মধ্য রাতের স্বপ্ন

মধ্য রাতের স্বপ্ন

” এইযে সাহেব , লজ্জা কিনতে এসেছেন ? এমন প্রশ্নে চমকে যাওয়াটাকে নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক বলা যায় না একদম। চোখের ইশারায় আমি খুব একটা অভ্যস্ত নই । আজকাল জ্বরটা ঘন ঘন হচ্ছে । ওষুধ খেলে কিছুটা বিরতি দিয়ে আবার শরীরের তাপমাত্রা অধিকমাত্রায় বেড়ে যায় । লক্ষন ভালো না । মাথা ব্যথার জন্য ডাক্তার ডাইকোফ্লেনাক্স সোডিয়াম দিয়েছেন । জ্বর হলে আমার ঘুম আসেনা । অগত্যা গভীর রাতে ল্যাম্পপোস্ট আর চাঁদের আলোয় মাখা মাখি করতে মন চায় । মধ্যরাতে ফার্মগেট এলাকায় এমন কারবারি চলে তা অজানা নয় । কালো বোরখার মুখোশ পরে ওভারব্রিজের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ইশারায় কথা বলে । আমি ফিরে তাকিয়ে উত্তর দিতে চেয়ে দেইনা । মধ্যরাতে এই রাস্তায় খুব একটা জ্যাম দেখা যায়না । সময়ের বেশ ব্যবধান রেখে শো শো করে দামি কিছু পাজেরো বা মার্সিটিস দেখা যায় । দূরে লাল – নীল আলোয় পুলিশের টহল গাড়ির হুইসেল আনমনা ভ্রম কাটিয়ে দেয় ।

আমি ওভারব্রিজের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে ক্রমান্বয়ে এপাশ ওপাশ করে যায়গা বদল করি । গলায় শব্দ করে কোণায় দাঁড়ানো কালো মুখোশের ওপাশ থেকে থেমে থেমে বললো ,” সাহেব, পছন্দ হয়নাই ? ” বেশ অপ্রস্তুত বেশে বললাম , ” আপনি যা ভাবছেন তা না । ভুল করছেন । ” আমরা বুঝি সাহেব । লজ্জা পাইয়েন না । আমাদের আর আপনাদের লজ্জা থাকতে নাই । এ শহরে লজ্জা বিক্রি করে আহার যোগাড় করতে হয় । বলতে পারেন সাহেব, লজ্জা কিনে আপনারা কি আনন্দ পান ?  আমি বেশ বিব্রত হয়ে তাকাই । কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্নোত্তর পর্বে উত্তর মিলেনা । আনন্দ সিনেমা হলের সামনে একদল কালো বোরখার মানুষ । স্যুট – বুটের কিছু ভদ্রলোক । কিছুক্ষন কথা হওয়ার পর কালো বোরখার একজন করে গাড়িতে উঠছে । এই যাবে? ৪০০ পাবে। পাঁচশ দিয়েন স্যার। সাড়ে চারশ, হবে ? ঠিক আছে স্যার।

মধ্যরাতের এই লজ্জা বিক্রির বাজারের সাথে অন্ধকারের বেশ খাতির । অন্ধকারের সাথে সাথে বাজার জমজমাট হয়ে ওঠে । দরকষাকষির এমন কথাবার্তাই হয়তো হচ্ছিলো । দীর্ঘশ্বাসের কম্পনে বুঝতে পারি মেয়েটি আমার থেকে দুই ফুট দূরে এসে দাঁড়িয়েছে । কি ভাবছেন সাহেব ? ওদিকে তাকিয়ে কি চিন্তা করছেন? লজ্জা বিক্রি হতে দেখছেন বুঝি ? এক এক লজ্জার দাম বেশিনা । মাত্র তিনশত টাকা । বললেন না আমারে পছন্দ হইছে কি না ! খদ্দের ধরে লজ্জা বিক্রি করতে না পারলে কাল খাবো কি একবার ভেবেছেন ? ”

আমি কেমন নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে আছি । রাতের গল্প চোখে দেখতে দেখতে সম্ভবত হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছি । কালো বোরখার মানুষের বেশ কয়েকটি প্রশ্ন জমে আছে । উত্তর দিবো দিবো করেও দিয়ে উঠতে পারছিনা , গুলিয়ে যাচ্ছে । জ্বরে শরীর কাঁপছে রীতিমতো । কথা বলার সাহস কিম্বা শক্তি হারিয়েছি প্রায় । কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “এ লাইনে কতদিন?”

” ওই , যেদিন থেকে খাওয়ার প্রয়োজন মনে হলো ! সেদিন থেকেই । লজ্জা বিক্রির ব্যবসা আছে জানা ছিলো না । এখানে এসেই জানলাম । মামা পথ দেখাইছে । মা মরে যাওয়ার পর থেকে মামার বাড়িতেই মানুষ । শহরে ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার আশায় এসে অন্যরকম এই কাজের সন্ধান দিলো মামা । সহজ কাজ । রাতে রাতে লজ্জা বিক্রি করতে হবে । তিনশো টাকা দরে । আমি পাবো একশো আর তিনবেলা খাবার । লজ্জা বিক্রি করা সহজ কাজ না সাহেব ? ”

লজ্জা বিক্রি করা সহজ কাজ না সাহেব ? চমকে ওঠার মতো প্রশ্নে নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে পরে । আমি এড়িয়ে যেতে চাই । এমন ভারি প্রশ্নের উত্তর জানা নেই বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা । সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম “হাঁটবে ওদিকে?” একটু আশ্চর্য হতে লক্ষ্য করলাম । ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষন চুপ থেকে কালো বোরখার আচ্ছন্ন মানুষটি বললো , ” সংসদ ভবনের ওদিকে ? না । ওদিকে যাওয়া নিষেধ । টাকা দিবো। তিনশ না , পাঁচশ দিবো । প্রথম সিগারেট শেষ। দ্বিতীয়টি মুখে দিতে দিতে বললাম আমি । ” লজ্জার দাম তিনশো । বেশি দিতে হবেনা । চলুন ।

পথের দুপাশে সোডিয়াম আলোয় আমার সাদা শার্টের রং বদলে হলুদ দেখাচ্ছে । সাদা শার্টের এই একটা সুবিধা । একেক সময়ে একেক রং উপভোগ করা যায় । হলুদ , সোনালী আবার অন্ধকারে ভয়ানক পর্যায়ের কালো । কালো রং আমার কাছে বেশ রহস্যমুখর লাগে বলে আমি আঁধারেই হাঁটতে পছন্দ করি । শাদা শার্ট অন্ধকারে কালো দেখানোর কথা থাকলেও সাদা দেখায় । এর মাঝে অবশ্য অন্যরকম ব্যাপার স্যাপার আছে । কালো প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট । দূর থেকে অন্ধকারে প্যান্ট দেখা যাবেনা অথচ শার্ট দেখা যাবে । চমকে উঠে পথিক রাস্তার মোড় নেবে । এই মধ্যরাতের হিন্নতার গল্পদেরকে চমকে দেওয়া দরকার । অথচ এমন গল্পে আমরা এমনভাবে চমকে উঠি । হিন্নতার গল্পেরা জিতে যায় । ভাঙা ভাঙা স্বরে জিজ্ঞেস করি , নাম কি আপনার ? নীলা । সহজ সরল নাম । নীলা । সম্ভবত বেদনার রং নীলের সাথে সামঞ্জস্য করে নাম রাখা হয়েছে । সুন্দর নামের ভাবার্থ থাকে । আবার অসুন্দর নামেরও থাকে । মানুষ মাথা ঘামায় সুন্দর মানুষ নিয়ে, না হয় অসুন্দর নাম নিয়ে ।

” রাতে টহল পুলিশ কিছু বলেনা আপনাদের ? ” সংসদ ভবনের পাশে গাছের ডাল ছিঁড়ে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করি। ” তাদেরও জৈবিক চাহিদা আছে । ইউনিফর্ম গায়ে সময়ে অসময়ে চাহিদা মিটিয়ে নেয় । মিটে যায় । শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে খাকি পোষাক গায়ে জড়ালেই কি মানুষ দায়িত্ববান হয়ে যায় সাহেব ? ” আবার ভারি প্রশ্ন । এই ধরনের মানুষেরা বেশ যৌক্তিক হয়ে থাকে । প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন করতে হয় । ‘হাঁটবেন?’ মেয়েটি স্পষ্টভাবে আমার দিকে তাকায় ।

একটু থেমে হাঁটতে শুরু করি । সংসদ ভবনের এপাশেও লজ্জা বিক্রিত ব্যবসা হয় । রাতের ব্যবসা । হাঁটতে হাঁটতে দু’জোড়া পায়ের একসাথে হয়ে যাওয়া । এলোমেলো পায়ের ছাপ কাটিয়ে পা মিলিয়ে পা ফেলা । কথা বার্তায় স্পষ্ট বেশ পড়ালেখা জানা মেয়ে । স্কুল পেরিয়ে কলেজে পড়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে হয়ে ওঠেনি । ধানমন্ডি সাতাশ দিয়ে উদ্দেশ্য সংকর হয়ে জিগাতলা । হাঁটতে হাঁটতে আসি ঢাকা কলেজের সামনে । চন্দ্রিমার কাঁচা বাজারে কলেজ জীবনে কতো আড্ডা দিয়েছি ! একসাথে গোল হয়ে বসে চা খাওয়া । সিগারেটের বিলটা একজনের হাতে দিয়ে আস্তে করে সবার কেটে পরা । আমি একবার সেদিকে তাকিয়ে সেই জীবনে ফিরে যাই ।

কলেজের সামনে খানিকটা বসি । মাথার উপরে স্পষ্ট লেখা , ” ঢাকা কলেজ । ” ঠিক বিপরীত পার্শ্বে লেখা সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি, ” নো দায়সেল্ফ । ” অর্থ , নিজেকে জানো । আমরা সত্যিই নিজেকে জানি বা জানার চেষ্টা করি ? যদি নিজেকে জেনেই থাকি তবে এটাও জানি , সমাজের অমানুষগুলো দেখতে ঠিক মানুষের মতোই । শুধু কাউকে জানতে দেইনা হয়তো । পাছে ভোট হারানোর ভয় ।

” লজ্জা বিক্রির কাজটা ছেড়ে দিতে পারবেন ? ” একপ্রকার কঠোর কন্ঠেই বললাম । এই ধরনের কথা বলার উদ্দেশ্য আমার জানা নেই । জানার প্রয়োজনের ইচ্ছে থাকারও কথা না । বলাটা প্রয়োজন তাই বললাম । ” দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়াটাকেও আপনাদের সহ্য হয়না সাহেব ? ” প্রকট ধরনের প্রশ্ন করাটা মেয়েটার স্বভাব । সম্ভবত উত্তর নেই এমন প্রশ্ন মাথায় সাজানো থাকে । সুযোগ পেলেই জানতে চেয়ে বসে । অথচ জানা যাবেনা জেনেই এমন জানতে চাওয়া বলে আমার ধারনা ।

” হাতটা ধরি? ” উপরন্তু না ভেবেই বলে ফেললাম । সময়ের অপেক্ষা না করে হাত চেপে ধরে বললাম ” সব সাহেব মধ্যরাতে লজ্জা কিনতে আসে ধারনাটা ঠিক নয় । ” মধ্য রাতের লজ্জা বিক্রেতার হাত ধরে রাত ফুরোলেই মানুষ ছেড়ে যায় । নতুন কিছুনা এমন । রাত শেষের দিকে । কোথায় যাবেন বললেন না ? ” আকাশের দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো মেয়েটি ।

আমি পকেটে থাকা শেষ সিগারেটটা জ্বালালাম । “চলুন আমার সাথে” বলেই হাঁটতে থাকলাম । নিউমার্কেট দিয়ে শাহবাগ হয়ে আবার ফার্মগেট । পূর্ব রাজাবাজারের প্রথম গলির তিন নাম্বার বাসা । পেছন থেকে নিলা বললো “তবে এটাই লজ্জা আর বিবেকের ধ্বংস হবার যায়গা?” দাঁড়িলাম। এলোমেলো পায়ের ছাপ কাটিয়ে একসাথে হাঁটবো বলে । মাথা নাড়িয়ে বললাম “না, লজ্জা আর বিবেক ফিরিয়ে সুস্থ আর স্বাভাবিক গল্পের সন্ধান পাওয়ার আশা পূরণের। বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেন না”

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে নীলা বললো “স্বপ্ন দেখাটাও সবার জন্য না । ভয় হয় । পাছে আবার না স্বপ্নকেও পাইকারি দরে বিক্রি করতে হয়।” একটু থেমে বেশ ভারি কন্ঠে নীলা জানতে চায় “আচ্ছা একজন মধ্যরাতের অভাগীর স্বপ্ন পূরণ না হয় করলেন, তবে বাকিদের ক্ষেত্রে কি হবে? লজ্জার সাথে আপনারা ভদ্রসমাজের মানুষেরা স্বপ্নও কিনে নিয়ে যান। জানা আছে আপনার?” খুব বেশিক্ষন সময় নিয়ে উত্তর খুঁজতে গিয়েও পারিনি। শুধু মাথা নাড়িয়ে জবাব দেই “হ্যাঁ। সমাজের অসভ্যতাকে নিয়ে ব্যবসা করা মুখোশগুলো সভ্য সমাজেই লুকোনো।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত