সেই গোলাপি টেডি বিয়ার

সেই গোলাপি টেডি বিয়ার

মোনালিসা আর প্রাঞ্জলের প্রেম সেই কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে থেকে। কলেজে ভর্তি হবার পর থেকেই একে অপরের খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিল। একই ডিপার্টমেন্ট বলে সব ক্লাস একসাথে, আর ততই নিবিড় হচ্ছিল সম্পর্ক।
দু’জনেই বুঝেছিল তারা একে অপরকে ছাড়া কতটা অসম্পূর্ণ। সম্পর্ক টা যে বন্ধুত্ব ছাড়িয়ে আরো গভীর কোনো নাম না জানা দিকে এগোচ্ছে তার আভাস পেয়েছিল দুজনেই। কিন্তু কেউ কাউকে জানায়নি সে কথা। প্রেম টা যেন নিজে থেকেই দানা বেঁধে গেছিল কেউ কাউকে প্রপোজ না করেই।

সারা কলেজ জানত মোনালিসা আর প্রাঞ্জলের চিরসবুজ বন্ধুত্বের কথা। ভ্যালেন্টাইন উইক টা শুরু হবার পর থেকেই মোনালিসা সমানে বলে যেত তোকে কিন্তু আজ আমায় রোজ দিতেই হবে। আজ প্রপোজ করতেই হবে। আজ চকলেট খাওয়ালি না? কি রে টেডি দিবি না? আর প্রাঞ্জল ছিল ঠিক তার উল্টো। ও এসব বোকা বোকা কনসেপ্ট গুলোতে বিশ্বাসই করত না। কোনোদিনই এইসব ডে গুলো ঠিকভাবে পালন করেনি সে। ভালবাসার আবার দিনক্ষণ হয় নাকি? মোনালিসা দেখত তাদের বন্ধুদের বয়ফ্রেন্ড রা এত এত সব গিফট দিচ্ছে অথচ প্রাঞ্জল ওকে কোনোদিনই কিছু দেয়নি।

একদিন তিয়াসা একটা গোল্ড প্লেটের চেন দেখিয়ে বলেছিল, “এই দেখ এটা মৃদুল দিয়েছে আমায়।” তারপরই মোনালিসা রাগ দেখিয়ে প্রাঞ্জলকে বলেছিল, “আমাকে যতদিন না একটাও গিফট দিচ্চিস আমার সাথে আর কথা বলিস না।” ঠিক তার পরদিনই ইয়া বড় একটা গিফট বক্স হাসিমুখে মোনালিসার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল প্রাঞ্জল। বাড়ি ফিরে মোনালিসা তার ভেতর থেকে বের করেছিল একটা গোলাপি টেডি বিয়ার। তবে সেদিন কিন্তু টেডি বিয়ার ডে ছিল না। মোনালিসার জন্মদিন বা অন্য কিছুও ছিল না।

মনখারাপের সময় বা খুশির সময় ওই গোলাপী টেডি টাই ছিল মোনালিসার সঙ্গী। যদিও বাবা মায়ের কিনে দেওয়া আরো অনেক বড় বড় টেডি বিয়ার বাড়িতে ছিল তবু ওই গোলাপী টাই ছিল মোনালিসার সবচেয়ে প্রিয়। কলেজ শেষ করে আবার একসাথে মাস্টার্স এ একই ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু প্রাঞ্জল যখন ভার্জিনিয়া চলে গেল পি এইচ ডি করতে মোনালিসার মন খুব অস্থির হয়ে উঠেছিল। প্রাঞ্জল কথা দিয়েছিল পড়া শেষ করে ফিরে এসেই সে মোনালিসকে বিয়ে করবে। মোনালিসা স্কুলে চাকরি টা পেয়ে যাওয়ার পরই বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য ভাবনা চিন্তা শুরু হয়। মোনালিসা বাড়িতে সব কিছুই খুলে বলে। আর সবাই সব টা মেনেও নেয়। তার বাবা মা প্রাঞ্জল ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি হয়। বছর পাঁচ পর প্রাঞ্জল ফিরে এসে কলকাতারই একটি বিখ্যাত রিসার্চ সেন্টারে কাজ শুরু করে। কিন্তু মোনালিসা লক্ষ্য করে প্রাঞ্জল যেন কেমন একটা বদলে গেছে।

আগের মত সেই প্রাণোচ্ছল ভাব নেই, সেই মাদকতা কোথায় যেন ঢাকা পড়ে গেছে। তার বদলে বড্ড বেশি যান্ত্রিক মনে হয় আজকাল প্রাঞ্জলকে। বিয়ের কথাবার্তা ভালভাবেই এগোচ্ছিল, শুধু দিন স্থির হওয়াটাই যা বাকি ছিল। মাঝপথে বেঁকে বসল মোনালিসা। এরকম যান্ত্রিক, নির্লিপ্ত মানুষের সাথে সংসার করতে সে পারবে না। সবাই খুব অবাক হলেও এবং কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিল মোনালিসার সিদ্ধান্ত। আর মোনালিসা ভেবেছিল প্রাঞ্জল ঠিক একবার তার কাছে এসে তাকে বোঝাতে চাইবে। কিন্তু না তা হয়নি। প্রাঞ্জল আসেনি। পুরোপুরি ভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল মোনালিসার থেকে। মোনালিসা এই গোলাপী টেডি টা কে জড়িয়ে ধরে তখনও কেঁদেছিল খুব।

টেডি টা যেমন কথা বলতে পারে না যেমন নির্বাক হয়ে থাকে সবসময় তেমনই প্রাঞ্জল ও এই কিছুদিন ধরে মোনালিসার সাথে নির্বাক ব্যবহারই করে এসেছে। আজ আর এই টেডি আর প্রাঞ্জলের মধ্যে কোনো তফাৎ করতে পারে না মোনালিসা। সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে ভুলতে চেষ্টা করেছে সবকিছু। কিন্তু সম্ভব হয়নি। সারাদিনের কোনো না কোনো মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ে যায় কলেজের সেই পুরোনো সোনালী দিনগুলো। সেদিন মোনালিসার মাসতুতো দাদা বৌদি এসেছিল তাদের পুচকে মেয়ে তিউ কে নিয়ে। তিউ বাড়িতে যত খেলনা ছিল সব নাড়াচাড়া করে খুব মজা পাচ্ছিল। ওরা বাড়ি ফেরার সময় সেই গোলাপি টেডি টা মোনালিসা তিউ কে দিয়ে দিল। কি দরকার একটা মিথ্যে স্মৃতি বয়ে বেরিয়ে! স্মৃতি শুধুই কষ্ট বাড়ায়।

পাক্কা তিনমাস হয়ে গেল প্রাঞ্জল একটা খোঁজ খবর ও নেয়নি। একবার ফোনও করেনি। ও হয়ত খুব ভাল আছে তাহলে। মোনালিসার জন্য পাত্র দেখা শুরু হল। প্রথমবার যে ছেলে দেখতে এল তাদের খুব পছন্দ হয়ে গেল। ছেলে সরকারি অফিসার। কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল নিমেষের মধ্যেই। এরইমধ্যে ছেলেটি বেশ করেকবার ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু মোনালিসা রিসিভ ই করেনি। ও এখনও ভুলতে পারছে না যে প্রাঞ্জলকে। মঝেমধ্যেই অবচেতনে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। পারছে না অন্য কাউকে নিজের সবকিছু ভাবতে। তবু সব ভুলে ভবিতব্যকে মেনে নেওয়ার চেষ্টায় মত্ত থাকতে চায় মোনালিসা।

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পায় দোকানগুলোতে রং বেরঙের ছোট বড় টেডি বিয়ার। তাতে আবার নানা ধরণের অফার। ওহ আজ তো টেডি ডে। এখন আর এই সব দিনগুলো মোনালিসার মনে কোনো দাগ কাটে না। সত্যি কলেজে কত পাগলামিটাই না করেছে! রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগেও প্রাঞ্জলের মুখটায় চোখে ভাসে। ঘুম আসে গভীর রাতে। কি একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। চোখ খুলে দেখে সামনে প্রাঞ্জল দাঁড়িয়ে। সত্যি এত ওর কথা ভাবছে যে ঘুমের ঘোরেও ওকেই দেখছে।

চোখ দুটো রগড়ে নিয়ে আবার তাকায়। সত্যিই প্রাঞ্জল। হাবাগোবা মুখে ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এবার চমকে উঠলো মোনালিসা। ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, “তুই এখানে?” “হ্যাপি টেডি ডে। তোকে এই টেডি টা দিতে এলাম। আর দুটো কথা বলতে চাই।” “তুই এত রাতে এখানে এলি কি করে?” প্রাঞ্জল কাচুমাচু মুখ করে বলে “পাইপ বেয়ে।” হেসে ফেলল মোনালিসা। “তুই আর পাইপ বেয়ে? বলিস কি রে? তা কি বলতে চাস?” প্রাঞ্জল খাটের উপর বসে বলল, “আমার এই তিন মাস খুব কষ্টে কেটেছে রে। এতদিন বুঝিনি কিন্তু তুই চলে যাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি তোকে আমি কতটা ভালোবাসি। আমি না বুঝে তোকে ইগনোর করেছি। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে। আর কখনো এমন হবে না। তুই যেভাবে চাইবি যা চাইবি তাই হবে। প্লিজ আর মুখ ফিরিয়ে থাকিস না।” মোনালিসা চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে গিফ্টবক্স খুলে দেখে সেই একইরকম দেখতে সেই গোলাপি টেডি বিয়ার।

–“ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ রাত বারোটা পেরিয়ে গেল। টেডি বিয়ার ডে আর নেই।” “কিন্তু আমি এটা তোকে বারোটা বাজার আগে দিয়েছি তো। আর আজ এখন থেকে প্রমিস করছি তোকে কোনোদিন দুঃখ দেব না।” মোনালিসা প্রাঞ্জলকে জড়িয়ে ধরে বলে, “হ্যাপি প্রমিস ডে মোনালিসা প্রাঞ্জলকে জড়িয়ে ধরে

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত