:- এই শুনো! আমাদের নিচতলায় কিছু ব্যাচেলার সাবলেট নিয়েছে। এদের মধ্যে ছাগলের মতো দেখতে কালো একটা ছেলে আছে, আবুল নাকি টাবুল যেন নাম, চরম পর্যায়ের বেয়াদব ও উশৃঙখল। আমার একদম অপছন্দ। মাসুমকে বলে দাও ছেলেটিকে যেন চলে যেতে বলে।
মাশুক সাহেব গম্ভীর অথচ হাসিখুশি সাদামনের একজন কর্মব্যস্ত মানুষ। যেকারো মুখের কথায় বিচলিত হওয়ার মত মানুষের উনি না। পরিস্থিতি বিবেচনা ও গুরুত্বের তারতম্য উনি ভালো করেই করতে জানেন। উনি আন্দাজ করতে পেরেছেন যে ছেলেটি হয়তো উনার স্ত্রী ফরিদা বেগমের কোনো অর্ডার অমান্য করেছে, বা অসাবধানতা বশত তাকে গুরুত্ব কম দিয়েছে তাই ছেলেটির প্রতি উনি চটেছেন। মাশুক সাহেব খবরের কাগজ থেকে চোখ ফিরিয়ে ‘ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন’ ভান করে ফরিদা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন:- আমি এক্ষুনি মাসুমের সাথে এ ব্যপারে আলাপ করছি।
‘মাসুম’ মাশুক সাহেবের ছোটভাই। বাসা ভাড়া সহ পুরো ছয়তলা বিল্ডিং এর সবকিছু দেখভাল মাসুমই করে, সে দুতলায় তার পরিবার নিয়ে থাকে। মাসুমের বাসায় এই মহাগুরুত্বপুর্ন বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতে যাচ্ছে বলে বাসা থেকে নিচে নামলেন মাসুম সাহেব। কিন্তু উনি ছোটভাই মাসুমের বাসায় যাবেন না। উনি জানেন এটা নিয়ে তার সাথে কথা বলাটা হবে খুবই নিম্নমানের কাজের মধ্যে একটা।
তবু তিনি বাসা থেকে নামলেন দু’টো উদ্দেশ্যে। সকাল থেকে একটা সিগারেটও উনি স্পর্শ করতে পারেন নি। ছুটির দিনগুলোতে উনার এই সমস্যাটা হয়। নিচে গিয়ে টঙে বসে দুইটা সিগারেট ওয়ান বাই ওয়ান টানবেন। উনার ছোটভাই মাসুম নিশ্চয় উদ্ভট ও অসামাজিক কোনো ছেলেপুলেকে বাসা ভাড়া দেবেন না, তবুও তাদের সাথে দেখা করে ভালো করে জানাশুনা হওয়া প্রয়োজন।
নিচে নেমে প্রথমই ব্যাচেলার ফ্ল্যাটে নক করলেন মাশুক সাহেব। দরজা খুললো রনি। সালাম দিয়ে ঘরে আসতে বললো সে। ফ্লোরে পাতা অগোছালো বিছানায় বসে একজন একজন ইউনিভার্সিটির প্রজেক্ট তৈরি করছে, চেহারাটা বাদামি ও হ্যান্ডসাম। মাশুক সাহেবের ধারণা অনুযায়ী সে’ই ‘আবুল নাকি টাবুল’। তার পাশেই বসে আরেকজন সস মাখিয়ে ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাচ্ছে। পাশের রুমে একজন শর্টস পরে হাতে কারেন্ট এফেয়ার্স নিয়ে শুয়ে শুয়ে পড়ছে। ওয়াশরুম থেকে গলাফাটা গানের শব্দ আসছে। আরেজন চেয়ারে বসে পা নাচিয়ে আরাম করে সিগারেট খাচ্ছে আর হেডফোনে গান শুনছে। মাশুক সাহেবকে দেখা মাত্র দাঁড়িয়ে প্রায় শেষ হয়ে আসা সিগারেট টা বুজিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলো। মাশুক সাহেব ফ্লোরে পাতা একটা বিছানায় পা বিছিয়ে বসে কারো কাছে সিগারেট থাকলে উনাকে এক শলা দিতে বললেন। পাপেল বললো – “ডার্বি আছে স্যার।”
মাশুক সাহেব খুব আরাম করে সিগারেট জ্বালালেন। আর বলতে লাগলেন:- “আমাদের এই পুরো বাড়িটাতে আমি আশ্রয়, নিরাপত্তা, ভালোবাসা, মোহ, ঐশ্বর্য ও আধুনিকতা সবই পাই কিন্তু একটা জিনিস এতোদিন আমার প্রাপ্তির বাহিরে ছিলো। আমার উদ্ভট – উশৃঙখল চির চঞ্চল মেস লাইফের সেই অগোছালো জিবন। আজ তা উপলব্ধি করতে পারছি। আমার ছাত্রজীবনও কেটেছে মেস বাসায়। খাওয়া-দাওয়া, গোসল, ঘুম, পড়াশোনা কোনোকিছুরই কোনো নিয়ম ছিলোনা। খুব মিস করি সেই দিনগুলোকে।”
তারপর মাশুক সাহেব উনার মেস জীবনের কিছু মজার ঘটনা শেয়ার করলেন। রুমমেটদের গল্প করলেন, এখন কার সাথে যোগাযোগ আছে, কে কোথায় আছে সব গল্প করলেন। গল্প করতে করতে দুপুর হয়ে গেছে। বাসা থেকে হেনা’র মা ফরিদা বেগমের ফোন পেয়ে চেতনা ফিরলো যেন। উঠে আসার সময় সবাইকে বললেন- ” আজ থেকে তোমরা আমার বন্ধু। আমি প্রায়ই এখানে আসবো। তোমাদের সাথে গল্প করবো।”
এদিন রাতেই মাশুক সাহেব অফিসার্স ক্লাব থেকে রিক্সায় করে ফেরার সময় বাড়ির সামনে লেগুনার ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে গিয়ে বৃষ্টিতে জমা পানির নিচে থাকা ভাঙা কাঁচের বোতলে লেগে ডান হাতের টেন্ডন সহ দুইটা রগ কেটে যায় এবং মাথায়ও ভীষণ আঘাত পায়।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো, ততক্ষণে রক্তক্ষরণে মাশুক সাহেব নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন। বাসার সবাই হাসপাতালে আসার আগে ব্যাচেলার ফ্ল্যাটের সবাই OT’র সামনে উপস্থিত। সার্জন যখন তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে বললেন “ইমার্জেন্সি রক্ত জোগার করুন, বি(-)।” কালো করে হ্যান্ডসাম ছেলেটা বুক শক্ত করে এগিয়ে এসে বললো-“আমার ব্লাড বি(-), যতটুকু লাগে নিন।” প্যাথলজিস্ট জিজ্ঞেস করলো “আপনার নাম কী? রুগী আপনার কী হয়?” ছেলেটি বললো- আমি বাবুল, রোগী আমার ভাই হয়।
ভরসা ও কৃতজ্ঞতায় ফরিদা বেগমের চোখে পানি চলে আসলো। অথচ এই ছেলেটার নামে মিথ্যে অভিযোগ করে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো শুধুমাত্র তাকে দেখে সালাম না দেয়ায়। ভাবতেই লজ্জা হচ্ছে তার। রক্ত দেয়া শেষে মাসুমকে দিয়ে নিচ থেকে একটা ডাব আনিয়ে ডাবের পাইপটা বাবুলের মুখের সামনে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে ফরিদা বেগম বাবুলকে বলছেন “ডাবটা পান করো ভাই।” বাবুল ভরপুর তৃষ্ণা নিয়ে ডাব পান করছে। ফরিদা বেগম মন ভরে সেই দৃশ্য দেখছে।