শব্দগুলো ফিরে ফিরে কানে আসছে। এক চাপা শব্দ। থেকে থেকে যা অস্পষ্টতার চাদরে মুড়ে থেকেও অস্পষ্ট থাকছে না। এর উৎস, এর কারণ, এর প্রয়োজনীয়তা– সবটুকুই স্পষ্ট। তবু পাশ ফিরে সেটিকে অগ্রাহ্য করে নিতে চাইছে সাইফ। চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু শোনা যাচ্ছে। রুমের বাতি বন্ধ। তাই দেয়ালঘড়ি থাকলেও তা দেখার উপায় নেই। তবে খুব সম্ভবত রাত আড়াইটা বেজে গিয়েছে। প্রতি রাতে এ সময়েই তো শব্দখানা ভেসে আসে।
শহরের কোলাহলে এ সময়ে বেশ ভাটা নামে। শহরের যে অংশটুকুয় এখনও কিছু ঝোপঝাড়ের জঙ্গল অবশিষ্ট আছে, সেখান থেকে ভেসে আসে ঝিঁ-ঝিঁ পোকার রাতের সঙ্গীতের সুর। অলিগলির পাহারাদারের বাঁশির শব্দও ভেসে আসে কানে। আরো ভেসে আসে কিছু সময় পরপর সাঁই সাঁই করে ছুটে যাওয়া দূরপাল্লার বাস-ট্রাকের শব্দ। তবে সেসব সাইফকে বিব্রত করে না। সে শব্দগুলো চাপা কিংবা অস্পষ্টও নয়।
রুমটা খুব বেশি বড় নয়। একজনের থাকার জন্যেই বেশ পরিমাণ যথেষ্ট। সাইফ একাই থাকে। তার আসবাবপত্রের সংখ্যাও অপ্রচুর। এখানে এসেছে গত তিন দিন আগে। ভাড়াটুকু বেশ অল্পই। তবে ভাড়ার মতোই সুযোগ-সুবিধাগুলোও অল্প। রুমটায় কোনো জানালা নেই। ফ্যান ঘুরছে নিরন্তর। লোডশেডিং হয়নি বলে রক্ষা। কে জানে এটি শহরের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অংশ কি না! আসা পর্যন্ত খুব একটা লোডশেডিং-এর ধকল সামলাতে হয়নি। রাতের বেলাতে তো সেটা একেবারেই আসে না। হয়ত বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তারা রাতের ডিউটিতে থাকে না। এটা হাস্যকর ভাবনা। সাইফও হেসে ওঠে তার এমন হাস্যকর ভাবনাটুকু টের পেয়ে।
তার হাসির সাথে সাথে আরেকটা চাপা হাসির শব্দও ভেসে আসে। এটি আগের অস্পষ্ট শব্দের চেয়ে অনেকটাই স্পষ্ট। তবে সমস্ত শব্দটুকু সাইফকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তার কপাল ঘেমে যায়। সে ব্লাশ করে। চোখের মাঝে অস্বস্তির চাপে পানি জমে যায়।
সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় ক্লান্ত হয়ে ওঠা দেহেও ঘুমটুকু আসে না। কানের ফুটো চেপে ধরে রাখতে রাখতে হাতের আঙ্গুল যেন ব্যথায় অবশ হয়ে ওঠে। শেষমেশ শুনতে হয়। এবং শব্দগুলো যখন থেমে আসে একটা সময়ে, তখন ধীরে ধীরে ঘুম নেমে আসে সাইফের চোখে। গত তিন রাত ধরে তো এমনই হয়ে আসছে।
জানালা না থাকলেও ঘরের উপরের দিকে একটি লম্বা জানালা আছে। একে ভেন্টিলেটর বললেও ভুল হবে না। দেয়ালের অপর পাশে আরেকটি রুম। দু’রুমের মাঝে এই ভেন্টিলেটরসদৃশ জানালা। এখানের শব্দ ওখানে, ওখানের শব্দ এখানে ভেসে আসে। সাইফের রুম থেকে ফ্যানের শব্দ পাশের রুমে যায়, এবং পাশের রুমের যাবতীয় রাত্রিকালীন শব্দ সাইফের রুমে যায়।
এরা নবদম্পতি। সাইফ মেয়েটিকে দেখেছে। সদ্য কৈশোর পেরোনো এক মায়াবী মেয়ে। বোধহয় সে-ই এতক্ষণ সিক্ত আর আদৃত হচ্ছিল। শব্দ ভেসে আসছিল। তৃপ্তিতে হয়ত তাই সে হেসে ওঠেছে।
খুব সম্ভব বেশিদিন এখানে থাকা যাবে না। সাইফ চিন্তায় পড়ে গেল। নির্ঘুম রজনী মানেই দিবাকালীন ঝিমুনি। কী আর করার। অত্যাচারটুকু সয়ে নেয়া লাগবে।
নিঃশ্বাসের প্রবল শব্দ ভেসে আসলো। সাথে ব্যথাতুর আর্তনাদ। খুব সম্ভব একেই শীৎকার বলে। সাইফ সঠিক জানে না। কবিতার বইয়ে পড়েছিল। আর শোনা যাবে না এসব। কানে আঙ্গুল চেপে ধরলো সাইফ। ধরণীকে দ্বিধা হতে বলে সে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলো।
