চলার পথে

চলার পথে

দিনের শেষভাগ উপস্থিত। আকাশের নির্লিপ্ত সূর্য আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে গভীরে। সমস্ত পৃথিবীতে নেমে আসছে অন্ধকার। আচ্ছা এই সূর্য তলিয়ে কোথায় যায়? বিজ্ঞানের কথা মানতে মন চাই না। ইচ্ছে হয় একটু অন্যরকম ভাবতে। সে অন্যরকমটা কেমন? আকাশটাকে একটা বিশাল সমুদ্র ভাবতে ইচ্ছে হয়। যার একভাগ হতে ভেসে ওঠে সূর্য। সারাদিন মেঘেদের সাথে সমুদ্রজলে সাঁতার কেঁটে আর খুনসুটি করে বিকেলে নির্লিপ্ত হয়ে ফিরে যায় নিজের ঘরে। যেমন সারাদিনের কাজের শেষে ক্লান্ত মানুষ ঘরে ফিরে আসে।

সন্ধ্যা। সূর্য ফিরে যাচ্ছে নিজের ঠিকানায়। সকালে কাজে বের হওয়া মানুষগুলো ফিরছে নিজের ঠিকানায়। পাখিরা ছুটে চলেছে তাদের নিজ ঠিকানায়। একটা জিনিস কখনো খেয়াল করেছেন? মানুষ আর পাখিদের জীবনযাত্রা মাঝে অনেকটা মিল রয়েছে। প্রতিদিন সকালে মানুষেরা যেমন নিজের এবং পরিবারের রিজিকের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি পাখিরাও বেরিয়ে পড়ে নিজের এবং পরিবারের রিজিকের খোঁজে। আবার রোজ সন্ধ্যায় সবাই ফিরে আসে আপন ঠিকানায়। আচ্ছা সবাই কি ফিরে আসে? হয়তো আসে নয়তো না।

অনেকে খুব সহজেই ফিরে আসে, কেউ ফিরে আসে অনেক সংগ্রামের পর, আবার হারিয়ে যায় অনেকে। আকাশে কিংবা অন্ধকারে। হারিয়ে যারা যায়, তাদের কেউ কেউ অনেক চেষ্টা করে ফিরে আসার, আবার অনেকে নির্লিপ্ত হয়ে থেমে থাকে একেবার। কারো পিছনে টানটান করে বাঁধা থাকে তাদের হাত। ছাড়াতে গেলে খুব কষ্ট হয়, ব্যথা অনুভূত হয়। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয় তখন। আচ্ছা পাখিদেরও কি এমনটা হয়? তাদের কেউ কেউ কি অন্ধকারে হারিয়ে যায়? নাকি সবাই ফিরে আসে? আমাদের কারো হয়তো জানা নেই। আমরা কেউ কখনো কোনো পাখির জীবনধারণ পর্যবেক্ষণ করিনি হয়তো।

সূর্য অস্ত গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। মসজিদে মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে তবুও আকাশে হালকা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। টিপটিপ করে গাছের ডগা থেকে বৃষ্টির পানি ঝরে পড়ছে। দল থেকে ছিটকে পড়া পাখিগুলো একে একে নিজ আস্তানায় ফিরছে। সেখানে অপেক্ষায় রয়েছে তাদের পরিবার। অনেক ব্যস্ত শহরের মাঝে শুনশান একটা এলাকা। দূরে বড় রাস্তা দিয়ে চলতে থাকা বড় গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তা থেকে ছোট গলির ভেতর ঢুকতে মোড়ের ওপর একতলা শীর্ণ বাড়ি। বাড়ির পাশে একটা ছোট খেলার মাঠ। সন্ধ্যা নামায় কেউ সেখানে নেই। সবাই ফিরে গেছে নিজের ঠিকানায়। খেলার মাঠের একপাশে বৃষ্টির পানি বেঁধে আছে। একটা কুকুর এই ভরা সন্ধ্যায় ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলোতে পিপাসা মেটাচ্ছে। অদ্ভুত রকমের একটা শব্দ হচ্ছে। কিছুদূর এগিয়ে একটা বাড়ি। বাড়িটা পেরলেই একটা পুকুর। পুকুরের পাশে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে একটা ঝোঁপ। সেখান থেকে ঝিঁঝিপোকারা ডেকে চলেছে অবিরাম।

ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝিপোকার শব্দ কানে আসলেই আমার মনে পড়ে, গ্রামের মেঠো পথ, ধানের ক্ষেত, পানিতে টুইটম্বুর ছোট ছোট ডোবা; যা কচুরিপানায় একেবারে পরিপূর্ণ থাকে। সন্ধ্যার আগে যেখান থেকে ভেসে আসে বক কিংবা পেঁচার কণ্ঠ। ধানের ক্ষেতের অদ্ভুত রকমের গন্ধ। শো-শো করে বয়ে চলা দক্ষিণা বাতাস। সন্ধ্যার মেঘমুক্ত আকাশের তারার মেলা। কোলাহল মুক্ত পরিবেশ। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। কিছুক্ষণ পর পর দূরের কোন কলমি কিংবা কাঁশবন থেকে ভেসে আসা শেয়ালের ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ আসে না কানে। চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় কত-শত জোনাকি পোকা। এসব দেখে আনন্দে মেতে উঠতো আমার সমস্ত তনুমন। কিন্তু ইট পাথরে ঘেরা এই কোলাহলময় শহরে এসব শোনার ইচ্ছা একেবারেই অর্থহীন। এগুলোর কিছুই এখানে নেই। এখানে যা আছে তার সবকিছুই কৃত্রিম।

ভেজা রাস্তা চলতে থাকা বিভিন্নরকম গাড়ির ফাঁকফোকর গলিয়ে বড় রাস্তা পার হয়ে এই গলির মাঝে ঢুকেছি আমি। ঠিক গলি বলা যায় না এটাকে। একপাশে খেলার মাঠ। অন্যপাশে কিছুদূর পরপর একেকটা বাড়ি। আর ফাঁকা যায়গাগুলোতে বিভিন্নধরনের গাছ। মেহগনি, শিমুল, সেগুন, বরইসহ আরো অনেক ধরনের গাছের সমাহার। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে কিছুক্ষণ আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির পানি। মেঘলা আকাশের কারণে চারিদিকের অন্ধকার আরো বেশি গাঢ় হয়ে পড়েছে। যদিও চারিদিক বিভিন্ন রকমের আলোতে ভর্তি থাকায় অন্ধকার দেখা যায় না এ শহরে। গলির মাঝে একেবারে শুনশান পরিবেশ। খুব একটা শব্দ শোনা যায় না। বড় শহরগুলোতে সাধারণত এরকম যায়গা পাওয়া যায় না। কিন্তু এশহরে আছে।

আমি খেলার মাঠের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছি। পাশের ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝিপোকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনকার মতো আজও দূরের কোন এক বাড়ি থেকে গানের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। রবীন্দ্র সংগীত,
“আমারো পরানো যাহা চাই, তুমি তাই, তুমি তাই গো। আমারো পরানো যাহা চাই। তুমি ছাড়া আমার এ জগতে, মোর কেহ নাই কিছু নাই গো। আমারো পরানো যাহা চাই।”

কী চাই আমার পরান? হাফ ছেড়ে বাঁচতে চাই। সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি চাই। সমস্ত ক্লান্তি-ক্লেশ, সমস্ত অপমান অপদস্থতা ঝেড়ে ফেলতে চাই শরীর থেকে। বিশাল এই জগতে আমাদের মতো মানুষদের জীবনে কিছু নেই। না আছে ইচ্ছা পূরণের পরিতৃপ্তি; না আছে ঘুরে দাঁড়াবার সামর্থ্য। ইচ্ছে পূরণের পরিতৃপ্তি কিংবা ঘুরে দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই বলে আমাদের জীবন যে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। আমরা সফল মানুষ; সংগ্রামী মানুষ।

২.

রাতের আকাশ পরিস্কার হচ্ছে আস্তে আস্তে। তারা ফুটে উঠছে। পাশের পুকুর থেকে মাঝে মাঝে পানির শব্দ কানে আসছে। পাশের ঝোপের আড়ালে ঝিঁঝিপোকারা ডেকে চলেছে এখনো। গাছ, বাড়িঘর, ঝোপঝাড়, খেলার মাঠ পেরিয়ে এগিয়ে চলছি। দূরের বাড়ি থেকে ভেসে আসা গানের শব্দ এখনো শুনতে পাচ্ছি কিছুটা।

“তুমি শুখো যদি নাহি পাও; যাও সুখেরো সন্ধানে যাও। আমি তোমারে চেয়েছি হৃদয়ো মাঝে আরো কিছু নাহি চাই গো।আমারো পরানো যাহা চাই।”

আমি কি কাউকে পেয়েছি? যাকে আমার সমস্ততা উজাড় করে দিতে পারি? আমার আশেপাশে এমন কেউ কি আছে, যে আমার সমস্ততা জুড়ে আছে। না; তেমন কাউকে দেখছি না। আমার মতো মানুষের কাছের মানুষ বা শুভাকাঙ্ক্ষী থাকতে নেই। আমি নিজেই অন্যের সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতে পারি না। অন্য কাউকে জড়াব কি করে? তাছাড়া আমার কৃষক বাবার অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা আমাকে নিয়ে; অনেক বিশ্বাস আমার ওপর। বাবা মানে বিশাল আকাশ। যাকে বাদে কল্পনা করা যায় না আমার পৃথিবীকে; বাবা তো আমার মেরুদন্ড যার ওপর ভরসা করে আমি দাড়ানোর সাহস পাই। যার আশ্রয়ে বেড়ে উঠছি আমি। আমি আমার আকাশ, মেরুদন্ড কিংবা আশ্রয়দাতার স্বপ্ন, আশা বিশ্বাস কি কোনোভাবে ভাঙতে পারব না।

ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে এগিয়ে পুকুর পেরিয়ে তিনতলা স্কুলের পাশে যেখানে গলিটা মোড় নিয়েছে ঠিক তার উল্টো পাশের দোতলা বাড়িটা আমার গন্তব্য। এইতো বছর দুই হতে চলেছে আমি জড়িয়ে পড়েছি এই বিশ্বাস পরিবারের সাথে। এ বাড়িতে আসা যাওয়া শুরুর আগে শহরের ধনপতিদের সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা ছিল আমার। আগে ভাবতাম, ধনপতিরা তাদের ধনের মোহে গরীব কিংবা আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের মানুষ মনে করে না। ডাস্টবিনে পঁচে যাওয়া, দুর্গন্ধযুক্ত ময়লাগুলোর মতো মনে করে। এরকম ভাবার কারণ আছে। তার আমি প্রমাণ পেয়েছি। কিন্তু এদের সাথে জড়িয়ে যাবার পরে আমি বুঝতে পেরেছি আসলে পৃথিবীর সব ধনপতিরা এক নয়। কারো কারো কাছে টাকার থেকে মানুষ পরিচয়টাই বেশি মূল্যবান।

বছর দুই হতে চলল এই বিশ্বাস বাড়ির বড় ছেলে একমাত্র ছেলেকে পড়াচ্ছি আমি। ছেলেটার নাম আবির। এবার চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছে। আবিরের রঙের মতই রাঙা তার জীবন। দুষ্টামি, খুনসুটি আর অভিমানে অতিবাহিত হয় তার জীবন। তাকে দেখা মাত্রই আমার নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে। কত আনন্দময় ছিল আমার শৈশব! সকালে মায়ের আদরে ঘুম থেকে জেগে পাড়ার সমবয়সীদের সাথে খেলতে ছুটে যাওয়া। মায়ের হাতে মার খেয়ে ক্লাসের বই মাথায় তুলে স্কুলে ছুটে যাওয়া। স্কুলে খেলাধুলা, মারামারি, খুনসুটি করে ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ফেরা। মায়ের হাত থেকে খাবার মুখে পুরে বিভিন্ন খেলায় মেতে ওঠা, বিকেলে ঘুড়ি আর নাটাই হাতে ফাঁকা মাঠে ছুটে যাওয়া, সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে কেরোসিনের বাাতির সামনে পড়তে বসেই ঘুমিয়ে যাওয়াই ছিলো প্রতিদিনের রুটিন। দিনের পর দিন কোনো পরিবর্তন ছিল না তার। কোথায় সেই দিনগুলি! কোথায়! কোন অন্ধকারে হারিয়ে গেল! হয়তো আর কোনদিন ফিরবে না সেদিনগুলি।এখনকার ছেলেরা পায় না সেরকম সুযোগ। শৈশব-কৈশরের অনেক আনন্দ থেকে এখন বঞ্চিত এরা। এদের নিজস্ব জগত নিয়ে এখন ব্যস্ত এরা।

৩.

মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ার ইচ্ছায় এসেছি এই ইট-পাথরের শহরে। বাবার অনেক বড় স্বপ্ন আমি বড় মানুষ হবো। সে ইচ্ছে পূরণ হবে কি তা জানি না। কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? চেষ্টা করতেই পথে নেমেছি। সফলতা, বিফলতা কিংবা গন্তব্য অনেক দূরে। ধীরে ধীরে এগোতে হবে আমাকে। কৃষক বাবার কষ্ট কমাতেই টিউশনি করি। আজ মাসের প্রথম। বেতন পাব। গতবার বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম, বাবার পরনের পাঞ্জাবিটা ছিঁড়ে গেছে; জোড়া লাগানো সেখানে। মায়ের শাড়ির আঁচলটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। সামনে ঈদ আসছে।

পুকুর পেরিয়ে তিনতলা স্কুলটা পেরিয়ে আমার গন্তব্যের কাছে পৌঁছেছি। কলিংবেল চাপা মাত্রই ওপাশ থেকে আবির বলে উঠল– কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন স্যার। আমি আসছি।

পুকুরের পাশের ঝোপ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ পাচ্ছি কিছুটা। দূর থেকে সেই গানের মৃদু সুর ভেসে আসছে। তার কোনো শব্দ বোঝা যাচ্ছে না। আমি দাঁড়িয়ে আছি আবিরের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর আবির এসে দরজা খুলেই আমার দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিল। আমি ওর হাসির জবাবে কিছু না বলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। আবির আস্তে করে দরজা লাগিয়ে দিল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত