জেলখানার মানুষগুলো বন্দী। এর মধ্যেকার সমস্ত ঘাস, লতা-পাতা, গাছ, গাছে বসা পাখিকেও বন্দী মনে হচ্ছে বাহারের। পাখিগুলোর যদিও ডানা আছে এবং তারা সন্ধ্যা হলে নিজ ঘরে ফিরে যায়, তারপরেও দিনের বেলায় জেলখানার গাছে এসে বসার কারণে অথবা এখানকার গাছে বাসা বাঁধার কারণে তাদেরকেও বন্দী বলে মনে হচ্ছে। এখানকার গাছ-পালাগুলোকে আরো বেশী বন্দী মনে হচ্ছে তার। কারণ ডানা থাকায় পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ ফুট উঁচু প্রাচীর টপকিয়ে পাখিরা অনায়াসে এপার-ওপার যাওয়া-আসা করতে পারে। কিন্তু প্রাচীরের ভেতরকার গাছেরা আমৃত্যু সাজা ভোগ করছে। তাদের কি অপরাধ তারা বোধ হয় জানে না। তারপরেও বিনা বাক্যে সাজা ভোগ করে চলেছে। জেলখানার প্রাচীরের বাইরের গাছগুলো উঁকি দিয়ে ভেতরকার গাছগুলোকে মাঝে-মধ্যে প্রশ্ন করে– কেমন আছ ভায়া ?
ভেতরকার গাছগুলো মলিন সুরে উত্তর দেয়– তোমরা তো খোলা বাতাসে মনের সুখে নিঃশ্বাস নিচ্ছ। চোখের সামনে বিশাল ফাঁকা বিশ্ব। বাঁধাহীন দৃষ্টিতে সমস্ত পৃথিবী দেখছ। আর আমরা যে দিকেই তাকায় শুধু উঁচু প্রাচীর চোখে পড়ে।
তিনদিন থেকে জেলখানায় এসে বাহার এভাবে গাছদের কথা শুনছে। প্রথম দিন জেলখানায় বাহারের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে যে দিকেই তাকাতো মনে হত এত বড় পৃথিবীর মাঝে সে এতটুকু জায়গার মধ্যে বন্দী রয়েছে। চারিদিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতো আর দু’চোখ দিয়ে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ত।
গত দু’দিন থেকে সে গাছের দিকে তাকিয়ে থেকে তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। বাহার যে রুমে থাকে সেখানে জানালার পাশে একটি বড় বট গাছ রয়েছে। সকাল থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সে গাছের গোড়ায় বসে থাকে। আর পাঁচটায় লকাপ হয়ে গেলে সে জানালা দিয়ে গাছটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে গাছটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার শুধু মনে হয় ঐ গাছটিও কি তার মত বিনা অপরাধে বন্দী রয়েছে? তাকেও কি মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে? আচ্ছা বট গাছটা কি জন্মলগ্ন থেকেই এর মধ্যে আছে, নাকি খোলা পৃথিবীর কোথাও থেকে তাকে তুলে এনে এখানে বন্দী করা হয়েছে? যদি জন্মলগ্ন থেকে সে বন্দী থাকে তাহলে সে কি তার পিতা-মাতার অপরাধের সাজা ভোগ করছে? বাইরে থেকে এনে বন্দী করলে তার কি অপরাধ ছিল? তার কি লাইফ সাজা?
বাহার ভাবে, জেলখানার মানুষদের তো মেপে মেপে খাবার দেয়া হয়। ঐ গাছটিকেও কি মেপে খাবার দেয়া হয়। গাছের নেতিয়ে পড়া পাতাগুলো দেখে বাহারের মনে হয় কত দিন গাছটি পেট পুরে খেতে পায়নি। গাছটির মলিনতা দেখে বাহার ভাবে কত দিন সে তার প্রিয়জনকে দেখেনি। প্রিয়জনের মুখ দেখার জন্য, মুখের একটি কথা শোনার জন্য সে কতটা ব্যাকুল হয়ে আছে। তার ছলছল চোখ-মুখ দেখে তা বোঝা যাচ্ছে। আচ্ছা তার সাথে দেখা করার জন্য কেউ আসে না? জেলখানার মাইকে তো প্রতিদিন অনেককে ডাকে, তার সাথে দেখা করার জন্য লোক এসেছে। এই বট গাছের কেউ কি কখনো আসে না? মাইকে কি কখনো ডাকে না- “বট গাছ আপনার দেখা এসেছে, আপনি অতি সত্বর কাউন্টারে গিয়ে দেখা করুন”।
বাহার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অনেক কথা বলছে গাছটির সাথে। গাছটিও তার মনের মধ্যে জমে থাকা রাশি রাশি কথা বলতে চেষ্টা করছে বাহারকে। এভাবে চলতে চলতে রাত বেড়ে চলল। চোখে এমন সময় একটু তন্দ্রা আসতেই বাহারের মনে হল সাদা পোশাকে কোন এক নারী বট গাছ থেকে নেমে এলো। বাহার তাড়াতাড়ি চোখ খুলতেই দেখতে পেল সাদা পোশাকধারী একজন নারী জানালার সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। বাহার সাথে সাথে জানালা দিয়ে এদিক-ওদিক উঁকি দিল। কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকল।
তার মনে হল, জেলখানার মধ্যে নারী! এটা কেমন কথা। এখানে তো নারী থাকার কথা নয়। নারী কয়েদীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড আছে। সেখান থেকে কারো বের হওয়ার উপায় নাই। জেলখানায় যে নারী কারারক্ষী রয়েছে তারা তো শুধুমাত্র নারী কয়েদীদের জন্য। তবে এখানে কেমন করে নারী এল? সে কি তাহলে ভুল দেখল। নাকি ঘোরের মধ্যে অন্য কিছু দেখল। কিন্তু সে যে নারীটিকে দেখল তার সমস্ত মুখাবয়ব এবং অঙ্গ সৌষ্ঠব দেখতে পেয়েছে। তাতে ঘোরের প্রশ্নই আসে না। কারণ সে যে নারী কে দেখল তার টানা টানা দু’চোখে কাজল পরা ছিল। ভরাট কপোলে এমন একটি আকর্ষণ ছিল যার দ্বারা সারা বিশ্বকে সে তার পিছু টানতে পারে। তার গোলাপী ঠোঁট দুটি এক নিমিষেই ধ্বংস করতে পারে পুরুষচিত হৃদয়। মরালীসম গ্রীবা যে কাউকে পাগল করতে যথেষ্ট। বুকের সুউচ্চ দু’পাহাড়ের মাঝখানে পড়ে থাকতে যে কেউ সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকবে। এক নিমিষের মাঝে বাহার সে নারীকে দেখেছিল তার বর্ণনা সে এভাবে দিলেও তার মনে হল সে ঐ নারীর অঙ্গের সৌন্দর্যের এক অংশও বলতে পারেনি। সে ভাবল এরকম রূপবতী নারী কি তন্দ্রা বা ঘোরের কেউ হতে পারে?
পরদিন সকালে বাহার তার পাশের ওয়ার্ডের এক সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীকে বিষয়টি বলল। আরমান নামের ঐ কয়েদী বয়সে বাহারের চেয়ে ৪/৫ বছরের বড় হবে। কোন এক মাদক মামলায় তার ৭ বছরের সাজা হয়েছে। বাহার এখানে আসার পর থেকেই আরমান তার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছে। আরমানের সাজা হওয়ার পর তাকে নাপিতের কাজ দেয়া হয়েছে। বাহার যেদিন প্রথম এখানে আসে সেদিন আরমান তার চুল কেটে দেয়। চুল কাটতে কাটতে আরমান বাহারকে জিজ্ঞাসা করেছিল কি মামলায় সে এখানে এসেছে। বাহার তার বিষয়টি খুলে বলেছিল। সেদিন থেকেই সে বাহারকে তার ভালো লেগেছে। একথা সে বাহারকে বুঝতে দেয়নি। পরের দিন সকালে বাহার যখন রুমের বাইরে একা বসেছিল তখন আরমান তার কাছে এসে বলল– আপনাকে দেখলেই আপনার কাছে এসে বসতে ইচ্ছা করে, কথা বলতে ইচ্ছা করে। কোন নিষ্ঠুর নারী যে আপনাকে না বুঝে এমন ভুল করেছে।
বাহার এ কথার জবাব দিতে পারেনি। শুধু চেয়ে থেকেছে। আরমান বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ তার সাথে কথা বলেছে। তার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে বাহারের ভালো লাগে। এরপর থেকে তার একে-অপরের কথা বলত। এভাবে তাদের সাথে ভালো সখ্যতা গড়ে ওঠে।
বাহার আরমানকে রাতের কথা বলতেই আরমান জোক করে বলল– এক নারী তোমাকে ফাঁসালো, আবারো নারী!
আসলে আমি কি স্বপ্নে এরকম দেখলাম, নাকি ঘোরের মধ্যে আমার এমন হলো। বাহার বলল।
আরমান আর তেমন কিছু না বলে একটু হেসে বলল- আচ্ছা থাকো, আমি গেলাম। আমার কিছু কাজ পড়ে রয়েছে।
আরমান যাওয়ার পর বাহার কিছুক্ষণ চুপ করে সেখানে বসে রইল। এরপর সে তার বেডে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল। সে আশা করছিল যেহেতু রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে না, সেহেতু এখন যদি একটু ঘুমিয়ে নেয়া যায় তবে খুব ভালো হবে। এই ভেবে সে ঘুমানোর চেষ্টা করল। সে কিছুক্ষণ ঘুমালো। যখন সে জাগা পেল তখন বেলা ১২টা বেজে গেছে। এরই মধ্যে গোসল ও দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। গোসল করে সে দুপুরের খাবার নিল। এখানে আসার পর সে কখনোই পেট পুরে খেতে পারেনি। জেলখানার খাবারের জন্য নয়, তার ক্ষুধাই লাগে না তেমনভাবে। প্রায়শ সে নিজের জন্য খাবার নিয়ে অন্যকে দিয়ে দেয়। এভাবে থাকতে থাকতে আবার সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত ফিরে এলো। রাত এলেই বাহারের চিন্তা বেড়ে যায়। বুকের মধ্যে জ্যাম ধরে থাকে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে কয়েদী এবং বন্দীদের খাবার সরবরাহ করা হয়। বাহার তার খাবার নিয়ে বিছানার পাশে রেখে দেয়। পরে রাত বেশী হলে খায় অথবা খায় না। রাত ৯টা বাজতে বাজতে প্রায় সকলে ঘুমিয়ে পড়ে। বাহারের ঘুম আসে না। সে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। সে ভাবে এখানে থেকে থেকে সকলেই কি সুন্দর ভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। নিজ ঘরের মত করে থাকছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে।
রাত ১১টা বেজে গেল। বাহারের ঘুম আসছে না। সে শুয়ে শুয়ে নানা কথা ভাবছে। যে মেয়েটিকে সে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালোবাসতো সে কিভাবে পারল তার বিরুদ্ধে এরকম মিথ্যা অপবাদ দিয়ে জেলখানায় পাঠাতে। তার কি অপরাধ ছিল যে সেই মেয়েটি এরকম করল। বাহারকে একজন কয়েদী প্রশ্ন করেছিল, যাকে আপনি এত ভালোবাসেন সে কিভাবে একাজ করতে পারল। সে নিশ্চয় আপনাকে ভালোবাসে না। আপনার সাথে প্রতারণা করেছে। বাহার বলেছিল, আমি যদি অন্যকোন কারণে এখানে আসতাম তাহলে বোধহয় সে মেয়েটি হার্টফেল করে মারাই যেত।
বাহার ভাবছে, আমাকে ফাঁসিয়ে তার কি লাভ হয়েছে। সেকি অন্যের হাত ধরে এখন খুব সুখী। সে যে হাত ধরেছে সে হাত কি আমার হাতের চেয়ে বেশী শক্ত? আমি তো প্রাণের চেয়ে বেশী তাকে ভালোবাসতাম। সে তো জানতো তাকে একটি মুহূর্ত না দেখতে পেলে আমি কেমন অস্থির হয়ে যেতাম। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস তার শরীরের উপর পড়ত। তার ছোঁয়া না পেলে আমি অবশ হয়ে যেতাম। এরপরেও আমি যে অপরাধ করিনি সেই অপরাধে সে আমাকে কেন অপরাধী করল। এরকম ভাবতে ভাবতে বাহার কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ তার মনে হল কোন একটা নরম হাত তার মাথায় ছোঁয়া দিচ্ছে আর মৃদু স্বরে বলছে– বাহার ঘুমিয়ে পড়েছো? বাহার! এই বাহার, ওঠোইনা। দেখ আমি এসেছি।
বাহার বুঝতে পারছে কেউ তাকে ডাকছে। কন্ঠটি মেয়েলি। সে লাফ দিয়ে উঠল। কোন মেয়েকে সে দেখতে পেল না। কিন্তু বুঝতে পারল তার খুব কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। বাহার বলল– কে তুমি? তোমাকে তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। তুমি কি আমার পাশে? এখানে এলে কিভাবে?
এক সাথে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দিব কিভাবে। এখানে সবাই ঘুমাচ্ছে। চল বাইরে ওই বট গাছটির ওখানে গিয়ে বসে কথা বলি। মেয়েটি বলল।
কিন্তু বাইরে যাব কিভাবে? গেটে তো তালা লাগানো।
সে ব্যবস্থা আমি করছি। তুমি চোখ বন্ধ কর।
বাহার চোখ বন্ধ করল। চোখ খুলতেই দেখল সে বট গাছটির গোড়ায় একটি শেকড়ের উপর বসে আছে। বাহার বলল- কই আমি তো তোমাকে দেখতে পাচ্ছিনা। তুমি কি আমার পাশে আছো?
মেয়েলী কন্ঠ ভেসে এল– আবার চোখ বন্ধ কর।
বাহার চোখ বন্ধ করল।
এবার চোখ খোল। আবার সেই কন্ঠ।
বাহার এবার চোখ খুলতেই চোখের সামনে যা দেখল তাতে তার মুর্চ্ছা যাওয়ার মত অবস্থা। সে দেখল অপরূপা এক নারী তার সামনে বট গাছটির আরেকটি শেকড়ের উপর বসা। সে ভাবল মানুষ আবার এত সুন্দর হয় কিভাবে? আমি কেন বিশ্বের কেউ কোন দিন এত রূপসী নারী দেখেনি। বিধাতার উপর তার রাগ হতে লাগল, একই অঙ্গে এত রূপ না দিয়ে বিধাতা যদি এর কিছু অংশ পৃথিবীর বাকি নারীদের দিতেন তাহলে পুরুষেরা সারাক্ষণ নিঃস্পলক দৃষ্টিতে নারীর দিতে তাকিয়ে থাকত। সাদা পোশাকে মোড়ানো শরীরটি যেন জ্বলছে। বাহার লক্ষ্য করল আকাশে চাঁদ নেই। সে ভাবল চাঁদটি বোধ হয় লজ্জা পেয়ে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। চাঁদ না থাকলে কি হবে, তার শরীরের ঝলকানিতে চারপাশ আলোকিত হয়ে গেছে।
কি হলো, তুমি চুপ হয়ে গেলে কেন? মেয়েটির এ প্রশ্নে বাহারের সম্বিত ফিরে এলো।
সে বলল– কই কিছু হয়নি। আচ্ছা তুমি কে, তোমার নাম কী?
মেয়েটি এবার হাসতে শুরু করল। তার হাসিতে চারপাশ থেকে সুরেরা ছুটে এল। হাসির সময় মুক্তার মত দাঁতগুলো যখন দেখা গেল বাহার ভাবল– পৃথিবীর সমস্ত মনি-মুক্তা এক জায়গায় করলেও এর সমপরিমাণ হবে না। সে বলল– হাসছ কেন, আমি কি হাসির কোন কথা বলেছি?
না, তুমি আমার নাম জিজ্ঞাসা করলে তাই হাসি পেল।
কেন নাম জিজ্ঞাসা করতে নেই? নাকি তোমার নাম বলা যাবে না?
আবারো অট্টহাসি হেসে প্রসঙ্গ এড়িয়ে মেয়েটি বলল– আমি যতদূর জানি তুমি একজন ভালো ছেলে। তারপরেও এই অবস্থায় তুমি কেন? তুমিতো তোমার বৌকে তুমি নিশ্চয় ভীষণ ভালোবাসতে।
তোমাকে তো আমি চিনি না। এর আগে কখনো দেখিওনি। তাহলে তুমি কিভাবে জানলে আমি আমার বৌকে এত ভালোবাসতাম। বাহার জিজ্ঞাসা করল।
তুমি আমাকে দেখনি এটা সত্যি। কিন্তু আমি তোমাকে চিনি। কিভাবে সেটা নাইবা জানলে। আমি অনেক কিছুই দেখি, অনেক কিছুই জানি। তুমি এই মুহূর্তে ভাবছ আমি কেন এখানে। আসলে আমার কোন ঘর নেই, আমার কোন বাড়ি নেই। তাই এখানে এই বট গাছেই থাকি। তুমি প্রথম যেদিন এখানে এসে বট গাছটির দিকে তাকিয়ে নানান কথা ভাবছিলে সেদিন থেকেই আমি তোমার পাশে রয়েছি। অনেকে বলে সুন্দর যুবক এখানে এলেই আমি নাকি তার পিছু ধরি। আসলে আমি সুন্দরের পূজারী। আমি সবসময় সুন্দরের মর্যাদা দিই। আর এই মুহূর্তে আমার দৃষ্টিতে তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর যুবক। এছাড়া আমি তোমার ভিতরকার ভলোবাসার পরিমাণও মেপে দেখেছি। আকাশের মত উদার তোমার মন এবং অতল সাগরের মত তোমার ভালোবাসা। আমার মনে হয় কোন নারী এক জনমে এ ভালোবাসা নিয়ে ফুরাতে পারবে না। তাকে এর জন্য বারবার জনম নিয়ে তোমার কাছে আসতে হবে। পৌরুষদীপ্ত ভালোবাসা কোন নারী পেতে চায় না বল। তোমার পুরুষোচিত চেহারা, সুঠাম দেহ, লোমশ ভরাট বুক আমাকে ব্যাকুল করে ফেলেছে। তাই আমি তোমার কাছে কাছে থাকছি। জানি কয়েকদিন পরে তুমিও এখান থেকে চলে যাবে। তখন আমি আবারো একা হয়ে যাব। কিন্তু আমি ভাবছি ওই হতভাগা নারী কেন এতবড় অন্যায় করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারল।
আমিতো মাত্র পাঁচ দিন হলো এখানে এসেছি। এর মধ্যে তুমি আমাকে এত পর্যবেক্ষণ করলে কিভাবে? আর তুমি এখানে কত দিন ধরে আছো।
দেখ, একটু বুদ্ধি থাকলে মানুষ চিনতে আর বুঝতে খুব বেশী দেরী হয় না। তুমি যেদিন প্রথম আসো সেদিনই আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি। আর আমি এখানে কতদিন ধরে আছি তা আমি নিজেও জানি না। হতে পারে এক যুগ অথবা একশো বছর অথবা এক হাজার বছর, এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নাই।
কথা শুনে এবার বাহার একটু নড়ে উঠল। মেয়েটি তাড়াতাড়ি করে বাহারের কাছে এসে তাকে ধরল। মেয়েটি বলল– কি হলো তোমার? তুমি পড়ে যাচ্ছ কেন?
না কিছু হয়নি। মাথাটা একটু ঘুরে উঠেছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে।
এখনো মেয়েটি বাহারকে দু’হাত দিয়ে ধরে আছে। বাহারের মনে হলো তুলতুলে নরম দু’টি হাত তাকে জড়িয়ে আছে। তার শরীরের মিষ্টি সুবাসে আশ-পাশ ভরে গেল। সে মনে মনে বলল– এটাও কি নারীর শরীর।
মেয়েটি বাহারকে ধরে রেখেই বলল– এবার তোমার কথা বল। কেন তোমাকে এ নরক পুরীতে আসতে হলো?
বাহার এবার অকপটে বলল– শোন আমার বেশী ভালোবাসাই আমাকে ডুবিয়েছে। আমি আমার বৌকে সারা পৃথিবীর সমস্ত কিছুর চেয়ে বেশী ভালোবাসতাম। সে যখন যা বলতো তাই করতাম। হঠাৎ একদিন সে বাবার বাড়ি যাবে বলে গেল। এরপরে কিহলো আমি জানি না। পুলিশ আমাকে ধরে এখানে নিয়ে এলো। পরে শুনলাম, আমার বউ নাকি আমার বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা করেছে। আচ্ছা তুমি বলতো কাউকে কি বেশী ভালোবাসা মানে নির্যাতন করা? নাকি এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল না হতে দেয়া মানে নির্যাতন করা? নাকি আমার সমস্ত নিঃশ্বাস তার শরীরে পড়া মানে নির্যাতন করা? পরে অবশ্য জানতে পেরেছি তার পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে দিয়ে জোর করে একাজ করানো হয়েছে। কারণ অর্থ বিত্তের মোহে অন্ধ তার পরিবার কখনোই আমাকে মেনে নেয়নি।
তাই বলে তোমার বউ-এর কোন বিচার-বিবেক ছিল না। যে নিজের সর্বনাশ নিজে করবে?
তাকে হয়ত কোনভাবে বুঝিয়ে অথবা প্রেসার দিয়ে একাজ করানো হতে পারে।
এরপরেও তুমি তোমার বউ-এর উপর এত আস্থাশীল?
দেখ, পৃথিবীতে ভালোবাসার পাত্র একজনই হয়।
মেয়েটি বলল– আহা! আমি যদি তোমার সে একজন হতাম তাহলে ধন্য হতাম।
রাত কত হয়েছে বাহার জানে না। সে আর চোখ খুলে রাখতে পারছে না। পরিষ্কার করে কথা বলতে পারছে না। কথাগুলো তার জড়িয়ে আসতে লাগল। এসময় মেয়েটি বলল– তোমার বউ তো এখন তোমার কাছে নেই। আমাকে কি তোমার সাথে নেবে?
বাহার জড়ানো গলায় বলল– আমি যুগ-যুগান্তরে তার, শুধুই তার। আর কেউ…
বাহার আর কিছু বলতে পারল না। পরদিন সকালে দু’জন ঝাড়ুদার কয়েদী বট গাছটির নিচে বাহার কে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার শুরু করল। এতে মুহূর্তের মধ্যে সেখানে ভীড় জমে গেল। কেউ কেউ তাকে ডেকে তোলার চেষ্টা করল। এতে সে উঠল না। জটলা দেখে বাহারের সেই কয়েদী বন্ধু আরমান ছুটে এল। সে এসে বাহারকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে শরীরে হাত দিয়ে ঝাঁকি দিয়ে ডাকল। এতেও সে উঠল না। কিছুক্ষণ পরে দু’জন কারারক্ষী এলেন। তারা দেখে তাড়াতাড়ি করে জেলখানার হাসপাতালে নেয়ার জন্য দু’জন কয়েদীকে বললেন। হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন সবশেষ।
কয়েকজন কয়েদী বলাবলি করতে লাগল– ওই বটগাছটিতে একটি দুষ্টু পরী রয়েছে। এর আগেও ওখানে এ রকম কয়েকটি ঘটনার কথা শোনা গেছে।
বাহার কি তাহলে এখন মুক্ত স্বাধীন?