পিটুনি

পিটুনি

স্টুডেন্টের পরীক্ষা নিচ্ছি। পরীক্ষা নেওয়ার সময় বসে থাকা ছাড়া আমার কোন কাজ নাই। ফোনটাও বাসায় রেখে এসেছি। সময় কাটানোর জন্য টেবিলের উপর থেকে একটা পুরাতন রুবিক্সকিউব নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। ছাত্র বললো স্যার মিলাতে পারেন? গম্ভীর গলায় বললাম হুম পারি। শুনেছি যারা রুবিক্স কিউব মিলাতে পারে তাদের হাতের ঘুরানো দেখলেই নাকি বুঝা যায়। হাত ঘুরাতে লাগলাম। কিভাবে মিলায়? সূত্র নাকি আছে কি! যেহেতু ছাত্রকে হুম বলে ফেলেছি সেহেতু হাত ঘুরানো থামানো যাবেনা। হাত ব্যাথা হয়ে গেছে ছাতার রুবিক্সকিউব মিলেনা। মুছিবতে পড়লাম। ছাত্র পরীক্ষা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে স্যার মিলেনি এখনো? বললাম আরে নাহ, আমিতো এম্নিই ঘুরাচ্ছিলাম। তুমি মিলাতে পারো? ছাত্র হাসিমুখে বলে না স্যার পারিনা। তো রুবিক্সকিউব দেখতে তো অনেক পুরান, মনে হচ্ছে অনেক আগেই কিনেছো। পারোনা কেনো?

– স্যার পারিনা তবে প্রতিদিন আপনার মতো এম্নিই ঘুরাই তাই পুরান হয়ে গেছে।

এম্নিই ঘুরালে হবেনা। কালকে তোমাকে শিখিয়ে দিবো বলে বের হয়ে গেলাম। বললাম তো ঠিকিই, শিখাবো কেমনে? নিজেই তো পারিনা! অর্পণার সাথে দেখা হবে কাল। ওর অনেক ধরনের রুবিক্সকিউব। সব মিলাতে পারে। একদিন আমাকে চোখ বন্ধ করে মিলিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবলাম, হুয়াই আমার এত টেনশন? আমার আছে অর্পণা, সব সমস্যার সলুশ্যন!

বাসায় গিয়ে দেখি হুলস্থূল কারবার। গ্রাম থেকে মতিন চাচার বউ, কন্যা আর ছেলে সব উপস্থিত। তারা প্রায়ই আমাদের এখানে আসে বেড়াতে। গ্রামে আমাদের সবকিছু দেখাশোনা করে আর জমিতে টুকটাক যা হয় তা আমাদের জন্য নিয়ে আসে৷ মতিন চাচার ছেলের বয়স ৮। নাম পিটুনি। আসল নাম পিন্টু। আমি ডাকি পিটুনি। একবার অনেক আগে গ্রাম থেকে এসে পিন্টু আমাকে দেখেই বলে মিয়া ভাই আফনের লাইজ্ঞা গাঙেত্তে(নদী থেকে) পিটুনি মাছ ধইরা আনছি। আমি বললাম পিটুনি মাছ কি? পাশ থেকে আম্মা হাসতে হাসতে উত্তর দিলো আরে তর জন্য পুটি মাছ নিয়ে আসছে। সব মাছের মধ্যে পুটি মাছ আমার অসম্ভব প্রিয়। নদীর ছোট ছোট পুটি মাছ। পিটুনি সামনে এসে দাত কয়টা বের করে বলে, মিয়া ভাই কিরাম আছেন?

– ভালো আছি পিটুনি। তুই কি আমার জন্য পিটুনি মাছ আনছস?
– মিয়া ভাই পিটুনি মাছ না, পুটি মাছ। হ আনছি। আর আমার নাম পিন্টু মিয়া ভাই। কিন্তু আফনে পিটুনি কইলে আমার ভালা লাগে। অন্যকেউ কইলে নাক ফাডাইয়া লাইতাম!

– অবশ্যই। অন্যকেউ পিটুনি বললেই নাক ফাটাবি। পিটুনি মানেই নাক ফাটাও।

পিটুনি তর বোন কই? আয়েশা? পিটুনি বলে আছে মিয়া ভাই। আয়েশা আফার বিয়া অইবো! আব্বা কইছে। আমি বললাম ভালো ভালো। সামনে প্রচুর বিয়ে খাওয়া হবে। তর দাতে অনেক ময়লা। দাত মেজে পরিষ্কার করে রাখ।
আয়েশা এসে সালাম দিলো। সালাম নিয়ে বললাম কিরে আয়েশা তর না সামনে ইন্টার পরীক্ষা? এখন বেড়াইতে আইছস কেন? এত বেড়াইলে পড়বো কে? বিয়ের পর বাচ্চা হইলে কেমনে পড়াবি? আতা গাছের তোতা পাখি কবিতাটা পারোছ? আয়েশা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আয়েশা কিছু বলার আগেই আম্মা এসে বললো তর শুধু মেয়েটাকে খোচানো। খোচা না দিয়ে মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারোছ না? আমি বললাম আয়েশা খোচায় ব্যাথা পেয়েছো? আয়েশা মাথা নিচু করে বললো, না মিয়া ভাই। বললাম ব্যাথা পেয়োনা আয়েশা। তোমার সাথে মশকারা করি।

আয়েশা বড় হয়েছে। আমার আর আয়েশার বয়সের পার্থক্য ৪ বছর। ছোটবেলায় যখন গ্রামে যেতাম তখন আয়েশার সাথে মিছেমিছে জামাই বউ খেলতাম। ছোটছোট হাড়ি পাতিলে লতাপাতা রান্না করে আয়েশা আমাকে বউ এর মতো করে খাইয়ে দিতো। আমার গরম লাগলে আয়েশা আমাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতো। এগুলো যখন আম্মা আর মতিন চাচার বউ মাঝে মাঝে গল্প করে আমাদের সামনে তখন আয়েশা লজ্জায় কেমন মাথা নিচু করে ফেলে। আমার জন্য তখন সেটা হয় এক বেসামাল অবস্থা। আমার একটু লজ্জা শরম কম, কিন্তু আয়েশাকে দেখলে ওই মুহূর্তে আমারো কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে!

রাতের খাবার খাচ্ছি সবাই একসাথে। আম্মা জিজ্ঞাসা করলো তোকে না চা পাতা আনতে বলেছিলাম? এনেছি আম্মা। ভার্সিটি থেকে আসার পথেই নিয়ে এসেছিলাম। আমার ব্যাগেই আছে। খাওয়া শেষ করে রুমে ঢুকে দেখি পিটুনি শুয়ে আছে। আমাকে ঢুকতে দেখেই পিটুনি বলে, মিয়া ভাই আজকে আফনেরে সেইরাম মেসেজ দিয়া দিমু। হাত পা এমন ভাবে টিপ্পা দিমু আফনের ঘুম পাইয়া যাইবো। আমগো হেডমাস্টাররে দেই। সে একমিনিটেই ঘুমাইয়া যায়।

– আচ্ছা দিছ। কিন্তু তুই কি আমার সাথেই ঘুমাবি?
– হ মিয়া ভাই। আফনের বিছানাটা আরামের। বালিশটাও নরম। ঘুমাইতে ভাল্লাগে। আফনে চিত অইয়া হুইয়া ফরেন। আমি মেসেজ করা শুরু করি।
– কিন্তু রাত্রে তো আমার রুমে জানালার ওইপাশে ভূতে কথা বলে। ভয় পাবিনাতো? ওই যে ব্যালকনিতে।
– কি কন মিয়া ভাই? ভূতের নাক ফাডাইয়া লাইতাম না? আর আফনে আছেন না? ডর কিয়ের আবার? আচ্ছা মিয়া ভাই ওইডারে আফনে কি কইলেন? বেলকানি? ওইডা না বারিন্দা?

– হ বারিন্দা। তুই মেসেজ শুরু কর।
– মিয়া ভাই একটা দোয়া হিখবেন?
– কিসের দোয়া?
– কোন কিছু হারাইয়া গেলে ফির্যা পাওয়ার দোয়া।
– আমার কোন কিছু হারায়নি। তুই পা টিপ।
– মিয়া ভাই শিখ্যা রাহেন। হারাইয়া গেলে কামে লাগবো। আমাগো মুক্তবের হুজুর শিখাইছে।

“ইন্নানিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন”। হারাইয়া গেলে এইটা পইড়া পইড়া খুজবেন পাইয়া লাইবেন। মেসেজ শুরু করার ২ মিনিটের মাথায় পিটুনি আমার হাটুর উপরেই ঘুমিয়ে গেছে। গ্রামের ছেলে, রাত জাগার অভ্যাস নাই। তার উপর জার্নি করে এসেছে। আয়েশা আসলো টি-ব্যাগ নিতে। বললাম ব্যাগে আছে নিয়ে যা। আয়েশা বললো মিয়া ভাই আফনের জন্য একটা জিনিষ এনেছি। কি করবো? বিরক্ত হয়ে বললাম কি করবি? রেখে যা। লাইট অফ করে অর্পণাকে মেসেজ দিলাম। কোন খবর নাই। যখন খবর আসলো ততক্ষণে একটু আধটু ঘুমে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। অর্পণার ফোন পেয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে রিসিভ করলাম।

-কি ঘুমিয়ে গিয়েছিলা?
-উঁহু। ঘুমের প্র্যাকটিস করছিলাম। একটুপর ঘুমিয়ে যেতাম।
-কালকে দেরী করবানা। দেরী করলে খবর আছে। রাখলাম।
-রেখে দিবা? একটা গান শুনাই?
-কি গান?
-কাছে আসোনা, আরো কাছে আসোনা। হুশ.. কথা বলোনা, কোন কথা বলোনা!

ভিতর থেকে পিটুনি চিল্লাই উঠেছে। আমি ফোন কেটে দ্রুত রুমে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দেখি ভয়ে পিটুনির মুখ বেয়ে লালা পড়ছে। জিজ্ঞাসা করলাম কিরে পিটুনি কি হইসে তর? পিটুনি লালা মুছতে মুছতে বলে, ও মিয়া ভাই ভূত আছে ভূত। আফনের বারিন্দায় ভূত আছে। আমি কথা কইতে হুনছি। কেমন কইরা জানি কথা কয়। বললাম তরেতো বলছিই ভূত আছে। তুই ঘুমা। পিটুনি একলাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বলে, আফনের রুমে ঘুমাইবো কে? আমি যাইগা। আমি আমার আম্মার লগে ঘুমামু মিয়া ভাই। সূরা পড়তে পড়তে পিটুনি রুম থেকে চলে গেলো। অর্পণাকে রুবিক্সকিউব নিয়ে আসার জন্য ম্যাসেজ দিয়ে আমিও ঘুমালাম।

অর্পণা চলে এসেছে। তারমতো এমন সুন্দরী মেয়ে আমার প্রেমিকা হওয়ায় আমি প্রায়ই এটা নিয়ে গর্ব করি। শুনেছি যে মেয়েদের রুপ থাকে সে মেয়েদের গুন একটু কম থাকে। যে ব্যাটারা এ কথা বলে গিয়েছে তাদের কানের নিচে একটা দিয়ে অর্পণাকে দেখানো উচিৎ। তুমি কি বলো?
অর্পণা শুনেই বলে-

-কিসের কি বলো?
-মেয়েদের রুপ এবং গুন একিই সাথে থাকতে পারে।

এটার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ তুমি। জোরে বলো ঠিক না বেঠিক? অর্পণা আমায় হতাশ করে বলে তোমার মাথা! এসব আজাইরা ঢং করবানা আমার সাথে। আসো রুবিক্স কিউব শিখাই। আমি বললাম চোখ বন্ধ করে মিলানোটা আগে শিখাও। স্টুডেন্টকে তাক লাগিয়ে দিবো আজ। যে রেস্টুরেন্টে বসলাম ওয়েটারের কাছ থেকে ওয়াশরুমটা দেখে নিয়ে অর্পণাকে বললাম যা খাবা অর্ডার দাও। আমি আসতেছি। ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে কয়েকবার হাত ঘুরিয়ে প্র্যাকটিস করে নিলাম।

মনে মনে ভাবলাম দেখি ওয়াশরুম থেকে অর্পণার কাছে চোখ বন্ধ করে যেতে পারি কিনা। এখন থেকে সব চোখ বন্ধ করে প্র্যাকটিস হবে, কোন কথা হবেনা শুধু খেলা হবে। চোখ বন্ধ করে গিয়ে দেখি একটা খালি টেবিলে বসে পড়েছি। চোখ খুললাম দেখি টেবিল তো ঠিক আছে কিন্তু অর্পণা কই? আশেপাশে কোথাও নেই। মনে মনে কোন কিছু হারিয়ে যাওয়ার দোয়াটা পড়লাম কিন্তু অর্পণাকে খুজে পেলাম না। তারমানে হারিয়ে যাওয়ার দোয়া পড়লে হারানো প্রেমিকা খুজে পাওয়া যায়না! খুব কষ্টের ব্যাপার। হঠাৎ টেবিলে চোখ পড়ে আমি আৎকে উঠলাম। টেবিলের উপর চিঠি। চিঠিতে লিখা,

“মিয়া ভাই আমি খুব ভয়ে আছি। আব্বা নাকি আমাকে পরীক্ষার পর বিয়ে দিয়ে দিবে। আমি বিয়ে করতে চাইনা। ছেলেটাকেও আমার পছন্দ হয়নি। কিভাবে হবে? আপনাকেই তো আমার পছন্দ। আপনি আমারে বিয়া করবেন মিয়া ভাই? আপনি বিয়ে করলে আমি সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে যাবো। করবেন মিয়া ভাই? আপনারে বলতে খুব ভয় লাগে। আমারে উত্তর দিয়েন মিয়া ভাই। ইতি আপনার ছোটবেলার বউ, আয়েশা! চিঠি পড়ে আমি চোখ খুলেও অন্ধ হয়ে গেছি। সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগছে। এই বদাইশ মেয়ে কাল রাতে আমাকে এই জিনিষ দিতে চেয়েছিলো? দিবি দে, তাই বলে আমার ব্যাগেই দিতে হবে কেন?

অর্পণা প্রায়ই আমাকে সারপ্রাইজ গিফট দেয়। কিছু না বলে ব্যাগে গিফট লুকিয়ে রেখে দেয়। আজকেও হয়তো তাই করছিলো। খুলে বেচারা নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেসে। এখন আমার কি হবে? আমি কোথায় যাবো? অর্পণাকে ফোন দেই ফোন অফ। ওয়েটার এসে বলে স্যার অর্ডার গুলো রেডি। পার্সেল দিবো নাকি খাবেন? আমি বললাম তর পাসা দিয়ে ঢুকাবো শালা। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো কিনা বুঝলাম না। হঠাৎ দেখি আমি বাহিরে আর ঘাড়ে ব্যাথা। স্টুডেন্ড ফোন দিলো, স্যার পড়াতে আসবেন না আজকে? আমি বললাম কে তুই? স্টুডেন্ট বলে স্যার কে তুই মানে? আমি সাজিদ আপনার ছাত্র।

– হ্যা বুঝেছি। ফোন রাখ তুই।
– স্যার আজ হঠাৎ এভাবে তুই তুই করে বলছেন যে?
– তরে কি আপনি করে বলবো? তুই একটা তুই। তর চোদ্দগুষ্টি তুই। ফোন রাখ হারামজাদা।

ফোন কেটে গেলো। আমি এভাবে কথা বলছি কেনো? এমন লাগছে কেনো? মাথাটা এমন ভনভন করা কিসের লক্ষন? পাগল নাতো আবার! মনে মনে বেশ কয়েকবার পড়লাম “ইন্নানিল্লাহী ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন”!

আমার অবস্থা এখন “কি করি আজ ভেবে নাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই” টাইপ। বনে পরে যাবো। আগে বাসায় যেতে হবে। বাসায় গিয়ে টিপুনিকে বললাম আয়েশাকে ডাক। আয়েশা এসে লজ্জায় মাথা নিচু করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম আয়েশা ভালো আছো? আয়েশা শুধু মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো। বললাম আয়েশা তুমি পিন্টুকে পিটুনি বলোতো। আয়েশা বললো পিন্টু তুই একটা পিটুনি। পিটুনে বললাম আমি ছাড়া তোকে কেউ পিটুনি বললে কি করার কথা? পিটুনি ভেটকি দিয়ে বলে মিয়া ভাই নাক ফাডাইলাউনতি। বললাম দাঁড়িয়ে আছস কেন তাইলে?

পিটুনি প্রায় দৌড়ে গিয়ে আয়েশার নাক বরাবর মারলো। আয়েশা ধপাশ করে পরে গেসে। পিটুনি আয়েশাকে জিজ্ঞাসা করলো বইন তোমার কি রক্ত পড়তাছে? আয়েশার নাকে রক্ত নাই। মাইরটা লেগেছে আয়েশার গালে। পিটুনি বললো মিয়া ভাই রক্ত তো বাইর অইছেনা। আরেকটা দিমু? আমি বললাম না থাক। হুশ ফেরার পরে দিছ।
পিটুনি কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো মিয়া ভাই কি হইসে? আমি বললাম সর্বনাশ হয়েছেরে পিটুনি, আমার সর্বনাশ হয়েছে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত