এই লোকটা কি সার্কাসের লোক? উজ্জ্বল নীল রঙের একটা চাদর গায়ে দিয়ে আছে। গায়ের বাকি পোশাকও কেমন অদ্ভুত রকমের। সাধারণের পোশাক নয় এটুকু বোঝা যায়। মাথা নিচু করে গলির এমাথা থেকে ওমাথা বারবার ধীর ভঙ্গিতে আসা যাওয়া করছে। ঘনবসতিপূর্ণ একটা গলির মাঝামাঝি চায়ের দোকানে বসে আছি। অধিক খদ্দরের চাপ সামলানোর জন্য দোকান বরাবর রাস্তার অপরপাশেও একটি বেঞ্চি পাতা আছে। আমি একাই বসে আছি বেঞ্চিটিতে। সিগারেট টানছিলাম। চা দোকানটির একটু পরেই একটি রাজনৈতিক দলের লোকাল পার্টি অফিসে টিভিপর্দায় ক্রিকেটের তুমুল লড়াইয়ে যুবকেরা স্নায়ু চাপে জর্জরিত হচ্ছে। সর্ব রোগের দাওয়াই এক মলমের ক্যানভাস করছে একজন মলম বিক্রেতা। আরেক দিকে রাস্তা সংলগ্ন টিনশেড বাড়িটিতে রান্না ঘরের দখল নিয়ে গৃহিণীদের মাঝে ব্যাপক বাহাস চলছে। অফিস ফেরত পিতার জন্য মাতাসহ অপেক্ষা করছে তিন চার বছরের এক শিশুকন্যা। একটা বাইসাইকেলের দখল নিয়ে দুই সহোদরের মাঝে লড়াই চলছে প্রবল। শীতের রাতে কলা খাওয়ার আব্দার করে পিতার কাছে গো ধরেছে এক বালক। পিতা ঘরে প্রস্তুতকৃত অধিক সুস্বাদু খাবারের লোভ দেখিয়ে প্রায় টেনে হিচড়ে বালককে ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পুরনো এক মোবাইল কেনাবেচা নিয়ে ক্রেতা বিক্রেতার মাঝে একে অপরকে পরাস্ত করার খেলা চলছে। আরও কত ঝাকি দেওয়ার মত ঘটনা ঘটছে গলিটিতে। এত ঘটনার মাঝেও লোকটি নির্বিকার ভঙ্গিতে গলির এমাথা থেকে ওমাথা বরাবর হেটেই চলছে। এত নির্বিকার মানুষ হয়? লোকটির উচ্চতা কত? এত উচ্চতার লোক সচরাচর দেখা যায় না।
একটা বড় রব উঠল হঠাৎ পুরো গলি জুড়ে। শীতকালেও অনিয়মের চিহ্ন হয়ে লোডশেডিং শুরু হয়ে গেল গলিতে। পড়ার টেবিলে আবদ্ধ কিশোরেরা গলির দখল নিয়ে নিল নিমিষেই। নিরবচ্ছিন্ন হাটার অধিকার হারিয়ে লোকটি এইবার বেঞ্চিতে আমার পাশে এসে বসল। একটু নজর করে তার দিকে তাকাতেই আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। কেবল চাদর নয় লোকটির চোখও নীলবর্ণের। অন্ধকারে তার চোখ দিয়ে নীলরশ্মি ঠিকরে বেরুচ্ছে যা মনে হয় যে কোনো কঠিন মাধ্যম ভেদ করে বহুদুর পৌঁছাতে পারে। অথচ গলিতে গিজগিজ করা মানুষেরা তা দেখতে পারছে না। কেবল আমি দেখছি কেন?
‘তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে।’ ভারী অথচ নিচু গলায় বলল লোকটি ।
’কোথায়? তুমি কে?’
‘আমি ঈশ্বরের দূত। ঈশ্বর তোমার সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’
‘তুমি কি আমাকে খুন করবে?’
‘না। তুমি আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। ঈশ্বরের আলাপ শেষ হলেই তুমি আবার স্বাভাবিক মানব জনম ফিরে পাবে।’
তারপর বিশাল এক হল রুমে আমি দেখি আমাকে। সেই নীলবর্ণ চক্ষু লোকটিকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। চারপাশে বিচিত্র সব রং ঝলমল করছে অথচ একটা রং-ও আমি চিনতে পারছি না। একপা দুইপা এগিয়ে সামনে এগুতেই একটা দরাজ কন্ঠ ভেসে আসল।
‘এখানেই দাঁড়িয়ে থাক। আর সামনে যাবার প্রয়োজন নেই।’
‘কোথায় আপনি? কে কথা বলছেন? আমি কি মারা গেছি ? ’
‘আমি ঈশ্বর। তুমি আমায় দেখবে না। ভয় নেই। তুমি আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে যাবে।’
‘আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে?’
‘আমি সর্বত্র বিরাজমান। আবার আমি খুব একা। আমার অসীম একাকীত্ব। সমগ্র জাহান ব্যাপিয়া আমি বিরাজমান কিন্তু তুমি সামান্য এক ভূখণ্ডে বসবাস কর। অতি অল্প প্রাণ তোমার চারপাশে। এত নির্বিকার কেন তুমি সবকিছুতে? এত মূল্যবান মানবজীবন অথচ তুমি প্রায়ই আত্মহত্যার কথা ভাব। এত কমের সাথে কেন মেশ তুমি? আমি তোমার সৃষ্টিকর্তা অথচ আমার একাকীত্ব তোমার কাছে পরাস্ত। তুমি এত একা কেন? তুমি ভালোবাস না কেন মানুষকে? এত অভিযোগ কেন তাদের নিয়ে? তোমার একাকীত্ব আমাকে পীড়া দেয়।’
কে যেন সজোরে থাপ্পড় মারল তখন ডান গালে। একটু পরে বুঝতে পারি আমিই মেরেছি। ডান হাতের তালুতে থেতলে যাওয়া একটা মশা। সদ্য শুষে নেয়া রক্তের ছাপ লেগে আছে হাতে। ঘুম ভেঙ্গে গেল। কানের কাছে মশার কর্কশ কলরব। চোখ খুলে দেখি কয়েকটি স্বাস্থ্যবান মশা উদরপূর্তির ভারে নত হয়ে অনেক কষ্টে উড়ছে চারপাশে। রুম অন্ধকার ।পাশের একটি ভবন থেকে তির্যক আলো এসে পড়ছে রুমে ।বারান্দার দিকের দরজা খোলা থাকার কারনে মশাদের আজ অবাধ প্রবেশাধিকার। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। কলিংবেল বেজে উঠল তখন। রান্না করার লোকটি এসেছে মনে হয়। অফিসে ভয়ঙ্কর একটি দিন কাটিয়ে বাড়ি ফিরে স্নান আহার ছাড়াই শেষ বিকালে লুটিয়ে পড়েছিলাম বিছানায় এটুকু মনে পড়ছে এখন। স্বপ্নদৃশ্যের ওই গলিটা কোথায়? কখনো গিয়েছিলাম এমন জায়গায়? মনে পড়ে না।
ভরসন্ধ্যায় অযাচিত ঘুম স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে অমিয়ম বলেই স্বীকৃত। কিছুটা অনিয়ম হোক। সন্ধ্যার বেয়াড়া ঘুমের মাঝে স্বপ্নে কথোপকথন ছাড়া আমার জন্য ঈশ্বরের আর্দ্র হওয়ার সুযোগ আর কই? আমার চেয়েও অধিক একা আছে কেউ! মশাদের রক্ত শুষে নেয়া এবেলা বিধিসম্মত।