ভাঙ্গা গড়া

ভাঙ্গা গড়া

নছিমনের নছিবটা বরাবরই খারাপ। মনে মনে আশা ছিল এবার একটা ছেলে হবে। কিন্তু সকল আশায় ধূলি উড়িয়ে আবারো জন্ম নিল মেয়ে, এমন সংবাদে (?) আশাহত সিরাজ মিয়া এক পলকের জন্যও দেখতে আসেনি মেয়েটাকে আর ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক গেঁথে জিজ্ঞেস করেনি– নছি কেমন আফিসরে তুই?

২.
বাবা মারা যায় বারো বছর বয়সে। অভাবের সংসারে মা আর এক ছোট ভাই ছিল। পেটে ভাত, শরীরে তৈল-পানি ঠিক মতো না পড়লে কি হবে শরীরটা নজরে পরার মতোই বাড়ছিল। বাড়ন্ত শরীরে নছিমনের রূপ-যৌবন ক্রমেই বিপদজ্জনক হয়ে উঠছে দেখে পনের বছর বয়সে বিয়ে হয় আফসর আলীর সাথে।

দিন মজুর আফসার আলীর আয় রোজগার ভালোই ছিল। চাওয়ার আগেই পাওয়া যেত সব। কিছু অপূর্ণ রাখেনি। দিন শেষে কাজ থেকে ফিরে মানুষটা এমনভাবে জড়িয়ে ধরতো যেন বুকের সাথে পিষে ফেলতে চায়। অন্য রকম সুখে নছিমন ও নিজেকে সপে দিতো সরল মানুষটার বুকে। বিয়ের ছ’মাস না হতেই কপাল ভাঙ্গে নছিমনের। একদিনের ডায়রিয়ায় মারা যায় মানুষটা…।

৩.
খাওয়া পরার অভাব ছিল না সগির মিয়ার সংসারে।
দালাল সগির মিয়ার সবকিছুই ছিল ছোট বউ নছিমনকে ঘিরে। দিনে মিষ্টি মিষ্টি কথা, হালকা-দুষ্টুমি, লুকোচুরি খেলা-বালই লাগত। কিন্তু রাত হলেই মানুষটা কেমন যেন অন্য রকম হযে যেতো। মদ খেয়ে মাতাল হওয়া, গভীর রাতে বাড়ি ফেরা, অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ, অমানুষিক নির্যাতন আর জোর করে প্রতিরাতেই…।

অমানুষটার হিংস্র থাবার দাগগুলো এখনো যায়নি শরীর থেকে। হঠাৎ এক রাতে রক্তাক্ত শরীরে পালিয়ে আসে নছিমন যান্ত্রিক ঢাকায়। আর পেছনে ফেলে আসে একটা বুকফাঁটা চিৎকার…।

৪.
সিরাজ মিয়ার সাথে বিয়ের পর গার্মেন্টেসর কাজ ছেড়ে দেয় নছিমন। বিয়ের তিন বছরে তিন তিনটা মেয়ে। মেজে মেয়ে ফুলির জন্মের পর সিরাজ মিয়া বহু কাকুতি-মিনতি করে বলেছিল আমারে একটা ছ্যারা দিবার পারবি নারে নছি? তোর থ্যাইকা আমি সব পাইছি, এইবার আমারে একটা ছ্যারা দে! নছিমন কথা দিয়েছিল এবার একটা ছেলে দেবে। কিন্তু এবারও…।

৫.
বাইশা বড্ড মজার মানুষ। সিরাজ মিয়ার প্রাণের দোস্ত। দুই হাতে দুইটা আঙ্গুল বেশি থাকায় কলিম মিয়া থেকে নাম হয়ে বাইশা। প্রায়ই আসা-যাওয়া ছিল। রং তামাশা করতো। কোনো এক দুর্বল মূহুর্তে নছিমন আটকা পড়ে শিকারী বাইশার জলে। আর বাইশা প্রায়ই…।

৬.
অন্দরমহল থেকে মালা খবর দিয়ে গেল ছেলেটার মুখ দেখার জন্য। সিরাজ মিয়ার আনন্দ আজ বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। সিরাজ মিয়া ব্যাকুল হয়ে ঘরে ঢুকল। ছেলেকে কোলে নিয়ে সিরাজ মিয়া খুশিতে কী করবে ভেবে পায় না। হঠাৎ চোখ পড়ে ছেলেটির দু’হাতে! নছিমন-ছেলের হাত, ছেলের হাত-নছিমন। সিরাজ মিয়ার চোখ বারবার উঠানামা করছে। মনে পড়ে বাইশার কথা, নতুন নতুন কাপড়, সুগন্ধি সাবান, স্নো লিপিস্টিকের কথা…।

৭.
নছিমনের নছিবটা সত্যিই খারাপ। নয়তো হাসপাতালের পাঁচ তলার বেডে তাকে শুয়ে থাকতে হতো না। চলন্ত ট্রাক নিভিয়ে দিতে পারেনি তার জীবন প্রদীপ। খুলে দিতে পারেনি নছিবের দ্বার।

নছিবটাকে শেষবার পরখ করতে চায় নছিমন। একবার থাকায় পাশে শুয়ে থাকা নিষ্পাপ শিশুটির দিকে, আরেকবার ছাদে উঠার দিকে….।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত