আমি এই বাড়িতে ভয় পাই মা। শুভ্রা ভয়ে ভয়ে বলে। শুভ্রার শাশুড়ি তাচ্ছিল্যর চোখে ওর দিকে তাকালেন।কোনো জবাব দিলেন না।ছেলের বউয়ের অধিকাংশ কথার উনি কোনো জবাব দেন না। হাত পাখা ঘুড়াতে ঘুড়াতে এমন ভাবে তাকান যে তার আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাধ জাগেনা।
— মা শুনছেন । এবার একটু জোরেই বলে শুভ্রা । উনি ঘুমের ভান করে পরে থাকেন। ওর অসহ্য লাগে। আর একটা সন্ধে আসছে। তার মানেই রাত। রাত মানেই সেই দমবন্ধ করা ভয়।
অঞ্জনের সাথে শুভ্রার বিয়ে হয়েছে ছয় মাস। ওর বাবা নেই। বিধবা মা আর শুভ্রা জ্ঞাতি কাকাদের সংসারে অবাঞ্ছিত হয়ে মুখ গুজে পরে ছিল। ওর মা গায়ের গহনা বিক্রি করে কোনমতে ওর লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছে। পূজাপার্বণ ছাড়া নতুন কাপড় চোখে দেখেনি কোনদিন । সংসারের কর্তা ছিল শুভ্রার কাকিমা। দু চোখে দেখতে পারতোনা ওদের। ওর মা মাকে ডাকতো অপয়া বলে , ওদের মা মেয়ের মুখ দেখে নাকি যাত্রা করতে নেই। সকলের খাবার শেষে কাকার এঁটো পাতে খেতে বসতো শুভ্রা। প্রায় প্রতিদিনই এঁটোকাঁটা ছাড়া কপালে তেমন কিছু জুটতো না। মন্দিরে পূজা দিতে এসে ওর দিকে চোখ পরে ওর শাশুড়ি মায়ের । তারপরেই বাড়িতে ঘটক এলো। সমন্ধ দেখে সবাই অবাক! কাকিমাতো বলেই ফেললেন, সেকি – পোড়া কপালির এমন রাজভাগ্য !
কাকা ছেলে দেখে এসে আর কোনো খোঁজ করলেন না। পরের মাসেই পাঁজি দেখে বিয়ের দিন ঠিক করলেন । বাসর রাতে স্বামীর রুপ দেখে শুভ্রা’তো রীতিমত অবাক! এতো সুন্দর মানুষ হয়! এতো সাক্ষাৎ কার্তিক ঠাকুর। শুভ্রা গড় হয়ে তাকে প্রণাম করতেই উনি শুভ্রাকে হাত ধরে কাছে বসালেন। মৃদু হেসে বললেন। — শোন শুভ্রা, তোমার জায়গা আমার মনে। শুভ্রা লজ্জায় জড়সড় হয়। উনি ওকে অনেক কথা বলেন। অনেক গল্প, মানুষ হিসেবে যে উনার মনটা অনেক উঁচু দরের, বুঝতে কষ্ট হয়না শুভ্রার।
কিন্তু কেনো যেন সেই প্রথম রাতেই শুভ্রা ঘুমাতে পারেনা। খাটের যে দিকেই শোয়, মনে হয় কে যেনো ওর দিকে চেয়ে আছে। ওর অস্বস্তি দেখে, ওর স্বামী অঞ্জন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে – ‘প্রথম দিন তো, তাই এমন হচ্ছে, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এরপরে একদিন রাতে উনি শুভ্রাকে অঞ্জন বলে তার জীবনের এক ভয়ঙ্করতম সত্যি গল্প । ওর স্বামীর জীবনে মস্ত এক ফাঁড়া আছে। এ বংশের কেউই বেশিদিন বাঁচেনা। তাই তাড়াহুড়ো করে শুভ্রাকে বিয়ে করানো হয়েছে । উনাদের চাই বংশধর। শুভ্রা অবাক হয়ে শোনে। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কি করে? উনার শরীরে কোনো রোগ নেই। তারপর ও এ কেমন বিশ্বাস ! শুভ্রা ওর স্বামীর হাত ধরে।
— আপনার কিছু হবে না। আমার সিঁথির সিঁদুর এর জোড় আছে। আপনি অনেক দীর্ঘায়ু হবেন। আমি সতী হয়ে আপনার আগে চিতায় যেতে চাই।
অঞ্জন বলে — না শুভ্রা..তুমি জানোনা, আমাদের বংশে আছে অভিশাপ। আমার বাবা অল্প বয়সে রাজ রোগে মারা গেছেন। জ্যাঠা মরলেন ছাদ থেকে পরে গিয়ে। তারপরে একটু থামেন। হয়তো কোনো স্মৃতি মনে পরে যায়। একসময় নিজেকে সামলে আবার বলতে থাকে
— আতুর ঘরেই মারা গেছে আমার চার ভাই বোন। সাত বছরের ছোট ভাই আমাদের সবার সামনে পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছি। শেষমেশ আমি একাই বেঁচে আছি। এবার আমার পালা। শুভ্রার চোখে জল এসে যায়। স্বামীর হাত ধরে বলে।
– আপনি থামুন এবারে । আপনার কিছু হবে না। আর কি এমন কারণ, যে আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন!
— শুভ্রা আমার কিছু হলে তুমি বাড়ি ছেড়ে যেওনা। আমাদের ঘরে সন্ধে প্রদীপ দেবার কেউ নেই।
— আমি আমার সিঁথিতে সিঁদুর নিয়েই সন্ধে দেবো আপনি ভাববেন না।
সাত দিন পর অঞ্জন চলে যায় সীতাকুণ্ড। সেখানেই সে চাকরি করে । প্রতি সপ্তাহে চিঠি আসে। চিঠিতে লেখা থাকে সে কেমন আছে , কি করছে সব। শুভ্রা জবাব দিতে পারে খুব কম। মাসে একটা দুটো। শাশুড়ি মা এসব চিঠি চালাচালি মোটেও ভালবাসেন না। চিঠি এলে ডাক পিয়নের হাতে আগের চিঠির উত্তর ধরিয়ে দেয় । প্রথম দুমাস ভালোই কেটেছে ওর। আজ প্রায় মাস তিনেক হলো শুরু হয়েছে জ্বালা। ভর দুপুরবেলা যখন পুড়ো বাড়ি খাঁ খাঁ করে। অথবা মাঝ রাতে,ও স্পষ্ট শুনতে পায়।
ওর ঘরের কোণে চার পাঁচ বছরের একটি মেয়ে কাঁদে। প্রতিদিন শুভ্রা মেয়েটির একটানা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শোনে। কখনো কখনো ঠিক ওর বয়সী একটা মেয়েকে আবছা ছায়ার মতো দেখে। খুব দ্রুত মিলিয়ে যায়। কখনো কখনো বারান্দায় কখনোবা ছাদে। কখনো দরজার পাশে থেকে মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, শুভ্রা তাকাতেই সরে যায়। তাই ও আজ বাধ্য হয়ে শাশুড়িকে বলতে এসেছে। কিন্তু উনি কানে শুনলেন কি না! ঠিক বোঝা গেল না। তবে কোন উত্তর দিলেন না। সন্ধ্যে নামতেই শুভ্রার কাছে সব কিছু শুণ্য মনে হয়। ভয়ে আতঙ্কে হাত পা কাঁপতে থাকে। কিন্তু ও নিরুপায়। মস্ত এই বাড়িতে শুভ্রা আর ওর শ্বাশুড়ি ছাড়া কেউ থাকে না। আত্মীয় স্বজনেরাও কেউ আসে না।
একদিন মাঝরাতে ওর ঘুম ভেঙে যায়। ওর কানে আসে কে যেনো হালকা স্বরে ঘুম পাড়ানি গান গাইছে… দরজা খুলে আস্তে বাইরে আসে শুভ্রা। কে হতে পারে! খোলা বারান্দায় হা হা জোস্নার আলো। আস্তে আস্তে এগোয় শুভ্রা। আজ যেন ওর গায়ে প্রেত ভর করেছে । বারান্দার শেষ মাথা থেকে হালকা গহনার নড়াচড়ার শব্দ আসছে। কেউ মনে হচ্ছে অনেক কাঁকন পরা হাতে মৃদু আঘাত করে বাচ্চাকে ঘুম পারাচ্ছে। আর একটু এগোতেই স্পষ্ট দেখা যায়। কে একটা বৌ এলোচুলে বসে আছে। গা ভর্তি গহনা। তার কোলে মাথা দিয়ে আছে এক মেয়ে শিশু। শিশুটির নাক মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে শুকনো রক্ত। শুভ্রা এক চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারায়। পরদিন ওর জ্ঞান ফেরে পিসি শাশুড়ির কোলে। ও চোখ মেলতেই উনি বলে ওঠেন।
— মাগো মা জ্ঞান ফিরলো তাহলে! আমরাতো সব ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি । ভাবছি তোমার কাকার বাড়ি খবর পাঠাবো। শুভ্রা উঠে বসার চেষ্টা করতেই উনি চিৎকার দিয়ে বলেন — থাক থাক, উঠে বসে ভাল আছো কি না সেটা দেখাতে হবেনা। শরীর দেখেই বোঝা যাচ্ছে। গায়ে তো শুধু হাড়। চোখের নিচেও কালি পরে গেছে।
এবার শুভ্রার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন। ‘তোমায় ও বলি বৌ, মেয়েটা যে একেবারে ‘আধমরা হয়ে গেছে
গায়ের রঙ চেহারার একি হাল। কিছু খেতে দাওনা নাকি? ওর শাশুড়ি মুখ ঝামটে বলে ওঠেন।
— খায়না কেনো আমি কি করে বলবো? বাড়িতে তো ভাত, শাক সবজী কিছুর কোনো অভাব নেই।
— শুধু শাকসবজি ! কেনো তুমি মাছ আনাও না?
— আমি কি মাছ খাই! যে মাছ আনাবো!
— ও মা সেকি কথা? তোমার না হয় সিঁথি খালি। বৌয়ের তো নয় ! আমার ভাইয়ের ছেলে শত পরমায়ু হোক। তা এই বাচ্চা মেয়েটির শরীরে বুঝি এসব দরকার নেই!
— তা এতোই যদি দরকার মাছ মাংস সপ্তব্যঞ্জন খেয়ে শরীর ঠিক রাখার। মা, কাকা, কাকি তো রয়েছে সেখানেই যাকনা। আমি একাই বাড়ি পাহারা দেই!
শুভ্রা ইশারায় পিসি শাশুড়িকে চুপ থাকতে বলে। জানে এসব বললে পরে ওকেই হয়তো দু’কথা শুনতে হবে। উঠোন ঝাড়ু দিতে দিতে ওর শাশুড়ি বাতাস’কে শুনিয়ে শুনিয়ে ওকে হা’ঘরের মেয়ে বলে। সে দিন এসব কথা ওখানেই চাপা পরে। ভয় পাওয়া নিয়ে কেউ কিছুই বলে না। কিন্তু পিসিমা অঞ্জনকে চিঠি দেন। এবার আর ওর না এসে উপায় থাকেনা। এর আগে ও যতবার আসতে চেয়েছে, শাশুড়ি স্রেফ চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছেন পূজোর আগে যেন ছেলে বাড়ি মুখো না হয়।
সেদিন বিকেলে এলোচুলে সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রা। হঠাৎ অঞ্জনকে আসতে দেখে খুব অবাক হয়। সাত’টা দিন কিভাবে কেটে যায় সে জানেনা। যাবার দিন অঞ্জন ওকে মাথার দিব্বি দিয়ে বলে যায়, ও যেন ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে। এবার পূজার একটু আগে আগেই অঞ্জন বাড়ি আসবে। শুভ্রাকে কথা দিয়ে চলে যায়। অঞ্জন চলে গেছে প্রায় দু’মাস হতে চললো। বাড়ি সেই আগের মতোই ফাঁকা। প্রতিদিন পুরো বাড়ি পরিস্কার করা ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই। শাশুড়ি পূজা আর্চা নিয়ে থাকেন, দুবেলা দু’মুঠো শুভ্রাই রাঁধে। সব নিরামিষ খাবার, অঞ্জন চলে গেলে আমিষের বাসন গুলোও উঠিয়ে রাখা হয়।
সেদিন রাতে রান্নাঘরের হাতের কাজ সেরে যেই ও শুতে যাবে। হঠাৎ কে যেন ওর পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। শুভ্রা হুমড়ি খেয়ে পরে যায়। হঠাৎ মনে কে যেন তীক্ষ্ণ গলায় হেসে উঠলো। এরপর থেকে শুরু প্রতিদিন দুপুর সন্ধে, রাত, প্রায় ওকে অতিষ্ঠ করে তোলে। আড়াল থেকে, কখনো সামনে এসে ওকে দেখা দেয়। কখনো একটি বাচ্চা মেয়ে। কখনো একজন ঘরের বৌ। হয়তো ও একটা কাজ করছে পিছনে ফিরে দেখে, দরজায় বৌটি এলোমেলো হয়ে বসে আছে। আয়নায় মুখ দেখছে, পেছন থেকে দেখা যায় আর একজন নারীর মুখ। কি বিভৎস সেই মুখ ।
বেঁচে থাকার সাধ ওর প্রতিদিনই মিটে যায়। শাশুড়িকে বলতে গেলেই উনি চুপ করে থাকেন। পরে উঠোন পরিষ্কার করতে গিয়ে বাতাস কে জানিয়ে দেন। ভাল না লাগলে কেউ যেন মায়ের কাছে চলে যায়। এভাবেই চলতে থাকে একাকী নির্জন এই বিশাল বাড়ির ইতিহাস। শাশুড়িকে খেতে দিয়ে আস্তে আস্তে সবই বলে যায় শুভ্রা। অবশ্য বলে কোনো লাভ হয়না। এর মাঝে একদিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখে ওর পুরো গায়ে খামচির দাগ। ভয়ে কেঁদে ফেলে শুভ্রা।
এদিকে প্রায় ছ’মাস হলো ওর মাঝে বেড়ে উঠছে আর একজন । হাটতে কষ্ট হয় শুভ্রার। ওর বেশি ভয় ধাক্কা খাওয়া নিয়ে। এভাবে চলতে থাকলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে নির্ঘাত। একদিন ও ঘুমিয়ে আছে একা ঘরে, ঠিক মাঝরাতে কি একটা শব্দে ওর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখে, বাতাসে ওর মশারি দুলছে। ঘরে আবছা আলো এসে ঢুকেছে। আর কি আশ্চর্য দরজাটা হা করে খোলা। ভেজা চুলে এক নেতিয়ে পরা মেয়ে শিশুকে কোলে নিয়ে বিলাপ করে কাঁদছে একটা মেয়ে। সবকিছু জানিয়ে শুভ্রা আবারো চিঠি লেখে অঞ্জন’কে। অঞ্জন পূজায় বাড়ি এসে, সব দেখে। বাকিটা শুভ্রার কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনে। সেদিন বিকেলেই বাড়িতে নিয়ে আসে মুসলমান এক হুজুরকে। উনি সব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তারপর অঞ্জন কে ডেকে বলেন-
— বাবা তোমাদের এই বাড়িতে দুষ্টু দুইটা প্রেতাত্মা আছে। তারা তোমার স্ত্রীকে হয়তো এই বাড়ি থেকে তাড়াতে বা মেরে ফেলতে চাইছে।
— কিছু তো করুন হুজুর! অঞ্জন ধরা গলায় বলে। আপনাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী যা করতে হয় করুন। তবুও এই মন্দ অবস্থা থেকে আমাদের বাঁচার ব্যবস্থা করুন। অঞ্জনের চোখে স্পষ্ট ভয়।
উনি বাইরে থেকেই বলেন, তুমি কাল এসো দেখি কি করা যায়। পরদিন অঞ্জনের কাছে কি করতে হবে সব বুঝিয়ে দেন। অঞ্জনের হাতে দেন শুভ্রার জন্য একটি তাবিজ আর ঘরের দরজায় ঝুলিয়ে রাখতে দিলেন আরেকটি তাবিজ । উনি নিজে এসে পুরো বাড়ির চারপাশে চারটে লোহার পেরেক পুতে দিলেন। তারপর দোয়া পড়ে পড়ে বাড়ির চারদিকে পানি ছিটাতে লাগলেন। এসব কাণ্ড দেখে শুভ্রার শাশুড়ি দেখেও না দেখার ভাণ করে থাকলো। শুভ্রাও চুপচাপ তাবিজটা হাতে পরে নেয়। পানি ছিটানোর বেশ কিছুক্ষণ পরে ফোঁস ফোঁস করতে করতে দুটি কালো রঙের সাপ বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরের পাকুড় গাছের দিকে চলে যায় । হুজুর বললেন।
— এগুলোই মনে হচ্ছে খারাপ আত্মা। যাক, বাড়ির বাইরে চলে গেছে। আপাতত আর ভয় নেই। তবুও তোমরা সাবধানে থেকো। সেদিন রাতে শুভ্রাকে অনেক কথা বললো অঞ্জন। এতোদিন কথাগুলো না বলতে পারায় মনে হয় ওর বেশ কষ্ট হচ্ছিল। শুভ্রার হাত ধরে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলতে থাকে।
— শুভ্রা শোন। আমার বাবা, কাকা, জ্যাঠা মিলে ছিলেন তিন ভাই। বহুদিন আগে আমার জ্যাঠামশাই
একটি পাপ করেছিলেন। তার ফল ভোগ করছি আমরা সবাই। আমার কাকা বড় চাকরি করতেন। থাকতেন চিটাগাং। বাড়িতে প্রচুর টাকা পাঠাতেন। সব টাকা আসতো আমার কাকিমার নামে। কাকিমা টাকা নষ্ট না করে প্রচুর সম্পদ করেন। এই বাড়িও তৈরি হয় কাকার পাঠানো টাকাতেই। তখন সবাই একসাথে থাকতাম আমরা। কাকিমা ছিলেন খুব সুন্দরি আর বুদ্ধিমতি নারী । উনার একটি মাত্র মেয়ে ছিল। সে বছর বহুদিন পরে মাত্র একমাসের জন্য কাকা বাড়ি এসেছিলেন। এরপর আবার কাকিমা অন্তঃসত্ত্বা হন। লক্ষণ দেখে সবাই বললো ছেলে হবে।
এতো টাকা, সম্পত্তি সব তাহলে কাকিমার দখলে চলে যাবে? জ্যাঠামশাই পড়লেন লোভে। কাকিমা একদিন কাপড় শুকাতে ছাদে গিয়েছিল। জ্যাঠামশাই পেছন থেকে গিয়ে তাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেললেন। চিঠি পেয়ে কাকা এলেন। খুব কান্নাকাটি করলেন। একসময় চিটাগাং চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আমাদের বোনটিকে আমার মায়ের হাতে দিয়ে গেলেন । মা ছিলেন প্রসূতি। এক দুপুরে ‘খুকি’ হারিয়ে গেল। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। পরদিন পুকুর থেকে খুকির লাশ উদ্ধার হলো। কি করুণ সেই দৃশ্য। আসলে জ্যাঠামশাই নিজেই পুকুরে ডুবিয়ে মেরেছিলেন খুকিকে । সেইথেকে আমাদের পরিবার অভিশপ্ত হয়ে গেলো। জ্যাঠামশাই নিজেও একদিন ছাদ থেকে পড়ে মারা যান। আর অন্যদের কথা তোমায় বলেছি। এর আগে বাবা অনেক সাধু, তান্ত্রিক এনেছেন। কোনো কাজ হয়নি। তাই আমি এবার মুসলমান হুজুরের সাহায্য নিলাম। দেখা যাক এখন কি হয়।
যথা সময়ে শুভ্রার কোলে এলো ফুটফুটে এক মেয়ে।অঞ্জন আর সীতাকুণ্ড ফিরে গেলো না। এখানেই একটা চাকরি ঠিক করে নিলো। শুভ্রা আর অঞ্জন দিন রাত পালা করে মেয়ে পাহারা দেয়। তবুও সব দিক রক্ষা হয় না। একরাতে শুভ্রার মেয়ের প্রায় রাতেই প্রচণ্ড জ্বর আসে। এদিকে রাতে বারান্দায় তাকালেই দেখা যায় লম্বা দীর্ঘ ছায়া। হঠাৎ করে মাঝরাতে কে যেন ঘাড়ে শ্বাস ফেলে যায়। বাড়ির আশেপাশে প্রায়ই রাতেই সেই পুরোনো কান্না শোনা যায়।
একদিন সন্ধ্যা থেকে ওর বাচ্চা কাঁদতে শুরু করে। কিছুতেই থামে না। অঞ্জন পাড়ার ডাক্তার নিয়ে আসে। তিনি কিছুই বুঝতে না পেরে চলে যান। পেটে ব্যথা থাকতে পারে, ভেবে বাচ্চাদের একটা ওষুধ দিয়ে যান। ওষুধ খেয়েও বাচ্চার কান্না থামে না। এবার আর সহ্য হয়না শুভ্রার। ও দৌড়ে বাইরে ঘরের বাইরে চলে আসে। চারদিকে তাকায়। ছাদের দিকে দেখে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রা চিৎকার করে বলে
— কাকিমা কই আপনি ! আসুন,আমি প্রাণ দিতে রাজি শুধু আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন। কেউ আপনার সাথে অন্যায় করেছে। কিন্তু আমি বা আমার মেয়ে কি দোষ করেছি বলে যান আপনি। অন্যের পাপের বোঝা আমি কেনো বইতে যাবো! হুহু করে কাঁদতে থাকে শুভ্রা। এই বাড়িতে বিয়ে হবার পরে একদিন ও সে শান্তিতে কাটাতে পারেনি। অহংকারী শাশুড়ি ওর সাথে কথা বলে না। তারপর এসব উপদ্রব। নিজের বেলায় সওয়া যায়। কিন্তু ওর নিষ্পাপ বাচ্চা! ফুলের মতো শিশুটির কি দোষ?
উঠান থেকে ছাদের দিকে তাকায় শুভ্রা। চাঁদের ম্লান আলোয়, দেখা যায় তখনো কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। খুব বিষণ্ণ চোখে চেয়ে আছে বহুদূরের অন্ধকারের দিকে । বাতাসে উড়ছে তার খোলা চুল। একটা ছায়া ছায়া শিশু মেয়েকেও দেখা যায়। মনে হয় শিশুটি মেয়েটির হাত ধরে টানছে। একসময় আর কাউকেই দেখা যায় না। রাত বাড়তে থাকে। শুভ্রার শাশুড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখে একটু কেঁপে ওঠেন। কিন্তু কিছু বলেন না। প্রায় শেষ রাতে অঞ্জন এসে শুভ্রার হাত ধরে।
— ঘরে এসো,খুকীর কান্না থেমেছে ও ঘুমিয়ে পরেছে। মনে হচ্ছে বেশ ভাল আছে। সেই থেকে ওরা ওই বাড়িতে ভালই আছে। এখনো শুভ্রার শাশুড়ি শুভ্রা কোন কথা বললে জবাব দেননা। একা একাই উঠোন ঝাড়ু দেন। আর বলেন –
— ওই তো ভাগ্যের ছিঁড়ি , অবশেষে জন্মালো
কিনা একটা মেয়ে ! আর আমার ছেলে পুড়াই বৌ পাগলা। দিন রাত ওই মেয়ে নিয়েই কি হাসি তামশা। ছিঃ ঘেন্নায় মরে যাই। দিনরাত বৌ এর পিছুপিছু শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে কলিকালে আর কতো দেখবো। হুহ…