ইস্কুলে পড়ার সময় এক সিনিয়র আপু আমাকে “গরু” বলে গালি দিয়েছিল, আমি ভয়াবহ রকমের মন খারাপ করে লজ্জায় কুকড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস পাই নি। কেননা, সেই সময় আমি নিতান্তই এক রাখাল।
বছরে ছয় মাস হাওরে গরু চড়াই। জাল টেনে মাছ ধরি। বানের জলে ধানক্ষেত ডুবে যাওয়ার আতঙ্কে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা না দিয়ে কাস্তে হাতে খেতে নামি। সিনিয়র আপুটার গায়ের রঙ সাদা ছিল। বাবা ছিল অখ্যাত একটা এনজিওর চাকুরে। উপজেলার কোয়াটারে বাসা ছিল। হাই হিল জুতা পরত। দূর থেকে ওকে দেখে সমীহ হত৷ খুব ইচ্ছে হত, একদিন আমিও তার মতো সাদা হই। ওদের মতো হাই-হিল ক্যাডস পরি। দুইতলা ইটের দালানে বাসা হোক আমাদের।
কিন্তু কই। সেই সময়ে আমার সকল বন্ধুরা ছিল পাড়াগাঁয়ের রাখাল। অন্তজ জেলে। হাভাতে দিনমজুর। ওরা প্রায়ই সময় করে আমার ইস্কুলে আসত। স্বাদ করে ইস্কুল বাড়ির দুইতলা বোর্ডিং-এ নিয়ে যেতাম ওদের। বুক চেটিয়ে দেখাতে চাইতাম, কত্ত বড় ইস্কুলের ছাত্র আমি৷ কী ভীষণ অভিজাত আমার ঠাটবাট।
কিন্তু এই ঠাটবাট দেখাতে গিয়েই একদিন সাদা চামড়ার আপুর হাতে নাকাল হয়েছিলাম। আপুর প্রেমিক ছিলেন এলাকার লিডার। রাজনীতি করতেন। রাজনৈতিক দাপট খাটিয়ে বোর্ডিং বাড়িতে রুম নিয়ে থাকতেন। আপু সেই রুমে যেত। দরজা বন্ধ করে প্রেমিকের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়ে বাইরে আসত৷ এইগল্প সবাই জানে। কেউ প্রতিবাদ করে না। মাঝেমধ্যে দুইতলা বোর্ডিং এর নিচে পরিত্যক্ত কনডম পাওয়া যায়। সকলেই দেখে, শুধু আওয়াজ করে না।
পাড়া গা থেকে ইস্কুলে বেড়াতে আসা বন্ধুদের নিয়ে দুইতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে হল্লা করছিলাম আমরা৷ অকস্মাৎ বন্ধ দরজা খোলে গেল। সাদা চামড়ার আপুটি হাতের ইশারায় আমাকে ডাকল। কাছে যেতেই কলার চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,”যা ভাগ এইখান থেকে, শালা গরু!” আমি ভেগে গেলাম। কিন্তু হেরে যাই নি। বলার মত পরিচয় তখন আমাদের ছিল না। ছিল না রাজনৈতিক রক্ষাকবচ।
একটা মাত্র অবলম্বন ছিল, অতলান্ত স্মৃতি শক্তি। কেউ অপমান করলে ভুলতে পারতাম না। এই ঘটনাটাও ভুলি নাই। দুই বছর পর ইস্কুলের যাবতীয় রেকর্ড ভেঙে আমরাই প্রথম আর্টস থেকে এ-গ্রেড পেয়ে গেলাম। এলাকায় আলোড়ন তৈরি হয়ে গেল। সকলেই সমীহের চোখে দেখে। সাগ্রহে জানতে চায়,”ইন্টারমিডিয়েট কোথায় করব? গুরুদয়াল কলেজ নাকি আনন্দমোহন?” সাত পুরুষের কেউই আমার কিশোরগঞ্জ শহরে এসে পড়ার সাহস করে নাই। কিন্তু আমরা ছিলাম ভিন্ন ধারা। ফ্যামিলি থেকে হ্যাচকা টানে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। আদমজী ক্যান্টমেন্ট কলেজ। জীবনের রেখাচিত্র আচমকাই বদলে গেল। কলেজেও ফাস্ট হলাম। আসমানে উড়াল দেওয়ার সাহস হল। আসমান আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়!
তখন ঢাবিতে পড়ছি। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। ফাস্টক্লাস ফাস্ট। গল্পটল্প লেখা শুরু করি নাই। কবিতা লিখছি। স্বপ্ন তখন কবি হবার। পৌষের বন্ধে কিশোরগঞ্জ শহরে বেড়াতে গেলাম। বন্ধুর ভাইয়ের বিয়ে। দল বেঁধে একটা হোটেলে উঠেছি। সকলেই আনন্দ ফুর্তি করে। আমি উদাস চোখে সন্ধ্যার অন্ধকার ও কুয়াশায় ম্লান হয়ে আসা নাক্ষত্রিক আকাশের দিকে তাকিয়ে কবিতার শব্দ মেলাই। আচমকা কেউ একজন রাস্তার ওপার থেকে ডাক দিল,”এই নিজাম, এই-!” চমকে ফিরে তাকাই। তাকিয়ে বিহ্ববল হয়ে যাই। সাদা চামড়ার সেই আপুটি হাসি মুখে রাস্তা পেরিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আন্তরিক কণ্ঠে জানতে চায়,”এইখানে তুই?”
“বিয়েতে এসেছি।”
“কনে পক্ষ?”
“না। বর পক্ষ।”
“আমি এসেছি কনে পক্ষের হয়ে, কী আশ্চর্য!”
আশ্চর্য সেও হয়েছিল, আমিও হয়েছিলাম। সে আশ্চর্য হয়েছিল পক্ষ-বিপক্ষের বৈচিত্র্য দেখে। আর আমি, এককালে গরু বলে গালি দেওয়া একটা ছেলের গা ঘেষে দাঁড়ানো আপুটির বিগলিত ভাব দেখে! “তোর কথা অনেকেই বলে। ভালো করছিস। দোয়া করি, এগিয়ে যা-!”
আমি মাথা নুইয়ে ওর আশীর্বাদ গ্রহণ করি। কিন্তু ঠোঁটের কোনে একটা তাচ্ছিল্যের রেখা। ওকে পাত্তা দেই নি। নিরস গলায় দুইটা কথা বলে দূরে সরে যাই। আমি এইভাবেই প্রতিশোধ নেই। গালাগালি নয়। থাবড়াথাবড়ি নয়৷ নিজে বড় হয়ে বড়কে ছোট করে দেওয়া৷ কিন্তু তখন আমার বয়স ছিল অল্প। জীবনের রঙ্গরেখা তখনো অজ্ঞাত। একটা ভুল মানুষের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমি নিজেই ভুল করে ফেললাম। ভুলে যে করেছি তা কিন্তু সেই দিনই ধরা পড়ে নি৷ ধরা পড়ল একমাস পরে।
গ্রামে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। খবর পেয়ে আমার এক কলেজ পড়ুয়া ভাগ্নে ওর দুই বন্ধুকে নিয়ে দেখা করতে এল। ওরা আমাকে আইডল ভাবত। কিন্তু আমি ছিলাম কবিতা লেখার মুডে। ওদের পাত্তা দিলাম না। ভ্রু কুচকে দায়সারা গোছের দুইটা কথা বলেই বিদায় করে দিলাম। যাওয়ার আগে একজন হাসিমুখে বলল,”ভাই আমার খুব ইচ্ছে ঢাবিতে পড়ার!” আমি শুকনো গলায় বললাম,”ভালো।”
“কিছু টিপস দিবেন?” “আজ একটু ব্যস্ত। অন্য কোনদিন ওরা বেজার হয়ে চলে গেল। দুইদিন পর আমার ভাগ্নে বলল,”খুব মন খারাপ করেছে ছেলেগুলা। ওরা তোমাকে নিয়ে কত গর্ব করে। এলাকার বড় ভাই অথচ তুমি এমন তাচ্ছিল্য করলে ভাগ্নের কথা শুনে অল্প একটু মন খারাপ হল। ভাবলাম, আবার যখন দেখ হবে, দুইটা মন ভোলানো কথা বলে খুশি করে দেব। দেখা হল দুই বছর পর। ওদের একজন তখন বুয়েটে পড়ছে। অন্যজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য অনার্স। আমার থোতা মুখ ভোতা হয়ে গেল। আড়ালে কান ধরে শপথ করলাম, জীবনে যাই করি, তাচ্ছিল্য কোনদিন কাউকে করব না আর!
নিজে তাচ্ছিল্য না করলেও, এখনো মাঝেমধ্যে ভয়াবহ তাচ্ছিল্যের শিকার হই৷ দুই বছর আগে স্যারের সঙ্গে এটিএন বাংলার অফিসে গেলাম। এক উঠতি নায়কের সঙ্গে দেখা। তার একটা সিনেমা তখন খুব হিট। ধুমায়ে ব্যবসা করছে। নতুন ছবিতে সাইন করিয়ে নেবার জন্য হাউজগুলি তার পেছনে পেছনে ঘুরছে। সিনেমা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাই হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলাম। নায়ক উত্তর দিল না। আমি বললাম,”ভাই আপনার সিনেমাটা দেখেছি। অসাধারণ অভিনয় করলেন।” নায়ক সাহেব বিরস গলায় জানতে চাইলেন,”ভাইয়া বলছ কেন? দুনিয়ার সবাই কি ভাই লাগে?”
আমি ধাক্কা খেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,”স্যরি বস। মুদ্রা দোষ! বস, আপনার সিনেমাটা দেখেছি বস, অসাধারণ অভিনয় করেছেন বস..!” নায়ক সাহেব মাছি তাড়ানোর মত একটা ভঙ্গি করে বললেন,”আচ্ছা যাও, বস ওদিকে। একটু ব্যস্ত আছি..!” আমি ওর থেকে একটু দূরে গিয়েই স্মোকিং জোন পেয়ে গেলাম। পকেট থেকে সিগারেট বের করে আগুনে অভিমান পোড়াচ্ছি আর নিখাদ আনন্দের সঙ্গে ভাবছি, ভুল করে ফেললেন ভাইয়া। এইভাবে কাউকে তাচ্ছিল্য করতে নেই। কেননা, জীবন আমাকে একেবারেই অন্যভাবে কিছু জিনিস শিখিয়েছে।
যে তোমাকে আজ তাচ্ছিল্য করে, আগামীকাল তুমি তার থেকেও বড় হয়ে যাবে…. মাস্ট! তুমি যাকে আজ তাচ্ছিল্য কর, একদিন সে তোমার থেকেও বড় হয়ে যাবে… মাস্ট। জীবন আমার পিতার মত। সে কখনো ভুল শিক্ষা দেয় না! উঠতি নায়ক পড়ে গিয়েছেন। বাদ-বাকি অনেকেই বিনয়, ভালোবাসা ও প্রীতিময় ব্যবহার নিয়ে ঠিকে আছেন। ঠিকে থাকবেন মাস্ট!