“হইতে হইতে তো চাইরখান বেটি ছাওয়াল হইলো। মোল্লা বংশেরবাতি বুঝি এইবার নিইভায়ি গেলো?” মুখে পান গুঁজতে গুজতে রইস মিয়াঁর উদ্দেশ্যে কথা ছুড়ে দিলো করিমুন্নেছা। দুপুরের এই সময় টা কোনো কাজ না থাকায় ঘরের সামনে সোফায় বসেই হয় পান চিবুয় নয় তো হুক্কা টানে রইস মিয়াঁ। বয়েস তার কম করে হলেও পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু চেহারায় এখনো বয়েসের ভাটার কিঞ্চিতও চিহ্ন পড়েনি। লম্বা, গায়ে গোতোরে বড়সড় একটা মানুষ রইস মিয়াঁ।
মাথার চুলে আর দাড়িতে মেহেদির লাল রঙ যেনো তার বয়েস কে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে দিচ্ছে। গ্রামের সম্মানিত ব্যাক্তিদের মধ্যে তিনি একজন। বসন্তপুর গ্রামে তারি আধিপত্য চলে,গঞ্জে তার ধানের কল আছে। জমি জামার কোনো অভাব নেই,জমিদারি হাল অবস্থা। মোল্লা বংশের এক মাত্র ছেলে তিনি। তিন বোন আর এক ছেলে তার বাবার। বংশের বাতি জ্বালানোরর জন্য এক মাত্র তিনিই সম্বল। কিন্তু তা আর হলো কই? রইস মিয়াঁর ছেলের আশায় আশায় চার টা মেয়ে হইলো। তাই তার বোনরা সবাই তাকে বিয়ে করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
করিমুন্নেছা রইস মিয়াঁর ফুফুআম্মা লাগেন। মোল্লা বংশের খুটি হিসেবে আছেন তিনি। তার কথা অমান্য করার সাধ্যি কারো নেই। দুপুরের এই সময় টা তিনি আরাম করেন,কিন্তু আজ হঠাৎ রইস মিয়াঁর কাছে এসে বসলেন তিনি। হয়তো রইস মিয়াঁর বোনেরা ফুফুআম্মার কাছে গিয়ে কানপড়া দিয়েছেন। “কি বাবা রইস তুমি কি আমার কথা হুনতে আছো না?” “জি ফুফুআম্মা আপনি বলেন,আমি শুনতে আছি। ”
“হো বাজান,হুনো তাইলে। বয়েস তো আমার কম হইলো না,ভাই আর ভাবি গত হওয়ার পর তোমাগো চাইর ভাই বোনরে আমি আগলাইয়া রাখছি। বংশের খুটি এহন তুমি,কিন্তু বাজান ভবিষ্যৎ এর খুঁটির জোগাড় যন্ত তো করাই লাগবো,কি বলো?” “জি ফুফুআম্মা, আপনার যা মর্জি। ”
“আমি তো চোখের সামনে নিজ বংশের ভাঙন দেখতে পারিনা, তাই আমি একখান সিদ্ধান্ত লইছি। তোমার বোনেরা হগ্গলেও আমার লগে এক মত। এহন আমি তোমারে জানাইতে আইলাম। “ফুফুআম্মা আপনি কন। আমি আপনার কথা ফালাইতে পারিনা, সেটা আপনি জানেন। “হ বাবা,হেই কারণেই তোমারে জিজ্ঞাস করা। আমি সিদ্ধান্ত নিছি তোমারে আবার বিয়া দিমু। আর এই বিয়া তোমারে করতেই হইবো। এটা আমার হপ কথা। ” “জি ফুফুআম্মা আপনি যা ভালো মনে করেন। ” “আলহামদুলিল্লাহ। আইচ্ছা বাবা,তুমি তোমার বউ তাসলিমা রে কইয়া অনুমতি নিয়ো। হেয় অমত করবোনা নিশ্চয়, আর অমত করলে কইবা চাইর বেটিরে লইয়া বাপের বাড়িত যাইতে। ”
কথা শেষ করেই নিজের ঘরের দিকে হাটা দিলেন করিমুন্নেছা। তাকে আস্তে দেখেই পর্দার আড়াল থেকে তসলিমা বেগম সরে গেলেন। এতক্ষণ স্বামী আর ফুফুশাশুড়ির কথা শুনছিলেন তিনি আড়াল থেকেই। তিনি জানতেন যে এসব নিয়ে ঘরের মধ্যে তার ননদেরা কানাঘুষা করেন। কিন্তু তিনি ভাবতে পারেননি তার ফুফুশাশুড়ি যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, সব সময় আল্লাহ বিল্লাহ করেন তিনিই কিনা তার বিরুদ্ধে কথা বললেন। চাইরডা মাইয়ার দিকে ফিরেও চাইলেন না। মুখে কাপড় গুঁজে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ একটা ১৫ বছরের কিশোরী এসে বলল, “আম্মা, আমি ক্লাসে এইবার প্রত্থোম হইছি। দেহো দেহো আমারে স্যারেরা মেডেল দিছে। ”
তসলিমা বেগম মেয়েকে ঝাপটে ধরে হুহুহু করে কাঁদতে লাগলেন। তার বড় মেয়ে তানিবা,এই বার দশম শ্রেণিতে পড়ে।পড়া লেখায় অনেক ভালো ও বুদ্ধিমতী তানিবা। কিছুদিন যাবৎ মাইয়াডার লাইগা ঘর আইতেছিলো।লম্বা,গায়ের রঙ ধবধবা সাদা,আর কোমর অব্ধি চুল। কিছুদিন পর যে মেয়ের বউ সাজার কথা সেই মেয়ের বাবা কিনা বিয়ে করবে এখন। সমাজে মুখ থাকবেনা আর, মাইয়াডারেও আর ভালা ঘরে বিয়া দেওয়ন যাইবো না। এসব ভেবেই তসলিমা বেগম কাঁদতে লাগলেন। “ও আম্মা,তুমি এমনে কানতাছো কিসের লাইগা? তুমি কি খুশি হও নাই শুইনা?” পাশ থেকে তসলিমার মেঝো মেয়ে তাফিয়া বলল, “আমি তো প্রত্থোম হইনাই, তাই তুমি আমারে আদর করতেছো না আম্মা?” তাফিয়া সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে।তসলিমা বেগম তাফিয়া কেও বুকে টেনে নিয়ে বলল, “না রে পাগলি মাইয়া, আমি মা।আমার কাছে তোরা সবাই সমান। ”
“আইচ্ছা আম্মা এহন কি খাইতে দিবা,খিদায় পেটের ভিতরে ইন্দুর নাচতাছে। “আচ্ছা মা, তোরা হাত মুখ ধুয়ে আয়। আমি তোগো লাইগা ভাত বারতাছি। ” “আইচ্ছা আম্মা,তনু আর তাবিয়া কৈ? ইস্কুল থে আইবার পর একবার ও দেখলাম না যে?” “তনু গুমাইতাছে, আর তাবিয়া কই খেলবার গেছে আমি কইতে পারুম না। আইচ্ছা তোরা আয়,আমি খাওন দিতাছি। ” তানিবা আর তাফিয়ে কলপাড় থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখল তাদের মা ভাত বেড়ে বসে আছে। দুজনে এসেই খেতে বসলো। তসলিমা বেগম হাত পাখার বাতাস করছেন দুজন কে,বিদ্যুৎ নেই। দুবোনের খাওয়ার মাঝে তাদের বড় ফুফু রুবিনা মানে তসলিমার বড় ননদ এসে দুজন কে খেতে দেখে বলল,
“খাঁ খাঁ খিইয়া ল শান্তিতে। নুতুন মা আইলে যদি খাইবার না দেয়। তহন কি করবি?” খাওয়ার মাঝখানে দুবোনেই থমকে গেলো। কি বললো তাদের ফুফ কি বলছে? তানুবা কিছুটা বুঝতে পেরেছে তাই চুপ করে রইলো। কিন্তু তাফিয়া না বুঝেই জিজ্ঞাস করলো, “নতুন মা মানে কি ফুফুজান?” তসলিমা বেগম মেয়েদের থেকে আঁড়াল করার জন্য বললেন, “কি বলো বুজান এসব। ওরা বাচ্চা মানুষ, ওগোরে কি এইসব না কইলেই হয়না? ” “তোমার যতো আদিখ্যেতা বাবা,মাইয়ারা আজ হইলেও জানবো কাল হইলেও জানবো।গোপন কইরা কি লাভ কও দেহি?” কথা টা বলেই মুখ বাঁকিয়ে সেখান থেকে রুবিনা চলে গেলো। তাফিয়ে তার মা কে কিছু বলতে যাবে,তার আগেই তানিবা তাফিয়ার হাত ধরে টেনে বললো, “চল মেঝো,ঘরে চল। বড়দের কথায় কথা বলতে নেই। ”
তসলিমা বেগম বুঝতে পারলেন যে তানিবা সব বুঝেই তাফিয়া কে ঘরের দিকে টেনে নিয়ে গেলো। তসলিমা বেগম আবার মুখে কাপড় গুঁজে দৌঁড়ে ঘরে গিয়ে দরজা লাগালেন। মোল্লা বাড়িতে উৎসবের ভাব,কারণ রইস মিয়াঁর বিয়ের জোগার যন্ত চলছে। আগামি শুক্রবার তার বিয়ে। জমির বেপারির একমাত্র মেয়ে জোলেখা বানুর সাথে বিয়ের দিন ধার্য করে হয়েছে। জোলেখার বয়েস সবে ১৮,কিন্তু সম্পত্তির লোভে তার বাপ রইস মোল্লার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য রাজি হইছে। বাড়ি তে এমন সাজসজ্জা দেখে তসলিমার সেঝো মেয়ে তাবিয়া তসলিমা কে বললো,
-আইচ্ছা আম্মা,বাড়িতে এত্ত কাম করতাছে ক্যাঁ?
-এমনিতেই মা, তুমি যাও বড় বুবুর লগে ঘরে গিয়া পড়তে বহো।
-আইচ্ছা আম্মা, বাজানের নাকি বিয়া?
-ছিঃ মা,এসব কয় না। যাও তুমি ঘরে যাও,আম্মা আইতাছি।
তানিবা এই কইদিন নিজেরে ঘরবন্ধি করেই রাখছে। বাইরে গেলেই সবাই হাসাহাসি করে,টিটকার করে। কাল ইস্কুলেও তার বন্ধু মোহন বলেছে এমন ঘরের মাইয়ার লগে নাকি বন্ধুত্ব করোন যায়না। কেউ তার সাথে মিশে না। তাই সে ইস্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিছে। ৩ বোন কে সাথে নিয়ে রুমেই পড়ে থাকে তানিবা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল,বিকেল গড়িয়ে রাত। এভাবেই দেখতে দেখতে রইসের বিয়ের দিন কাছেই চলে এলো। আর দুইদিন পর রইসের বিয়ে। তসলিমার ননদেরা এসে তসলিমা কে বলে গেলো রইসের ঘর থেকে তসলিমার সব জিনিস সরিয়ে ঘর খালি করে দিতে। তসলিমা কাউকে কিছুই না বলে চুপচাপ ঘরের জিনিস গুলো সরাতে লাগলো। এই ঘরেই একদিন লাল টুক টুকে শাড়ি পরে বউ সেজে এসেছিলো তসলিমা। এই ঘরেই জন্ম নিলো তার চার মেয়ে। এই ঘরটা জুড়ে কতো শত স্মৃতি, কিন্তু রইস আজ সব ভুলে নতুন বউ ঘরে তুলতে ব্যাস্ত। তসলিমা যখন সব জিনিশ সরিয়ে নিচ্ছে,তখন তানিবা এসে মা কে জিজ্ঞাস করলো,
-মা, তুমি এই সব কই নিতেছ? পাশ থেকেই রুবিনা বলল,
-এইডা এহন জোলেখার রুম,তাই তোর মায়ের সব জিনিশ সরাইতেছে।
-কেন? এইডা আমার মায়ের রুম সেডা তুমি জানো না ফুফুজান?
-কি,ছেমড়ির দেহি মুখ বাড়ছে। এই বাড়িতে তোগো দিন শেষ। বিলাইয়ের মতো থাকলে থাকবি না হয় বেটা ধর গিয়া।
-তোমার নিজের ও তো দুইখান মাইয়া,তাগো গিয়া কও না বেটা ধরতে।
-হারামজাদি, আইজ তোর একদিন কি আমার একদিন।
রুবিনা এই বলেই তানিবার গালে ঠাশ করে চার আঙুলের দাগ বসিয়ে দিলো। তানিবা টাল সামলাতে না পেরে দরজার পাশেই পড়লো। আর সেইখানেই রইস দাঁড়িয়ে ছিল। তানিবা করুণ ভাবে তার বাবার দিকে তাকালে,রইস কিছুই না বলে সদর্পে চলে যায়। তানিবা বুঝতে পারলো তার বাবা ও আর তাদের নেই।
তসলিমা এসব দেখে চুপচাপ মেয়ে কে নিয়ে ঘরে চলে গেলো। তার কিছুই বলার বা করার নেই। সেই ১৩ বছর বয়েসে এই ঘরে এসেছিলো সে। এই ননদ গুলো কে সে হাতের উপর বড় করে বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সময়ের সাথে সবার কাছেই তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। রাতে তসলিমা রান্না ঘরে কাজ করছিলো, হঠাৎ পাশের ঘর থেকেই রইস আর রুবিনা বেগমের গলার আওয়াজ শুনা গেলো। তসলিমা রান্না ঘর থেকে এগিয়ে গিয়ে দেখলো, করিমুন্নেছা কে ঘিরে রইস আর রুবিনা বসে আছে। রুবিনা বললো,
-ফুফুজান, জোলেখা বাপের এক মাত্র মাইয়া। এহনো ১৮ বছর বয়েস।কচি একখান মাইয়া,এরে বউ কইরা আনাতে গেলে সম্পত্তি লেইখা দিলে ক্ষতি কি? পাশ থেইকা রইস বইলা উঠলো,
-হ ফুফুআম্মা। আর সম্পত্তি লেইখা দিলে তো আর চইলা যাইতেছে না। মাইয়াডা তো আমারি বউ হইয়া আইবো। আর এমনিতেও তারে না দিলে তো সব মাইয়াগুলা আর তসলিমার নামেই চইলা যাইবো।
-হ ফুফুজান।আর জোলেখার বাপ হফ কথা কইয়া দিছে,তার মাইয়ারে বিয়া কইরতে হইলে ভাইজানের সব সম্পত্তি লেইখা দিতে হইবো।নইলে হেতেনে মাইয়া দিবো না। এহন তুমি বলো কি করবা? করিমুন্নেছা খানিক চুপ থেইকা কইলো,
-মুইও হেডাই ভাবতাছি। জোলেখারে লেইখা দিলে পরে রইসের পোলা পাইবো। আইচ্ছা তোমরা ব্যবস্থা করো। শুক্কুরবার বিয়ের কাবিনের লগে দলিল ও কইরা দিবা জোলেখারে।
-আইচ্ছা ফুফুজান আমি তাইলে সেই ব্যবস্থাই করি।
তসলিমা পর্দার আড়াল থেকে সরে রান্না ঘরে চলে গেলো। রান্না সেরে সবালিরে খেতে দিয়ে তসলিমা নিজের মেয়েদের জন্য খাওয়ার নিয়ে ঘরে চলে গেলো। খাওয়া দাওয়া শেষ তসলিমা মেয়েদের কে নিয়ে শুয়ে পড়ল। মাঝরাতে তসলিমা উঠে ঘর থেকে পা টিপেটিপে বেরিয়ে গেলো। গায়ে মুখে কাপড় পেঁচিয়ে গ্রামের রাস্তায় হাটা ধরলো। কিছুদুর গিয়ে দেখতে পেলো দুরেই মতি বাইদ্দা দাঁড়াই আছে। তসলিমা তার কাছে গিয়েই নিজের হাতের বালা জোড়া খুলে দিতেই মতি তসলিমার হাতে একটা কাচের সিশা হাতে দেয়। তসলিমা বলে,
-এই গেরামে যেন আর তোমার ছায়াও না দেখা যায়।
-আইচ্ছা কর্তা মা।
তসলিমা আবার বাড়ির পথে হাটা ধরে। বাড়ি এসেই নিজের ঘরের দরজা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আজ রইসের হলুদ। এত্তো সব করার ইচ্ছে না থাকলে ও জোলেখার বাপের কথায় বড় কইরাই আয়জন করা হয়েছে। তার একটা মেয়ে হওয়ায় কোনো কিছু বাদ রাখবেন না তিনি। জোলেখার ছোট ভাই জমিলেরে ও সকালেই রইসের বাড়িতে পাঠাই দিছে। দেখার জন্য সব ঠিক ঠাক আছে কিনা। তসলিমা রান্না ঘরে কাজ করার সময়েই হঠাৎ তনু এসে হাসতে হাসতে মা কে বলল,
-মা মা, বাজানেরে আইজকা জামাই জামাই লাগতাছে।
-ছিঃ মা এসব কেমনে কয়?
-তাইলে তুমি দেখতে আইসো। বাজানের মেহেন্দি দেওয়া লাল দাড়ি সব ফালাইয়া দিছে।
কথাটা বলেই তনু হাসতে লাগলো। তসলিমা তনুকে ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলো। তসলিমা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-চারদিকে রঙিন দেখতাছো রইস মোল্লা, নিজের যে একখান মাইয়া বিয়ার যোগার হইছে তার খেয়াল নাই। আর তুমি দাড়ি ফালাইয়া জোয়ান সাজতে আছো। কালকের সকাল টা যদি তুমি না দেখো, চাইরখান ফুল যত্নে বাচবো। কথা টা ভেবেই মুখে তৃপ্তির হাসিতে ভরিয়ে তুলল। সকালে থেকেই কোমর বেধে সব আয়জন নিজের হাতেই করতেছে তসলিমা। আজ আর তার মুখে কোনো বিষাদ নাই। বরং সবাইকে সদর্পে হাসি মুখেই বলে বেড়াইতেছে,
-এই বংশেরবাতি জলবে,কষ্ট পাইয়া লাভ আছে নাকি। আমি তো অনেক খুশি আমার বোন আইতাছে। আর রইস তো বিয়া করার যথাযত যুক্তি আছে। বংশ তো আর গুম করে দেওয়া চলে না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে এলো, রুবিনা তানিবাকে ডেকে হাতে নাস্তার থালা দিয়ে বললো,
-তানিবা মা,কাইলকার লাই ফুফুজান তোর কাছে সরমিন্দা। তুই আমারে মাফ কইরা দে।
-কি কোন ফুফুজান,আপনি আমার মায়ের মতো।
-আইচ্ছা ল, এই নাস্তা গুলান তোর জমিল মামা রে দি আয়।
-কই আছেন মামা?
-তোর বাপের ঘরেত।পুরা বাড়িত তো ভিড় হেই কারনে জমিল হেইখানেই বইছে।যা মা দিয়া আয়।
তানিবা হাতে নাস্তা নিয়ে উপরে তার বাবার ঘরের দিকে গেলো। দেখল ঘর থেকে রুবিনার বড় মেয়ে বেরিয়ে গেলো, আর তানিবার দিকে তাকিয়ে কেমন কুৎসিত হাসল।তানিবা সেদিকে খেয়াল না করেই ভিতরে ঢুকল। ভিতরে ঢুকেই নাস্তা রাখতে গেলে দেখল বাইরে থেকে কে জানি দরজা বন্ধ করে দিলো।আর জমিল তার দিকে কুনজরে আগাইয়া আসিল।
তসলিমা রান্না ঘরে কাজ করার সময় কেমন একটা শব্দ শুনতে পেলো উপর থেকে। তার মনে হলো তানিবা চিৎকার করছে। তসলিমা হাতের কাজ রেখে উপরের ঘরের দিকে গেলো। গিয়েই ঘরের ভিতর থেকে কেমন শব্দ শুনতে পেলো। বাইরে থেকে দরজা লাগানো দেখে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে তানিবা এসে তসলিমা কে জরিয়ে ধরল।মেঝেতে জমিল পরে আছে,আর তার কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে।পাশেই ফুলদানি টা ভেঙে দুই টুকরা হয়ে আছে। তসলিমার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হয়েছে। সে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছে।
এতক্ষণে বাড়ির সবাই উপরে চলে এলো। আর জমিল সবাই কে মিথ্যে বানিয়ে বলতে লাগলো। জমিলের কথা শুনে রইস এসে তানিবা কে কয়েক টা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। তসলিমা কিছুই বলছে না,শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে।
রুবিনা আর তার মেয়ে তানিবা কে নানান কথা শুনাতে লাগলো। তসলিমা বুঝে গেলো মা মেয়ে বুদ্ধি করেই তানিবা কে এই ঘরে আটকে দিয়েছে। তসলিমা কাউকে কিছু না বলেই তানিবা কে নিয়ে রুমে গেলো। গিয়ে মেয়েকে শরীরে মলম লাগিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে আবার কাজে লেগে পড়লো তসলিমা। জমিলের কাছে গিয়ে ক্ষমাও চাইতে হলো তাকে। তসলিমা সব মুখ বুজে সহ্য করছে,আর রইসের দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই আফসোস করছে।
সন্ধা নেমে এলো, রইসের হলুদের আয়জন করা হয়েছে। রইসের বোনেরা সবাই আমোদ ফুর্তি করছে। তসলিমা তাদের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। মেয়েদের বললো, বাবার পায়ে সালাম করে মাফ চেয়ে নিতে শেষ বারের মতো। তানিবা ভাবলো হয়তো তার বাবার এই আচরণে তসলিমা এই কথা বলছে। হলুদের কাজ শেষ হতেই খাবারের পালা আসতেই তসলিমা সবাইকে খাবার দিলো।
খাবার খেয়ে রইস নিজের ঘরে শুতে গেলো। তানিবা তার বোন দের নিয়ে বাবাকে সালাম করে মাফ চেয়ে চলে আসলো। রইসের বোনেরা সবাই যে যার মতো করে ঘুমিয়ে পড়ল। তসলিমা এক গ্লাস দুধ নিয়ে রাতে মতির কাছে থেকে আনা কাচের শিশা টার পুরোটাই ঢেলে দিলো। গ্লাস হাতেই রইসের ঘরের দিকে গেলো তসলিমা। রইস অবাক হলে তসলিমা বললো,
-কাল থেকে তো সুযোগ পাবো না তাই।
রইস গ্লাস নিয়ে সবটুকুই উদারজাত করলো। তসলিমা রইস কে সালাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। দরজায় এসেই রইসের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে মেয়েদের নিয়ে শুয়ে পড়ল আর একটা নতুন সকালের আশায়।
জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে চোখে পড়ায় ঘুম ভেঙে গেলো তসলিমার। আজকের সূর্য টা কেমন রঙিন আভা ছড়াচ্ছে। রঙের খেলা খেলিতে খেলিতে তাহার উদয়, রঙ ছড়াইতে ছড়াইতে তার অস্ত। সুখ তেমনি একটি বস্তু,যাকে পেতে হলে সত্যি কিছু ত্যাগ করিতে হয়।
কিচ্ছুক্ষণ বাদেই বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ কানে এসে ঠেকল তসলিমার। কিঞ্চিৎ হেসে গায়ে কাপড় টেনে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।
দেখতে দেখতে অনেক দিন কেটে গেলো, উঠানের শেষে রইসের কবরের বেলি ফুলের গাছটা আবার শুকিয়ে গেছে। পাতায় তার খয়েরি দাগ পড়েছে,আর তসলিমার গায়ে উঠেছে সাদা শাড়ি। তানিবার বিয়ের পর থেকে কেউ আর গাছ টা তে পানি দেয়নি।মেয়েটার বড় ঘরে ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছে,আর তাফিয়ার ও আগামি শুক্কুরবার বিয়ার লগ্ন।
রুবিনার মেয়েটির পেটে জমিলের বাচ্চা,কলংক বইতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়েছে। আর রুবিনা মেয়ের শোকে পাগল প্রায়। করিমুন্নেছার শরীরে পচন ধরেছে,তাফিয়া দাদির সেবায় রয়েছে। তসলিমা হাতে পানির জগ নিয়ে রইসের কবরে পানি দিচ্ছে, আর তাচ্ছিল্য ময় হাসি দিয়ে বললো,
রইস মোল্লা তোমার বিয়ে করার শখ বুঝি মিটলো না। বেচারা বর সাজার অবসর আর পেলো কই।হঠাৎ সেদিন সকালে মরে গেলো। অথচ বিয়ের কন্যা জোলেখা বউ সেজেই বসে ছিল। তার মৃত্যু টা আজও রহস্য রয়ে গেছে। যেমন করে সাঁঝের বেলায় পাতা ঝরে গেলে নাম দেই ঝরাপাতা তেমন করে তার মৃত্যুর নাম হলো অকাল মৃত্যু।