ফেরা

ফেরা

হতভম্বের মতোই নিথর নিশ্চল হয়ে দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে রইল ফারিয়া। বজ্রাহত মানুষের মতো একদৃষ্টিতে সে দেখছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে। এও কী সম্ভব? একদম অবিকল দেখতে আরেকটা মানুষ। সেই নাক, চোখ, দৃঢ়বদ্ধ পুরু ঠোঁট, সেই অপ্রশস্ত ছোট্ট কপাল। ঘন কালো একমাথা ঝাকড়া চুল। শুধু গায়ের রং-টা মিলছে না। রানা’র গায়ের রং ছিল অনেক উজ্জ্বল, উজ্জ্বল শ্যামলা যাকে বলে। মাঝে মাঝে সাবান আর শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করে বের হলে রীতিমত ফর্সাই দেখাত ওকে। তার উপর এই লোকটার মুখের উপর দাঁড়িগোঁফের জঙ্গল তার আসল চেহারাকে আড়াল করে আছে। তবুও, না, এই লোক রানা নয়। হওয়ার কোনো সুযোগও নেই। কী করে সম্ভব? বিজয়ের ছয় মাস পরেও যার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সে কী করে আজ হঠাৎ এমন করে মাটি ফুঁড়ে বের হবে!

যুদ্ধ শেষ হবার পর রানাকে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছিল চেনা-জানা পরিচিত মানুষের ঠিকানায়। রানার বাবা-মা পাগলের মতো ছেলেকে খুঁজে বেরিয়েছে। ফারিয়া খবর পেয়েছিল রানা ফিরে এসে মরিয়ম খালার বাসায় এসেছিল তার খোঁজ নিতে। রানা’র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার খবরও ভাসা ভাসা জানতে পেরেছিল নানা জনের কাছে। তাই ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছেও ঠিকানা যোগার করে আফজাল খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মেলেনি কোন হদিস। কেউ বলেছে, ‘ওহ্ , হ্যা, কোলকাতায় দেখা হয়েছিল’। কেউ বলল, ‘হুম মনে পড়েছে, বিক্রমপুরের অপারেশনের সময় সে আমাদের দলেই ছিল। তারপর আগরতলায় চলে গেল লিডারের ডাকে। আর দেখা হয়নি।’

ইফতেখার নামের এক কমবয়সি ছেলের খোঁজ পাওয়া গেল অনেক কষ্টে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে সে রানার সাথে ট্রেনিং নিয়েছিল। সেই জায়গাটির নাম ‘মেলাঘর’। বাংলাদেশের কসবা এবং ভারতের বিলুনিয়ার মাঝামাঝি একটি ঘন জঙ্গল মতো জায়গায় তাদের ক্যাম্পটি ছিল। কয়েকশ ছেলে তাদের সাথে সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ। এখান থেকেই তৈরি হওয়া ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসেবে তারা সবাই একত্রে ঢাকা শহরে প্রবেশ করেছিল। এরাই তখন ঢাকার পাকসেনাদের রীতিমত ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। তাদের সাথে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমীও এই গ্রুপেরই একজন সদস্য ছিল। সে ধরা পড়েছিল ঊনত্রিশে আগস্ট। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাকে খুব নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল।

ক্যাম্পের জায়গাটায় পানির খুব অভাব ছিল। ইফতেখার স্মৃতিচারণ করে বলল, ‘রানাভাই আমাকে প্রায়ই তার বরাদ্দ পানি থেকে পানি ধার দিতেন। কথা ছিল একদিন সুদে-আসলে আমাকে তা শোধ করতে হবে।’ এতটুকু বলেই ইফতেখার সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। তারপর ব্যথিত কণ্ঠে বলল, ‘সম্ভবত ওর গুলিটা মাথার বাম সাইডের কান ঘেঁষে লেগেছিল। তারপর কোলকাতায় কোন এক হাসপাতালে চিকিৎসার খবরও শুনেছিলাম। অবস্থা খুব সংকটজনক ছিল। কিন্তু রানাভাইয়ের খবর আমি শেষ পর্যন্ত আর রাখতে পারিনি। আমি দুঃখিত ভাবী। ঋণ শোধ করার কোনো সুযোগ আমি ভবিষ্যতে পাব কিনা জানি না।’

এরপরে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার পর ফারিয়া আফজালকে বিয়ে করতে আর আপত্তি করেনি। কারণ রানার বেঁচে থাকা আর ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলিতে ফারিয়া আর তার ভেতরে বড় হতে থাকা রানার ভাবী সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে এই মানুষটির ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য ফারিয়ার ছিল না। বলতে গেলে তাদের মা আর ছেলের জীবন এই মানুষটির দয়ায়ই বেঁচে গিয়েছিল। তখন কোথায় নিজের বাবা-মা; আর কোথায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন। সবাই ছিন্নভিন্নভাবে নানা জায়গায় পালাতে বাধ্য হয়েছিল। কেউ কারও খোঁজ নিতে বা খোঁজ জানানোর সুযোগটুকুও পায়নি। আফজাল শেষপর্যন্ত নিজের স্ত্রীকেও পাকবাহিনীর হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। ক্র্যাকডাউনের পর সবাই পাগলের মতো পালাচ্ছিল। আফজালদের পরিবারের সাথে ফারিয়াকেও পালাতে হচ্ছিল। সাথে শতশত মানুষ। তারা নৌকায় করে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে জিন্জিরার দিকে যাচ্ছিল। তখন মিলিটারি বোম্বিং শুরু করল। আফজালের স্ত্রী রাহেলা বুকে প্রচন্ড আঘাত পেয়ে প্রায় সাথে সাথেই মারা গেল। লাশ বুড়িগঙ্গায় ফেলে দৌড়ে পালাতে হয়েছিল। পাঁচ বছর বয়সি কন্যাকে সাথে নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে পালাতে গিয়ে, তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ফারিয়াকেও তারা আগলে রেখেছিল।

যুদ্ধের ভয়াবহ উন্মাদনা শেষ হয়ে জনজীবন যখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, তখনই সবাই যার যার ব্যক্তিগত শোক, ক্ষতি, দুঃখ, বেদনার দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসত পেল। নিঃসঙ্গ, শোকার্ত, আর বিপর্যস্তভাবে ভেঙ্গে পড়া আফজাল আর তার পাঁচ বছর বয়সি একমাত্র মেয়ের ভার নেয়ার জন্য মরিয়ম খালা ফারিয়ার হাত ধরে অনুরোধ করলেন। ফারিয়া নিজেও তখন নিঁখোজ রানার শোকে, যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে প্রথম সন্তানের জন্ম দেয়ার নিদারুণ অভিজ্ঞতায় এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় বিপর্যস্ত। তারও কাউকে অবলম্বন করে বাঁচার জন্য একটা আশ্রয় একটা সান্ত্বনার জায়গার খুব দরকার ছিল। তাই দুই পরিবারের আগ্রহে অচিরেই আফজাল আর ফারিয়ার বিয়ে হয়ে গেল।

ফারিয়া ছেলের জন্মের পর রানার প্রিয় নামটিই রেখেছিল তাদের ছেলের জন্য। ‘পাভেল’ ছিল রানার কৈশরের হিরো। বিয়ের পর তারা দুজনের ঠিক করেছিল তাদের ছেলে হলে রানা’র প্রিয় উপন্যাসের নায়ক পাভেলের নামটি রাখবে তাদের ছেলের জন্য। আজ রানা না থাকলেও পাভেলই রানা’র স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকবে ফারিয়ার জীবনে।

কনসিভ করার সুসংবাদটা রানাকে দেয়ার জন্য ফারিয়া গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল। ময়মনসিংয়ের ট্যুর শেষ করে ঢাকায় ফিরলেই তাকে এই সুসংবাদ দেয়ার একটা ছোট্ট আনুষ্ঠানিকতাও ফারিয়া মনে মনে ছঁকে রেখেছিল। কিন্তু মার্চের সাতাশ তারিখে রানা’র ফেরার কথা থাকলেও তার আগেই পঁচিশে মার্চের রাতে ঢাকা শহর লন্ডভন্ড হয়ে গেল। দেশের এই পরিস্থিতিতে মধুবাগের দুকামরার ভাড়া বাসায় একা একা থাকা ফারিয়ার জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। সে প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল। কয়েকবার চেষ্টা করেও হোটেলের ফোনে রানাকে পাওয়া গেল না। ঢাকায় আপন বলতে তার তেমন কেউ নেই। এই পরিস্থিতিতে রানা কখন, কীভাবে এসে পৌঁছাবে তারও কোন ঠিক ঠিকানা নেই। ফারিয়ার মনে পড়ল তার মায়ের খালাত বোন মরিয়মের কথা। একা একা বাসায় না থেকে বরং খালার বাসায় গিয়ে থাকা যায়। সে প্রথমে রানার কাছে গুছিয়ে একটা চিঠি লিখল। তারপর মরিয়ম খালার বাসার ঠিকানা সহ লেখা চিঠিটি আলমারির পাল্লার সাথে স্কসটেপ দিয়ে আটকে দিল; যাতে রানা ফিরে এলে চিঠিটি তার চোখে পড়ে। তারপর কারফিউ শিথিল হওয়ার প্রথম সুযোগেই তাদের বাড়িওয়ালীর দেয়া একটি বোরকা পরে অনেক কষ্টে সে মরিয়ম খালার বাসায় এসে উঠল। তারপর তাদের সাথেই স্রোতের শ্যাওলার মতো ভাসতে ভাসতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ভেসে চলল।

রানা হায়দার নামের সেই মানুষটা আজ কেবলই অতীত। অতীত থেকে আর ফেরা হয় না। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতোই সে অতীতকেও ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করল ফারিয়া। তারপর দরজাটি পুরোপুরিভাবে খুলে সে আগন্তুকের মুখের দিকে তাকালো। কম্পিত গলায় জানতে চাইল, আপনাকে ঠিক চিনতে পারছিনা; কার কাছে এসেছেন এখানে?

খুব বিষণ্ণ করুণ একটা হাসি মুখে ধরে রেখে আগন্তুক বলল, ‘কেমন আছ ফারি?’

সেই গভীর গলার স্বর! এই গলার স্বরে কোনো ভুল নেই। ভুল হতে পারে না। ফারিয়ার চোখের সামনের পৃথিবী ততক্ষণে দুলতে শুরু করেছে। ঘরের দরজা, দেয়াল আর মেঝে সব দুলছে। লম্বা, রুগ্ন, কৃশকায় সেই আগন্তুকের মুখ তার কাছে, খুব কাছে ঝুঁকে এল। জ্ঞান হারানোর আগে ফারিয়া বিরবির করে শুধু বলতে পারল, ‘রানা, তুমি! এতদিন পরে এলে!’

জ্ঞান ফেরার পর আধ খোলা চোখে তাকাল ফারিয়া। শরীর খুব দুর্বল; মাথা অসম্ভব ভার।তার শোবার ঘরের বিছানায় তার পাশেই উৎকণ্ঠিত মুখে আফজাল বসে আছে। ফারিয়ার দুই চোখ খুঁজে বেড়াতে লাগল আরও একটি কাংখিত মুখ। সেই ভালোবাসার মুখটি। অসম্ভব প্রিয় একটি মানুষের মুখ। কোথায় সে?

ফারিয়াকে চোখ খুলতে দেখে আফজাল তার মাথায় হাত রাখল। সেই হাত আশ্বাস আর অভয়ের। নিরাপত্তার। তারপর ফারিয়ার মুখের খুব কাছে ঝুঁকে এসে বলল, ‘এখন কেমন ফিল করছ ফারি? ভয় পেয়েছিলে?’ তারপর বিরক্ত মুখে বলল, ‘কতবার বলেছি, অজানা, অচেনা উটকো লোককে দরজা খুলবে না কখনও। কে না কে এল, আর দরজা খুলে দিলে? যদি খারাপ কিছু হত? দেশের অবস্থা এমনিতেই ভাল নয়। অভাবী মানুষে দেশ ভরে গেছে।’

ফারিয়া বিস্ফোরিত চোখে ফ্যালফ্যাল করে আফজালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ব্যথিত কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল, ‘অজানা, অচেনা উটকো একটা লোক! কোথায় সে?’ বুকভাঙা কান্নায় তার গলা বুজে এল।

আফজাল তাড়াতাড়ি পাশ ফিরে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ভয় নেই সোনা। সে এখানে আর নেই। তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নাম, ধাম ঠিকানা জানার চেষ্ঠা করেছিলাম অবশ্য; কিন্তু লোকটা কোন কথাই বলল না। কেন এসেছিল, কাকে খুঁজছে কিছুই জানা গেল না। স্ট্রেন্জ পাবলিক। কোন ধান্দায় এসেছিল কিনা কে জানে। রক্ষা আমি সেই সময় বাথরুম থেকে বের হয়েই তাকে দেখতে পেয়েছিলাম। তবে তুমি এমন ভয় পেয়ে জ্ঞান হারালে দেখে আশ্চর্য লাগছে। একেবারে ভীতুর ডিম একটা।’

ফারিয়া চোখ বুজে, দু’ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে, গলা চিড়ে বেরিয়ে আসা উদগত কান্নাটা প্রাণপনে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলো। না, আফজালও রানাকে একদমই চিনতে পারেনি। আর কী করেই বা চিনবে? শুধু তাদের বিয়ের দাওয়াত খেতে এসে ঘন্টা খানেকের জন্য দুজনের দেখা আর পরিচয় হয়েছিল। প্রবল উত্তেজনায় আর নিস্ফল আবেগে ফারিয়ার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। আফজাল ফারিয়ার কাঁপুনি টের পেয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘ফারি, এমন কাঁপছ কেন? এখনও ভয় করছে? ডাক্তার কল করব? খুব কী খারাপ লাগছে?’

দিশাহারা আফজাল প্রথমে কী করবে ভেবে পেল না। ছুটির দিনের এই সকালে কোন ডাক্তারকে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। হঠাৎ মনে হল, ফারি আর রানার বন্ধু মনসুর’কে ফোন করা যায়। সে যদিও গুলশানে থাকে। তবে ফারি অসুস্থ শুনলে গাড়ি নিয়ে কলাবাগানে চলে আসতে পারে। সে ফারিয়াকে বিছানায় রেখে মনসুরকে ফোন করতে ডাইনিং রুমে গেল।

মনসুর এসে ফারিয়ার ব্লাড প্রেসার মেপে একটু চিন্তিত মুখে বলল, ‘ব্লাড প্রেসার এবং হার্টবিট একটু আনইয়ুজালী এলিভেটেট। তবে এটা সাময়িক উত্তেজনার জন্যও হতে পারে। বিশ্রাম নিলে বা একটু ঘুমাতে পারলেই আশা করি ঠিক হয়ে যাবে। আমি রিলাক্সেশন জাতীয় একটা ওষুধ দিচ্ছি। ওকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে দিন। ঠিক হয়ে যাবে। আমি না হয় আবার রাতে রূপাকে নিয়ে এসে ওকে দেখে যাব। তাছাড়া ফারি খুব শক্তধাঁচের মেয়ে। সামান্য একজন অজ্ঞাতনামা আগন্তুকের ভয়ে এমন কাহিল হবার মেয়ে সে নয়।’ কথাটা শেষ করতে না করতেই কিছু একটা মনে হতেই মনসুরের কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল এবং একটু উদ্বিগ্ন মুখে সে আফজালের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, যে লোকটা এসেছিল বললেন, তাকে আপনি দেখেছেন? তার সাথে আপনার কথা হয়েছিল?’

‘হ্যা, কথা হয়েছে বৈকি। আরে, অনেকক্ষণ জেরা পর্যন্ত করলাম। কিন্তু কোন কথারই উত্তর দিল না লোকটা। শুধু বলল, ‘ফারি’র সাথে কথা না বলে আমি আপনার কোন কথার উত্তর দেব না। আপনি ফারি’র খেয়াল রাখুন। আমি যাচ্ছি।পরে আবার আসব।’ কিন্তু হ্যা, সে ফারি’র নামটা জানে। কোত্থেকে কী মতলবে এসেছিল কে জানে?’

মনসুর চিন্তিত মুখে আফজালের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর দ্বিধার সাথে জানতে চাইল, ‘আফজাল ভাই, আপনার কী কখনও রানার সাথে পরিচয় হয়নি?’

আফজালের বুকের ভেতরে একটা অজানা শংকায় যেন কেঁপে উঠল। রানা হায়দার! কিন্তু তাও কী সম্ভব? কীভাবে? কিন্তু সে যথাসম্ভব সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘হ্যা, পরিচয় হয়েছিল বৈকি। আমার মা আর ফারি’র মা যেহেতু খালাতো বোন, তাই পারিবারিক সূত্রে ওদের বিয়ের অনুষ্ঠানেই পরিচয় হয়েছিল। তারপর আমি বেশ কয়েক বছর দেশের বাইরে থাকায়, আর কখনও দেখা হয়নি। তারপর ফিরে আসার পরপরইতো শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। রানা ঢাকার বাইরে থাকায় ফারি এসে উঠল আমাদের বাসায়। তারপরের সব গল্পইতো আপনার জানা মনসুর। ’

— হুম, তাইতো। আচ্ছা, এখন চলি। ফারি ঘুমিয়ে পড়েছে, তাকে আর জাগানোর দরকার নেই। একটা লম্বা ঘুম দিয়ে উঠলে আশা করি ঠিক হয়ে যাবে। কোনো দরকার হলে ফোন করবেন, প্লিজ।

সারাটা দিনই একরকম আধোঘুম আর আধো জাগরণে কাটিয়ে দিল ফারিয়া। মাঝেমাঝেই ঘুমের মাঝে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখল সে। সে, রানা আর পাভেল কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেছে; কী প্রবল ঠেঁউ তখন সাগরে। সে কিছুতেই পানিতে নামবে না; রানা তাকে জোড় করে পানিতে নামাবেই। হঠাৎ সাগরে সুনামি শুরু হল, রানা ঢেউয়ের তোড়ে কোথায় ভেসে গেল। সে ছোট্ট পাভেলকে বুকের সাথে জাপটে ধরে ঠেঁউয়ের উপর ভাসতে লাগল। একবার তলিয়ে যায়, আবার ভেসে উঠছে, ঠিক এমনি সময় কে একজন এসে তাকে জড়িয়ে ধরে পানি থেকে টেনে তুলল। এইতো… পায়ের তলায় মাটির স্পর্শ লাগছে। আহ্, বেঁচে যাওয়ার কী আনন্দ, কী আনন্দ। কিন্তু পাভেল কোথায়? আমার পাভেল? আফজালের কোলে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল ফারিয়া।

আফজাল পাভেলকে তার ডানপাশের কোলে বসিয়ে বাহাতে ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরল। গভীর মমতায় স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ফারি, তুমি মনে হয় কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিলে। এইতো পাভেল এখানেই আছে; আমার কোলে। ছেলেকে একটু আদর করে দাও।আর হ্যা, সারাদিনতো তোমার কিছুই খাওয়া হয়নি। ঘুমুচ্ছিলে বলে ডাকিনি। এখন কী একটু কিছু খাবে?’

ফারিয়া বেশ কিছুক্ষণ আফজালের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর তার দুচোখ সারা ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। নিস্ফল হাহাকারে ভরা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস কেঁপে কেঁপে তার শরীর থেকে বেরিয়ে এল। সে অনেকক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করল। একে একে তার মনে পড়ল সকালে ঘটে যাওয়া স্মৃতিগুলো। সে বোঝার চেষ্টা করল এইমাত্র দেখা সুনামির মতো সেগুলোও কী স্বপ্ন ছিল? নাকি সত্যি সত্যি ঘটেছিল? সত্যিই কী রানা ফিরে এসেছে? সে তাহলে বেঁচে আছে।

বিভ্রান্ত ফারিয়া আবার যেন অথৈ সমুদ্রে ভাসতে লাগল। সে জানে না; সে এখন কী করবে! সে এখন কাকে বেছে নেবে? আফজাল না রানাকে?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত