রাত ১০ টা ৩০ বাজে। বাবা মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি কাপড় চোপড় গুছিয়ে ব্যাগে যত্নসহকারে রেখে দিলাম। ঘরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুই ফুট সামনে কি আছে তা দেখতে পারাটা ভীষণ দায়। আজ অহনাকে নিয়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পা টিপে টিপে আওয়াজ না করে ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলাম তখনই ঘরের বাতিটা জ্বলে উঠলো। বাতির আলো দেখে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। পেছন থেকে ডাক দিলেন বাবা। “নীল কোথায় যাচ্ছিস?” বাবার প্রশ্ন শুনে ভয়ে আমার বুক ধড়ফড় করে কাঁপতে লাগলো।
আমি ভয়ে প্রচন্ডভাবে ঘামতে শুরু করেছি। বাবার প্রশ্নের জবাবে কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনই বাবা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কয়টার ট্রেন?” আমি বাবার মুখে ট্রেনের কথা শুনে সীমাহীন অবাক হলাম। বাবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “কয়টার ট্রেন মানে?” “আমি জানি আজ তুই আর অহনা পালানোর প্ল্যান করেছিস! কিন্তু কয়টার ট্রেন তা জানিনা। বলবি তো কয়টার ট্রেন?” আমি ভাঙা কণ্ঠে জবাব দিলাম, “১২ টা ২১ এর ট্রেন বাবা।”
বাবা দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলেন কয়টা বাজে। তারপর আমাকে বললেন, “এখন তো মাত্র ১০ টা বেজে ৩০ মিনিট। মেলা সময় বাকি এখনো। আয় তুই আর আমি একটু সময় বসে গল্প করি।”
বাবার কান্ড দেখে আমি যে কি পরিমাণ অবাক হচ্ছিলাম তা মুখের ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। আমি পালাচ্ছি, তাও আবার একটা মেয়েকে নিয়ে কিন্তু বাবার ললাটে চিন্তার দাগ বিন্দুমাত্রও নেই। বাবা বসলেন। কিন্তু আমি উনার পাশে বসার সাহসটুকু সঞ্চয় করতে পারছিনা৷ আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাবা বললেন, “বস। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?” আমি বাবার পাশে বসলাম। বাবা বাঁ পায়ের উপর ডান পা টা উঠিয়ে আরাম করে বসে আমাকে বললেন, “তুই হয়তো ভাবছিস আমি কিভাবে জানলাম যে তুই আজ অহনাকে নিয়ে পালাবি তাই না?” আমি মাথা নিচু করে নিলাম।
বাবা বললেন, “সকালে যখন তুই অহনার সাথে ফোনে পালানোর প্ল্যান করছিলি তখন তদের সব কথোপকথন আমি শুনে ফেলি। তুই জানিস আমি কোথায় টাকা রাখি। কিন্তু আমি এটাও জানতাম যে তুই সেই টাকাতে হাত দিবি না। তুই বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধারে টাকা নিয়েছিস সেটাও আমি জানি। কিন্তু তুই পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কি আমাকে একবারো তোদের ভালোবাসার কথা বলতে পারলি না? তুই তো বলতে পারতি যে বাবা আমি অহনাকে ভালোবাসি, আমি তাকেই বিয়ে করবো! দেখতি তোর বাবা রাজি হয় কিনা!”
আমার চোখে ততক্ষণে জল ঘর করে নিয়েছিলো। আমি কাঁদো কাঁদো অবস্থায় বাবাকে বললাম, “বাবা আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি মনে করেছিলাম অহনার পরিবারের মতো তুমিও আমাদের ভালোবাসাকে অস্বীকার করবে। আমি মনে করেছিলাম আমি আর অহনা কখনো এক হতে পারবোনা। অহনাকে হারানোর ভয়ে বাবা আমি পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে মাফ করে দাও বাবা!” “তুই কি জানিস, আমি আর তোর মা ও পালিয়েই বিয়ে করেছিলাম?” বাবার সব কথাই আমাকে অবাক করছিল। কিন্তু বাবার পালিয়ে বিয়ে করার কথাটা আমাকে ভীষণ অবাক করে দিলো। আমি বিস্মিত চোখে বাবার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বাবা বললেন, “অবাক হওয়ার কিছু নেই, এটাই বাস্তব। আমিও তোর মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। আমিও ভেবেছিলাম যে আমাকে আর তোর মাকে আমাদের পরিবার কখনো মেনে নিবেন না। সেই ভুল চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়ে পালানোর ভুল সিদ্ধান্তটাও নিয়ে ফেললাম।” “তারপর?”
“তারপর আর কি? তোর মায়ের হাত ধরে পালিয়ে গেলাম এক অজানা ভবিষ্যৎ নিয়ে অজানা এক শহরে। প্রতিদিন তোর মাকে কান্না করতে দেখতাম। তোর মা কখনো আমার সামনে কাঁদত না, কাঁদত আমার আড়ালে। কিন্তু তবুও তার কান্না আমার নজর এড়াতে পারতনা। তোর মা নিজের মা বাবাকে খুব খুব খুব মিস করতো। মা বাবার অনুপস্থিতি তোর মাকে তিলে তিলে পুড়িয়ে দিতো। তোর মায়ের লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করা আমার বুকটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতো। শহরে দুয়েক বছর কাটানোর পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি আর তোর মা দুজনেই আমাদের মা বাবার কাছে গিয়ে তাদের পা ধরে নিজের ভুলের ক্ষমা চেয়ে নেব।
মা বাবা তাদের সন্তানদের ভুলগুলো সবসময় ক্ষমা করে দেন এটা আমার মনের বিশ্বাস ছিলো। আমি আর তোর মা প্রথমেই গেলাম তোর নানা-নানির কাছে অর্থাৎ তোর মায়ের বাবা মায়ের কাছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যে ঘটনাটার সম্মুখীন হই তা আমি কখনোই ভুলতে পারবনা।” বাবা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। আমি বাবার গল্পের পরের অংশটুকু শুনার জন্য ততক্ষণে ভীষণ উদগ্রীব হয়ে গিয়েছিলাম। বাবাকে উৎসাহ সহকারে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছিল বাবা?” বাবা বললেন, “তোর মায়ের বাসায় গিয়ে শুনলাম তোর মাকে নিয়ে পালানোর তিন চারদিন পর এক সকালেই তোর নানা আত্মহত্যা করেন। তোর নানার মৃত্যু তোর নানি সহ্য করতে না পেরে উনিও মারা যান।
সেদিন তোর মায়ের কি যে কান্না! তোর মায়ের কান্না দেখে সেদিন নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো তোর নানা নানির হত্যার জন্য আমিই দায়ী। তোর মামা তোর মায়ের হাতে একটা চিঠি দিল। চিঠিটা তোর নানা লিখেছিলেন। চিঠিতে লিখা ছিলো, মারে আমরা চেয়েছিলাম তোর বিয়েটা খুব জাঁকজমকভাবে দিবো। কত স্বপ্ন ছিলো তকে নিয়ে৷ মারে তুই তোর মা বাবাকে একবার বলে দেখতি তোর সম্পর্কের কথা। আমরা তো তোরই খুশি চাই। আমরা তোর বিয়েটা তোর পছন্দের ছেলের সাথেই দিতাম। তুই কিভাবে পারলি আমাদের মুখে চুনকালি মেখে দিতে? এই সমাজের লোক আমাদেরকে বাঁচতে দেয় না রে। পথে ঘাটে যেখানেই পায় থুথু ফেলে দেয়, নানান ধরনের কু মন্তব্য করে। আমি আর পারিনি তাদের করা অপমান সহ্য করতে। ভালো থাকিস মা, সুখে থাকিস!!” এই কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে লিখিত চিঠিটা জানান দিচ্ছিলো অপমানের সূচ কতটা বিষাক্ত।
আমার তখন মনে পড়লো আমার বাবা মায়ের কথা। তাড়াতাড়ি তোর মা আর আমি বাসায় আসলাম। মা যখন আমাকে দেখতে পেলেন তখন কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে বললেন, “খোকা কেন তুই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলি? মায়ের কথা কি তোর একটিবারের জন্যও মনে হয়নি?” বাবা অনেকটা মিথ্যে অভিমান জমিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু তা অনেক্ষণ ধরে রাখতে পারেননি। উনার চরনে পড়তে মাত্রই সবকিছু ভুলে আমাকে জড়িয়ে নিলেন। কিন্তু তোর মায়ের কষ্টটা আমি এখনো ভুলতে পারিনি। সে ভাবে তার কারণেই তার বাবা মায়ের মৃত্যু হয়েছে।
আমি চুপচাপ বসে আছি। জীবনের প্রথম বাবার চোখে জল দেখলাম,। বাবা চোখ মুছে বললেন, “আমরা ভাবি বাবা মা আমাদের জেনারেশনের নয়। তারা আমাদের ভালোবাসা কখনোই বুঝতে পারবেনা। কিন্তু বাবারে ভালোবাসা কি জেনারেশনের পর জেনারেশন পালটাতে থাকে? না, পাল্টায় না। আমরা এখন এত আপডেট হয়ে যাচ্ছি যে সবসময় অনলাইনে সময় কাটাই। মা রান্নাঘরে রান্না করে আর আমরা ফোন নিয়ে একান্তে ব্যস্ত থাকি। মায়ের সাথে গিয়ে বসে একটু গল্প করার সময় নেই আমাদের। বাবাও থাকে পাশের রুমে টিভি অন করে। কি করবে? আমরা লেপটপে অথবা মোবাইলে মুভি দেখি। কখনো বাবার পাশে এসে মুভি দেখতে আমাদের মন চায় না, মুভি দেখতে দেখতে গল্প করতে মন চায় না। এভাবেই সন্তান আর বাবা-মায়ের মধ্যে একটা গ্যাপ সৃষ্টি হয়। আমরা একে বলি জেনারেশন গ্যাপ। আসলে ওটা জেনারেশন গ্যাপ না, ওটা আমাদেরই তৈরি করা দূরত্ব। আর এই দূরত্বের কারণে আমরা ভাবি যে আমার বাবা বা আমার মা আমাকে বুঝবে না। কিভাবে বুঝবে? আমরা নিজেকে মা বাবার কাছে প্রকাশই বা কখন করি? ”
বাবা কথাগুলো বলার পর কিছুক্ষণ চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন আর বললেন,
“আসলে বাস্তবতা কি জানিস? বাস্তবতা এটা যে মা বাবাকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হয়ে বাঁচতে পারেনি। আমরাও ভোগছি আমাদের বাবা মাকে দেয়া কষ্টের ফল। মা বাবার চোখের এক এক ফোটা জলের হিসেব দিতে হয় সারাটা জীবন জুড়ে।”
বাবা যুক্তিযুক্ত কথাগুলো প্রমাণ দিচ্ছিলো যে আমি কতোটা ভুল ভাবতাম আমার বাবা মাকে নিয়ে। আমি বাবার পা টা ধরে ক্ষমা চেয়ে বললাম, “বাবা আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে ক্ষমা করে দেন। আমি সত্যিই অনেক বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম।” বাবা আমাকে বসিয়ে রুমের ভেতর থেকে কিছু টাকা এনে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, “মেয়েটা মনে হয় তোর জন্য স্টেশনে এসে অপেক্ষা করছে। আমি জানি তোর কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই। এই টাকা গুলো রাখ। আর যদি টাকার দরকার হয় তাহলে আমাকে জানাস আমি তোর বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেব।”
আমি আর অহনা ট্রেনে বসে আছি। ঘুটঘুটে অন্ধকারকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ট্রেন তার আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তার গন্তব্যের দিকে। অহনা আমার পাশে বসেও যেন অনেক অনেক দূরে। নিশ্চুপ বসে থাকা অহনার চোখ থেকে জলের ধারা অবিরত বয়ে চলেছে। মেয়েটা নীল ওড়না দিয়ে চোখের জল ক্রমাগত মুছছে। আমি অহনার বুকের ভেতর সৃষ্ট ব্যথার পরিমাণ আন্দাজ করতে পারছিলাম। আমার মনটাও বারবার আমাকে এই ভুলটস করতে বারণ করছিল। বাবার বলা কথাগুলো বারংবার আমার মনকে খুঁচা দিচ্ছিলো। ভেতরে ভেতরে আমিও জ্বলছিলাম। অহনাও এক পর্যায়ে নিজের মনের ব্যথা কে সহ্য করতে না পেরে আমাকে প্রশ্ন করলো, “নীল আমরা ভুল করছি না তো?” অহনার প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো উত্তর আমার কাছে ছিলনা। আমি শুধু অহনার হাতটা ধরে রেখেছিলাম। তাকে আশ্বাস দিচ্ছিলাম যে “আমি তো আছিই।”
ট্রেন একটি স্টেশনে এসে থামলো। যদিও এই স্টেশনটি আমার গন্তব্য না, তবুও অহনার হাত ধরে নেমে পড়লাম। গন্তব্যের আগে নেমে যাওয়ায় অহনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো নীল? এখানে নামলে যে!” আমি অহনার অপরূপ চোখ দুটোর জল মুছে বললাম, “যে ভুলটা করতে যাচ্ছিলাম সেটা শুধরানোর জন্য!” সকাল হতে হতেই অহনার বাসায় এসে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু অহনার ঘরে ঢুকতেই যা দেখলাম তা দেখে আমার দেখে লক্ষ লক্ষ লোম গুলো দাঁড়িয়ে গেলো। শরীর টা শিহরণ দিয়ে উঠল। অহনার ঘরের ভেতর আমার বাবাকে আর মাকে দেখতে পেলাম। বাবাকে দেখে ভীষণ অবাক হলাম। কিন্তু বাবা মনে হয় আমাকে দেখে ততটা অবাক হননি।
অহনা আমার সামনেই তার বাবা মায়ের পা ধরে ক্ষমা চাইতে চাইতে বলল, “বড্ড ভুল করতে যাচ্ছিলাম বাবা। একটু সময়ের জন্য পথ হারিয়ে গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম যে নীলের মতোই তোমরাও আমাকে ভালোবাসো। এটা সত্যি যে আমি নীলকে ছাড়া বাঁচবোনা, কিন্তু এটাই ততটাই সত্য যে তোমাদেরকে কাঁদিয়ে আমি কখনোই সুখী হতে পারবোনা। আমাকে মাফ করে দাও বাবা!” অহনার বাবা মা তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, আর কাঁদিস না মা। তুই যে আমাদের মান সম্মানের কথা ভেবে ফিরে এসেছিস সেটাই অনেক। আমরা খুব জাঁকজমকভাবে তোর আর নীলের বিয়ে দেব।
মাও আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। সব ঠিক হয়ে গেলেও কিন্তু আমার মনে বাবা মায়ের এখানে আসা নিয়ে শতশত প্রশ্ন জেগে উঠলো। বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা তোমরা এখানে কেন?” বাবা একটু মুচকি হেসে বললেন, “তোর হয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম। একবার তোর মা হারিয়েছিলো তার মা বাবাকে। এবার অহনা যেন তার মা বাবাকে না হারায় সেজন্যই এখানে এসেছিলাম।”