স্বপ্নযাত্রা এবং অতঃপর

স্বপ্নযাত্রা এবং অতঃপর

অনেকদিনের দুশ্চিন্তাটা ইদানিং বেড়েই চলেছে ইউনুছের বউয়ের। কৃষকের বউ সে। সুখের সংসার। পরের ক্ষেতে কাজ করে যা রোজগার করে তা দিয়ে বুদ্ধির জোরে সংসারটা ভালোই চালায় ইউনুছের বউ লতা। সংসারে কোনো টানাপড়োন নেই। লতার আট বছর বয়সী একটাই মেয়ে লামিয়া। শরীরের আকার-আকৃতিতে বাড়লেও বুদ্ধিতে বাড়েনি। ইউনুছ-লতার সংসারে একটিই দুঃখ তাদের এই প্রতিবন্ধী মেয়েটা। রাস্তার পাশে বাড়ি হওয়ায় লামিয়াকে নিয়ে লতার যত দুশ্চিন্তা। কখন যেন মেয়েটা বড় রাস্তায় গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে। ইউনুছের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে দেবোত্তরের বড় রাস্তাটি। চৈত্রের খরতায় ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া মাঠে কিংবা মরা নদীতে হঠাৎ জল প্রবাহিত হলে মাঠ-নদী যেমন যৌবনবতী হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি মফস্বলের এই রাস্তাটিও খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। রাত-দিন রাস্তায় নানা রকম যন্ত্রচালিত গাড়ি, ভ্যান, রিক্সা এমনকি গরু-মহিষের গাড়িও চলাচল করে। হাট, হাসপাতাল, শহরে বা দেশের যে কোন প্রান্তে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা এটি। রাস্তাটির বেহাল দশা। মাঝে মাঝে খানাখন্দে ভরা। রাস্তার পিচের প্রলেপ উঠে গেছে। কংক্রিটগুলোও খসে খসে চারিদিকে নিদারুণ অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তবুও এই রাস্তাটিই এ অঞ্চলের মানুষের ঐশ্বরিক আশীর্বাদ। অনেকের রুটি-রুজির মাধ্যমও এই রাস্তা।

তোরাব আলী ইউনুছের পড়শী। দুজনের বাড়ির মাঝে তিনটি বাড়ির ব্যবধান। তোরাব কাঁচা তরকারীর ব্যবসা করে। খুব ভোরে কৃষকের ক্ষেত থেকে সবজি সংগ্রহ করে শহরে বড় আড়ৎ-এ দিয়ে আসে। তোরাবের প্রথম স্ত্রী মারা গেছে কয়েক বছর হলো। সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। প্রথম পক্ষের দশ বছর বয়সী একটি ছেলেও আছে, নাম জহির। জহির একটু শান্ত প্রকৃতির ছেলে। মুখটা দেখলে মায়া হয়। মা-হারা ছেলেটা কারো সাথে মেশে না। বিকেলে যখন সবাই মাঠে খেলতে যায় তখন জহিরকে হয়তো দেখা যাবে গ্রামের মেঠো পথে একা হাঁটছে কিংবা ফাঁকা মাঠে সখের ঘুড়িটা আকাশে উড়িয়ে দিয়ে নাটাই ধরে ধান ক্ষেতের আলে বসে আছে। জহিরের আরো একটি খেলার জায়গা আছে। তার সবচেয়ে পছন্দের খেলার সাথী লামিয়া। জহির-লামিয়া একে অপরের খেলার সাথী। দুজন যেন মানিকজোড়। ভোরে মক্তব থেকে ফিরে স্কুলে যাওয়ার আগে আবার স্কুল থেকে ফিরে লামিয়ার সাথে খেলায় মেতে ওঠে জহির। ওরা অনেক রকম খেলা করে। জহির পাশের ঝোপ থেকে লতাপাতা এনে দেয়। লামিয়া সেগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে পাঁকা রাঁধুনীর মত মাছ, গোশত, সেমাই, ডাল, পিঠা ইত্যাদি রান্না করে। ধুলা দিয়ে ভাত আর পোলাও রান্না করে। জহির সেগুলো খাওয়ার ভান করে মুখে আজব শব্দ করে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। লতা এগুলো দেখে খুব খুশি হয়। জহির লতার দুশ্চিন্তাকে অনেক হালকা করেছে। জহির লতার ভরসারও পাত্র। সংসার কাকে বলে না বুঝলেও ওরা সংসার পাতে। দুটি শিশুমন কী এক মায়ার খেলায় মেতে ওঠে! এ খেলা প্রকৃতির; এ খেলা প্রাকৃতিক। লামিয়া মায়ের কাছে আবদার পাতে। লতা মেয়েকে সুন্দর করে লাল শাড়ি পড়িয়ে বউ সাজিয়ে দেন। জহিরও তার ঈদে কেনা লাল পাঞ্জাবিটা পড়ে বর সাজে। লামিয়া ছোট লাল শাড়িটার আঁচল মুখে নিয়ে জহিরের দিকে তাকিয়ে হাসে। জহিরও লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে ,“তুই আমার কিডা?” লামিয়া কোন হিসেব না করেই হেসে উত্তর দেয়,“ ক্যা, আমি তুমার বউ।”

আজ তোরাবের বিশেষ ক্ষতি হয়েছে। সকালে সবজি নিয়ে শহরে যেতে পারে নি। ভোরে গিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে সবজি আনতে গিয়ে দেখে আজ তারা সবজি তোলে নি। যদিও তোরাব আলীর সাথে তাদের কথা ছিলো সবজি তুলবে। আজকের দিনটাই তার মাটি। এমনিতে তোরাবের মেজাজটা একটু খিটখিটে স্বভাবের। কৃষকদের সাথে একটু চেচামেচি করে বিফল হয়ে সে বাড়ি ফিরলো। বাড়ি ফিরেই প্রথমে চড়াও হলো বউযের উপর। প্রতিদিনের মতো আজও বউটা ভাত রাঁধতে গেলো একটু বিলম্ব করে। সে কি জানতো আজ ইউনুছ এতো তাড়াতাড়ি ফিরবে তাও আবার গরম মেজাজ নিয়ে? কোনো যুক্তিই ইউনুছের কাছে ঠেকলো না। সে তার বউটাকে বেদম মারপিট করলো চাওয়ার সাথে সাথে ভাত না দেওয়ায়। তারপর চড়াও হলো জহিরের উপর। জহির আজ মক্তবে যায় নি। স্কুলে যাওয়ার সময় হলেও সে এখনো স্কুলে কেনো যায় নি এই অপরাধে মায়ের সাথে সাথে তাকেও বাবার হাতে প্রহার খেতে হলো। ইউনুছ চেচামেচি করতে করতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো।

দুপুর গড়িয়ে গেছে এখনো জহিরের পেটে ভাত পড়েনি। শেষমেশ বাড়িতে রান্না হয় নি। জহির পাশের মাঠের বড় গাছের নিচে একা একা বসে অনেক কেঁদেছে। জহিরের মনে বিষন্নতা চেপে বসে। অনেক অভিমানে সে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো। সে আর বাড়িতে থাকবে না। অনেকদূরে চলে যাবে। যেখানে কোন দুঃখ নেই। যেখানে কেউ তাকে মারবে না; গালি দেবে না। সে এক স্বপ্নের পৃথিবী। জহির মাঠের সরু পথ ধরে হাঁটতে থাকে। স্বপ্নের পথে হাঁটা, স্বপ্নের পথে যাত্রা।

তোরাব আলী রাতে বাড়ি ফেরে। এসে জহিরকে দেখতে পায় না। তোরাব আলী বুঝতে পারে মা-হারা ছেলেটার সাথে এমন আচরণ করা তার ঠিক হয় নি। কিন্তু ছেলেটা কোথায় গেলো? এমনতো হয় না। যতকিছুই হোক জহির কোনোদিন বাড়ির বাইরে থাকে না। জহির এই এলাকার বাইরের কোনো জায়গা চেনে না। তোরাব আলী চিন্তিত হয়ে পড়ে। আশে পাশের বাড়ি, জহিরের সাথে যারা পড়ে সবার বাড়িতে খোঁজ নিয়েও জহিরকে পাওয়া যায় না।

দেবোত্তর থেকে সাত মাইল দূরে শাহপুর গ্রাম। এই গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ সর্দারবাড়ীর জলিল সর্দার। তিনি যেমন অনেক টাকার মালিক তেমনি অনেক বড় মনের মানুষও। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এলাকার আবালবৃদ্ধবণিতা তাকে সম্মান করে। জলিল সর্দারের বাড়িতেই ঠাঁই হয় জহিরের। সন্ধ্যার পর গ্রামের বড় মোড়টার কাছে জহির একা দাঁড়িয়ে কাঁদছিলো। এই এলাকায় সে এবারই প্রথম এসেছে। কোনো কিছুই সে চেনে না। এলাকার কয়েকজন জহিরকে জলিল সর্দারের কাছে নিয়ে আসে। সর্দার সাহেব সব বুঝতে পারেন। তিনি জহিরকে তার বাড়িতে থাকতে দেন।

জহিরের বাবা ইউনুছ তার ছেলেকে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তার নাওয়া-খাওয়া ছাড়ার মত অবস্থা। এভাবেই কেটে গেলো কয়েকদিন। লামিয়াও ইদানিং অশান্ত হয়ে উঠেছে। তার কিছুই ভালো লাগে না। আগের মতো সে আর খেলা করে না। মনমরা হয়ে থাকে। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করে না। অস্বাভাবিক আচরণ করে। তাকে সামাল দেওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। দিন দিন লামিয়াকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ছেন লতা।

জহির তার স্বপ্নের পৃথিবীতে বিচরণ করতে থাকে। এখানে কোনো ঝামেলা নেই। জলিল সর্দার জহিরকে খুব ভালোবাসেন। জহির সর্দার সাহেবের ছোট এঁড়ে বাছুরটাকে দেখভাল করে। মাঠে নিয়ে যায়। ঘাস কেটে খাওয়ায়। গোসল করিয়ে দেয়। এসব দেখে সর্দার সাহেবও খুব খুশি হন। সর্দার বাড়ির অন্য মানুষগুলোও জহিরকে খুব ভালোবাসে। জহির যেন এ বাড়িরই মানুষ।

জহিরের ইদানিং কিছুই ভালো লাগেনা। যেপথে সে এই গ্রামে এসেছিলো সেই পথের ধারেই সে আজ একা একা বসে আছে। এই রাস্তায় হাঁটলেই তার বাড়ি ফেরা যাবে। বাড়িতে বাবা কত চিন্তাই না করছে তাকে নিয়ে। স্কুলের বন্ধুরা বা কেমন আছে? মক্তবে ঈমাম হুজুর তার মক্তবের সবচেয়ে ভালো ছাত্রটিকে না পেয়ে কী যে ভাবছেন। আর একটি সরলমুখ জহিরকে যেন ডাকছে। কী মায়াভরা মুখ তার! একটা মায়া জহিরকে জড়িয়ে ধরেছে এখন। জহির আর স্থির থাকতে পারছে না। শেষ বিকেলের সূর্যটা তার রক্তিম লাল আভা চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। একটু পরেই সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়বে। জহির একটা মায়ার টানে মেঠোপথে হাঁটতে থাকে। তার কানে একটি কথা কে যেন বার বার বলে যাচ্ছে,“ক্যা, আমি তুমার বউ।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত