টিউশানি পড়াতে যাওয়ার পথে বাড়িটা প্রায়ই চোখে পড়ে সমীরণের। জানলায় খড়খড়ি লাগানো। একটানা লম্বা বারান্দার পুরোনো দিনের রঙচটা গ্রিলে লোহার ফুল ফুটে আছে চিরকালের মতো। কেমন পুরোনো বই-এর মতো দেখতে বাড়িটা।
সাইকেল চালাতে চালাতে ভাবে বারান্দা বিষয়টা তো চলে ফিরে বেড়াবার জন্যই। তবে কেউ ওখানে কখনো যায় না, কাপড় মেলে না।
কেন?
রাস্তা থেকে সরাসরি চোখে পড়ে বলেই মনে হয়। পুরুষের আব্রু তেমন দামী না হলেও মেয়েদের কাপড়-চোপড় টাঙানো আছে দেখলে একটু লজ্জা লাগে বই কি! পথিকের যদি চোখ না পড়ে তবে লজ্জার কোনো কারণ নেই। সাথে সাথে চোখে পড়বে না এমন গ্যারান্টিও নেই। তাই যাতে বিষয়টার সমূলে নিষ্পত্তি ঘটে সেজন্য কোনো কিছুই মেলা হয় না। শুধু ‘হদ্দ-পাগলে’ দৃষ্টির মতো দোল খায় একটা শূন্য নাইলনের দঁড়ি।
এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ছাত্রের বাড়ি এসে যায়। তখন ওর মনে অন্যের হাঁড়ির খবর জানার আগ্রহ ওকেই খোঁচা মারে। মনে হয়,”এসব হাজিবাজি কথা মাথাটাকে বড্ড জ্যাম করে দিচ্ছে। অতি-ভাবুকতা ও কৌতূহল অতিরিক্ত সাহিত্য এবং রকমারি ইতিহাস বই পড়ারই ফল। ওসব বন্ধ করতেই হবে।”
দিন যায় তবু এই অদৃশ্য শত্রুরা সমীরণের পেছন ছাড়ে না। একদিন ছাত্র পড়ানোর জন্য নয়, অন্য একটা কী কাজে ওই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ও দেখতে পেল একটা সবুজ পাড় ধনেখালি শাড়ি টাঙানো রয়েছে সেই বারান্দায় আর ময়লা পুরোনো বাল্ব জ্বলছে একটা মাত্র। বাল্বের উল্টো দিকের দেওয়ালে একটি মেয়ের ছায়া পড়েছে। সম্ভবত ওই শাড়ির মালকিন। চুরি যাওয়া আলো আর যন্ত্রনার মতো নীল ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার মেখে বুক পকেটের গভীরতার মত পরিসর নিয়ে যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ডিসেম্বরের বিকেল। ওই একমাত্র আলোক অবলম্বন করেই দুলছে একটা আঁচল। আনন্দে নাকি দুঃখে নাকি অন্য কোনো নিমগ্নতায়, অন্য কারুর অস্তিত্বে? কে জানে! কিছুক্ষণের জন্য এই ভাবনায় বিবশ হয়ে গেছিলো।
হঠাৎ একটা প্রশ্ন সমীরণের মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো খেলে গেলো। এই শাড়ি কার, কে মেয়েটি, কী তার পরিচয়? সে কী হিন্দু নাকি মুসলিম নাকি অন্য কিছু?
একথা মনে হতেই আস্তে আস্তে পরিবেশের অপার্থিব এই মোহময়তা ঘুচে গিয়ে ওর সমস্ত ভেতরটা কিরকম বিষন্নতায় ভরে উঠলো। অবচেতনটা ওর নিজের সজাগ চেতনার কাছে লজ্জায় যেন গুটিয়ে গেলো, ভীষণ ছোট হয়ে গেলো। তবে কি সেও বাকি সবার মতো ?
এমন পরিবেশ, ছায়াছবির মতো এই প্রচ্ছন্ন নৈঃশব্দের চেয়ে তার কাছেও কি পরিচয়ই বড় হয়ে উঠলো! এই মুহুর্তে হঠাৎ ওর খেয়াল হল সন্ধ্যে হবার সাথে সাথে একটা পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। ওই ময়লা বাল্ব, মেয়েটির ছায়া আর শেষপর্যন্ত গোটা ধনেখালি শাড়িটা কোথায় মিলিয়ে গেলো। বারান্দা-টা হারিয়ে গেলো অন্ধকারের বুকে, যেমন হারিয়ে গেছিলো মিশরের দেব-সন্তানেরা। সমীরণের মনে হলো দৃশ্যের মৃত্যু ঘটলো এই মুহুর্তে।
সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মন্থর গতিতে ও এগিয়ে চললো, যেদিকে ওর যাওয়ার কথা।