আমি কখনো ভুলেও সে বাড়িতে পা মাড়াতাম না, যদি কুকুরের লাশ নিয়ে এভাবে চিৎকার চ্যাঁচামেচি না করতো পাড়ার ছেলে মেয়েরা, হৈ হুল্লোড়ে মেতে না উঠতো প্রতিবেশী চাঁন মিয়ার বউ মোছাম্মদ আনোয়ারা বেগম এবং কান্নায় মেতে না উঠতো চাঁন মিয়ার একমাত্র ছেলে ফজলে সিদ্দিক।
আমি গেঁয়ো অশিক্ষিত মহিলা কুলসুম বেগমের মতো এখন এই মুহূর্তে কোরানের কসম নিয়ে বলতে রাজি আছি, চারুভদ্র গ্রামের অতি ক্ষুদ্র পুলে অতীতে কোনো এক শুক্রবারের আকাশে ঝলসে ওঠা পূর্ণিমার দিকে চেয়ে ঐ যে মনে হয়েছিল, যন্ত্রণায় দাউদাউ করে জ্বলছে বিবর্ণ চাঁদ এবং আমিও জ্বলছি ভেতরে ভেতরে দগ্ধ সিগারেটের মতো নিষ্করুণ। এবং আমায় সেদিন-ই চাঁদ ওঠা পূর্ণিমায় সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় নিজস্ব ভাবনার ভেতর দিয়ে, একদিন গহীন অন্ধকারে গড়া ভবিষ্যতে পাড়ি জমানোর ব্যাপারে, একা নয় সঙ্গে থাকবে ফাতেমা তুজ জোহরা। চারুভদ্র থেকে অন্ধকারে কেন এই দুঃসাহসিক অভিযান, অথবা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ানোর স্পৃহা কেন এবং কিভাবে জন্ম নিয়েছিল এই আমির ভেতর, আজও ভাবলে আমায় অবাক হয়ে যেতে হয় এবং আমি অবাক হই।
অতঃপর ফাতেমা তুজ জোহরাকে বলি, তুমি একটু দাঁড়াও, আমি দেখে আসি পাড়ায় কিসের এত্ত হট্টগোল এবং যখন ফাতেমা তুজ জোহরার কাছে খবর নিয়ে পৌঁছাই কুকুরের লাশ, একদিকে শোক এবং অপরদিকে উল্লাস, তখন প্রচণ্ড প্রসব ব্যাথায় কাতর ফাতেমা তুজ জোহরা এবং কাজেই আমায় একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়, পাড়ার মহিলাদের অবগত করাতে ছুটে যেতে হয় নিকটে এবং দূরে, বিশেষত সকিনা ভাবীর ছিল খুব প্রয়োজন এবং রাত অতিক্রান্ত ভোরে যখন নিশ্চিত হয়ে ওঠে পারিপার্শ্বিকতা, একটি মৃত কন্যা সন্তানের জননী হয় ফাতেমা তুজ জোহরা, তখন মুষড়ে ওঠে আমার পিতৃহৃদয়।
কখন জীবন কি চায় বোঝা বড় দুঃসাধ্য, নাকি খুবই সাধারণ বোঝাপড়া অথবা অবান্তর এই প্রশ্ন কাউকে ভাবায়, কাউকে ভাবায় না, যেমন– চানখার পুলে এখন এই যে আমার পদচারণা, সাংসারিক মগজে দিন ও রাত এবং কোনো একদিন, না একদিন নয় বরং প্রতিনিয়ত আমার দাঁড়িয়ে থাকা চারুভদ্র গ্রামের সেই পুলে কখনো একা, কখনো বন্ধুরা মিলে, কেননা সেই পথ দিয়ে হেঁটে আসত ফাতেমা তুজ জোহরা, তাছাড়া প্রেমে পড়ে সব ভুলে একদিন বাসের টিকিট কেটে সকলের অগোচরে ফাতেমা তুজ জোহরাকে নিয়ে পাড়ি জমাই ঢাকায় এবং সেই ফাতেমা তুজ জোহরা যে কিনা জন্ম দিলো মৃত কন্ন্যা সন্তান অথচ তাকে সন্তান ধারণের জন্য ধর্ণা দিতে হয় মাজারে মাজারে কতদিন।
প্রথম সেই রাতের স্মৃতির কথা স্মরণ করা যাক, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাস যখন গন্তব্যে এসে পৌঁছালো তখন ছকিনা ভাবী আমাদের দিলো আশ্রয় এবং খাবার, ফাতেমা তুজ জোহরা তখন কাঁদছে অথবা কাঁদছে না, কিন্তু বাড়ির জন্য বিষন্ন মনে বিছানায় ঠেস দিয়ে কাত হয়ে শুয়েছিল ফাতেমা তুজ জোহরা, সান্ত্বনা বাক্য দিতে তার মাথায় আমায় হাত বোলাতে হয়, মাথাও তো শরীরের অংশ বটে এবং ক্রমশ সেই হাত মাথায় সুদীর্ঘ কালো চুলে আশ্রয় খুঁজে পায় এবং নিষ্পাপ ঠোঁট ঠোঁটকে স্পর্শ করতে করতে একসময় হাত গিয়ে বুকে পৌঁছাতে রক্তের ভেতর যে উষ্ণতার সৃষ্টি হয় তা প্রশমিত হতে সেই রাত এসে পৌঁছায় ভোরে এবং টানা ৮ ঘন্টার ঘুম শেষে ছকিনা ভাবীর মুখে বাঁকা হাসি দেখে একটু বিব্রতবোধের চিহ্ন লেগে থাকে আমার চোখে আর মুখে।
সারাই বাজার থেকে কিছুদূর অগ্রসর হলে ধুম নদী যেখানে– দৃষ্টিগোচর হয় সুবিশাল বাঁশের পুল, বটগাছ, ভাসমান কচুরিপানা ও লোকমুখে প্রচলিত বুলি– নজরুল সাব এসেছিলেন এই ভূখণ্ডে একবার, কথাটি ফেলে দেয়ার মতো না, তথ্য প্রমাণাদিও আছে কাজী নজরুল ইসলামের আগমন সমর্থনে এবং আমাদের দুজনের সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো এক শরতের বিকেলে, এবং কথার ছলে একদিন হয়তো অকস্মাৎ বলেছিলাম আমার প্রেয়সী ফাতেমা তুজ জোহরাকে, বর্তমানে যে আমার বউ তাকে। সহস্রবার ‘দুঃখিত’ বলতে হবে তবেই হয়তো মুছে যাবে আমার মন থেকে শামসুর রাহমানের কবিতার লাইন মনে পড়ছে ‘পাপবোধ অল্প বিস্তরণ’ এবং যখন সে বলে, বিগত রাতে এক হাজার বার দুঃখিত শব্দটি জপ করে সে ঘুমিয়েছিল, তখন বিস্মিত দু নয়নে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, আমি ভালোবাসি তুমি-কে এবং সেদিন তার চোখে মুখে দেখতে পাই আলোর ঝিলিক, কিন্তু আজ মৃত কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে সেদিনের বিপরীত চিত্র দেখি ফাতেমা তুজ জোহরার মুখে এবং চোখে, এবং হঠাৎ সে বলে, চলেন আমরা ফিরে যাই।
ফিরে যাব আবার সেই চারুভদ্র গ্রামে, কোন মুখে, কি নিয়ে, কিসের প্রত্যাশায়, যেখানে ফাতেমা তুজ জোহরাকে নিয়ে পালিয়ে এসে স্বাধীন হয়ে বেঁচে থাকার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল সেটি ধুসর পরাধীনতায় পর্যবসিত হয়ে উঠছে দিন এবং রাতে, অতঃপর আর কোনোক্রমেই সম্ভব না নিজ বাসভূমে ফিরে যাওয়ার, কিন্তু ফাতেমার চোখে আমায় তাকিয়ে বলতে হয়, যাব। যেভাবে একদিন এই ফাতেমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমায় আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে বলতে হয়েছিল, আমরা মিশে যাব চন্দ্রিমায় এবং আমাদের বর্তমান বসবাস চানখার পুলের পাশে বুঝি এই আবাস মূলত কল্পনায় হয়ে ওঠে চন্দ্রিমা এবং আমার চোখ সেসময় হয়ে ওঠে কবির চোখ।
একটি সময় আসে যখন পুরুষের প্রয়োজন হয়ে ওঠে নারীর শরীর, নারীর সঙ্গ, তাই ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসে সেই নারীকে লোকচক্ষুর আড়ালে ধরে নেয়া যাক, সুরভী উদ্যানে নির্মল গাছের ছায়ায় কপোত কপোতী হয়ে ঠোঁটে গুজে দিতে হয় ঠোঁট, না তবু স্বস্তি পাওয়া যায় না, এক ঝাঁক ডেঙ্গু মশা এসে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে যুগলদের অথবা নিজেই নিজেরা ভূতগ্রস্ত হয়ে গল্পে মজে গিয়ে হারিয়ে ফেলে স্পর্শের স্বাদ কিংবা ম্যালেরিয়াও তাদের উপেক্ষা করতে পারে না, স্বচক্ষে দেখি ‘কুচ পরোয়া নেহি’ দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন আর আলিঙ্গনে হয়ে ওঠে মেঘের ভেতর এক অনাবিল চন্দ্রিমা।
ধুম নদীর হাওয়া এসে এখনো স্পর্শ করে আমার হৃদয়, প্রাক যৌবনের স্মৃতি এসে জমায় ভিড় এবং মূলত এখন ভাবতে হচ্ছে আমায়, ফিরে যেতে হবে নিজ বাসভূমে পুনরায়, মা যেখানে অসুস্থ এবং ফাতেমা তুজ জোহরার বিষন্ন মুখচ্ছবি আর স্মৃতিতে সুস্পষ্ট ধুম নদীর হাওয়া।
অথচ কে জানত, আমাদের আগমনের সাথে খনন করা হচ্ছে একটি কবর, শিমুল গাছের পাশে শায়িত হবেন আমার মা, ঘাস এবং আকাশ মিলেমিশে সাদা কাফনে আবৃত আমার মায়ের শরীরকে বরণ করার জন্য প্রস্তুত, ছেলে হিসেবে মাতৃ অধিকার থেকে মাকে নিদারুণ বঞ্চিত করে খেয়ালের বশে সেই ঝলসে ওঠা পূর্ণিমার দিকে চেয়ে আমার ঐ একটি সিদ্ধান্ত আমায় বারবার ঠেলে দিচ্ছে অনুশোচনার গভীর থেকে গভীরতর স্তরে, অথচ ভালোবাসা বা প্রেমের অর্থ আজও ঝাপসা হয়েই রইলো দু চোখে, জগতের রূপ পালটে গেল নিমেষেই যখন খোদেজা চাচী বললেন, “হায় বুঝি বেচারীর পরাণের আকুতি আল্লায় শুনছে নইলে মইরাও চোখ খোলা থাকে ক্যান, দাও বাবা স্বপন, মায়ের চোখ হাত দিয়া বুইজা দাও, সে অখন শান্তিতে ঘুমাক।”