পাত্রপক্ষের সামনে আমি বসে আছি। পাত্রের মা আমাকে দেখে ই বললেন,
— মাশাআল্লাহ, একদম বাবার মত হয়েছে মেয়ে।
আসলে উনারা আমাদের দূর-আত্মীয়। দেশের বাইরে থাকেন সম্পর্কে ফুপু হন। অনেক বছর পর এসেছেন ছেলেকে বিয়ে দিবেন বলে। কিন্তু যখনি উনি বললেন আমি আমার বাবার মত হয়েছি। তখন ই বাবা বললেন, এই বিয়েতে বাবার মত নেই।
এই কথা শোনার পর ফুপু কিছুটা অবাক হলেন। কারণ জানতে চাইলে বাবা বলেন, তিনি কৈফয়ত দিতে অভ্যস্ত নন। ছেলেপক্ষ একপ্রকার অপমানিত বোধ করে বিদায় নিলেন। আমি ঠিক বুঝলাম না কোন কারণে বাবা এমন করলে। গতকাল পর্যন্ত এমনকি মেহমান আসার আগ অব্দি বাবা কত খুশি ছিলেন। হঠাৎ করে কি কারণে মুখের উপর না করে দিলেন। সে যাই হোক, আমার জন্য তো ভালো ই হয়েছে তাতে ই খুশি। রাতে খাবার টেবিল যেন নিরব নিস্তব্ধ। বাবা কিছু বলছেন না আর মাও কেমন জানি চুপচাপ খেয়ে বাকি কাজ গুলো করে যাচ্ছেন। কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করতে পারিনি।
খাওয়া শেষ করে একটু সময় পর ঘুমিয়ে পরলাম। কিন্তু হঠাৎ পানির পিপাসা পেল। জগে পানি না থাকায় রুম থেকে বেড়িয়ে পানির বোতল আনতে গেলাম। গিয়ে দেখি বাবা মা’য়ের রুমের দরজা খোলা ভিতরে কেউ নেই। পুরো বাসা খোঁজলাম কোথাও নেই। চিন্তায় পরে গেলাম এত রাতে কোথায় গেলেন।
ফোন দিলাম বাবার মোবাইলে, মোবাইলটা রুমে ই রাখা। দারোয়ান চাচাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে মনে হল একবার ছাদে গিয়ে দেখে আসি। আমি আবার একটু ভীতু টাইপের রাতে ছাদে যেতে ভয় লাগছে ছোট বোন ইরাকে নিলাম সাথে। ছাদের দরজা পেরুবার আগে ই দেখি বাবা মা সেখানে। একটু নিশ্চিন্ত হলাম। চলে আসছিলাম কিন্তু মায়ের কান্নার আওয়াজে আবার থেমে গেলাম। মা কেঁদে কেঁদে বলছিল,
— কেন এমন করলে? এত ভালো একটা প্রস্তাব সবসময় পাওয়া যায় নাকি।
বাবা বললেন, তোমার মনে আছে আমি যখন তোমাকে বাবার কথাতে বিয়ে করেছিলাম তোমাকে আমার একটুও পছন্দ হয়নি। শুধু বাবার ভয়ে বিয়ে এখনকার মত এত আধুনিক চিন্তাধারা ছিল না নিজের পছন্দ মত বিয়ে করা বা বাবার সামনে বাবাকে এমন বিষয় দ্বিমত পোষন করা। শুধু বাবা একটা কথা ই বলেছিলেন, মানুষ চেন। কিন্তু তোমার ব্যবহার, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান, সেবা খুব বেশি দিন লাগে নি আমার তোমাকে ভালোবাসতে। তুমি যখন চোখে কাজল দিতে গাঢ় করে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। সে চোখে ই হয়ত আমার প্রথম ভালো লাগা শুরু।
যখন ছোট ভাই রিয়াদের বিয়েতে তুমি সবুজ রঙ এর একটা শাড়ি পছন্দ করেছিলে কিন্তু তোমাকে এই রঙে মানাবে না বলে বড় ভাবি একপ্রকার কটাক্ষ করেছিল তখন আমার পা থেকে মাথা অব্দি রাগে ফেটে পরছিল শুধু বড় বলে কিছু বলতে পারিনি। তোমার সেই লুকানো চোখের জল কিন্তু আমি দেখেছি। কিচ্ছু বলতে পারিনি। মনে মনে নিজেকে গালি দিচ্ছিলাম।
— এতটা খেয়াল করেছিলে !
করব না ! আবার যখন আমাদের প্রথম সন্তান বীথি ঘরে আসে শিমু তোমার ননদ মানে আমার বোন তোমার কোলে বীথিকে দেখে বলেছিল অমবস্যার কোলে যেন পূর্ণমার চাঁদ মনে হচ্ছে। তখন আর সেই রাগ টা সামলাতে পারিনি। নিজের বোন বলে তোয়াক্কা করিনি।
আগে যা বলেছে বলেছে, এখন আমার সন্তানের মাকে যদি এভাবে কেউ বলে আমি ছেড়ে কথা বলব না। আর আজও তাই হয়েছে। মানুষকে চেহারায় বা বাহ্যিক দিক দিয়ে বিচার কেন করব। আর সেই শিক্ষা টা আমি বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। মানুষকে তার আপন রুপে ভালোবাসতে হবে আর তাতে ই তুমি সত্যিকার ভালোবাসার সন্ধান পাবে। আজ তোমাকে এরকম ভাবে আঘাত এর কারণে আমি এমন করেছি। আমি জানি তোমার খারাপ লেগেছে।
— না, আমার খারাপ লাগেনি। আমার মেয়ে তো আমার মত বাইরের সবার কাছে ফেলনা নয়..! হ্যা, আর আমার স্ত্রী আমার কাছে ফেলনা নয় তারও দাম আছে। তাই
বাবা মায়ের এসব কথা শুনে আমি আমার অজান্তে কেঁদে যাচ্ছিলাম। কতটা ভরসা কতটা বিশ্বাস আর কতটা ভালোবাসা থাকলে মানুষ এরকম করতে পারে। সেটা আমি নিজ চোখে দেখতে পেলাম। ভালোবাসা ক্ষণিকের নয় অসীম যা সময়ে সময়ে বাড়তে থাকে। শেষ বয়সে শেষ নিশ্বাস টুকুও যেন এর নড়চর না করে।