মুখোশের এই নগরে

মুখোশের এই নগরে

আজ কয়েকদিন যাবৎ উনার পেছনে ঘুরছি। উনি একজন যাদুকর। বিভিন্ন রাস্তায় যাদু দেখিয়ে বেড়ান। কিন্তু আমি খবর পেয়েছি উনার কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আছে। যা অন্যদের নেই। হবে হয়তো! তবে উনাকে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। আজকাল আমাকে দেখলে উনিও সটকে পরেন। মহা মুসিবত অবস্থা। অনেক কষ্টে এবারে উনার আস্থাভাজন হয়েছি। আজ উনি আমাকে বললেন

– বাবা তুমি ভদ্রঘরের ছেলে। সব ফেলে কেন আমার পেছনে পেছনে ঘুরছো?

– ওস্তাদজী আমি আপনার কাছে যাদু শিখতে চাই।

– যাদু ! সেতো বাবা হাতের কেরামতি। মানুষের চোখে ধুলা দেওয়া। এসব শিখে কি হবে?

আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উনার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকি। উনি প্রথমে তিন তাসের খেলা, দড়ি কাটা, পাঁচ টাকার কয়েন উধাও করলেন। এরপরে হাত থেকে গোলাপ ফুল বের করে আবার সেটা থেকে রুমালে বদলে ফেললেন। আমি তাজ্জব হইনা। আমি জানি এগুলো আসলে পামিং। উনি এর বাইরেও কিছু জানেন। উনার চোখ দেখে আমি বুঝতে পারি কিন্তু ধরতে পারি না। সব শেষে উনি যখন হাতের রুমালকে এক নিমিষেই কবুতর বানিয়ে উড়িয়ে দিলেন। আমি আর চুপ থাকতে পারি না। নাছোড়বান্দার মতো উনাকে বলি ” আরো কিছু একদম আলাদা কিছু জানেন আপনি।”

– এতো কিছু জানলে আমিতো সব বদলে দিতে পারতাম তাই না! আসল যাদু হচ্ছে মানুষের রুপের। আমরা যা সামনে দেখি তা ভুল। অধিকাংশ মানুষের এই ভোলাভালা চেহারার পিছনে অন্য কোনো রুপ থাকে। কারোটা ভাল কারোটা খুব মন্দ। তুমি এসব সইতে পারবে না। তাই দূরে থাকো। বলেই উনি চলে যাবার প্রস্তুতি শুরু করেন।

” আপনি যাবেন না, যতো কঠিনই হোক আমি মানুষের আসল রুপ দেখতে চাই। ” দৃঢ় কণ্ঠে বলি আমি। নিজেই নিজের গলার স্বরে চমকে উঠি। এতো কঠিন করে কথা আমি এর আগে বলিনি। বাবা, আমরা সামনে যা দেখি সব হচ্ছে ‘ মুখোশ ‘ সত্য আর মিথ্যার। তুমি কি সেই গল্প শোননি! সত্য আর মিথ্যে ছিল দুই বোন! না শুনিনি, এবারেও কঠোর আমি। আমার দুই ঠোঁট পরস্পরকে চেঁপে ধরে আছে। রমনা পার্কের একটা বেঞ্চে বসি আমরা। উনি বলে যান। ” সত্য, মিথ্যা দুই বোন একসাথে পথ চলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে এক পুকুরের ধারে বসলো। পিপাসা মিটে যাবার পরে মিথ্যা সত্যকে বলল ‘ বোন চলো আমরা গোসল করে নেই। ‘
‘ আমাদের সাথে তো বাড়তি পোশাক নেই। ‘ সত্য
ভয়ে ভয়ে বলল।

‘ এটা বড় সমস্যা না। এখনো ভোর হয়নি। আমরা আমাদের পোশাক খুলে রেখে গোসল করতে পারি। ‘ অন্য উপায় না দেখে সত্য রাজি হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে মিথ্যা পুকুর থেকে উঠে সত্যর পোশাক গায়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। সত্য পুকুর থেকে উঠে দেখে মিথ্যে তার কাপড় পরে পালিয়ে যাচ্ছে । সত্য কিছু না ভেবে সেই অবস্থাতেই মিথ্যের কাছ থেকে পোশাক ফিরিয়ে আনতে দৌড়ে গেল। ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, সত্যর পোশাক পরা মিথ্যেকে সবাই সত্য বলে মেনে নিয়েছে।

নিজের পোশাক ফিরে না পেয়ে সত্য সবার সামনে এসে কেঁদে কেঁদে বলল। ‘আমিই সত্য, তোমরা বিশ্বাস করো। ‘ পথচারী লোকজন, সমাজের সবাই, চোখ ফিরিয়ে নিল। নগ্ন সত্যকে কেউ গ্রহণ করতে পারলো না। আমি জানি। তবে এই গল্পের সাথে আপনার সম্পর্ক কি বুঝলাম না। বিশ্বাস করুন যাই দেখি আমি মেনে নিতে পারবো। ঠিক আছে, দেখো তাহলে। নিজ চোখেই সব দেখো এবার। ওস্তাদ কায়েস উদ্দিন পকেট থেকে একটা অদ্ভুত চশমা বের করে আমায় বললেন, চোখে দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাও। কিছু দেখতে পাচ্ছো কি?

প্রথমে খুব ঘোলাটে লাগলেও আস্তে আস্তে সব পরিস্কার হয়। একি ! রাস্তায় তো কোনো মানুষ নেই। সব জন্তুজানোয়ারে ভর্তি পথঘাট। না না ঠিকঠাক জন্তু জানোয়ার নয় কেউই। মানুষের শরীর কিন্তু মাথাটা জন্তুর। কুকুর, বিড়াল, শূকর, বানর, সাপ। পাখির মুখ ও আছে কিছু, ময়ূর, পেঁচা, চিল। আমি চশমাটা খুলে ভালভাবে মুছে আবার চোখে দিলাম। সবই আগের মতো দেখতে পাচ্ছি শুধু মানুষের মুখগুলো অন্যরকম হয়ে গেছে। কারো মুখ ঠিক যেনো সাপের মতো। কারো মুখের আদল হনুমানের মতো। কারো মুখ কুকুরের মতো কারোটা বাঘ বা ভাল্লুকের মতো। এমন কি দানবের মতোও কয়েকজন কে দেখলাম। আমি দ্রুত চশমা খুলে অবাক হয়ে ওস্তাদজীর দিকে তাকালাম। উনি মুচকি হেসে বললেন।

– এবার বুঝতে পেরেছো তো মানুষের এই সুন্দর চেহারার পিছনে আসলে কি থাকে?

উনি আবার আমাকে চশমাটা পড়িয়ে বললেন সামনে তাকাও। একটা দামি গাড়ি এসে থামলো। দামি পোশাক পড়া ড্রাইভার দরজা খুলে দিল। এক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামলেন। সাথে সাথে অনেক পথচারী উনাকে ঘিরে দাঁড়ালো। উনি হাত মাথা নেড়ে কি সব বোঝাচ্ছিলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের একচোখ অন্ধ। আর অন্য চোখটা খুবই বড় আর লাল টকটকে। বড় বড় দাঁত আর জিভটা অনেক লম্বা হয়ে কুকুরের মতো ঝুলছে।

আমি তাজ্জব বনে গেলাম, কারণ উনি আমাদের খুব প্রিয় একজন নেতা। উনার এমন চেহারা কেন? আমি চিৎকার করে উনাকে বলতে চাইলাম ‘ এই আপনার আসল স্বরুপ? ‘ ওস্তাদজী আমাকে কিছু বলতে নিষেধ করলেন। কাঁধ চাপড়ে বললেন। ‘ কতো কিছু এখনো দেখা বাকি! এখনই কিছু বললে তো তুমি আর কিছু দেখতে পাবে না। ‘ আমি বিস্মিত হলেও চুপচাপ থাকলাম। আমি সত্যিই আরো কিছু দেখতে চাই। শুধু এটুকু বললাম ‘ ওস্তাদজী, পুরো পৃথিবীটাই বুঝি এমন? না বাবা, এর চেয়েও মন্দ আছে। তবে মন্দর সাথে কিছু পবিত্রতাও আছে। আমাদের কাজ মন্দ থেকে দূরে থেকে পবিত্র কে গ্রহণ করা।

আমরা দুজন আনমনে হাঁটছি। মাথায় বেশ কিছু প্রশ্ন ঘুরছে, কিন্তু ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছিনা। আবার কি না কি দেখতে বলেন। উনি হঠাৎ বললেন। বাবা তুমি কি দুনিয়ার আশ্চর্য একটা জিনিষ দেখতে চাও? আমি মাথা নেড়ে সায় দেই। আরো বেশ কিছুদূর হেঁটে আমরা পুরাতন একটা একতলা বাসার সামনে আসি ।কলিংবেল চাপতেই এক মাঝবয়সী মহিলা দরজা খুলে দিল। সাধারণ মধ্যবিত্তর ঘর, আধপুরানো সোফা আর পুরানো একটি খাট পাতা। একপাশে মিষ্টি চেহারার বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে আমাদের সালাম দিয়ে বসতে বললো। ওস্তাদ মেয়েটিকে তার বাবাকে ডেকে দিতে বললেন।

– বসুন, আব্বুকে ডেকে দিচ্ছি। বলে মেয়েটি চলে গেলো।

কমদামী কিন্তু পরিষ্কার একটা শার্ট গায়ে এক ভদ্রলোক এলেন। ঠোঁটে মিষ্টি অমায়িক হাসি। ‘আমি কি আপনাদের চিনি, ঠিক মনে পড়ছেনা। ‘ ওস্তাদজী মাথা নেড়ে বললেন। – না..চেনেন না। তবে আপনার বাবার সাথে আমার পরিচয় ছিল।

– দুঃখিত বাবা মারা গেছেন দু’বছর আগেই। উনি পাশের দেয়ালে সস্তা ফ্রেমের একটা ঘোলাটে ছবি দেখান।

– আপনার বাচ্চা কয়জন বাবাজী?

– দুটি, একটি মেয়ে আর একটি ছেলে। আমার ছেলেটি গতবছর মারা গেছে। লোকটি ধরা গলায় বললেন।

– আপনি কিসে যেনো চাকরি করেন বাবাজী?

– আমি পুলিশে চাকরি করছি আজ পনের বছর। আমার বাবা কাষ্টমসে চাকরি করতেন।

– এতো বছর চাকরি করছেন, আপনার সংসার দেখেতো এমন মনে হচ্ছেনা। লোকটি কোন উত্তর দিল না।

এমন সময় মেয়েটি নাশতা নিয়ে এলো। পাঁপড় ভাজা। ঘরে তৈড়ি দুধ সেমাই, সাথে চা। আমরা ভদ্রলোককে চা নিতে বললাম। উনি জানালেন উনি চা খাননা। অল্প নাশতা দেয়ার জন্য উনাকে খুব লজ্জিত মনে হচ্ছিলো।

বারবার বলছিলেন, ‘ বাচ্চাদের মা অসুস্থ্য। বিশেষ করে ছেলে মারা যাবার পর থেকে। ‘ আমাদের চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। এমন অবস্থায় অন্য কিছু খাওয়াও যায় না। ওস্তাদজী বললেন, ‘ অনেকদিন যোগাযোগ নেই। আপনারা কেমন ছিলেন জানতে পারিনি। খুব খারাপ লাগছে। ‘ উনি ধরা গলায় বললেন – বাবা জীবনে মিথ্যা বলেননি, ঘুষ নেয়াতো দূরে থাক। আমাদেরকেও সেই শিক্ষা দিয়েছেন। আমার বাচ্চাটি অনেক অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। প্রতিদিন মানুষ অনেক টাকা নিয়ে আসে আমার কাছে। বলে – ভাই লিখে দিন এটা ‘খুন না আত্বহত্যা।’

আবার কেউ বলে ‘ স্যার আসলে দেখুন এই বক্সে বাচ্চাদের বেবি পাউডার ছিলো। হিরোইন কি বস্তু আমি চিনিই না। এই প্যাকেট টা রাখুন। বাসায় গিয়ে খুলবেন। কিন্তু লোভের কালো হাতে আমি হাত মেলাতে পারিনি। বাবার নীতি আর নিজের সন্তানদের কথা ভেবে। বাবা শিখিয়েছেন সৎ থেকেও সুখে থাকতে। আর আমার বাচ্চারা যদি আমায় দেখে না শেখে, তবে বাবা হিসেবে আমার কি দাম বলুন? লোকটির চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পরছে।

এবার আমি নিজ থেকেই চশমাটা হাতে নিয়ে চোখে দেই। বাহ সাদামাটা শার্ট পরে কে বসে আছে ! মনে হচ্ছে মুখ দিয়ে আলো ঠিকরে পরছে! যেনো মানুষ না মানুষরূপী একজন ফেরেশতা। আমি সাবধানে পাশের ছবিটির দিকে তাকাই ঘোলাটে পুরাতন ফ্রেমটা হঠাৎ রুপোর মতো চকচক করে ওঠে। ছবির মানুষটা যেনো এখুনি কথা বলে উঠবে। শ্রদ্ধায় আমার মাথা নিচু হয়ে আসে। চশমা খুলে দ্রুত আমরা বিদায় নিয়ে নেই। ওস্তাদজীর সাথে আবার পথে নামি।

একটা পার্কের ব্রেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ রেষ্ট নিতে চাই। কোথাও জনসভা হচ্ছে। মঞ্চটা সুন্দর করে সাজানো। সেখানে কিছু মৃত নেতাদের ছবি টানানো আছে। একজন বড় নেতা তেজোদৃপ্ত কন্ঠে,দেশপ্রেম, সুসম অর্থনৈতিক বন্টন,স্বাধীনতা রক্ষা প্রভৃতি নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। ওস্তাদজী আমায় ইশারায় ডাকেন। ফিসফিস করে বলেন, ‘জনসভা চলছে বড় বড় মন্ত্রী আমলা, নেতা, সবাই আছেন। ‘ এবারে ওস্তাদজী নিজেই আমাকে চশমাটা চোখে দিয়ে বললেন।

– এইবার দুনিয়ার আসল জিনিষ দেখে নেন বাবা।

এ আমি কি দেখছি! মঞ্চে কারা বসে আছে ! কারো কারো মাথা ঝুকে আছে নিচের দিকে। চোখ পুরাই অন্ধ। কারো চোখ আছে তা দিয়ে রক্ত ঝরছে । আবার কারো জিভ সাপের মতো লকলকে। কারো জিভ কুকুরের মতো একেবারে বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। সেই জিভ দিয়ে টপটপ করে লোভের রস ঝরে ঝরে পরছে ।

এসব দেখে আমি আর সইতে পারিনা। যারা বক্তৃতা শুনছে সেই সাধারণ মানুষ গুলোর দিকে তাকিয়ে আমি লজ্জায় শেষ হতে থাকি। মঞ্চের সামনে দেখি , ‘ কি অবাক কাণ্ড ওখানে কোনো মানুষ বসে নেই। কিছু বানর আর কিছু কাঠের পুতুল চেয়ারে বসে আছে। ভয় পেয়ে আমি নিজেই, এবার চশমাটা খুলে ফেলি। ওইতো এবারে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে কিছু যুবক কিছু মধ্যবয়সী লোক। হতাস চোখে বসে আছে মঞ্চের সামনে। ওস্তাদজী এবার মৃদু হেসে বললেন।

– বাবা যে মৃত রাজা আর মন্ত্রীদের ছবি টানানো আছে সেগুলো দেখবা না ? আমি আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে ” না ” বলি। চশমাটা উনারর হাতে ফিরিয়ে দেই।

– ক্ষমা করুন ওস্তাদজী ওই মৃত মানুষ গুলোকে আমরা ভীষণ শ্রদ্ধা করি। উনাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা কবরে ফুল দেই, মিলাদ মাহফিল করি। নফল রোজা রাখি। এখন ওই রাজা, মন্ত্রী আর নেতাদের ছবিতে যদি তাদের চেহারা পালটে যাওয়া চেহারা দেখি, আমার আত্বহত্যা ছাড়া আর পথ থাকবেনা। আমি ইমতিয়াজ। সম্মানিত এক পরিবারে জন্ম নিয়েছি। এমবিএ করেছি বড় ভার্সিটি থেক। সব আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। আমি সস্তাদরের অলৌকিক চশমাটা ফিরিয়ে দিয়ে, আমাদের এই নগরের মুখোশ ঢাকা শহরে আবার পথে নামি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত