খোকা এই খোকা

খোকা এই খোকা

দীর্ঘ পাঁচ মাস পর মা’র কাছে যাচ্ছি। সে বায়না ধরেছে ছুটির কয়টা দিন বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে। প্রথম প্রথম যেতে ইচ্ছে করছিল না। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, তেমন একটা ছুটি-ছাটা পাই না। বন্ধুরা ছুটির এই কয়দিন বিভিন্ন যায়গায় ঘুরতে যাবার প্ল্যান করেছ। ছুটির আগে আজই শেষ ক্লাস ছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে আসার সময় আগামীকালের প্ল্যান সেট হয়ে গেছে। কাল সবাই মিলে ফ্যান্টাসি কিংডমে যাবার কথা। মেসে ফেরার পর থেকে বার বার মা’র মায়া ভরা মুখটা ভেসে আসছে। মনের ক্যানভাসে জমে থাকা ছোটবেলার স্মৃতি গুলো একের পর এক দৃশ্যমান হয়ে যাচ্ছে- অবচেতন মনে ঘণ্টার মতো বেজে চলেছে মা’র চিরচেনা কন্ঠস্বর- “খোকা এই খোকা।”

ছোটবেলায় আমি একদমই খেতে চাইতাম না। মা ভাতের বাটি নিয়ে আমার পিছু পিছু ঘুর ঘুর করতো। মাঝে মাঝে রাগ হয়ে যেত। এক লোকমা মুখে দিতেই তার সমস্ত মুখমণ্ডল হীরের ন্যায় চকচক করত, হাসিমুখে সে বলত- “এইতো আমার লক্ষ্মী সোনা।” রাতে না ঘুমিয়ে পেঁচার মতন মিট মিট করে তাকিয়ে থাকার বাতিক আমার ছোট থেকে। রাতে যখন মিট মিট করে তাকিয়ে থাকতাম, মা’র মিষ্টি কণ্ঠে তখন একের পর এক ছড়া আবৃত্তি চলত-

“আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।” ছড়া শুনতে শুনতে কখন যে ঠিক ঘুমিয়ে যেতাম, বুঝতাম না। ছোটবেলা আমার একটা বাজে স্বভাব ছিল। ঘুমের মধ্যে প্রায়ই বিছানা ভাসিয়ে দিতাম। সেই কত রাতে মা সেসব বদলে দিতো। কত ধৈর্যের বহিঃপ্রকাশ এতে রয়েছে। আজ যখন কোন বাচ্চা কোলে প্রসাব করে দেয় মা’র সেসব দিনের ধৈর্যের সামান্য হয়তো বুঝতে পারি। বয়স ভারে সে এখন পাওয়ারের চশমা পড়ে। মা’র ঘরে আমার ছোটবেলার একটা ছবি ফ্রেমে বন্দী করা আছে। আজ পর্যন্ত কোনদিন দেখলাম না তাতে এক বিন্দু ধুলোবালি জমেছে। বাবার মৃত্যুর পর থেকে পুরোটা সংসার সে নিজের হাতে চালিয়ে আসছে। আমার ছোট ভাইটা হাইস্কুলে পড়ে। মা সেই স্কুলেরই ইংরেজির শিক্ষক। এক নামে তাকে পুরো গ্রামের মানুষ চেনে “রাজিয়া বেগম” ইংরেজি বিষয়ের মাস্টারনি। খুব বিলাসবহুল জীবন না কাটালেও ছোট থেকে আজ পর্যন্ত অভাব জিনিসটা ঠিক কি, মা আমাদের কখনো বুঝতে দেয় নি।

সে কত আকুল হয়ে বসে আছে, কতদিন ছেলের মুখ দেখে না, ভাল মন্দ রেঁধে খাওয়াতে পারে না। মেসে কি খাই না খাই- এসব নিয়ে তাঁর চিন্তার কোন শেষ নাই। প্রতি রাতে সে একবার করে ফোন করবেই। আমার সাথে কথা না বললে নাকি তাঁর ঘুম আসে না। মাঝে মধ্যে শরীর খারাপ করলে ফোনে কথা বলতেই মা’র কাছে ধরা পরে যাই। শুধুমাত্র ফোনে কথা বলে এতো দূর থেকে মা কি করে বুঝে যায়! -সেই রহস্যের সমাধান আমি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। মাও তো কত অসুস্থ হয়, মাঝে মাঝেই তার প্রেশার হাই হয়ে যায়, সুগার লেভেল লো হয়ে যায়- কৈ কখনো তো আমি বুঝতে পারি না, তাহলে মা কি করে বুঝে যায়?

মায়ের মুখ উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারলাম না। অনলাইনে রাতের গাড়ির টিকিট কেটে, মেস থেকে বের হয়ে কাউন্টারে চলে গেলাম। গাড়ি কাউন্টারের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ছাড়বে রাত সোয়া দশটায়, এখন বাজছে রাত নয়টা পঞ্চাশ মিনিট। আমি মা’র ফোনকলের অপেক্ষা করে আছি। রাত দশটার দিকে প্রতিদিন মা ফোন করে, আমি জানি আজও তার ব্যতিক্রম হবে না। রাত ঠিক দশটার দিকে মা ফোন করল। গাড়ির শব্দ শুনে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞাসা করল- “এত রাত হয়ে গেছে এখনও মেসে ফিরিস নি কেন?” আমার ইচ্ছা- মাকে সারপ্রাইজ দেবো। বাড়ি যাবার ব্যাপারে কিছু না বলে বললাম, “কিছু জিনিসপত্র কিনতে নিচে এসেছি।” কথাটা ঠিক মিথ্যা না, গাড়িতে দূরে কোথাও যাবার সময়, সবসময়ই আমি কিছু চকলেট, চিপস এসব কিনে নেই। আজও কিনবো।

–“গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন বাবা? কি হয়েছে?”
–“কিছু হয়নি মা আজকে বেশ জার্নি করেছি তো, রাস্তায় জ্যাম-জট ছিল। টায়ার্ড লাগছে।”
–“কি কিনবি, তাড়াতাড়ি কিনে মেসে ফিরে যা।”
–“আচ্ছা।”
–“রাতে খেয়েছিস তো?”
–“হ্যাঁ, খেয়েছি।”
–“আচ্ছা বাবা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়িস।”
–“আচ্ছা।”

মা আমার এমনই, আমাকে নিয়ে তাঁর শত-সহস্র চিন্তা। আমাদের বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নে। বাড়ির সাথেই আমাদের একটা পুকুর আছে। পুকুরে সরপুঁটি, তেলাপিয়া, রুই-কাতলা এইসব মাছ ছেড়েছে আমার কাকা। মাছ এবং গাছ এই নিয়ে তাঁর যত কারবার। মা’কে যদি বলতাম আমি আসছি, তাহলে সকালেই হয়তো কাকাকে মাছ ধরতে লাগিয়ে দিতো। বাড়ির চারপাশে কাকা- আমগাছ থেকে শুরু করে জলপাই, বড়ই, কাঁঠাল, পেয়ারা, জাম্বুরা, লিচু গাছ লাগিয়েছে। এসব ফলমূল আমাদের কিনে খেতে হয় না বললেই চলে।

সকাল আটটার দিকে গাড়ি থেকে নেমে এক কাপ গরুর দুধের চা খেয়ে অটোতে উঠে বসলাম। গ্রামে আগে ভ্যানগাড়ির খুব প্রচলন ছিল। অটো বাইক আসার পর ভ্যানগাড়ির সংখ্যা একদমই কমে গেছে। অটোতে উঠার পর থেকে মনের মধ্যে ভীষণ চঞ্চলতা বিরাজ করছে। একবার ইচ্ছে করছে অটো থেকে নেমে ধানক্ষেতে চলে যাই, আরেকবার ইচ্ছে করছে কারও বাড়ির আমগাছ গাছ থেকে দু-তিনটা আম চুরি করি। কোন কোন বাড়ির রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে মাটির চুলোর ধোঁয়া। মা’ও খুব সম্ভবত এখন রান্নাঘরেই আছে। প্রতিদিন সকালের খাবার আমাদের রান্নাঘরেই খাওয়া হয়। মা’র পাশেই বোধহয় বসে আছে ছোটভাই সোহান। কাকী নিশ্চয়ই মাকে রান্নায় সহযোগিতা করছে।

কাকা ঠিক কি করছে বলা বেশ মুশকিল। সে একেক সময় একেক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কখনো গরুকে খাবার দেয়া, কখনো গাছের যত্ন নেয়া, আবার কখনো কখনো সকাল সকাল সাইকেল নিয়ে কোথায় না কোথায় বেরিয়ে পড়ে। অটো থেকে নেমে দৌড়ে বাসায় ঢুকলাম, কাকা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। আমাকে দেখেই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলাম। শব্দহীন পায়ে রান্নাঘরে ঢুকে পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার হাত দুটো ধরে পিছন ফিরতে ফিরতে মা বলল, “রাত থেকে আমার মনে হচ্ছে তুই আসবি। তোর কাকীকে একটু আগেই তোর কথা বলছিলাম। জিজ্ঞাসা করে দেখ।” কাকী বলল, “হ্যাঁরে ভাবী এই একটু আগেই তোর কথা বলল।”

–“তাহলে তো আমার আসা ঠিক হয় নাই। তুমি তো আগে থেকেই জানতে।” মা আনন্দিত এবং অভিমান জড়ানো গলায় বলল, “ওমা! সে কি কথা?”
–“তুমি সবকিছু আগে থেকে জেনে যাও কি করে, বল তো?”
–“সে তুই বুঝবি না। যা তাড়াতাড়ি হাত মুখ-ধুয়ে আয়। একসাথে নাস্তা করবি।”

সোহান হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে। আমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিরে মোটু কেমন আছিস?” সোহান গম্ভীর গলায় মাকে বলল, “মা দেখলে? আসতে না আসতেই শুরু করে দিছে।” সোহানকে রাগাতে বেশ লাগে, মা কিছু না বলে হাসছে। আমি বললাম, “মোটু কে মোটু বলা যাবে না? ভুঁড়িটা যা বানিয়েছিস বস, কোন মেয়ে তো পাত্তা দিবে না?” সোহান এবার গলায় রাগ রাগ ভাব এনে বলল, “মা তোমার ছেলেকে কিছু বলবা?” মা হাসতে হাসতে আমাকে বলল- “দুষ্টুমি বাদ দিয়ে, হাত-মুখ ধুয়ে এসে নাস্তা কর।” আমি হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করতে বসলাম। মা আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “এত শুকিয়ে গেছিস কেনরে? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতন করিস না? বুয়া ঠিকমতন রান্না করে না?”

–“মা তুমি প্রতিবার এই একই কথা বল কেন? আমি কোথায় শুকালাম? কাকী দেখ তো আমি কি আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছি?”

কাকীও মা’র মতন বলল, “সত্যিরে অনেক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিস।” কাকী হচ্ছে আমার দ্বিতীয় মা, মা’র যা যা মনে হয়, কাকীরও তাই তাই মনে হয়। মায়ের মতো কাকীও আমায় লালন-পালন করেছে। ছোট থাকতে মা আমাকে কাকীর কাছে রেখে স্কুলে যেত। কাকী আমায় গোসল করিয়ে দিতো, খাইয়ে দিতো, কত রকম গল্প যে শোনাত। গ্রামে এলে এখনো আমরা তাঁরা ভরা আকাশের নিচে বসে গল্প করি, ছোটবেলার মতো রূপকথার গল্প না, বাবা, দাদা-দাদীর গল্প। আমি হয়েছি দাদার মতো ঠান্ডা, সোহান হয়েছে বাবার মতো। গল্পের শুরুটা হাসাহাসি দিয়ে শুরু হলেও শেষটা হয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তাঁরা কেউ আর এই পৃথিবীর বাসিন্দা নন, অথচ তাদের স্মৃতিগুলো আজও রয়ে গেছে অমলিন।

গ্রামে এলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়াটা একটা দায়িত্ব হয়ে যায়। ছোটবেলার বন্ধুদের মধ্যে সুজন এখন তুলা ব্যবসায়ী। বাজারের মাঝখানটায় তাঁর তুলার দোকান। গ্রামে যেই কয়টা দিন থাকি নিয়ম করে সে তিনবেলা ফোন করতে একদম ভুল করে না। সকালে, বিকালে, দোকান বন্ধ করার সময়। আমি গ্রামে এলে সে দোকান অন্যান্য সময়ের আগে বন্ধ করার চেষ্টা করে। জীবিকার তাগিদে গ্রামের বন্ধুরা এখন মহাব্যস্ত। সুজন, মামুন, আশরাফ, মিতুল বাদে গ্রামে কেউ নেই। কেউ চলে গেছে দেশের বাইরে, কেউ শহরে অথবা অন্যত্র। সবার সাথে দেখা হয় রাতে মোহনলালের হোটেলে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের আড্ডাবাজি চলে।

আমাদের গ্রামের দক্ষিণে বয়ে গেছে হিমশীতল স্বচ্ছ জলের নদী। নদীর নাম তিস্তা। রাতের তিস্তা আমায় তীব্র আকর্ষণ করে। চাঁদের আলোয় তিস্তায় এক অদ্ভুত সৌন্দর্য বিরাজ করে। গ্রামে এলে বন্ধুদের নিয়ে নিয়ম করে রাতের তিস্তা দেখতে যাই। গ্রামে এলে মামুন কোত্থেকে যেন অটো যোগাড় করে। অটোতে ডিস্কো গান বাজাতে বাজাতে আমরা তিস্তার পাড়ে যাই। কোন কোন দিন আমরা তিস্তার জলে স্নান করি। এবারও তার ব্যতিক্রম হলনা। আমরা সবাই মিলে পর পর দুদিন রাত দশটার পর তিস্তার পাড়ে গেলাম। দু’বারই মামুন অটো নিয়ে এসেছে। আমাদের সাথে যোগ হয়েছে গ্রামের কিছু সদ্য বয়ঃসন্ধী পেরুনো ইঁচড়েপাকা। আমি গ্রামে এলে ওরা আমার সাথে সাথেই থাকে। হৈ-হুল্লোড় করতে করতে আমরা তিস্তার পাড়ে গিয়েছি। নদীর হিমশীমল জলে সবাই মিলে চন্দ্র-স্নান করেছি।

গ্রামে এলে দিনগুলো কেমন করে যেন দেখতে দেখতেই ফুরিয়ে যায়। সাতটা দিন যেন চোখের পলকে কেটে গেল। ফিরে আসার দিন- সকাল থেকেই মা’র মন খারাপ। রাতে কাউন্টারে যাবার জন্য বাড়ি থেকে বের হবার সময়, সে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছে। অটোতে উঠার আগ পর্যন্ত সে কাঁদছিল। বার বার বলছিল- “বাবা সাবধানে যেয়ো, গিয়ে ফোন কোরো। ঠিকমতন খাওয়া-দাওয়া কোরো।”

গাড়ি চলতে শুরু করেছে বেশ কিছুক্ষণ। ভেতরের বাতিগুলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার সামনে বার বার ভেসে আসছে মা’র মায়া ভরা মুখ। মনের ক্যানভাসে জমে থাকা ছোটবেলার স্মৃতিগুলো একের পর এক দৃশ্যমান হয়ে যাচ্ছে- আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি মা’র চিরচেনা সেই কন্ঠস্বর- “খোকা এই খোকা।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত