রতন ও তার বন্ধুরা

রতন ও তার বন্ধুরা

সারাদেশে যুদ্ধ চলছে। প্রতিদিন লোক মরার খবর আসছে। রতনের বাড়ি পটিয়া থানার খরণা গ্রামে। রতনদের গ্রামের পাশ দিয়েই গিয়েছে বড় রাস্তা। যুদ্ধের আগে এ রাস্তা দিয়ে কত গাড়ি, মানুষ আসা যাওয়া করত। এখন কিছুই নেই। দিনের বেলায়ও নিরব। কয়েকদিন থেকে রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারির গাড়ি আসা যাওয়া করছে। সেদিন ১৬ এপ্রিল রতনদের গ্রামের কানু চাচা গিয়েছিলেন থানার হাটে বাজার করতে। বিমান থেকে বোমা ফেললে বাজারে অনেক লোক মারা যায়। কানু চাচাও মারা যায় বোমার আঘাতে। সেই থেকে সবার মনে ভয় আরো বেড়ে গেছে। গ্রামের কয়েকজন জোয়ান ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে।

রতনের বয়স মাত্র ১৪ বছর। তার মন খুবই খারাপ কানু চাচার জন্য। কানু চাচা খুব মিসুক লোক ছিলেন। মাঠে ধান কাটা হয়ে গেলে কানু চাচা নিজে ঘুড়ি বানিয়ে রতনদের হাতে দিয়ে বলতেন, ‘যা উড়া’। চাচাও মাঠে গিয়ে ঘুড়ি উড়াতেন। চাচা খুব ভালো ঘুড়ি উড়াতেন। লাঠিম ঘুরানো, মারবেল খেলাও খেলতেন চাচা। সেদিন কানু চাচার লাশ গ্রামে এলে এক মর্মান্তিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কানু চাচার ঘর সংসার ছিলো না। গ্রামের সবাই ছিলো তার আপনজন। রতন খুব কেঁদেছিলো। রতন শুধুই ভাবছে এমন মাটির মানুষটিকে তারা মেরে ফেলল! চাচার জন্য কিছু একটা করতে হবে। পাকিস্তানিদের শিক্ষা দিতে হবে। বয়স আরেকটু হলেই যুদ্ধে যেত। রতন প্রতিদিন ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি আর্মির গাড়ি যাওয়া আসা দেখে। তার ইচ্ছে করে সব শালাকে গুলি করে মেরে ফেলতে।

রতন তার বন্ধু রশিদ, হাসান, এনাম, কাসেমদে নিয়ে তাদের পুকুরপাড়ে বৈঠকে বসল। রতন বলল, ”কী করা যায় বলতো? কিছু একটা করতেই হবে।” অন্যরা বলে উঠল, ”আমরা কি করব? আমরা তো ছোট।”

“অতসব বুঝি না, কিছু একটা করতেই হবে। ঐ শয়তানদের একটা শিক্ষা দিতেই হবে।” কথা বলতে বলতে রতনের চোখ গেল এনামের হাতে থাকা লাঠিমের দিকে। সহসায় তার মনে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে বন্ধুদের বলল, ”প্রতিদিনই তো রাস্তা দিয়ে মিলিটারি গাড়ি যায়। আমাদের তো অনেক লাঠিম। লাঠিমের মাথায় যে পেরেক থাকে তা যদি রাস্তায় উল্টে রাখি তবে গাড়িগুলো অ্যাকসিডেণ্ট করবে। হাসান বলে, “যদি তারা আমাদের ঘর বাড়িতে আক্রমণ করে?” রতন দেখল হাসানের কথায় যুক্তি আছে। এবার একটু ভেবে বলল,”আমরা যদি গ্রাম থেকে দূরে লাঠিম বসায় তবে তারা আর এদিকে আসবে না।” রতনের কথায় এবার সবাই রাজি হল।

দুদিন পর রতনরা অনেকগুলো লাঠিম নিয়ে গ্রামের পথ ধরে তারা এগুতে থাকে ভাইয়ের দিঘি নামক জায়গার দিকে। জায়গাটি বেশ নির্জন এবং আশেপাশে কোন ঘর বাড়িও নেই। তারা সন্ধ্যার আধারে ভাইয়ের দিঘি এলাকার হাইওয়েতে লাঠিমগুলো রেখে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে। গ্রামে এসে তারা অপেক্ষা করতে থাকে কবে মিলিটারির গাড়ি যায়। মধ্যরাতের দিকে রতন গাড়ি যাওয়ার শব্দ শুনে। কিন্তু কী ঘটে তা বুঝতে পারে না। এপাশ ওপাশ করে রাত কাটিয়ে সকালে দ্রুত বের হয় খবর নিতে। কাশেম চাচার চায়ের দোকানে গিয়ে জানতে পারে, গতরাতে ভাইয়ের দিঘি এলাকায় পাকিস্তানি মিলিটারির গাড়ি উল্টে দিঘিতে পড়ে যায়। চারজন আর্মিও নাকি মারা গেছে। খবরটা শুনে রতনের কী যে খুশি লাগল! রতন ও তার বন্ধুরা কানু চাচার কবরে গিয়ে জিয়ারত করল। রতনের মনে হল যেন কানু চাচা হেসে বলছে, “চল রতন, লাঠিম ঘুরাই।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত