লেনা-দেনা

লেনা-দেনা

বদরুল ছুটছে৷ খুব জোরে৷ ধীরে ধীরে দৌড়ের গতি বাড়ছে বৈ কমছে না৷ নাম তার বদরুল হলেও হাতে গোনা কজন ছাড়া সবাই বদুই ডাকে৷ বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে বদু এবার থামলো৷ একটু শ্বাস নিচ্ছে বুঝি৷ পাশ থেকে ডাকলেন জলিল মিয়া৷

– কিরে বদু অমন ছুটতাছোস যে?

– কথা কওনের সময় নাই চাচা, বলতে বলতে আবার দে ছুট৷ গন্তব্য এখনো আধ মাইলের ফারাক৷ বদু বাজারে পৌঁছতেই ছুটে আসে লিটন৷ সে বদুর ছোট চাচা৷

– কিরে বদু? কী ঘটনা৷

– কিছু না, তয় অহন বেশি কথা কওনের সময় নাই৷ আব্বায় কইছে তোমারে একটা অটো লইয়া বারিত যাইতে৷ চাচির অবস্থা ভালা না৷ বদুর ছোটাছোটি দেখা গেলো এবার লিটনের মাঝে৷

বেশ কয়েকটা অটো দাড়িয়ে আছে এখানটায়৷ মফস্বলে মানুষের আনাগোনা ক্ষেত্র বিশেষ ভারীই হয়ে থাকে৷ বাজার তাই মফস্বলে সবার মিলনকেন্দ্র৷ সময় অসময়ে রিকশা, ভ্যানের খোঁজেও আসে অনেকে৷

ওদের বাড়িটা বেশ সুনসান৷ আর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ৷ বাড়ির চতুর্পাশে গাছের সারি৷ একপাশে তিনটে ঘর৷ অন্যপাশে নতুন ঘরের কাজ চলছে৷ মাঝে বড় সড় একখানা উঠোন৷ একটা লাল গাই উঠোনের একধারে বাঁধা৷ ওদিকে মুরগীর খোপ।

বদু আর লিটন একটা অটো নিয়ে ফিরেছে৷ দুজনই ছুটে গেল মাঝের ঘরটার দিকে৷ বদুর মেজো চাচার কামরা এটা৷ বছর দুয়েক হলো বিয়ে করেছে সে৷ বউটা বেশ ভাল৷ কাজে কর্মেও পাকা৷ বউ হয়ে এ বাড়িতে আসার পর হতে এ-যাবৎ বেশ সুনাম কুড়িয়েছে৷ কিন্তু এই ক’মাস হলো একটু নেতিয়ে পরেছে আরকি৷ বহুদিন তো হলো ডাক্তার, হাসপাতাল, ফার্মেসি চলছেই৷ নতুন শিশুর আগমনী বার্তা৷ আজ আবার ব্যথা উঠেছে৷ আর বোধহয় সময় নেই৷ মুরুব্বিদের কথায় তাই হাসপাতালে চলেছে রোগী৷ একটা সময় ছিল যখন বেশিরভাগ শিশুই দাদী নানীর হাতে পৃথিবীর প্রথম আলো দেখতো৷ আস্তে আস্তে উন্নয়ন, আধুনিকতা, আর বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় সব পাল্টে গেছে৷ একে একে সব এখন কাঁটা ছেড়ার ব্যাপার৷ যেনো সময়ের পূর্বেই এক রকম টানা হেঁচড়া লেগে যায়৷ আর এর পেছনে রয়ে গেছে ছুরি কাঁচি ওয়ালাদের দুটো পয়সা আমদানির ভাবনা৷

ধীরে ধীরে বদুর চাচির গোঙানির স্বর নেমে আসছে৷ দুজন দুদিক থেকে আটোসাটো ভঙ্গিতে কোনোমতে নিয়ে বসালো অটোটায়৷ আগ পিছ মিলিয়ে আরো বসলো জনা তিনেক৷ একটু একটু করে অটো ছুটে চললো জেলা শহরের দিকে৷

মুরাদগঞ্জ আধুনিক হাসপাতাল। তিন তলা ভবনটার দ্বিতীয় তলায় বদুরা৷ চাচির সিজার হয়েছে৷ এত লম্বা সময় ধরে সন্তান প্রসবের তীব্র যাতনা এখন আর নেই৷ কিন্তু কেবিনের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর চেহারায় হতাশার ছাপটাই ভেসে আছে মনে হলো৷ ডাক্তার মহিলাটি এসেছিলেন একটু আগে৷ বদুর চাচাকে ডেকে নিয়ে গেছেন তিনি— না তিনি বলেননি ‘কনগ্রচুলেশনস্ আপনি বাবা হয়েছেন।’ বরং গলা নামিয়ে বলেছেন ‘স্যরি! বাচ্চাটা বাঁচানো গেলো না!’

সন্তান প্রসবের ধকল পেরিয়ে চাচী এখন অনেকটাই সুস্থ। এর মাঝেই পেরিয়ে গেছে মাস কয়েক ৷ একদিন হঠাৎ শেষ বিকেলে মুরগীগুলোকে খোয়ারে নিতে নিতে বদুর চাচী দেখতে পেলেন, রোমেলার ছোট মেয়েটা— পনের ষোল হবে হয়তো বয়েস—, কেমন যেনো স্ফীতোদর হয়ে উঠেছে৷ আশপাশের লোকেদের নজর এড়ালো না ব্যাপারটা৷ আর এড়ালো না আমাদের চাচীর নজর! একদিন ওকেও নেয়া হয় হাসপাতালে৷ মাঝে কী হল কেউ জানে না৷ তবে প্রচার করা হয় ওর পেটে টিউমার হয়েছিল, তাই হাসপাতালে নেয়া৷ এর কদিন আগে বদুই বলছিল— সে নাকি দেখেছে রোমেলার ছোট মেয়েটাকে, কার সঙ্গে যেনো জড়াজড়ি করে যাচ্ছে ঝোপের আড়ালে৷ এরপর আর কিছু দেখেনি বদু!

পরদিন চাচি গেলেন চেয়ারম্যান বাড়ী৷ ওবাড়ীর বউটা নিঃসন্তান৷ একা একা থাকে৷ পান মুখে গুজে জর্দাটা নেবেন অমনি ও ঘর থেকে ভেসে এলো সদ্যপ্রসূত বাচ্চার কান্না৷

‘কার বাচ্চা গো ও ঘরে!’

বউটা গলা নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো— আরে বুঝলে না! তোমার চাচা… অনেক ট্যকা লাগছে বুঝলা! ঐ যে রোমেলার ছোট মেয়েটা, গ্যঞ্জাম ছিলো না!

শুনতে শুনতে চাচীর সামনে ভেসে উঠলো সেই মেয়েটার মুখ৷ আর কিছু লেনদেনের ভাষা৷ কতগুলো অব্যক্ত সত্য৷ যা জানা যায় না তবে বোঝা যায় ৷ শোনা যায় না অনুভব করা যায়৷

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত