অন্ধকারে আলো

অন্ধকারে আলো

হিমা দেখতে অনেক মায়াবতী বটে কিন্তু দেখতে কালো হওয়ায় ওরে নিয়ে বের হতে লজ্জা লাগতো আমার। বিয়ে করার পরে প্রথম প্রথম যখন ওরে নিয়ে ঘুরতে বের হতাম তখন এমন লাগতো না কারণ ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম আমি। ধীরে ধীরে যখন বন্ধুরা আমার পিছে ওরে নিয়ে কুটুক্তি করতো তখন থেকে কিছুটা লজ্জার শুরু হয় আর সেটা ক্রমশ বেড়ে গেলো যখন দেখলাম বন্ধুরা সুন্দরী বউ নিয়ে বের হতো।

হিমা আস্তে আস্তে কিছুটা বুঝতে পারে কিন্তু নিজে লজ্জিত হওয়ার পরেও যতটা পারতাম ওরে বুঝতে দিতাম না তবুও কিভাবে যেনো বুঝতে পারতো ও। সেদিন বন্ধুরা সবাই পরিকল্পনা করলো সবার বউ নিয়ে ঘুরতে যাবে আমি খেয়াল করলাম কেউ তেমন আমাকে যাওয়ার কথা বলেনি। আমি ভালভাবেই বুঝতে পারলাম যে আমার বউ কালো বলে ওরা মানিয়ে নিতে পারবে না। আমিও চুপ ছিলাম কিছু বলিনি ওদের, তারপরেও অনেক সময় দিয়ে আড্ডা দিলাম রাত অবদি। ছোট বোনের কলেজে নবীন বরণ, ও প্রথমদিন কলেজে যাবে একটু সেজেগুজে যাবে তাই ঘরের ভিতর হাঁটাহাঁটি করছে আর বার বার বলছে “ভাবির কাছে সাজবো কিভাবে কালো মুখ দেখে বের হবো!” আমি ওরে কিছু টাকা দিয়ে বললাম “পার্লারে সেজে তারপর যা”। ও খুশি হয়ে আমার সুনামের গান জুরে দিলো আমিও হেসে উঠলাম।

মা প্রায়ই বলেন, “কিযে বিয়ে করে আনলি! তোর সাথে এই মেয়েকি কখনো মানায়?” আমি চুপচাপ থেকে হেসে দেই কিছু বলিনা। প্রায়ই শুনি বাড়ির ভিতর বিভিন্ন মহিলার বলাবলি করেন, “মারুফ যে কি বিয়ে করে আনলো আল্লাহ ই জানে, ওর মতো ছেলের এই বউ মানায় না” সবার কাছ কুটুক্তি শুনি হেসে দেই কিন্তু কখনও ওরে ছেড়ে দেয়ার কথা কখনো মাথায় আসেনি আমার। কিন্তু ওর মাথায় ওইদিন এটা এসেছে যেদিন প্রথম ওরে নিয়ে বের হয়ে বন্ধুদের সাথে দেখাকরার পর ওরা বললো “ভাবিকে বাসায় রেখে আয় অনেক মেহমান আছে” আর আমি বন্ধুদের কথায় জলদি ওরে বাসায় নিয়ে এলাম। তখন বন্ধুদের সাথে ওদের বউ ছিলো আর তারপরেও আমি কিছু চিন্তা না করেই হিমাকে বাসায় রেখে এসেছি। আমার আসতে রাত ১১টা বেজে গিয়েছিল। ঘরে ঢুকে দেখি হিমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাদছে আর কেদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। এই প্রথম আমারও ওরে দেখতে বাজে লেগেছে কারণ কান্না করে চোখ লাল করে ফুলিয়ে ফেলেছে সে আর তাতে মায়াবী মুখটা কেমন যেনো হয়ে গিয়েছে। আমি তাও নিজেকে সামলে হাত রাখলাম ওর হাতে,

আমিঃ কি হয়েছে একি অবস্থা বানিয়েছো তোমার?

হিমাঃ এখন তোমারও আমাকে দেখতে বাজে লাগছে তাই না?

আমিঃ আরে না এটা কখন বললাম?

হিমাঃ তুমি না তোমার চোখ বলছে।

আমিঃ বাদ দাও তো এসব। খেয়েছো তুমি?

হিমাঃ সন্ধ্যার সময়ই পেট ভরে গেছে আমার। তুমি তো খেয়ে এসেছো তাই না?

আমিঃ হুম। খুব মাথা ব্যাথা করছে চলো শুয়ে পরি।

হিমাঃ আসছি তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।

আমিঃ হুম।

তখনো হিমা অনবরত কেঁদেই চলছে আর তাতেই ওরে আমার বিরক্ত লাগায় মাথা ব্যাথার মিথ্যে কথা বলে সরে এসেছি ওর কাছ থেকে। মাথা ব্যাথার অভিনয় করে ঘুমানোর চেষ্টায় যখন বিছানার এপাশ ওপাশ করছি তখন অনুভব করলাম হিমা ওর হাতটা রাখলো আমার মাথায় আর টিপে দিতে লাগলো। ব্যাথা না থাকায় এমন টিপুনি অসহ্য লাগছিলো আমার কিন্তু কিছু বলতেও পারছিনা।

অস্ফুটস্বরে হিমা বলছে “আমি জানি আমাকে নিয়ে চলতে তোমার অনেক কষ্ট হয় তাই না! কি করবো বলো বিধাতা আমাকে যে এভাবেই বানিয়েছেন। তোমার বোন কোথাও বের হলে আমার সামনে আসে না পাছে অমঙ্গল না হয়, মা ভালো ভাবে কথা বলেন না, বাবা আমার হাতে এখন অবদি তেমন কিছুই খায়নি কতটা অপয়া ভাবছে সবাই আমাকে। কিন্তু জানো তাতেও আমার দুঃখ ছিলো না তোমার উপর ভরসা ছিলো ভালবাসা ছিলো আজ সেটাও হারিয়ে ফেললাম আমি। আমার মনে হচ্ছে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিৎ, মাত্র তো দু’বছর হয়েছে বিয়ের এখনই আলাদা হই আমরা।

আমি শুধু চুপচাপ শুনছি কিন্তু কিছু বলিনি কিছুক্ষণ পর খেয়াল হলো ওর হাত নরছে না। উঠে দেখি কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে ও। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলোর দিকে চেয়ে আছি ল্যাম্পপোস্টের আলোয় কিভাবে অন্ধকার রাস্তাটা আলোকিত হয়ে আছে। নিজেকে প্রশ্ন করছি আমি, “আমার জীবনের আলো দিয়ে কি আমি আমার হিমার জীবনের এই অন্ধকার ঘুচতে পারবো?” নাহ আর ভাবতে হবে না উত্তর এসেছে আমি পারবো হ্যাঁ পারতে হবে আমার।

আমিঃ শুনছো? হিমা! ওঠো ওঠো নামাজের সময় হয়ে এসেছে জলদি ওঠো।

হিমাঃ উম? এইতো উঠছি।

ফজরের নামাজ আদায় করে নিলাম দুজন মিলেই। হিমার হাতে হাত রেখে বললাম, “আজ থেকে তোমার অন্ধকার হয়ে আসা জীবনে আমি আবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রবেশ করলাম বিশ্বাস রাখো আর কখনো তোমার কষ্টের কারণ হবো না” বলেই ওর কপালে ভালবাসা এটে দিলাম। সকালে নাশতার টেবিলে বসে সবাই মিলে নাশতা করছি হিমা সবাইকে খাবার দিচ্ছে আমি বললাম “তুমিও বসো” ওমনি বাবা আমার দিকে তাকালো সাথে ছোট বোনটাও ভ্রুকুচকে তাকালো। হিমা বুঝলো ও বসলে তারা হয়তো উঠে যাবে তাই ও বসেনি এজন্য আমিই উঠে গেলাম টেবিল থেকে। “হিমা চলো তোমাকে বাবার বাড়ি রেখে আসি যদি কখনো সম্ভব হয় তো নিয়ে আসবো আর না হলে ভাড়া বাসা নিবো” বলতে বলতে ওরে নিয়ে আমার কক্ষে ঢুকে গেলাম, পিছন থেকে মা ডাকলেন আমি আসছি বললাম।

হিমাঃ কি হয়েছে তোমার এসব কি বলছো?

আমিঃ ঠিকি বলছি, তুমি আমার বউ না? তো যা বলছি তাই করো ব্যাগ গুছাও জলদি।

হিমাঃ চুপ করো তো, বাবা-মাকে ছেড়ে আমি যাবো না তোমার চেয়ে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।

আমিঃ আচ্ছা তাইলে আমাকে বলো যে তুমি কয়দিন তাদের সাথে টেবিলে বসে খাবার খেয়েছো? কয়দিন তাদের সাথে বসে গল্প করেছো? কয়দিন আমার বোনের সাথে শপিংয়ে বেরিয়েছো বা তুমি ওর ব্যাপারে কতটুকু কি জেনেছো এই দু’বছরে? হয়তো অনেক কিছুই কিন্তু তা কি বড় ভাবি হিসেবে ওর কাছ থেকে জেনেছো? শুধু এইকথার উত্তর দাও তারপর বোঝা যাবে সব।

হিমা কাদছে ও কিছু বলতে পারছে না কারণ ওর কষ্টে যে আমি লবণ দিয়ে দিয়েছি। আজ আমি এতোদিনের কাপুরুষটা পুরুষ হয়েছি এই সুখের কান্নার চেয়ে ওর কাছে কষ্টের কান্নাটাই শ্রেয় মনে হচ্ছে আমার। এতো অবহেলার পরেও কেউ এভাবে ভালবাসতে পারে তা আমি জানিনা। ওর জন্য অনেক কিছু করতে মন চাইছে কিভাবে করবো তা জানিনা তবে এতটুকু জানি যে নিজেকে মানুষ করতে হবে আমার। আমি যদি নিজের সহধর্মিণীর মর্যাদাই রাখতে অক্ষম তাইলে আমি পুরুষ নই কাপুরুষ, তাই আর নয় এবার পুরুষ হইতে হবে।

আমিঃ মা ডাকছিলে?

মাঃ তুই কি শুরু করলি? এই বউয়ের জন্য তুই ঘর ছাড়বি?

আমিঃ মা এই বউ মানে? আমার কি আরও বউ আছে নাকি?

মাঃ ফাইজলামি করিস না। এরকম কালো অপয়া মেয়ের জন্য তুই ঘর ছাড়বি? এই জন্য তোকে বড় করেছি শিক্ষিত করেছি আমি?

আমিঃ হ্যাঁ মা আপনি এজন্যই আমাকে বড় করেছেন। তবে সেটা ঘর ছাড়ার জন্য নয় মানুষ হওয়ার জন্য করেছেন একজন আদর্শ পুরুষ হওয়ার জন্য। কিন্তু মা আমি এটা এতোদিনে হতে পারিনি, আমি আদর্শ পুরুষ হইতে পারিনি মা। বন্ধুদের জন্য নিজের বউয়ের মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছি, ছোট বোনের কাছে নিজের বউকে তার প্রাপ্য মর্যাদা হারাতে দেখেছি, বাবা ওর হাতের খাবার তেমন খায়না তুমি নিজেও বলছো কেমন মেয়ে বিয়ে করেছি আমি! এসব এতোদিন হাসি মুখে বুঝে মেনে নিয়েছি কিন্তু কষ্ট হয়েছে ঠিকি আমার। কাপুরুষ হয়ে ছিলাম মা নিজের বউয়ের মর্যাদাই রাখতে পারিনি আমি। কিন্তু মা তুমি এইমাত্রই বললা এই বউয়ের জন্য ঘর ছাড়ছি আমি, দেখো তুমিও বলছো ও আমার বউ। তাইলে কিভাবে আমি আমার সহধর্মিণীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করি মা? ওর মান-মর্যাদা সবই তো আমাকে ঘিরে তাইলে আমি ওর পাশে না থাকলে ওতো পৃথিবীতে সব চেয়ে বেশি অসহায়ের কাতারে চলে যাবে মা।

কথাগুলো বলছি মা কিছু বলছে না কারণ মা এখন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি ছোট বোন দাঁড়িয়ে আছে, ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম “বোন আজ যদি তোর গায়ের রঙ কালো হতো তাইলে কি এমনটা বলতে পারতি যে, ভাবির কাছে সাজবো কিভাবে কালো মুখ দেখে বের হবো! পারতি তুই এমন কথা বলতে যদি এই ফর্সা রংটা না থাকতো? তুই আমার ছোট বোন অনেক কিছুই বোঝো না তারপরেও বলি শরীরের মতো মনের রংটাও সুন্দর কর।”
বাবাকে কিছু বলিনি কারণ কিছু মানুষকে শুনিয়ে বলতে হয় সোজা বলা যায় নাহ। হিমাকে বললাম এখন যেতে না পারলে বিকেলে তৈরি থেকো অফিস থেকে ফিরে তোমার বাবার বাড়ি দিয়ে আসবো তখন যেনো কোনো কথা না শুনি।

বেরিয়ে পরলাম অফিসে, আজ কাজ বেশি থাকায় বিকেলে বাসায় যেতে পারিনি তাই যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতর থেকে অনেক শব্দ পাচ্ছি আমি কি হচ্ছে বুঝতেছি না বেল দিলাম দুবার তাতেও কেউ খুলছে না দরজা। অনেক্ক্ষণ প্রায় পাঁচবার বেল দেয়ার দরজা খুললো হিমা, হাসি মুখে সালাম দিলো আমাকে। আমি সালাম নিয়ে ঘরের ভিতর গেলাম কিন্তু সব কিছুই স্তব্ধ হয়ে আছে একটু আগের সরগরম ঘরটা নিমিষেই এমন চুপ! আর এতো শব্দের কারণ কি? নিজেকে প্রশ্ন করতে করতেই কক্ষে চলে গেলাম হিমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
হিমা আমার পিছে কক্ষে আসেনি দেখে আমি পিছে তাকালাম দেখি আম্মার কক্ষের দিকে তাকিয়ে কি যেনো ইশারা করলো! মাথা কিছু ঢুকছে না, হচ্ছে কি বাসায় তাই ডাইনিংয়ে গেলাম পানি খেয়ে গিয়ে দেখি দূরে এক কোনায় একটা কেক লুকানো আছে হয়তো জন্মদিনের হবে।

নিজের ঘরে এসে কাপড় বদলাচ্ছি আর ভাবছি আজ কার জন্মদিন! হঠাৎ খেয়াল হলো যে আজ তো হিমার জন্মদিন আল্লাহ আমি এখনো ওরে শুভেচ্ছা জানাইনি!! ভয়ে হাত পা নেই ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার কারণ ওর চোখ দিয়ে কিনা আবার ঝড় নামে। তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে পরলাম ফুল কিনতে, একরকম দৌড়ে বের হয়েছি আমি। জলদি গাড়িতে উঠে ফুলের দোকানের উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে কিনলাম ফুল। আবার ফিরে এলাম বাসায় আর ঘরে না ঢুকে চলে গেলাম ছাদে। ছাদে গিয়ে হিমাকে ফোন করে বললাম ছাদে আসো একটু ও প্রথম রাজি হচ্ছিলো না তারপরও জোর দিয়ে আনলাম। আমি ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছি হিমা আসছে আমার দিকে আর কাছাকাছি আসতেই হাটু গেড়ে বসলাম ওর সামনে,

আমিঃ (পিছন থেকে ফুলের হাতটা সামনে এনে) আজকের আকাশে অনেক তারা দিনছিলো সূর্যে ভরা, আজকের জোৎস্নাটা অনেক সুন্দর সন্ধাটা আরও উন্মাদান, আজকের পৃথিবী তোমার জন্য ভরে থাকা ভালো লাগা মুখরিত হবে দিন গানে গানে আগামীর সম্ভাবনায়, তুমি এই দিনে পৃথিবীতে এসে ছো শুভেচ্ছা তোমায়, তাই অনাগত কাল হোক আরও সুন্দর উচ্ছল দিন কামনায় শুভ জন্মদিন শুভ জন্মদিন তোমার শুভ জন্মদিন শুভ জন্মদিন তোমার, হিমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে তাকিয়ে কাদছে আবার হাসছে,

হিমাঃ (আমাকে উঠিয়ে জরিয়ে ধরে) তোমার সাথে জীবন জরানোর পর আজ আমি সবচেয়ে খুশি, জানো আজ তোমার আগেও আমি শুভেচ্ছা পেয়েছি অনেক অনেক যার কৃতিত্ব তোমার উপরেই যায়। আর হ্যাঁ এজন্যই দেরি করে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কিছু বললাম না।

আমিঃ কে দিলো শুভেচ্ছা?

কথাটি জিজ্ঞেস করতেই পিছন থেকে ছোট বোন শুকনো কাশি দিয়ে বললো, বাবা ডাকছেন। বাসায় ঢুকেই দেখি সবাই কেক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাথে হিমার বাবা-মা ও এসেছেন। হিমার সাথে আমিও কেক কাটছি আর ভাবছি আমি এখন পুরুষ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত