একটি চশমা ও চড়ুইভাতির গল্প

একটি চশমা ও চড়ুইভাতির গল্প

গ্রীষ্মের ছুটিতে রুপন্তি ও তিঁতলি বাবা-মায়ের সাথে ফরিদপুর মামা বাড়ি বেড়াতে এসেছে।বড় বোন রুপন্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের ছাত্রী।রুপন্তি বেশ শান্ত ও বুদ্ধিমতী মেয়ে।বই পড়া তার নেশা।তবে চশমা ছাড়া সে বই পড়তে পারে না।ছোট বোন তিঁতলি দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী হলেও খুব চটপটে ও দুষ্টু স্বভাবের।তার প্রধান কাজ হচ্ছে বোনের বই পড়ায় ব্যাঘাত ঘটানো।

রুপন্তি দুপুরের খাবার খেয়ে ভাতঘুম দিয়ে যখন উঠেছে তখন সূর্য নিস্তেজ হয়ে পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে।বিছানা ছেড়ে শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘রচনা সমগ্র’ বইটি নিয়ে সোজা চলে গেল পিছনের দরজায়।দরজার শিঁড়িতে বসে মনোযোগ সহকারে ওড়নার এক আঁচল দিয়ে চশমাটি মুছে নিচ্ছে।আর পাশেই রাখা ছিল বইটি।এমন সময় তিঁতলি সেখানে হাজির। তার প্রথমেই নজর পড়ল মোটা বইটির দিকে।সে তৎক্ষনাৎ একটা ফন্দি এটেঁ ফেলল।ছুটে গিয়ে বোনকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আল্হাদি গলায় বলল,”আপুনি!বল তো আমি কে?”রুপন্তি ভারসাম্য রাখতে পারল না।ফলে সঙ্গে সঙ্গে চশমাটি হাত থেকে পড়ে গেল।

সে চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটিয়ে বলল,আবার! রুপন্তির মুখ থেকে কথা ফুরানোর আগেই যেন তিঁতলি বলে ফেলল, আবার তুমি চশমা ভাঙলে? এ কথা শুনে রুপন্তি যেন ভড়কে গেল।চোখ বড় বড় করে হা করে তাকিয়ে আছে তিঁতলির দিকে। আর মনে মনে ভাবছে,বাপ রে!কার ঝাড়ি কে নেয়! তিঁতলি আত্মবিশ্বাসের সাথে আগের গতিতে আবারও বলতে লাগলো,তোমার বই পড়া আর চশমা ভাঙার জন্য বাবার কত টাকা নষ্ট হয় সে হিসাব তুমি রাখ? রুপন্তি এবার মুখ খুলে বলল,আমার যত চশমা ভেঙেছে তার জন্য তো তুই-ই দায়ী।

তিঁতলি তার দোষ স্বীকার না করে পুনরায় আবার বলতে লাগলো, চশমা কে ভেঙেছে সেটা কোন বিষয় না।বিষয়টি হচ্ছে তোমার চশমা ভাঙে এবং বারবার নতুন করে বানাতে হয়।এভাবে অনেক অর্থ আর সময় নষ্ট হয়!এটা তোমাকে মানতেই হবে।

তর্কে জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।তাছাড়া চশমাটি রুপন্তির খুব প্রয়োজন।বেড়াতে এসে অন্তত দুইটি উপন্যাস পড়ে শেষ করবে মুলত এই উদ্দেশ্যেই সে এখানে এসেছে।এখন যদি চশমার কারণে আজ তার বই পড়া না হয় তাহলে যে তার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে!এই ভেবে রুপন্তি বোনের সাথে তর্কে না জড়িয়ে বলল,বুঝলাম আমার দোষ।এবার দেখ চশমাটা গড়িয়ে কোথায় পড়ল?নাও তো ভাঙতে পারে। তিঁতলি চশমাটি খুঁজে পেয়ে বলল,এটাও শেষ!

পরক্ষণেই তিঁতলি বোনের হাত ধরে টানতে টানতে বলল,চলতো আপু!বাইরে চলো। রুপন্তি পিছনে তাকিয়ে বলল, আমার বই! তিঁতলি বোনের কথায় না থেমেই বলল,রাখ তো বই। রুপন্তি অসহায়ের ন্যায় বলল,বইটা অন্তত তুলে রাখি! তিঁতলি কোনরুপ মায়া না দেখিয়ে বলল, তোমার তুলতে হবে না।মামি ঘরে আসলে ঠিক তুলে রাখবে।

অবশেষে তিঁতলি এক প্রকার টানতে টানতে রুপন্তিকে বাড়ির উঠোনে নিয়ে গেল।উঠোনে যাওয়া মাত্র রুপন্তি রীতিমতো অবাক!বড় মামার মেয়ে তাজিয়া অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী যে তিনটি ইট দিয়ে চুলা তৈরি করে নিচ্ছে আর পাশে রাখা ছোট ভাতের পাতিল যাতে চাল ধুয়ে রাখা হয়েছে। তিঁতলি বোনকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি বস এখানে!আমি চাল ধুয়ে রেখেছি।তুমি চুলায় চড়িয়ে বসে বসে জ্বাল দাও।

রুপন্তি ইতিমধ্যে বইয়ের কথা ভুলে গেছে। সে ছোটবেলায় যখন মামা বাড়ি আসত এভাবেই চড়ুইভাতি খেলত।তার মনে পড়ে গেল খেলার সাথী শিলা,পলি,ঊর্মি,রুমি,ফরিদা,পারভিন ও সাহিদার কথা। তাদের সবাই অবশ্য এখন শশুর বাড়ি বড় চুলায় বড় পাতিলে রান্না করে।সেই রান্না কেবলই দায়িত্ববোধ থেকে করা।সেখানে শৈশবের অনুভূতি নেই। রুপন্তি ভাবনা কাটিয়ে তিঁতলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,ভাত না হয় রান্না করা হবে।কিন্তু তরকারি রান্না করার জন্য কি আছে?

তিঁতলি এক মুহুর্ত ভেবে পরক্ষণেই উত্তর দিল, দাঁড়াও আমি আসছি! এই বলে সে চলে গেল পাশের পুঁই মাচার দিকে।সেখান থেকে ২০-৩০ টা পাতা ছিড়ে ফিরে এসে বোনকে বলল,আপু,তুমি শাক কেটে নাও।তাজিয়া জ্বাল দিক। রুপন্তি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,না!আমিই সব করব।আমি জ্বাল দিতে পারব সাথে শাকও কেটে নিতে পারব। রুপন্তি তাজিয়ার দিকে বটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, তুই বরং পেঁয়াজ,মরিচ কেটে নে।আমি হাত দিয়ে শাক ছিড়ে নিচ্ছি।

মামিরা এসে বলল,রান্না যখন করবা বড় পাতিলে কর। তিঁতলি আপত্তি জানিয়ে বলল,না!ছোট পাতিলেই রান্না করব।এটাই মজা! নানি এসে বলল,এইটুকু ভাত তো একজনেরই হবে না। তাজিয়া দাদিকে আশ্বস্ত করে বলল,তাতে কি!সবাই মিলে না হয় এক লুকমা করেই খাব। রুপন্তি কারও কথায় কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মুচকি হাসলো। বড় মামার ছেলে দিপু আর ছোট মামার ছেলে তপু সন্ধ্যায় খেলা ভেঙে সবে বাড়ি ফিরেছে।উঠোনে চড়ুইভাতির আয়োজন দেখে তারা যেন আনন্দে আত্মহারা।খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,আমরাও খেলব!

রুপন্তি শাক ছিড়তে ছিড়তে মুচকি হাসলো। আর তিঁতলি উত্তর দিল,ছেলেদের নিব না।রুপন্তি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলল,থাক না তিঁতলি!ছোট ভাই আমাদের। কেন এমন করছিস? তপু বলল,তিঁতলি আপু, আমরা চার দিন আগে পুকুর থেকে বঁড়শি দিয়ে ১০৯ টা পুঁটি মাছ ধরেছি।সেখান থেকে অর্ধেক মাছ ফ্রিজে রাখা আছে। আমাদের খেলতে নিলে সেই মাছগুলো দিতে পারি। তিঁতলি এবার পটে গিয়ে আমতা আমতা করে বলল, ঠিক আছে!ঠিক আছে!নিয়ে আয় যা। পরক্ষণে দিপুকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুই গিয়ে টর্চ লাইটটা নিয়ে আয়।অল্প আলোতে আপুর দেখতে সমস্যা হবে।

রুপন্তি বোনের মুখ থেকে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে গেল।সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
তাকে নিয়ে যে তিঁতলির চিন্তা হয় এ কথা সে আগে ভাবতেও পারে নি। তাজিয়া পেঁয়াজ, মরিচ কাটা শেষ করে দৌড়ে ঘরে চলে গেল।ফিরে আসল পোলাও এর চাল নিয়ে।সে রুপন্তির দিকে চাল এগিয়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,আপু পোলাও রান্না করবা।

এদিকে রুপন্তির ভাত রান্না শেষ।তারপর সে একে একে পুঁই শাক ভাজি ও পুঁটি মাছ ভুনা করে ফেলল।শেষে চুলায় বসালো পোলাও এর চাল।গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে গেল।বড় মামা গ্রামের মাতুব্বর। বাড়ি ফিরে এই কান্ড দেখে সহাস্যে বলল,আরে আরে কি রান্না করে আমার রুপন্তি মামনি?আমি কি সেই পিচ্চি রুপন্তিকে দেখছি?রুপন্তি উত্তরে শুধু মুচকি হাসলো। মামা ইয়ার্কি করে বলল,বাবা!এত বড় পাতিলে রান্না হচ্ছে!বাড়ির সবাই খেয়ে শেষ করতে পারবে তো?নাহ্ গ্রামের সবাইকে দেখছি দাওয়াত দিতে হবে।তা নাহলে খাবারগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। বলতে বলতে সে ঘরে চলে গেল।আর বাইরের সবাই হাসতে লাগলো।

রুপন্তি যখন পোলাও রান্না করায় ব্যস্ত তখন ছোট মামা এসে পুঁটি মাছের বাটিটা নিয়ে দিল এক দৌড় তিঁতলি,তাজিয়া, দিপু ও তপুও ছুটল পিছু পিছু। অবশেষে দুইটা মাছের মায়া ত্যাগ করে বাটি নিয়ে ফিরে আসল। সমস্ত রান্নার পালা শেষ হলে তিঁতলি রুপন্তির চোখে চশমা পড়িয়ে দিয়ে বলল,”আপু, তোমার শৈশবের স্মৃতি ফিরিয়ে দিলাম।” রুপন্তির আর বুঝতে বাকি রইল না চশমাটা অক্ষতই ছিল।তার সাথে সময় কাটাতে এই মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছে তিঁতলি।

রুপন্তি সবসময় বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকত।ছোট বোনের সাথে বিশেষ কোন মুহুর্ত নেই বললেই চলে।নিজের ভুল বুঝতে পেরে চশমা পড়া সত্ত্বেও রুপন্তির চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠলো। সে অন্য দিকে ফিরে চশমা খুলে চোখের পানি মুছে নিবে এমন সময় তিঁতলি আবেগাপ্লুত হয়ে পুনরায় পিছন থেকে বোনকে জড়িয়ে ধরল।আর সঙ্গে সঙ্গে কাঁচ ভাঙার শব্দে সবাই চমকে গেল!

তিঁতলি চশমাটি তুলে বোনের হাতে দিয়ে অপরাধীর ন্যায় মুখ করে বলল,এবার সত্যিই ভেঙে গেল! রুপন্তির বাবা এ মুহূর্তে সেখানে হাজির হলেন।সে চোখ দুটো বড় বড় করে তিঁতলির দিকে তাকিয়ে রাগে কটমট করে বলল,আবার!আবার তুই চশমা ভাঙলি? রুপন্তি এবার ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা টেনে বলল, থাক না বাবা!ঢাকায় ফিরে না হয় আবার বানিয়ে নিব!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত