আবীরের ইচ্ছেঘুড়ি

আবীরের ইচ্ছেঘুড়ি

টিয়ে রঙের শাড়ি, লাল ব্লাউজ, কপালে লাল টিপ, চোখে কাজল আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজলাম আবীরের মনের মতো করে,,,

-আবীরের সাথে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে পরিচয় ফেসবুকের কল্যানে। ফেসবুকে একটা আইডি আমার সামনে সামনে ঘুরছিলো,,,কি মনে হতেই ওই আইডি তে ঢুকলাম, ঢুকে দেখি অদ্ভুত ধরনের সুন্দর কিছু জায়গার ছবি আর ছবি গুলোর নিচে লেখা ফটো ক্রেডিট আবীর,,,,আবার ওই জায়গা গুলো সম্পর্কে খুব সুন্দর করে বর্ননা করা, কিভাবে জায়গাগুলোতে যাওয়া যায় তাও লেখা আছে প্রত্যেকটি ছবির নিচে,,,,

-বুঝতে পারলাম এই আইডির মানুষ একজন ভ্রমণপিপাসু,,,,আর জীবন সম্পর্ক খুব ইতিবাচক কিছু লেখাও ছিলো সেখানে। তার ফলোয়ারের সংখ্যাও ছিলো অনেক,ভাবলাম এমন একজন মানুষকে ফ্রেন্ড লিস্টে রাখতে পারলে মন্দ হয় না,,, তাই ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠালাম আমি,,,কয়েকঘন্টা পড়ে রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট হলো, মনে মনে খুব খুশিই হলাম,,,

-রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করার জন্য আবীরকে একটা মেসেজ দিলাম, “আমার রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ,,, ” কিছুক্ষণ পরেই রিপ্লাই এলো,”আপনাকেও ধন্যবাদ” আমি তো বেশ খুশি যে এমন লোক আমার মেসেজের রিপ্লাই দিছে। আমি আবারও মেসেজ দিলাম,”আপনার ছবি তোলার হাত খুব ভালো, আর আপনার লেখা গুলোও চমৎকার, মানুষকে মোটিভেট করার জন্য যথেষ্ট,,, ”
আবীর রিপ্লাই দিলো, “যদি আমার লেখা পড়ে একজন মানুষও জীবনকে মোটিভেট করতে পারে তবেই আমি সার্থক,,,” আচ্ছা রাত হয়েছে, ঘুমান আপনি,,,, আমিও ঠিক আছে বলে মেসেজ দিলাম।

-এভাবে একদিন দুইদিন করে প্রতিদিন কথা চলতে লাগলো, আবীরের সাথে কথা বলাটা যেন আমার অভ্যাসে পরিনত হলো,,,প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম একটা নির্দিষ্ট সময়ের যখন আবীর অনলাইনে আসতো,,, আবীর এতোটাই হাসিখুশি ভাবে কথা বলতো যে ওর সাথে কথা বলতে বলতে সময় জ্ঞান থাকতে না,কখনো অন্যদের মতো আবদার করেনি, একটা ছবি দিবে বলে,,,?কখনো কোন বাজে কথাও শুনিনি ওর মুখ থেকে,, এভাবেই চলতে লাগলো বন্ধুত্বের দুইমাস,,,

হঠাৎ একদিন অপেক্ষা করছি আবীরের, কিন্তু সেদিন আবীর আর আসেনি,, সারারাত আমি চোখের পাতা এক করতে পারিনি শুধু ফোন চেক করি, এই বুঝি আবীর মেসেজ দিলো,,,এভাবে সারারাত কাটানোর পরে আবীরের আইডিতে ঢুকলাম,যদি কোন ফোন নাম্বার বা ঠিকানা পাওয়া যায় ? একটা ফোন নাম্বার পেয়ে গেলাম আর দেরি না করে নাম্বারটায় কল দিলাম। প্রথমবার ফোন কেউ রিসিভ করলো না। আবার ফোন দিতেই এক নারীকন্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলাম,কিছুক্ষণ চুপ থেকে সালাম দিয়ে আবীর আছে কিনা জানতে চাইলাম।

-ফোনের অপর পাশ থেকে নারী কন্ঠ বলে উঠলো, তুমি কে,,,?
~আমি অন্তি কিন্তু আপনি কে?
-আমি আবীরের মা,অন্তি নামে কাউকে তো চিনি না ?
~ওহ আন্টি আপনি,,,!কেমন আছেন?আবীর আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড,,, আবীরকে কি একটু দেয়া যাবে আন্টি,,,?
-আবীর আসলে তোমার কথা বলবো,,,
~ঠিক আছে বলে সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিলাম।যাক একটু শান্তি পেলাম যে আবীর পরে আমার সাথে যোগাযোগ করবে,,,

রাতে আবীরের অপেক্ষা করছি কিন্তু আবীর সেদিনও অনলাইনে আসলো না, খুব রাগ হচ্ছিল আবীরের উপর, আন্টি কি আমার কথা আবীরকে বলেনি? নানা কথা মাথায় ঘুরপাক করছিলো,,,আবারও সারারাত ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম, এই বুঝি আবীর মেসেজ দেয়,কিন্তু না আবীর কোনো মেসেজ দেয়নি,,, আবীরের জন্য আমার অস্থিরতা যেন আরো বেড়েই চলছে,,,সকাল হলেই আবার আবীরের নাম্বারে ফোন দিলাম। ফোন ধরলেন আবীরের মা,”সালাম দিয়েই কেমন আছেন তিনি জিজ্ঞেস করলাম আর আবীরকে একটু দরকার ছিলো তা জানালাম,,,” আন্টি বললো, আবীর তো এখন কথা বলতে পারবে না।

আবীরকে যে ভালোবেসে ফেলছিলাম সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলাম, ওর অনুপস্থিতি আমাকে ওর প্রতি আরও দূর্বল করে দিচ্ছিলো কিন্তু আবীরকে তো জানানো হয়নি সে কথা,,, আমি বললাম, “আন্টি আপনার ঠিকানা দিন আমি আসছি,আমার খুবই জরুরি কথা আছে আবীরের সাথে,,,” আন্টি কোন রকম ভনিতা না করেই একটা হসপিটালের ঠিকানা দিলো আমাকে, বললো পারলে এখানে চলে এসো।

তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হলাম,বাসে না উঠে তাড়াহুড়ো করে একটা সিএনজি নিলাম যাতে আবীরের কাছে তাড়াতাড়ি যেয়ে দেখা করতে পারি,,,আবীরকে প্রথম বারের মতো দেখতে পাবো, প্রথম ওর কন্ঠ শুনতে পাবো, ওর সামনে গিয়ে আবার বোকার মতো আচরণ করবো না সেগুলো ভাবতে লাগলাম।

হসপিটালের সামনে নেমে আবার কল দিলাম আবীরের নাম্বারে, যথারীতি আবীরের মা ফোন ধরে কেবিনের নাম্বারটা বললেন আমাকে, আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম আন্টি আমাকে বাসায় না ডেকে হসপিটালে ডাকলো কেন,,,?

৩০৪ নাম্বার রুমের কাছে যেয়েই আস্তে দরজায় কড়া দিলাম,ভিতরে যাবার অনুমতি পেয়ে রুমে ঢুকলাম, ঢুকেই দেখি একজন মধ্য বয়সী নারী চুপচাপ চেয়ারে বসে আছে, আমি তাকে সালাম দিতেই বলে উঠলো, তুমিই অন্তি,,,,?জ্বি হ্যাঁ আমিই অন্তি।রুমে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম একজন বেডে শুয়ে আছে,হাতে স্যালাইন লাগানে আর মুখে অক্সিজেন মাস্ক, চেহারা স্পস্ট বোঝা যাচ্ছে না। আমি এদিকে ওদিকে তাকিয়ে আবীরকে খুঁজছি,আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম আবীর কোথায়,,,? আমার খুব দরকার আবীরকে,,,

আন্টি আমার কথা শুনে এক দৃষ্টিতে বেডের দিকে তাকিয়ে আছে আর চোখের পানি ফেলছে,আমার আর বুঝতে নাকি রইলো না এই আবীর,,,,, যার জন্য আমি এতো অস্থির, যার কথা আমি সবসময় মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, যে আমাকে সব সময় হাসাতো,,,,আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যেই মানুষটার সাথে দুইদিন আগেও আমার কথা হয়েছে তার এমন অবস্থা হলো কেমন করে?

আবীরের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে তিনমাস আগে,ডাক্তার বলেছে বেশি হলে হয়তো ছয় মাস বাঁচবে, বিদেশেও নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু তারাও কোনো আশার বানী শোনাতে পারেনি,ওর লাস্ট স্টেজ চলছে মাঝে মাঝে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়, কিন্তু দুই দিন আগে হঠাৎ করেই অবস্থা বেশি খারাপ হলে ওকে এখানে নিয়ে আসি,,, কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললেন আবীরের মা।

আমি স্তব্ধ হয়ে আছি,দুই মাস ধরে একটা মানুষের সাথে প্রতিদিন চ্যাট করছি অথচ একবারও টের পেলাম না যে আবীর একজন মৃত্যুপথ যাএী,,,,অথচ এই আবীরই আমাকে নানা ভাবে সব সময় হাসানোর চেষ্টা করতো, ভালো রাখার চেষ্টা করতো,আমি কাদঁছি না কিন্তু নিজের অজান্তেই চোখের কোন বেয়ে পানি পড়ছে।

আন্টি বললো আবীর সব সময়ই হাসি-খুশি একজন ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে জেনেও কখনো ভেঙে পড়েনি আর আমাদেরও ভেঙে পড়তে দেয়নি কখনো,,,

খুব ইচ্ছে ছিলো আবীরের,,, টিয়েরঙা শাড়ি, লাল ব্লাউজ, লাল টিপ আর লাল চুড়ি পড়িয়ে আমার জন্য একটা বেস্ট ফ্রেন্ড এনে দিবে,,,আমি যাতে এই বয়সে একজন মনের মতো বান্ধবী পাই যা কিনা আমার ছেলের বউ পূর্ন করবে,,,,

আমার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পড়ছে, আমি আবীরের কাছে যেয়ে খুব আস্তে করে ডাক দিলাম আবীর বলে।আবীর তাকালো না আবারো ডাক দিলাম আবীর বলে, এইবার আস্তে আস্তে চোখ খুললো আবীর। আবীর আমার দিকে তাকিয়ে আছে হয়তো ভাবছে আমি কিভাবে এলাম এখানে,,,?আবীরের একবারে কাছে যেয়ে বললাম, ভালোবাসি তোমাকে আবীর,,,!আবীর চোখ গুলো বড় বড় করে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে,,,,,,

আমি কোনোমতে সেখান থেকে চলে আসলাম,সারা রাস্তায় ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম, মানুষজন আমার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে সে খেয়াল নেই আমার,,,বাসায় ঢুকতেই আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, কি হইছে তোর, চোখ ফোলা কেন,,,? চোখে কি যেন পড়েছে তাই চোখ লাল আর ফুলে গেছে বলে রুমে ঢুকলাম,,,,আম্মুও আমার পিছু পিছু রুমে ঢুকলেন আর বললেন, দেখি তো চোখে কি পড়লো তোর,,,, চোখ ফোলা তো ভালো নয়। আম্মুকে বললাম আজ দেখি, ফোলা না কমলে কাল ডাক্তারের কাছে যাবো।আম্মু আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন,,,, আমি আবীরের কথা ভাবছি আর কাদঁছি,,,টিয়েরঙা শাড়ির বউয়ের কথা ভাবছি,,, আমার মাথায় শুধু আবীরের মুখটা আর আর টিয়ে রঙের শাড়ির কথা ঘুরছে,,,

একটু পরে হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে আম্মুর রুমে যেয়ে ড্রয়ার থেকে আলমারির চাবি নিয়ে আলমারি খুললাম।আম্মু আলমারি খোলার শব্দ পেয়ে রান্না ঘর থেকে এসে জিজ্ঞেস করলো আমি কি খুঁজছি,,,?আম্মু তোমার কোনো টিয়ে রঙের শাড়ি আছে? আম্মু বললো আছে কিন্তু শাড়িটা অনেক আগের ।আমি বললাম একটু আমাকে দেখাও না শাড়িটা,,,!আম্মু একটু খুঁজেই শাড়িটা পেয়ে গেলো আর আমাকে দেখালো, টিয়ে রঙের শাড়িটা সত্যিই খুব সুন্দর।
শাড়িটা নিয়ে আমি আমার রুমে চলে গেলাম।

নিজে থেকে একটা ডিসিশন নিলাম, শাড়ির সাথে লাল ব্লাউজ, লাল টিপ, লাল লিপস্টিক, লাল চুড়ি রেডি করে রাখলাম। তুলি আর শান্তাকে ফোন দিয়ে কাল কি করতে হবে বুঝিয়ে দিলাম আর আবীরের কথা চিন্তা করে সারারাত কাটিয়ে দিলাম নির্ঘুম।

সকালে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে টিয়ে রঙের শাড়ি পড়ে, লাল ব্লাউজ,কপালে লাল টিপ দিয়ে, চোখে কাজল দিয়ে আর হাত ভর্তি লাল চুড়ি পড়ে আব্বু আম্মুর কাছে গেলাম দোয়া নিতে। আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, এতো সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছি? আমি বললাম কলেজে অনুষ্ঠান হবে আর আমি খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়ে অংশগ্রহণ করবো তাই সেজেছি।আব্বু আম্মু আমাকে দোয়া করে দিলেন যেনো সফল হতে পারি,,,,

বাসা থেকে বের হয়ে তুলি আর শান্তাকে ফোন দিলাম আর বললাম যা বলেছি তাই যেনো করে।আর আমি আবীরের কাছে হসপিটালে গেলাম। আমার সাজগোজ দেখে আবীর আর আবীরের মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আন্টি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, অন্তি তুমি এভাবে সেজেছো কেন,,,? আর আবীরের চোখে মুখে কৌতুহল আমাকে নিয়ে,,,

আমি আবীরের কাছে যেয়ে আবীরের হাত ধরে বললাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে বিয়ে করে তোমার টিয়েরঙা শাড়ির বউ হয়ে তোমার ইচ্ছে ঘুড়ি হতে চাই। আবীর ওর হাত আমার হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে আমাকে চলে যেতে বলে।আমি তখন কাদঁছি আর আন্টিকে বলছি, আমি আপনার বেস্ট ফেন্ড হতে চাই। আন্টি আমাকে পাগলামি না করে বাসায় চলে যেতে বললেন, ততোক্ষণে তুলি আর শান্তা কাজিকে নিয়ে চলে আসছে। আবীর কাজি দেখে কাজিকে ওখান থেকে চলে যেতে বলে কিন্তু আমি কাজিকে বাধা দিয়ে যেতে না করি,,,আমি খুব চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। হসপিটালের নার্স,ডাক্তার, রোগী আমার কান্না শুনে রুমে ভীড় করতে থাকে,হসপিটাল কতৃপক্ষ বিষয়টি তাড়াতাড়ি সমাধান করতে বলে।

আমার কান্না কোনো ভাবেই থামছে না।হঠাৎ কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে আব্বু আম্মু চলে আসলো, আমার এমন পাগলামি দেখে আব্বু আমার গালে জোরে জোরে দুইটা চড় মারলো,,,, কিন্তু আমার কোন দিকেই কোনো খেয়াল ছিলো না।আমি আবীরের কাছে যেয়ে ওর হাত ধরে অঝোরে কাঁদছি,,,আব্বু কাজিকে চলে যেতে বললে আমি ব্যাগ থেকে বিষের বোতল আর একটা ধারালো ছুরি বের করে নিজেকে শেষ করতে চাইলাম।আবীর বেড থেকে কোনো ভাবে উঠেই আমার হাত থেকে ওগুলো ছিনিয়ে নিলো,আমি অসহায়ের মত চুপ করে ফ্লোরে বসে কাঁদছি, ঘটনার আকস্মিতায় সবাই হতবাক।

শেষ পর্যন্ত আবীর আমার জেদের কাছে পরাজিত হয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়।আব্বু আমার সাথে রাগ করে ওখান থেকে আম্মুকে নিয়ে চলে যায়।অবশেষে আবীরের সাথে আমার বিয়ে হয়।আবীরের মা আমার কাছে এসে মাথায় হাত রেখে আমাকে দোয়া করলেন কিন্তু আবীর কোন কথা বললো না আমার সাথে,,, আমি মামনির সাথে হসপিটালে থেকে আবীরের সেবা যত্ন করতে লাগলাম কিন্তু আবীর আমার সাথে বেশি কথা বলতো না।সাতদিনের মধ্যে আবীর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে ওকে বাসায় নিয়ে গেলাম।আমি নতুন বউ হিসাবে শ্বশুর বাড়ি প্রথম পদার্পন করলাম।

ধীরে ধীরে আবীরের মা মানে মামনির সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো,,,আবীর লুকিয়ে লুকিয়ে আমার আর মাননির খুনসুটি দেখে। বুঝতে পারতাম আবীরও আমাকে ভালোবাসে কিন্তু নিজের স্বল্প জীবনের মায়ায় আমাকে জড়াতে চাইছে না।আমি সব সময় আবীরের খেয়াল রাখতাম,এক মিনিটের জন্যও চোখের আড়াল করতাম না ওকে,এভাবে প্রায় মাস কেটে গেলো। একদিন আব্বু আম্মু বাসায় এসে আমাদের সম্পর্ক মেনে নিলো আর তাদের বাসায় বেড়াতে যেতে বললো।

পরদিন আবীরকে নিয়ে আব্বুর বাসায় গেলাম,মামনি আমাদের সাথে গেলো না।বাসায় গিয়ে দেখি তুলি আর শান্তাও এসেছে। আবীর আব্বুর সাথে ড্রইং রুমে বসে গল্প করছে আর আমি তুলি আর শান্তার সাথে আমার রুমে বসে কথা বলছিলাম।কথা বলতে বলতেই তুলি আমাকে বলতে লাগলো পাগলামি করে বিয়ে করেছিস আবার কনসিভ করিস না যেন খেয়াল রাখিস, কয়দিন পরেই তো আবীর মারা যাবে। অযথা ঝামেলায় জড়াস না। আমি তুলির কথা শুনে ওর দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, আম্মুও রুমে এসে তুলির কথায় সায় দিলো।আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে তুলিকে জোরে একটা চড় মারলাম আর বললাম তোদের মন মানসিকতা এতো ছোট তা জানতাম না।ড্রইং রুমে যেয়ে আবীরের হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়া আসলাম। আব্বু কি হয়েছে জানতে চাইলো, আমি কিছুই না বলে আবীরকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম।সারা রাস্তায় কাদঁলাম আর আবীরের সাথে একটাও কথা বললাম না। আবীর কি হয়েছে বার বার জানতে চাইলো, আমি শুধুই কাদঁলাম কোনো উত্তর দিলাম না।

মামনি আমাকে এই অবস্থায় দেখে আমার কি হয়েছে আবীরের কাছে জানতে চাইলেন।আমার কাছে এসে আমাকে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কাদঁছে কেন,,,?আমি মামনিকে জরিয়ে ধরে আরো কাদঁছি,,,, আবীর আমার কান্না সহ্য করতে না পেরে কি হয়েছে বলতে বললো।আমি লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে মামনির সামনেই বলে বসলাম, আমার স্ত্রী মর্যাদা চাই।আবীর কিছু না বলেই সরে গেলো সেখান থেকে। আমি মামনিকে বোঝাতে লাগলাম আমি কি ভুল কিছু বলেছি,,,? মামনি বললো না ভুল কিছু বলিনি কিন্তু আবীর এই পরিস্থিতিতে আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিবে না।

আমারও জেদ চেপে বসলো,খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিলাম।কিন্তু আবীরের খেয়াল রাখতে একটুও ভুল করলাম না।আমাকে মামনি আর আবীর জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারলে না দুইদিন। অবশেষে আমার জেদের কাছে আবারো আবীর পরাজিত হলো, আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে বাধ্য হলো।মনে মনে ভাবছিলাম আবীরের স্মৃতির মাঝে আর আবীরের অংশ আমার মাঝে যেন বেঁচে থাকে। আমি দুইমাসের মধ্যেই কনসিভ করলাম আবীরকে না জানিয়ে, তুলির সেদিনের কথাগুলো আমার জীবনে যেন আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে,,,আমি কি ভাবে আবীরকে কথাটা জানাবো বুঝতে পারছিলাম না।

ছোট্ট একটা চিরকুট লিখলাম আবীরকে,যেখানে লিখেছিলাম “নারী হিসেবে আমি পূর্ণ হতে চলেছি আবীর”। চিরকুটটা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সাথে লাগিয়ে রাখলাম যাতে খুব সহজেই আবীরের চোখ পড়ে। আমি মামনির কাছে যেয়ে গল্প করতে লাগলাম।সত্যিই কিছুক্ষণ পরে আবীরের গলায় আমার নাম শুনতে পেলাম জোরে জোরে কিন্তু আমার সাহস হলো না আবীরের কাছে যাওয়ার।আবীর একটুও দেরি না করে মামনির রুমে আসলো আর আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, এটা কি সত্যি,,,,,, ? আমি ভয়ে মাথা নিচু করে হ্যা বললাম।সাথে সাথেই আবীর চিৎকার দিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে মামনিকে বলতে লাগলো, মামনি তোমার শুধু বেস্ট ফ্রেন্ড আসেনি,,,একজন খেলার সঙ্গীও আসছে,,,

মামনি খুশিতে চোখের পানি মুছছে আর আবীর খুশিতে কি করবে বুঝতে পারছে না।আবীর আমার হাত ধরে কাঁদছে আর আবীরের কান্না দেখে আমিও কাদঁছি। আবীরকে এতো খুশি কখনো দেখিনি। আবীরের খেয়াল কি রাখবো আমি উল্টো মা -ছেলে মিলেই আমার খেয়াল রাখা শুরু করলো। হঠাৎ করেই একদিন আবীর খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে সাথে সাথে হসপিটালে নিয়ে যাই ঠিকই কিন্তু আবীরকে আর বাঁচতে পারলাম না।আবীরের শেষ পরিনতির কথা জানা থাকলেও বুকের মধ্যে যেনো পাহাড় সমান পাথর জমা পড়লো,,,,

খুব কাঁদতে চাইতাম কিন্তু কাঁদতে পারতাম না, মনে হচ্ছিল চোখের পানিগুলো শুকিয়ে গেছে,,,,,, মামনি দূরে বসে আবীরের জন্য কাঁদতো কিন্তু আমার সামনে শক্ত হয়ে থাকতো যেন আমি ভেঙে না পড়ি,,,আমি সারাক্ষণ রুমে বসে আবীরের জিনিসপত্র গুলো বুকের সাথে আগলে রাখতাম। আবীরের অংশ তখন আমার মধ্যে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে, আমার আর মামনির বেচেঁ থাকার একমাএ অবলম্বন। অবশেষে আমি এক রাজকন্যার মা হলাম,আবীর আর আমার নামের সাথে মিলিয়ে মামনি নাম রাখলেন, “অবন্তী ”

অবন্তীর মাঝে যেন আবীরের ছোয়া পাই সবসময়,,,,, আর মামনি তার ছোট্ট খেলার সাথী আর আমার মাঝেই নিজের সবটুকু খুশি বিলিয়ে দেন।আবীরকে এক মূহুর্তের জন্যও ভুলিনি,প্রতিটা সময় যেন কাছে থেকে আগলে রাখে আমাদেরকে। তিনটা নারীর মাঝে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল,,,,, আবীরকে দেখতে যাবার সময় সেই টিয়ে রঙের শাড়ি, লাল ব্লাউজ, লাল টিপ, চোখে কাজল আর লাল চুড়ি পড়তে ভুল করিনা,,,,,,, শত হলেও আবীরের ইচ্ছে ঘুড়ি হারিয়ে যেতে দেই না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত