হাইলাইট

হাইলাইট

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে মাস্টার্স করছিলাম। পাশাপাশি জবের জন্য আপ্রান চেষ্টা করছিলাম। জীবনের ২য় বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। কিন্তু রিটেনে গিয়ে ভালো করতে পারলামনা। মন মানসিকতা একটু খারাপ ছিল। সারাটা জীবন পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারের চিন্তা করতে করতেই কাটিয়ে দিলাম। একটা প্রেম কখনো করা হয়নি। জীবনটা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। কেন জানিনা মনে হতো, একটা প্রেম করলে একটু মানসিক দিক থেকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো কাউকে পেতাম। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন ডিপার্টমেন্টের সামনে দিয়ে হাঁটছিলাম। কয়েকটা মেয়ে গোল হয়ে বসে ছিল। আর তাদের মধ্যে একজন গান করছিল ” এই মেঘলা দিনে একলা, ঘরে থাকেনাতো মন, কাছে যাবো, কবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রন”

এই গানটা তো অনেক শুনেছি, কিন্তু এত ভালো লাগেনি কখনো। মেয়েটার কন্ঠে কিছু একটা ছিল, যেটা আমার মনকে বার বার তার কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল৷ মেয়েটাকে ভালো করে দেখলাম। শ্যামলা দেখতে। চেহারায় মাধুর্য আছে। চোখ দুটি বড্ড বেশি মায়াবী। প্রেমে পড়েছিলাম এটা বলবোনা। কিন্তু ওকে অসম্ভব ভালো লেগে গিয়েছিল। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম মেয়েটার নাম দিয়া। ও সেই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে৷ মজার ব্যাপার হলো দিয়া ইংরেজিতেই ভর্তি হয়েছে।

এরপর দুই মাস তার পেছনে ঘুরে অনেক কষ্ট করে অবশেষে তার মন পেয়েছি। তখন রবী ঠাকুরের একটা কথা মাথায় ঘুরতো, আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম। ওকে যতটা না ভাল লেগেছিল, ও মানুষ হিসেবে তার চেয়েও বেশি ভালো। খুব খোলা মনের একটা মেয়ে ছিল। দিয়ার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল ওর মা। আর তারপরে আমি৷ সময় খুব সুন্দর ভাবেই যাচ্ছিল।আমার মিনিংলেস লাইফটাও জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছিল। এভাবেই সময় চলতে থাকে। দিয়ার একটা স্বপ্ন ছিল, ও এমন কিছু করবে যেন সবাই ওকে একনামে চিনে। সেইজন্য ও চাইতো ও যেহেতু ভালো গান করে, তাই ও গান নিয়েই কিছু করবে৷ কিন্তু এতে ওর ফ্যামিলির ঘোর আপত্তি ছিল৷ তাই সে এগুতে পারেনি। তবে সত্যি বলতে কি, এতে আমার জন্য ভালোই হয়েছে।কারণ দিয়াকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। বউ গান করবে বাইরে, এইটা আমার বাবা- মাও হয়তো মেনে নিতোনা। এতে হয়তো পরবর্তীতে ঝামেলায় পড়তে হতো।

দেখতে দেখতে দুই বছর পার হয়ে গেল আমাদের সম্পর্কের। এরমধ্যে আমার খুব ভালো একটা জব ও হয়েছে। মোটামুটি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি। তারপর মহান আল্লাহপাকের অশেষ কৃপায় এবং দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের পর একটা জিনিস খেয়াল করলাম। দিয়া খুব ভালো লেখালেখি করতে পারে৷ ওর লেখা গুলোতে অন্যরকম একটা টুইস্ট থাকতো। তখন আমি ওকে উৎসাহ দিতাম লেখালেখি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।

আমিই ওকে বলেছিলাম সে তার লিখা গুলো প্রথম অবস্থায় ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে দিতে পারে। একটু পরিচিতি পেয়ে গেলে আর একটু অভিজ্ঞতা হলে তখন বই বের করতে পারে। তাতে করে তার স্বপ্ন ও পুরণ করা হবে আর দুই পরিবারের মানুষ গুলোও হয়তো পক্ষেই থাকবে। কারণ মিডিলক্লাস ফ্যামিলিতে বাড়ির বৌয়ের বাইরে গান করা বা সিংগার হওয়া টা মানুষ ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু লেখালেখি করে পরিচিতি লাভ করলে তারাই আবার গর্বিত হবে। সমাজে তো বাস করি। কিছু নিয়ম তো মানতেই হবে। চাইলেই সব কিছু করা যায়না।

দিয়া মাত্র ৬ টা গল্পের মাধ্যমেই ব্যাপক সাড়া পেয়ে গেল। আমি ওকে বলেছিলাম যেন একটু গ্যাপ রেখে গল্প পোস্ট করে। অন্তত একটা গল্পের ১ সপ্তাহ পর অন্য গল্প। দিয়া সেভাবেই এগুচ্ছিল। দিয়ার লিখার স্কিল আরো ভালো হচ্ছিল দিন দিন। ২ মাসে মাত্র ৬ টা গল্প পোস্ট করলেও দিয়া ২ মাসে প্রায় ২৬ টা গল্প লিখেছিল। সবই ঠিকঠাক প্ল্যান অনুযায়ীই চলছিল।

আমাদের সংসার জীবনটাও ভালো ভাবেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ৪ দিন প্রচন্ড জ্বরে ভোগার পর দিয়া আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেক দিন সময় লেগেছে। কেন জানিনা বারবার মনে হতো দিয়ার স্বপ্ন পুরণ করবো। তখন ওর আইডি থেকে আমি ওর লিখা গল্প গুলো একের পর এক পোস্ট করতে থাকি। সবাই তো আর জানেনা যে দিয়া আর নেই। সবাই খুব দোওয়া করতো দিয়াকে। সবাই ভবিষ্যৎ বাণী করে দিতো, যে দিয়া একদিন অনেক নামকরা লেখিকা হবে। আমার শুধু বারবার মনে হতো আজ দিয়া থাকলে কতো খুশি হতো!!

দিয়ার শেষ গল্পটা যখন ও লিখছিল তখন আমাকে অনেক বার বলেছিল, এইটা দিয়েই সে তার প্রথম বই বের করবে। কিন্তু গল্পটা অসম্পূর্ণ ছিল। আমি আমার দিয়াকে যতটুকু বুঝেছি ততটুকু দিয়ে গল্পটা আমার মতো করে শেষ করেছি। আজ আমার দিয়ার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। কেন জানিনা মনে হল, আজই সঠিক দিন সবাইকে সবকিছু জানানোর।। তাই এতদিন কোন ইন্টারভিউ দিতে চাইনি। সবাই আমার দিয়ার জন্য দোওয়া করবেন।৷

-এতক্ষণ অবাক হয়ে ভদ্রলোকের কথা শুনছিলাম। আমার এত বছর চাকুরী জীবনে কারোর ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে এতো অবাক হইনি। আজ হচ্ছি। সম্প্রতি বইমেলাতে একটা বই নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছিল। বইটির নাম “কাকতালীয় “যার লেখিকা হচ্ছেন ” দিয়া ইসলাম”। জানা গিয়েছে, এটি তার প্রথম বই। প্রথম বইয়েই কেউ এতটা জনপ্রিয়তা পেতে পারে এইটা জানা ছিলনা। কিছুদিন থেকেই লেখিকার ইনটারভিউ নেওয়ার চেষ্টা চলছে। কোন সাংবাদিকই কোন প্রকার ইন্টারভিউ নিতে পারেননি।

অবশেষে আমি সেই সুযোগটা পেলাম। তাই একটু খুশিতেই ছিলাম যে, এই প্রথম সেই বিশিষ্ট লেখিকা আত্নপ্রকাশ করতে যাচ্ছেন, আর সেই ইন্টারভিউ আমি নিতে পারবো। কিন্তু আসলেই ভাবতে পারিনি যেই মানুষকে নিয়ে এত্ত হৈচৈ, সেই মানুষটা পৃথিবীতেই নেই।। নিউজের হেডলাইন কি দেবো খুঁজে পাচ্ছিনা। আসলে এখানে হাইলাইট করবো কাকে? সেই অসম্ভব ট্যালেন্টেড লেখিকাকে, যে পৃথিবীতে না থেকেও এতো নাম পেল? নাকি আমার সামনে বসা অসম্ভব উদার মনের এই মানুষটিকে? যিনি কিনা ভালোবাসার মানুষের ইচ্ছা পুরণের জন্য এতো কিছু করে গেলেন। এই ধরণের মানুষেরা নিজেরা সবসময় পেছনে থেকে সামনের মানুষটাকে আরো সামনে এগিয়ে দেয়। এরা নিজেরা কখনো হাইলাইট হয়না।

মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। আসিফকে কফি দিতে বললাম, মাথায় বেশি চাপ পড়লে আমার আবার কফি না খেলে হয়না। এদিকে কাজ এখনো পড়ে আছে। নিউজের নাম টা দিতে হবে, নিউজ টা তৈরী করতে হবে। ইচ্ছা থাকেলেও কিছু কথা লিখতে পারবোনা।নিজের চাকুরীটাতো বাঁচাতে হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত