ঝড়

ঝড়

ধূলির শেষ পাখিটার উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে ভগ্নদেহধারী কঙ্কালসার শম্ভুনাথ কাঁচা বাঁশের নতুন বেড়ার ধারে বেলুম্বা বৃক্ষের নীচে বিষণ্ণ বদনে বসে পড়ে। অন্ধকারে ডুবে যায় সোনায় মোড়ানো দিন! এলোমেলো কত স্মৃতির বাতাস ছুটে আসে ক্লান্ত মনের ভাঙ্গা জানালায়। ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিল সে। একবার শক্তিশালী কৃষ্ণনগর ফুটবল একাদশকে একাই পাঁচটা গোল দিয়ে ৫-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে বাঁকা ফুটবল একাদশকে ফাইনালে জিতিয়ে দিয়েছিল। সেই দিনটাকে সে কোনোদিনও ভুলতে পারেনি।

সবার মুখেই সেদিন কেবল শম্ভুর প্রশংসা। মনে পড়ে, বর্ষায় চাতরার জলভরা বিলে মাছ ধরার সেই জ্বলজ্বলে স্মৃতি, একবার তো দা দিয়েই একটা বিশাল বোয়াল মাছ কুপিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল সে। হা-ডু-ডু খেলায় তাকে কেউ ধরেই রাখতে পারেনি কোনোদিন। টানাটানির সংসারে বাবা হরিহর চক্রবর্তী প্রায়ই ছেলে শম্ভুনাথকে বকাঝকা করতেন ছেলের ছন্নছাড়া স্বভাবের জন্যে। সবার জীবনেই কিছু না কিছু সুযোগ একবার এসেই যায়। হঠাৎ তার এক ফুটবলভক্ত অফিসার তাকে দরখাস্ত করতে বললে শম্ভুনাথের রেভিনিউ সেকশানে সামান্য একটা চাকরি জুটে যায়। পোস্টিং হয় নিজ এলাকাতেই। বাবা সেদিন ময়রার দোকান থেকে বড় বড় রসের জিলেপি কিনে নিজ হাতে তাকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। তারপর গ্রামে তার কত সম্মান! চাকরির দু’বছরের মাথায় দূরগ্রাম থেকে বাবা তার জন্যে ছোট্ট পার্বতীকে নিয়ে এলেন। মেয়েটি তখনো ঘরকন্যার কিছুই বোঝে না। গাছের ডালে আর পুকুরের জলে বালিকাবধূর বেলা বয়ে যায়। রাতে ঘুমায় ঠাকুরমার কাছে। সেসব মনে হয় যেন দু’হাত দূরের দিন। একসময় পার্বতীর কোল জুড়ে আসে মেয়ে চামেলি। এর মধ্যে চাকরির টাকা জমিয়ে জমিয়ে বাড়ির পিছনে বেশকিছু জমি কিনে ফেলে সে। সেখানে চাষবাস আর চাকরির টাকায় মোটামুটি ভালোই চলতে থাকে সুখের সংসার।

সময় কত দ্রুত সরে যায় জীবন থেকে! জাগতিক অমোঘ নিয়মে একে একে তার ঠাকুমা, বাবা, মা, একমাত্র দিদি সুলেখা– সবাই তাকে ফেলে ক্ষণিক অতিথির মতো পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে যায় চামেলি। আজ তার শ্বশুর বাড়ি হয়েছে, স্বামী-সংসার হয়েছে। কোলে সন্তান এসেছে। সোনার নাতনী। চাঁদের কণা নাকি! অভাবে কিছুই কিনতে পারেনি বলে সপ্তাহ পার হলেও লজ্জায় খালি হাতে তাকে দেখতে যেতে পারেনি। নীল আকাশ যেমন কখনো কখনো অন্ধকারে ছেয়ে যায়, ভরা বসন্ত যেমন কখনো কখনো নিশ্চিহ্ন হয় নিদারুণ ঘূর্ণিঝড়ে, তেমনি নিয়তিও নির্মম খেলা খেললো শম্ভুনাথের ভাগ্যলিপি নিয়ে। রিটায়ারমেন্টের সমস্ত টাকা দিয়ে বন্ধু কৈলাস মিত্রের পরামর্শে বাড়ির পিছনে কবলা সম্পত্তিতে বিশাল মুরগি ফার্ম গড়ে তোলে। সমস্ত বিশ্বাস, অহংকারকে মিথ্যা প্রমাণ করে টাইটানিক যেমন প্রথম ভ্রমণেই ডুবে যায়; একইভাবে শম্ভুনাথের সমস্ত স্বপ্নও হাবুডুবু খেতে খেতে অবশেষে দুর্ভাগ্যের সলিলে সমাধিস্ত হয়।

মুরগির ফার্মে কেবল উড়তে থাকে প্রাণহীন আশার নিথর পালক– বাতাসে ভাসা ছেঁড়া ছেঁড়া শিমুল তুলার মতো! দ্বিতীয় স্বপ্নজাল বোনা আর শেষ হয় না। নোটিশ আসে। অর্পিত সম্পত্তি ছাড়তে হবে। একেই বলে হয়তো, বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। এতদিনের সমস্ত দখল, দলিল সবকিছুকেই অস্বীকার করে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সদলবলে এসে কোর্টের পরওয়ানা দেখিয়ে আজ তার ফার্মের কাঠামো ভেঙে ফেলেছে। পুঁতে দিয়েছে সরকারি লাল নিশানা। জমি ছাড়তে হলো হতাশায় নির্বাক শম্ভুনাথকে। এই অফিসেরই এমএলএসএস হিসেবে সে অবসরে গিয়েছিল। আকাশে সপ্তর্ষি তখন আরো স্পষ্ট হয়েছে। পিছনে স্ত্রী পার্বতী কখন যে এসে দাঁড়িয়েছে, একটুও বুঝতে পারেনি শম্ভুনাথ। হঠাৎ দুই ফোঁটা জল তার গায়ে পড়তেই পিছনে তাকায় সে। স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে চমকে ওঠে শম্ভুনাথ– তুমি এই শরীরে আবার বাইরে এলে কেন?

– তুমি ঘরে আসছো না, তাই আমাকে বাইরে আসতে হলো।

– পার্বতী, কী হবে এবার? দু’জনে কি না খেয়েই মরবো?

– এত ভাবছো কেন? ভগবান এক ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবেন, তুমি ঘরে চলো।

– ভগবান আমাদের কবে দেখলো, বলো তো?

– হঠাৎ কি তুমি সব বিশ্বাস হারিয়ে ফেললে? ঘরে চলো।

– পার্বতী আর কোনো কথা না বলে স্বামীর বাঁ হাতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে খড়ের চালওয়ালা মাটির ভাঙা ঘরে প্রবেশ করে। রাতের জন্যে আজ কিছুই রান্না হয়নি। স্ত্রী পার্বতী দীর্ঘদিন নানা জটিল রোগে শয্যাশায়ী হওয়ায় দিনে দু’বার শম্ভুনাথই রান্না করে আর তিনবেলা কোনোরকমে দু’জনে খেয়ে নেয়। আজ রাতে স্ত্রীকে কেবল এক গ্লাস জল দিয়ে আর নিজে এক গ্লাস খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে দু’জন। ঘুম আসে না। পৈত্রিক এই ঘরটিতে কতদিন কত গল্পে, কত গানে, কত কথায় সময় গিয়েছে– ভাবতে থাকে শম্ভুনাথ। আজ সেই ঘরে শবের স্তব্ধতা!

ভোরের বাতাসে যখন দু’চোখের পাতা একটু বুজে আসছে, তখনই হঠাৎ “বাবা” ডাক শুনে চমকে ওঠে শম্ভুনাথ। চোখ মেলে অস্পষ্ট আলোয় দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়ে চামেলি। ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় আসে শম্ভুনাথ। মেয়ের কাছ থেকে নাতনীকে কোলে তুলে নেয়।

– কী হয়েছে রে, মা? এত ভোরে তুই? এলি কিভাবে? জামাই আসেনি? কাঁদছিস কেন?

নিমেষহীন দুর্বল চোখে শম্ভুনাথ দেখতে থাকে ফুলশিশুকে। চামেলি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে ওঠে– দু’সপ্তাহ হয়ে গেল, তোমরা তোমাদের নাতনীকে একবারও দেখতে গেলে না। ওরা বলছে, তোমাদের নাতনীকে যদি তোমরা এক ভরি ওজনের সোনার হার না দাও, তাহলে আর কখনোই যেন আমি শ্বশুরবাড়ি না যাই; গেলে আমাকে মেরে গাছে ঝুলিয়ে রাখবে।

হতভম্ব শম্ভুনাথ রাতভর কিছুই না খাওয়া ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখের দিকে বিষণ্ণভাবে চেয়ে থাকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত