ঠিক বাউণ্ডুলে না হলেও ভবঘুরে স্বভাবের ছিল তমাল। নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিয়মকে অবজ্ঞা করাতেই ছিল তার যত সুখ। অবজ্ঞার ভেতরে অন্য এক সুখ খোঁজার খেলায় মেতেছিল নিজেকে নিয়ে। অভাব বা অর্থকষ্ট কোনোটাই ছিল না ওদের। তমালের বাবা পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী। তিনি সারাজীবন বিদেশে থেকেছেন চাকরিসূত্রে। দু’তিন বছর পরপর দু’তিন মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসতেন আবার চলে যেতেন ছুটি শেষ হতেই। বাবার অবর্তমানে মা-ই সংসারের সব কিছু দেখ-ভাল করতেন। বাবা যতটা নরম, ঠাণ্ডা প্রকৃতির ছিলেন, মা ঠিক ততটাই কঠিন এবং রাগী প্রকৃতির ছিলেন। বাড়ির বড় ছেলে তাই বাড়তি আদর পেতো আত্মীয়-স্বজন সবার কাছ থেকে।
লেখাপড়াতে বরাবরই ভালো ছিল, তাই ভবঘুরে স্বভাবের হবার পরও তার লেখাপড়া নিয়ে কেউ তেমন একটা দুঃচিন্তা করত না। কারণ সবাই জানত তমাল ঠিকই তার কেরিয়ারটা গুছিয়ে নেবে। সবার বিশ্বাসের মর্যদা রাখে সে। ভর্তি হয় অনার্সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের মতো সাবজেক্টে। রাবিতে ভর্তি হবার পর তার ভবঘুরে স্বভাবটা যেন আরও একটু বেশি প্রশ্রয় পেল।
নতুন বন্ধু নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে অল্প দিনের মধ্যে বন্ধু মহলে বেশ পরিচিত একজন হয়ে ওঠে সে। কোনো বাঁধন, কোনো নিয়ম, কোনো কালেই ভালো লাগেনি তার। একাকী নির্জনতা তার কাছে প্রিয় ছিল। তাই ক্লাস, ক্যাম্পাসের বাইরে অন্য কোনো সম্পর্ক তাকে আকৃষ্ট করেনি। বাঁধা পড়েনি কোনো সম্পর্কের বাঁধনে। কিসের এত উদাসীনতা, কিসের এত হেঁয়ালিপনা কিছুই বুঝতে পারে না সে। এই উদাসীনতা, এই হেঁয়ালিপনা এই ভবঘুরে স্বভাব একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবে ছিল তার নিজের কাছেও! সময়ের কাঁটা তার নিজ কক্ষপথে চলে। অনার্সের রেজাল্ট হয়। তমাল অনার্স পাস করে।
অনার্স পাসের পর হঠাৎ-ই পড়ালেখা ছেড়ে দেয়, সবার অনুরোধ, উপদেশ উপেক্ষা করে। তার বোন তুলি ভাইয়ের পেছনে জোঁকের মতো লেগে থেকে একই কথা বারবার বলতে থাকে, ‘ভাইয়া এমএসসি-টা কম্পিলিট করো।’ কারো কথায় কানে তোলে না সে। কেনো তার এই উদাসীনতা, বোনের এই প্রশ্নের উত্তরে খানিকটা হেসে তমাল বলেছিল, ‘শোন তুলি, জীবনে পুরোপুরি পূর্ণতা পেতে নেই। কিছুটা অপূর্ণতা থাকা ভালো। অপূর্ণতা না থাকলে জীবনের সব মানে অর্থহীন।’
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তপস্যা করলেও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। তেমনি দিন যত যেতে থাকে তমালের এই উদাসীনতা সবার কাছে উত্তরহীন একটা বড় প্রশ্ন হয়ে ঝুলতে থাকে। কিন্তু সে বেশ আছে তার জীবন নিয়ে। কারো কাছে নেই তার দায়বদ্ধতা নেই জবাবদিহিতা। তবু জীবনের প্রয়োজনে কিছু না কিছু করতে হয়। সেই প্রয়োজন থেকে তাদের পারিবারিক ব্যবসা মাঝে-মধ্যে দেখাশুনা শুরু করে তমাল।
রসায়ন নিয়ে পড়ালেখা করলেও নিজ জীবনের রসায়নটা মেলাতে পারেনি তমাল, হয়তবা মেলানোর চেষ্টা করেনি। কঠিন উদাসীনতার মধ্যে সুখ খুঁজে পেয়েছিল কি’না তা আর জানা যায়নি।
ব্যবসার কাজে ঢাকা যায় তমাল। রাত ফুরিয়ে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়, তার কোনো খবর নেই। অস্থির, অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে বাড়ির সবাই। খবর জানতে ফোন করে হোটেলের রিসিপসনে। ততক্ষণে হোটেলের দরজা ভেঙ্গে উদ্ধার করা হয় তমালের মৃতদেহ!