রুমকী বুড়ো মহিলাকে আদুরে ধমক দিয়ে বলে,
“গত শুক্রবার আসেন নি কেন? আমি অপেক্ষা করেছিলাম।”
বুড়ি অপরাধীর মত মুখ নীচু করে, একটু হেসে বলেন,
“জানি গো মা ..
তুমি বসে থাকবে। কিন্তু কি করব, এক ঘরে মানুষ মরছে। আদর করে খেতে বললে, না কেমনে করি। তুমি কও?”
“ঠিক আছে, আর কখনও যেন না হয়। আমিও তো কষ্ট করে রাঁধি, অপেক্ষা করি..”
“তাইতো সবার দাওয়াত ফিরিয়ে দিই। আমাকে খাওবার জন্যে তো তুমি আছোই।”
“হুম ..
মনে রাখলে হবে।” রুমকী বলে।
তারপর রুমকী ভাত বেড়ে দেয়। হাত ধোয়ার পানি, ভাত তরকারি সব সাজিয়ে দেয় তার সামনে।
মহিলা কোনদিন টেবিলে বসে খায়না, সোফাতেও বসে খেতে বললে রাজি হয়না। সমস্যা কি জানতে চাইলে বলেন,
“আরাম করে খেতে পারিনা, লজ্জাও লাগে, কেউ এসে দেখলে!”
রুমকী এবারও ধমক দেয়,
“যার ইচ্ছা দেখুক, আপনি অবশ্যই টেবিলে বসে খাবেন।”
বুড়ি তবুও রাজি হয়না। তাকে সোফার রুমে তক্তা দিয়ে বসাতে হয়। রুমকী ফ্যানটা চালু করে দেয়, সে তৃপ্তি করে খায়। খাবার শেষ হলে রুমকীর কথা মতো সোফার উপর শুয়ে দেড় দু’ঘন্টা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে, কখনো ঘুমিয়ে পড়ে ।
রোদ কমলে চলে যাবার জন্য থলে নিতে গেলে, রুমকী তার শ্বাশুড়ী না জানে মত এক পোয়া, কখনো আধা কেজি চাল থলেতে ঢেলে দেয়। বুড়ি খুশি হয়ে দোয়া করতে করতে চলে যায়।
শ্বাশুড়ীকে না জানিয়ে দেয়ার কারণ, তিনি মনে করেন, যাকে ভাত খাওয়ায় তাকে আবার চাল দিলে ঘরের লক্ষী বা ভাগ্য সব চলে যাবে।
কিন্তু রুমকী তা বিশ্বাস করেনা। তার মতে দান করলে ভাগ্য যায়না বরং আসে, বাড়বে। শুধু ঐ বুড়ি বলে নয়, রুমকী কাউকেই খালি হাতে বা ক্ষুধার্ত ফেরত দিতে চায়না; যদি তার ডেকচিতে বা অন্য কোন খাবার পর্যাপ্ত জমা থাকে।
এখানে রুমকী একটা ঘরের বউ আর বুড়ো মহিলাটি ভিক্ষা করে খায়। রুমকী প্রায় গত তিন বছর ধরে এই মহিলাকে সপ্তাহে একবেলা খাওয়ায়। মহিলা প্রতি শুক্রবার পাড়া (ভিক্ষা) করতে আসেন এই গ্রামে। তো ঐদিনই রুমকী’র ঘরে তার দাওয়াত।
গত রমজানে রুমকী তাকে পাঁচ’শ টাকার একটা নোট দেয়। বুড়ি হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকেন। তারপর কেঁদে ফেলেন।
“কাঁদছেন কেন চাচী?” রুমকী জানতে চায়।
“তুমি আমাকে এত্তগুলা টাকা দিলে! আজ পর্যন্ত কেউ দেয়নি। একমাত্র মেয়ের ঘরের যে নাতিরে পালে পুষে বড় করছি , বাসের কন্ডাকটরি করে, মাস শেষে সেও দেয়নি কখনো।”
“আপনার জন্য জামা কিনব ভাবছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম, টাকা হয়তো বেশী কাজে লাগবে, তাই।”
“ভালো করছো মা। অনেকে নতুন পুরান কাপড় দেয়। এখন যাকাতের সময় তো। আর ফকিরদের কেউ পঞ্চাশ টাকার বেশী দেয়না।”
“কাঁদিয়েন না, চাচী। শুধু আমার ছোট বাচ্চা গুলোর জন্য দোয়া করিয়েন।”
“তা তো প্রতি নামাজে করি। তোমার মত আদর সম্মান ভালবাসা এই জীবনে কেউ দেয় নাই ।”
এক শুক্রবার রুমকী কি মনে করে তাকে এক’শ টাকা আর একটি লাক্স সাবান দেয়। খুব খুশি হয় বুড়ি। মাঝে মাঝেই রুমকী এমনই এটা সেটা দেয় তাকে।
তারপর থেকে এক,দুই শুক্রবার তিনি আসেন না। রুমকীর চিন্তা হয়।
অসুস্থ হয়ে পড়েন নি তো?
তার বাড়ির এক জোয়ান মহিলা আসে মাঝে মধ্যে। তারও দেখা নেই খবর নেয়ার জন্য। একদিন ঐ মহিলার আওয়াজ শুনে রুমকী দৌড় দিয়ে যায়।
“চাচীটা আসেন না কেন বলতে পারো?” চিন্তিত রুমকী তাকে জিজ্ঞেস করে।
“সে তো নাই। বার দিন হল মারা গেছে, অনেক জ্বর হয়েছিল। তিনদিন কষ্ট পেয়ে মরে গেছে বুড়ি।”
“কি বলছ! এতদিন আসো নাই কেন খবরটা দিতে? আমি কিছু মানুষ খাইয়ে দিতাম..”
“পেটের ধান্দায় একেক জায়গায় ভিক মাগি..
সময় কই?”
“তারপর বলো, তার দাফন কাফন কেমনে করল? টাকা কে দিয়েছে?”
“বুড়ির টাকা ছিলো, বের করে দিছে। আর একটা নয়া লাক্স সাবানও দিয়ে গেছে। ঐটা দিয়ে গোসল দিতে বলছে, মরনের আগে।”
রুমকীর মনটা কেমন করে উঠে। তার দেয়া সাবানটাই কি তাহলে শেষ গোসলে লাগলো?
“তুমি কি আগামী শুক্রবার কয়েকজন নিয়ে এখানে খেতে আসতে পারবে ?” রুমকী জানতে চায়।
“কেন পারবনা, ক’জন আসব?”
“কত জন পারবে ?”
“দশ বার জন আনলে হবে?”
“পারলে পনেরো জন এসো।”
রুমকী ভাত খেতে বসে মুখে নিয়ে চিবুতে থাকে। তার গলা দিয়ে ভাত ঢুকতে চায়না। অনাত্মীয় ঐ বুড়ির জন্য তার মন কাঁদতে থাকে। ভাতের প্লেটে ক’ফোটা চোখের জলও গড়িয়ে পড়ে ।
এখনো প্রতি শুক্রবার দুপুরে রুমকী কান পেতে থাকে। মনে হয় এখুনি বুড়ি চাচীটা এসে আস্তে দরজায় টোকা দিয়ে বলবেন,
“মা, অ মা, আছো?”
০৮.০৪.১৭