অনেক রকম চুড়ি। প্রত্যেক রঙের ৪টি করে চুড়ি।
৭ম পাতায় “তোমাকে কখনো হিজাব ছাড়া দেখিনি। বাসায় নিশ্চয়ই হিজাবে থাকোনা ! তখন পড়িও “সাথে ছোট দুটো কানের দুল, একটি চেইন। ৮ম পাতায় ” শুনেছি তুমি গান খুব পছন্দ কর! অবশ্য প্রায় সবাই করে। তাই তোমার জন্য। ” সাথে একটি ৩২ জিবি মেমোরি কার্ড আর একটি ব্লুথুড৷ ৯ম পাতায় ” ঘুরতে গিয়েছিলাম কক্সবাজার, তোমার জন্য কি আনবো ভেবে এইটা নিলাম ” সাথে খুব সুন্দর একটি মুক্তার মালা৷
১০ম পাতায় ” অনেক লিখতে গিয়ে যখন কালি ফুরিয়ে যাবে, তাই তোমার জন্য প্রিয়া ” সাথে ২২ টি হরেক রকম কলম। ১১ তম পাতায় লেখা ” শুনেছি আমার অপ্সরীর কেশবতীর চাইতেও লম্বা ঘন কালো কেশ। যখন কেশ গুলি বেখেয়ালি হয়ে যাবে তখন সেগুলোকে পোষ মানাতে কেশবতীর জন্য ” সাথে খোপা করার ১২ টি কাঠি । ১২তম পাতায় লেখা “ভেবেছিলাম তোমায় এইটা দিয়ে প্রপোস করবো। আমার কাছে থাকার চেয়ে তোমার কাছেই থাকুক ” একটি শুকনো গোলাপ আর একটি স্বর্নের রিং। ডাইরি শেষ।
কিন্তু বক্সে আরও অনেক কিছুই বাকি মনে হচ্ছে। একে একে খোলতে লাগলাম। প্রথমে দুটো শাড়ি। একটি লাল, আরেকটি নীল। শাড়িতে পিন দিয়ে আটকানো একটা কাগজে লেখা ” শুনেছি তোমার পছন্দ লাল, আর আমার নীল। তাই ২টিই দিলাম। কখনো যদি মনে হয় পড়িও। আশা করে ঐ পরিটিকে আরও অপ্সরী লাগবে ” এরপর পেলাম একটি চাদর, কাগজে লেখা” শীত অনুভব হলে গায়ে জড়িয়ে নিও কোন কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে। ভেবে নিবো আমিও আছি তোমার পাশে। ” তারপর পেলাম ১০ টি ভিন্ন রঙের হিজাব উড়না। কাগজে লেখা ” হিজাবে বারবার দেখেও বিরক্ত হয়নি জানো! বারবার তোমার প্রেমে পড়েছি ” তারপর পেলাম একটি পানির বোতল। কাগজে লেখা “যতবারই দেখেছি তোমায়, সবসময় তোমার সাথে একটি পানির বোতল দেখেছি। পানি খাওয়া স্বাস্থের জন্য ভালো। তাই তোমার জন্য “।
এরপর পেলাম একটি ভ্রমণ করার জন্য গাইড বই। কাগজে লেখা “আচ্ছা! তোমার নাকি খুব ঘুরতে যাবার সখ? অজানা জায়গায় যেতে খুব বেশি পছন্দ করো? যদি কখনো কোথাও হারিয়ে যাও গন্তব্য খোঁজে নিও। ” তারপর পেলাম একটা ছোট পার্শ ব্যাগ। যেটার গায়ে লেখা ” যদি হারিয়ে যাও ফিরে আসতেতো টাকার প্রয়োজন। তাই সংগে রেখো। ও হ্যা, টাকা রাখতে ভুলনা যেন ” বক্সের ভেতর সব দেখা শেষ। আর কিছুই নেই একটা বেবি ফ্রগ আর একটা কাগজ ছাড়া। কাগজে যা লেখা ছিল তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
কাগজটাতে লেখা ছিল ” সবতো তোমাকেই দিলাম। এখন নাহয় আরেকজন বিশেষ কাউকে দেই! গত পরশু তুমি হঠ্যাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে। হসপিটালে একদিন কত ঝামেলাইনা পোহাতে হল। একটা বারও রিপোর্ট দেখোনি। তুমি বোকা প্রেশার কমে গেছে কথাটা বিশ্বাস করে নিলে। রিপোর্টে কি লেখা ছিল জানো! তুমি মা হতে চলেছো আমার ভালবাসা। তাই এই ফ্রকটা আমাদের ভালবাসার ফসলের জন্য। আর কত বাইরে দাড়িয়ে রাখবে! নিশ্চয়ই আবার ঘুমিয়ে গিয়েছিলে ঘুম কাতুরে বাবুটা? দরজা খুলে দাও, আমার বাচ্চার মাকে একটু প্রানভরে দেখি। ঠিক যেমন বিয়ের আগে দূর থেকে দেখতাম।
ইতি তোমার কিপটা স্বামি “