বহুদিন পরে পুরীতে এলাম। এসে পুরী এক্সপ্রেস থেকে নেমে পুরী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই ধাক্কাটা খেলাম। না, কোনো মানুষ বা জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা নয়, ধাক্কাটা নিজের স্মৃতির সঙ্গে।
আমরা কামরা থেকে নেমে একটি ব্যাগ কাঁধে তুলে বাইরে যাবার গেট-এর দিকে এগোচ্ছি যখন, তখন ভিড় পাতলা হয়ে গেছে প্ল্যাটফর্মে। অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সিরা তাড়াতাড়ি হেঁটে বেরিয়ে গেছেন স্টেশন থেকে। আমার বয়স হয়েছে, এখন আর তাড়াহুড়ো করতে পারি না। একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে, হাঁটুতে আর্থারাইটিস। একটু হেঁটেই ক্লান্ত হয়ে গিয়ে পাখার তলাতে একটি চেয়ারে বসলাম জিরিয়ে নেবার জন্যে। হঠাৎ দেখি দীপশিখা আসছে একটি হুইল চেয়ারে বসে। পাশে পাশে একজন সুবেশা তরুণী আয়া। সে এতই বিপুলা হয়েছে যে তাকে মাত্র কয়েকদিন। আগে একটি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে না দেখলে চিনতে পারার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। সেই সাক্ষাৎকারেই শুনেছিলাম যে তার স্বামী-বিয়োগ হয়েছে গত বছর। দীপশিখার স্বামীর নাম। ছিল অগ্নিভ। খুব বড়োলোকের ছেলে। মেধাবী ও সুদর্শন ছেলে। টাটা কোম্পানির মস্ত বড়ো ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের পরে দীপশিখা জামশেদপুরেই চলে গেছিল। দীপশিখা আমাদের ছেটোবেলার কাঁকুলিয়া রোডের ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়ে ছিল। তার হাজার প্রেমিকের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। সে যেমন রবীন্দ্রসংগীত গাইত, তেমনই নাচত এবং রেডিয়োতে নিয়মিত অনুষ্ঠান করত। তখন টি ভি ছিল না। আমি তখন যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য পড়ি। নাটক করতাম, লিটল ম্যাগ করতাম, ডি ওয়াই এফ করতাম–ওই বয়সের তরুণরা প্রায় সকলেই যা করত। দীপশিখার সঙ্গে অভিনয়ও করেছি, দ্বৈতসংগীতও গেয়েছি। বন্ধুরা বলত দীপশিক্ষা আমাকে খুব পছন্দ করে। আমি তো ওকে করতামই। কিন্তু অনেক মেয়েরাই যেমন একসময়ে শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার কামিজ অথবা জিনস পরে তেমনই দীপশিখাও আমাকে ননশালান্টলি ত্যাগ করে সম্পূর্ণ অপরিচিত অত্যন্ত সচ্ছল অগ্নিভকে বাবা-মায়ের ইচ্ছেতে বিয়ে করে চলে। গেছিল। আমি বিয়ে করিনি কারণ দীপশিখাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। বন্ধুরা বলত, তুমি একটা ইডিয়ট। আজকাল কি লায়লা-মজনুর দিন আছে। আমার মেয়ে বন্ধুরাও একথা বলত। তবুও বিয়ে করিনি। বিয়ে করতে সাহস লাগে। আমার সেই সাহস ছিল না। টিভির সাক্ষাৎকারেই জেনেছিলাম যে দীপশিখা আর অগ্নিভর কোনো সন্তান নেই।
হুইল চেয়ারটাকে আমারই চেয়ারের পাশের একটি পাখার নীচে দাঁড় করাল কুলি। নিজেকে ও দীপশিখাকে এবং তার আয়াকে হাওয়া খাওয়াবার জন্যে। আমি এগিয়ে গিয়ে হুইলচেয়ারটাকে ছুঁয়ে বললাম, কেমন আছ?
দীপশিখা চমকে চাইল। আমাকে চিনতে পারল না। তারপর বলল, দেখতেই তো পাচ্ছেন। কিন্তু আপনি?
আমি আপনার একজন অনুরাগী। যাদবপুরের দিনগুলো মনে পড়ে?
চমকে উঠল আবার দীপশিখা।
কুলি হুইল চেয়ারটা ঠেলতে শুরু করল।
বলল, আর দেরি হলে ট্যাক্সি মিলিবনি মা।
দীপশিখা বলল, চলো।
তারপর ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল, খুবই চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু সরি, চিনতে পারলাম না।
আমি হেসে বললাম, ঠিক আছে।
তারপর মনে মনে বললাম, চেনা কি এত সহজ? তুমিও কি অগ্নিভকে চিনেছিলে? কাছে থাকা যায় সারাজীবন, হাতের উপর হাত রাখা যায় কিন্তু চেনা অত সহজ নয়।
উদভ্রান্তর মতো তাকাল একবার দীপশিখা। তার হুইল চেয়ারটা আমাকে ফেলে এগিয়ে গেল। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে সে যেমন আমাকে ফেলে এগিয়ে গেছিল। দীপশিখা আর তাকাল না পেছন ফিরে।
আমি লাঠি হাতে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, সকলের জীবনেরই বোধহয় এইই। নিয়ম। সামনে চলাই জীবনের ধর্ম। পেছন পানে তাকাতে নেই। তাকিয়ে কোনো লাভও নেই। প্রতিটি মানুষ নিরুপায়ে নিরন্তর সামনেই এগিয়ে চলেছে। দীপশিখা ও আমিও তাই চলব। এ পৃথিবীতে সমব্যথা নেই, সমব্যথী নেই, স্মৃতির বাসা নেই কোনো।
স্টেশনের গেটে পৌঁছে দেখলাম সকাল আটটাতেই রোদের চাঁদোয়া গনগনে আগুনের মতো মাথার উপরে বিছোনো।
একজন পাণ্ডা এসে বলল, আপনার পাণ্ডা কে বাবু?
রিকশা আর অটোঅলা বলল, আপনি কোন হোটেলে যাবেন?
আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম দীপশিখা একটি এয়ারকন্ডিশনড বোলেরোতে চড়ল। চক্ৰতীর্থর মে ফেয়ার হোটেল থেকে গাড়ি ও অ্যাটেড্যান্ট তাকে নিতে এসেছিল।
সেখান থেকে সমুদ্রের নীল দেখা যাচ্ছিল না, ঢেউ ভাঙার শব্দও শোনা যাচ্ছিল না।
দীপিশিখার বোলেরো চলে গেল। আমি একটি রিকশাতে উঠে বললাম, পুরী হোটেলে যাব। তারপর রিকশাওয়ালাকে বললাম, এখানে পানের দোকান আছে?
সে বলল আছিছ।
পানের দোকানের সামনে রিকশাটা দাঁড় করাতেই ট্রাফিক পুলিশ এসে রিকশার হ্যান্ডেলে দু ডান্ডা কষাল, বলল, রাস্তা জ্যাম করিচু কাঁই?
তাড়াতাড়ি দু-খিলি পান আর জর্দা আমার হাতে ধরিয়েই রিকশাওয়ালা প্যাডল করতে লাগল সিটে বসে। এখানে কলকাতা পাত্তি পাওয়া যায় না, বাংলা পাত্তি-দু-বার চিবোতেই মুখটা জ্বলতে লাগল। ফেলে দিলাম পানটা।
রিকশাওয়ালা বলল, পুরী হোটেলের পাশে যে গল্লি অছিছ সেটু মিলিব কলকাত্তা পাত্তি।
মুখটা এই সকালের মতোই বিস্বাদ হয়ে গেল। দীপশিখা এতক্ষণে মে ফেয়ারের এয়ার কন্ডিশনড কটেজের শাওয়ারের নীচে চান করছে হয়তো, নয়ত হোটেলের সেকুডেড বেলাভূমিতে লাল-নীল ছাতার নীচে পাতা ডেক চেয়ারে বসে প্রাইট বা সেভেন-আপ-এর গায়ে চুমুক দিতে দিতে সমুদ্র দেখছে হয়তো।
আমার সাইকেল রিকশা ক্যাঁচোর-কোঁচোর করতে করতে পুরী হোটেলের দিকে এগোতে থাকল, সময় লাগবে, একটু পরেই পথের বাঁ-দিকে সমুদ্র আর দীর্ঘ বেলাভূমি দেখা যাবে। মন ভালো হয়ে যাবে। লাঠি হাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেলাভূমিতে হেঁটে বেড়াব আমি। শারীরিক অসুবিধা ছাড়া আমি সব ব্যাপারেই স্বাবলম্বী। আমার কোনো দুঃখ নেই। একমাত্র দুঃখ এই যে দীপশিখা আমাকে চিনতেই পারল না। অথচ সারাটা জীবন আমি ওকে মনে রেখেই…।
যাদবপুরেরই এক বন্ধু ছিল, আমার ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রিমের, তার নাম ছিল হিতেন। হিতেন মারা গেছে গত বছর-ভরা সংসার রেখে। লারসেন এ্যান্ড টুব্রোতে ছিল ও। ভালো পদে। হিতেন বলত, তুই একটা রিয়্যাল ইডিয়ট অগ্নিভ। হিতেনের সুন্দরী স্ত্রী মণিকা বলত, হিতেনকে, তুমি কি বুঝবে ভালোবাসার? তুমি তো একটি মেশিন। অগ্নিভদার মতো রোম্যান্টিক মানুষকেই মেয়েরা পছন্দ করে এসেছে। দীপশিখাও হয়তো একটি মেশিনই ছিল তোমারই মতো। তাই আপনাকে দাম দেয়নি সে।
আমি ভাবছিলাম, কলকাতা ফিরে কারোকেই বলতে পারব না যে দীপশিখার সঙ্গে এত বছর বাদে দেখা হয়েছিল কিন্তু আমাকে চিনতে পর্যন্ত পারেনি সে।