এতদিন সরষের তেলে ভেজাল চলছিল, ঘি-এ ভেজাল চলছিল, ওষুধে ভেজাল চলছিল। কোর্টে, কাছারিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, সর্বত্র ভেজালে ভেজালে একাকার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার যা দেখলাম তারপর আমার বাকরোধ না হয়ে আর কোনও উপায় রইল না।
ছোটগল্প ছোটও হতে হবে আবার নাকি গল্পও হতে হবে। গল্পটা ছোট হল কিনা সেটা তবুও মেপে বলা সম্ভব, কিন্তু গল্প হল কিনা সেটা বিচার সাপেক্ষ। বিজ্ঞান যেমন অঙ্কঘটিত, গল্প তেমনি রস ঘটিত। অবশ্য অঙ্কেরও রস আছে। আমার এক অঙ্ক-রসিক বন্ধু আছে সে যখন কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন বিশ্রাম করবার জন্য অঙ্ক করতে বসে।
রস যে পায় সে পায়। মানে নিতে জানলে পাথর থেকেও রস নেয়া যায়। যেমন অশ্বত্থ গাছ। সঞ্জীবচন্দ্র পাহাড়ের ফাটলে সেই রকম একটা অশ্বত্থগাছকে জন্মাতে দেখে গাছটাকে খুব রসিকবলে ঠাউরেছিলেন। কিন্তু আমি জানি আর একটা অশ্বত্থ গাছকে। গাছটা আমাদের কার্নিসে জন্মেছিল। গাছটা দেখে সঞ্জীবচন্দ্রের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল স্বভাবতই। সত্যিই মনে হয়েছিল বাহাদুর গাছ বটে। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখলাম গাছটা শুকিয়ে গেছে। সিমেন্ট-কংক্রিটের মধ্যে রস খুঁজতে গিয়ে বেচারি বেঘোরে প্রাণ দিয়েছে।
বৈজ্ঞানিককে গালাগালি দেয়া শক্ত। কারণ বিজ্ঞান বুঝতে গেলে বোদ্ধাকে মোটামুটি বৈজ্ঞানিক হতে হবে। কিম্বা অন্য বৈজ্ঞানিকের সাহায্য নিতে হয়। কিন্তু সাহিত্য বুঝতে গেলে বোদ্ধা না হলেও চলে। কারণ রস বোদ্ধা নিরঙ্কুশ! তিনি বলবেন-আমি রস পেলাম না মশাই, সুতরাং এটা নিরস বস্তু।
অর্থাৎ অশ্বত্থ গাছটা যে সিমেন্ট-কংক্রিটের মধ্যে বাঁচতে পারল না সেটা যেন অশ্বত্থ গাছের রসগ্রহণ অক্ষমতায় নয়, সিমেন্ট-কংক্রিটের নিরসতার দোষে!
ব্যাপারটা ঠিক এই রকম ঘটেছিল!
আমার বন্ধু বিশ্বনাথ তখন বোম্বাই-এর পুলিশের বড়কর্তা। বোম্বের মদ-চোলাই কারবার ধরার কাজের অফিসের হেড।
আমি জিজ্ঞেস করলাম-মদ খাওয়া বন্ধ করতে পেরেছ-টেরেছ কিছু?
বন্ধু বললে– পারব কি করে? পাবলিকের ভালর জন্যেই প্রোহিবিশনটা হয়েছে, অথচ পিপ্ লই সাপোর্ট করেছ না প্রোহিবিশন! এতে কখনও মদ খাওয়া বন্ধ করা যায় না?
বললাম– তুমি নিশ্চয় মদ খাও না?
প্যাটেল বললে– না ভাই, অতটা হিপোক্রিট এখনও হতে পারিনি–
– কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ে তোমার বাবা মদ খেতেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মদ খেয়ে গেছেন।
প্যাটেল বললে– এ তো ভারি আশ্চর্য। বাবা মদ খেয়েছেন বলে আমি মদের বিরুদ্ধে বলতে পারবো না?
– আলবৎ পারবে। তোমার বাবা মদ খেতেন বলে আরও জোর করে প্রতিবাদ করবে। হিটলারের বাবা মদ খেতেন বলেই হিটলার ছিল টিটোটেলার।
– তাহলে কি বলতে চাও?
বললাম– আমি বলতে চাই যে, তোমার চেয়ে আর বেশি ভাল করে কেউ জানে না যে মদের নেশা ছাড়া কত শক্ত!
প্যাটেল বললে– সেইজন্যেই তো আমরা পারমিটের ব্যবস্থা করেছি। যারা পুরোনো নেশাখোর, তাদের আমরা পারমিট দিই, সেই পারমিট দেখালে তারা একটা লিমিটেড কোয়ানটিটি লিকার পায়–
– তাতে কি তাদের চলে?
প্যাটেল বললে– চলে না তো বটেই। তবু নেই মামার চেয়ে কানা-মামা ভাল। একেবারে না খেতে পেলে তারা মারা যাবে, তাই এই ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা চাই দেশ থেকে মদ খাওয়া উঠে যাক। এতে অনেক টাকা রেভিনিউ বন্ধ হচ্ছে বটে কিন্তু মানুষের মর্যাল ভাল হচ্ছে।
বিশ্বনাথ প্যাটেলের বাবাকে আমরা দেখছি। নাগ পুরে বিশ্বনাথদের বহু পুরুষের বাস। গনেশপূজোর দিন বিরাট হৈ চৈ হত! সেদিন নাগপুরের গণ্যমান্য লোকদের নেমন্তন্ন হত তাদের বাড়িতে। বড়লোক মানুষ। বিশ্বনাথের বাবার ছিল ফরেস্ট। ফরেস্ট থেকে প্রচুর টাকা আমদানি হত। সেকালে সেই টাকায় সব রকম বাবুয়ানি করেও অপব্যয় করবার অনেক পয়সা থাকত।
আমরা দেখছি সেই সব মাতলামি। গণেশপূজোর সকাল থেকেই আসর বসতো গানের। এদিকে গানও চলছে, ওদিকে মদও চলছে। শেষকালের দিকে জ্ঞানও থাকত না বিশ্বনাথ প্যাটেলের বাবার। তখন বাড়ির উঠোনেই নাচতে আরম্ভ করতেন। বিরাট ভুঁড়িওয়ালা চেহারা। ধপ ধপ করছে গায়ের রং। গায়ের জামা তখন মাতলামির চোটে ছিঁড়ে গেছে। সেই ছেঁড়া জামা, পরণের ধুতি খসে যাচ্ছে, আর তিনি ধেই ধেই করে নেচে চলেছেন।
আমরা ছোটরা সবাই বারান্দার ভেতরে আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুড়োদের মাতলামি দেখে মজা পাচ্ছি আর হাসছি। বিশ্বনাথের মাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছেন। কিন্তু কিছু করবারও উপায় নেই।
চাকরটা উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেসে ফেলছিল কর্তাবাবুর কাণ্ড দেখে।
বিশ্বনাথের মা আর থাকতে পারলেন না।
বললেন– এ্যায় ধনিয়া, দাঁত বার করে হাসছিস যে বড়? খুব মজা পেয়েছিস না? মজা দেখবার জন্য তোমাকে রাখা হয়েছে? দেখছিস না কর্তাবাবু মাতলামি করছে? কর্তাবাবুর কমরে কাপড়ের কষি খুলে যাচ্ছে, সেদিকে নজর নেই?
হঠাৎ কি যে হল কর্তাবাবুরও নেশা চটে গেল।
ডাকলেন এই ধনিয়া, দাঁত বার করে হাসছিস যে বড়, খুব মজা পেয়েছিস না? মজা দেখবার জন্য তোমাকে রাখ হয়েছে? দেখছিস্ না আমি মাতলামি করছি? আমার কাপড়ের কষি খুলে গেছে, নজরে পড়ছি না তোর?
ধনিয়া বহুদিন ধরে কর্তাবাবুর সেবা করিয়া আসছে। বাবুর কথায় লজ্জায় পড়ে গেল। কর্তাবাবু বললে– আমার মাথায় জল ঢাল বেটা, বালতি আন্-যা-
বিশ্বনাথের বাবার এ-সব কাণ্ড দেখে আমরা সবাই হাসাহাসি করছি বহুদিন। যে এ গল্প শুনেছে সে-ই হেসেছে। এবার সেই কর্তা বাবুর ছেলেকেই বোম্বেতে এসে মদ-খাওয়া বন্ধ করবার চাকরি করতে দেখে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
তা বিশ্বনাথ প্যাটেল সত্যিই ভাল ছেলে। আমাদের পাড়ায় যতগুলো ছেলে এক ক্লাশে পড়তাম, তাদের সকলের চেয়ে ভাল।
বিশ্বনাথ বললে– আসলে ভাই মন্দ কেউ খায় না, মদই সকলে খায়।
বললাম– সে আমি জানি। জানি বলেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। তুমি শেষকালে এই চাকরিতে ঢুকলে। এখানে কি তুমি কিছু কাজ দেখাতে পারবে?
বোধ হয় বিশ্বনাথের নিজের মনেও সন্দেহ ছিল। আর তাছাড়া চাকরি মানেই চাকরি। চাকরিতে তো বাছ-বিচার করার উপায় থাকে না সব সময়ে। বিশ্বনাথকেও নিজের অনিচ্ছাতে এই চাকরি নিতে হয়েছিল। কিন্তু বোম্বেতে এসে যে বিশ্বনাথের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, আর বিশ্বনাথের সঙ্গে দেখা হবার ফলে যে এমন একটা ছোট গল্প জুটে যাবে তা কল্পনা করতে পারিনি।
বোম্বেতে আমার এক দূর সম্পর্কের জ্যাঠাইমা থাকতেন। দূর সম্পর্কের হলেও এককালে জ্যাঠাইমার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমাকে নিজের ছেলের মত স্নেহ করতেন। আমাদের বিপদ-আপদের দিনে সাহায্য করেছেন। এখন অনেক বয়স হয়েছে। প্রায় আশি। কিন্তু তবুও স্বাস্থ্য ভাঙেনি। জ্যাঠাইমা এখনও ছোলা ভাজা মটর ভাজা খেতে পারতেন চিবিয়ে চিবিয়ে। বোম্বেতে জ্যাঠাইমার জামাই বিরাট বড়লোক ব্যবসায়ী। ভদ্রলোক মহারাষ্ট্রী। কীভাবে আমার জ্যাঠতুতো বোনের সঙ্গে কলেজে পড়তে পড়তে ভদ্রলোকের বিয়ে হয়ে যায়। তখন অবস্থা তত ভাল ছিল না তাদের। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় হতে শুরু করে। তখন একটার পর একটা প্রপার্টি করতে আরম্ভ করে।
আমি এমনিতে হটেলেই উঠেছিলাম। জ্যাঠাইমার সঙ্গে দেখা করিনি। টেলিফোন করতেই জ্যাঠায়ইমা বললেন– তুই হটেলে উঠতে গেলি কেন?
আমার এখানে চলে আয়।
জ্যাঠাইমা যে-রকম করে হুকুম করলে তার পর আসমার আর হটেলে তাকা চললো না।
সেই দিন আমার ভগ্নিপতি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে আমাকে নিজের বাড়িতে তুললো। দিদি যদিও অবাঙালিকে বিয়ে করেছিল, কিন্তু ভগ্নীপতিকে পুরো বাঙ্গালী করতে ভোলে নি। নামেই শুধু মিস্টার দেশপান্ডে, আসলে ভেতো বাঙ্গালি। চেহারা দেখে কে বলবে যে এই মানুষটাই হাজার হাজার লোক খাটিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেন। বোম্বের কাপড়ের মিল আর শেয়ার মাকের্টটাই যেন মিস্টার দেশপান্ডে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে পুরে ফেলেছে। সকাল থেকে যে সব লোক তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য কিউ দেয় তা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। আর ওদিকে আমার দিদি বেশ স্বাচ্ছন্দে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত দিন রান্নাঘরের ভেতরে কি অমানুষিক পরিশ্রম করে কেবল ভাল ভাল করে যায়।
মিস্টার দেশপাণ্ডে বললে– তোমার দিদির ওই কেমন শখ দেখ না কেবল রান্না, রান্না আর রান্না–
দিদির রান্নার বোধ হয় বাতিক ছিল।
বাড়িতে যে আসবে তাকে দিদি না খাইয়ে ছাড়বে না। শুধু খায়ানো নয়, খেতে হবে। রান্না কেমন হয়েছে বলতে হবে। আর একবার রান্নার প্রশংসা করলে তো আর কথায় নেই, বার বার খাইয়ে তার পেটে গ্যাসট্রিক-আলসার না ধরিয়ে দিয়ে আর তাকে ছাড়বে না।
আমি আমার জামাই বাবুর দিকে চেয়ে বললাম– আপনি? আপনার তো পেট ভাল রয়েছে। আপনার তো আলসার হয়নি?
দিদি বললে ওর-কথা ছেড়ে দাও– উনি কি এসব খান না কি? এসব ছঁয়ে দেখবে না–
– কেন? আলসারের ভয়ে?
জামাই বাবু হাসতে লাগলো। কিছু কথা বললেনা।
দিদি হাসতে হাসতে বললে– ওঁর পেটে কি আর খাবার জায়গা থাকে? সন্ধ্যে থেকেই চলে কিনা!
তা সত্যিই তাই। সন্ধে থেকেই তার বোতল আসে। সোডা আসে। যারা জামাই বাবুর বন্ধু তারাও খায়। দিদি তখন রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত। যারা অতিথি তারাও খাবে। আর খাওয়াও সামান্য কিছু নয়। একেবারে পুরো ডিনার। টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই সংসারে। সুতরাং অঢেল খাওয়া। যে যত পারো খাও। দিদি যেমন খাওয়াতে ভালোবাসে অতিথিরও তেমনি কামাই নেই। ব্রেকফাস্টের সময় কেউ এলে সে ব্রেকফাস্ট খেয়ে যাবে। লাঞ্চের সময়ে লাঞ্চ, ডিনারের সময় ডিনার।
আর আমার জ্যাঠাইমা?
জ্যাঠায়ই থাকতো দোতলায়। দোতলায় শাশুড়ির জন্যে জামাইবাবু, এলাহি পুজোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেখানে ছিল শাশুড়ির ঠাকুরঘর, গঙ্গাজলের জালা। কোষাকুষি। হরিণের চামড়ার আসন। শাঁখ, ধুপ-ধুনোর বন্দোবস্ত। সকাল থোকই উঠে জ্যাঠাইমা তার পুজোর যোগাড় নিয়ে ব্যস্ত। বেলা তিনটের সময় একমুঠো ভাত খেত। তাও নিরামিষ। আর রাত্রিটাও উপোস।
জ্যাঠাইমার ব্রহ্মচর্য ছিল বড় কঠোর। ওই এক মেয়ে নিয়ে জ্যাঠাইমা বিধবা হয়েছিল। ছোটবেলা থেকে নাগপুরে দেখছি জ্যাঠাইমা ঠিক ওই রকম করে দিন কাটিয়েছে। জ্যাঠামশাই টাকা রেখে গিয়েছিলেন। তাছাড়া বাড়ি-ভাড়ারও আয় ছিল। সে টাকা দিয়েই মেয়ে কলেজের হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করছে, এম.এ. পাশ করেছে। আর জ্যাঠাইমা তার গুরুদের নিয়ে মেতে দিন কাটিয়েছে।
জ্যাঠাইমা বললে– আমি বাবা ওদের কাছে খাইনে–
– কেন? খাওনা কেন তুমি?
জ্যাঠাইমা বললে– ওখেনে বড় নোংরা ওরা, কেবল মুগরী-টুরগী রাঁধে, ও-সব আমার ভাল লাগে না। গেলে আবার কাপড় কাচতে হবে তো–
ছোয়াছুঁয়ির বাতিকটা দেখলাম সেই রকমই আছে জ্যাঠাইমার।
জ্যাঠাইমা জিজ্ঞেস করলে– কদিন থাকবি বোম্বেতে?
বললাম কাজ হয়ে গেলেই চলে যাব–
– জন্মাষ্টমীর দিন থাকবি?
– কবে জন্মাষ্টমী?
– এই তো রবিবার। খুব ভাল করে ‘ঝলুন’ পুজো করি জন্মাষ্টমীর দিন। অনেক লোকজন আসবে, এবার নেমন্তন্ন করেছি কিনা, সবাই এখানে খাবে!
জিজ্ঞেস করলাম– তুমি এখানে এসেও সেই তখনকার মত পুজো-আচ্চা নিয়েই মেতে আছ জ্যাঠাইমা? তোমার দেখি কিছু বদলাই নি।
সত্যিই বয়স বাড়লেও চেহারা সেই আগের মতই আছে।
অদ্ভুদ সত্যবাদী ছিল জ্যাঠাইমা, একবার একটা সত্যি কথা বলার জন্যে একটা চল্লিশ হাজার টাকার সম্পত্তি হাত ছাড়া হয়ে যায়।
উকিল বলেছিল আপনার কিছু বলবার দরকার নেই, আপনি শুধু বলবেন যে, আমি এই সাক্ষ্যিকে চিনি– আর কিছু বলতে হবে না।
জ্যাঠাইমা বলেছিল আমি তাকে চিনি না।
– তা না চিনলেই বা, চিনি বলতে দোষ কী! আপনার চল্লিশ হাজার সম্পত্তিটা যে বেঁচে যাবে, সেটা ভাবছেন না?
জ্যাঠাইমা বলেছিল– না বাবা আমি বলতে পারব না, মিথ্যে কথা আমার আসে না–
– কিন্তু ভেবে দেখুন, চল্লিশ হাজার টাকার সম্পত্তিটা যে আপনার হাত ছাড়া হয়ে যাবে!
জ্যাঠাইমা বলেছিল– তা হোক বাবা, পরোলোকে গিয়ে কি আমি মিথ্যে বলে নরকে যাব?
তা সে সব কথা যাক, দেখলাম জামাই-এর বাড়িতে এসে জ্যাঠাইমার সে সভাব যায় নি। এখানেও সেই ধর্ম-কর্ম, এখানেও সে বাছ-বিচার, এখানেও সেই ন্যায়-অন্যায়, সত্যি-মিথ্যের মাপ কাঠি নিয়ে মাথা উঁচু করে দিন কাটাচ্ছে।
বললে– টাকাই থাকুক তোর আর যাই-থাকুক, আসলে তো সেই পাপ-পূণ্য নিয়ে পরকালে বিচার হবে তোর!
তা এর পরদিনই প্যাটেলের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। আমাদের নাগপুরের বিশ্বনাথ প্যাটেল!
আর অনেক দিন পরে দেখা। সুতরাং ছাড়লে না। অফিসে টেনে নিয়ে গিয়ে অনেক গল্প করলে। বন্ধু-বান্ধব কি করলে জিজ্ঞাসা করলে। তারপর জিজ্ঞেস করলে– কোথায় উঠেছিস তুই?
বললুম সব। মিস্টার দেশপাণ্ডের নাম শোনেন নি এমন লোক বোম্বেতে আর নেই তাও জানলাম।
বললাম এত তো তোদের প্রোহিবিশন, এত তো তোরা চেষ্টা করছিস, আমার ভগ্নিপতি তো মদ খায়, তার মদ খাওয়া তো বন্ধ করতে পারিসনি। তার মদ খাওয়া বন্ধ করতে পারলে বুঝতুম তোর কেরামতি!
বিশ্বনাথ বললে– আমি তো ভাই নতুন এখানে এসেছি, একবার দেখি চেষ্টা করে কিছু করতে পারি কি না! তারপর একটু থেমে বললে– আসলে কী হয়েছে জানিস, কারোর কোনো কো-অপারেশন পাচ্ছি না, গভর্নমেন্টে কেন সাহায্য করছে না, পাবলিকও না।
– কেন? গভর্নমেন্ট কেন সাহায্য করছেনা?
– গভর্নমেন্ট অফিসাররাও যে প্রায় সব মাতাল। সবাই মদ খায়। আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রায় সব পুলিশ অফিসারই যে খায়-কাকে বারণ করি! তা ছাড়া বেশি চেষ্টা করতে গেলে আমিই হয়ত কোনদিন খুন হয়ে যাব–
– কেন?
– পুলিশ যে বহু টাকা ঘুষ পায়! আমি বেশ বাড়াবাড়ি করলে তদের অনেক টাকা আয় কমে যাবে।
বলালাম– কিন্তু পাবলিক? পাবলিকের তো সাহায্য করা উচিত; তারা কেন কো-অপারেট করছে না?
বিশ্বনাথ বললে– সে অনেক কথা আছে ভাই, তোকে সে-সব কথা বলা যাবে না।
– কেন?
বিশ্বনাথ বললে– তবে দ্যাখ্, তোকে দেখাচ্ছি–
বললে বিশ্বনাথ একজন কনস্টেবলকে একটা ফাইল আনতে বললে। ফাইলটা দিয়ে চলে যেতেই বিশ্বনাথ আমাকে ফাইলটা দেখালে।
বললে– এই-দ্যাখ-কত লোকের মদের পারমিট দেয়া হয়েছে, তুই নিজে দ্যাখ-।
– আমি নাম গুলো পড়তে লাগলাম। অসংখ্য নামের লিস্ট। কাউকে চিনি না। তার মধ্যে আবার অনেক মেয়ের নাম রয়েছে। ডাক্তাররা যাদের সার্টিফিকেট দিয়েছে, তাদের মদের পারমিট দেয়া আছে। আমার ভগ্নিপতি দেশপাণ্ডের নামও দেয়া আছে তার মধ্যে।
বিশ্বনাথ বললে– এই মেয়েদের লিস্টটা দ্যাখ, এক দ্যাখ এক আশি বছরের বুড়ি সেও মদ খায়– কার কথা আর বলব? কার নামে বা দোষ দেব?
জিজ্ঞেস করলাম– কে?
বিশ্বনাথ বললে– এই যে মিসেস ভট্টাচার্য, বয়েস আশি,–
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। দেখলাম আমার জ্যাঠাইমার নাম। শ্রীমতী আরতিবালা ভট্টাচার্য, এজ্ এইট্টি, মাসে পনেরো বোতল–
আমি বললাম এই তো আমার জ্যাঠাইমা– একে যে আমি ভাল করে জানি–
বিশ্বনাথ বললে– তা জানিস, বেশ করিস, আমি নিজে গিয়ে এর এনকোয়ারি করেছি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম– আপনি মদ খান? তিনি বললেন– হ্যাঁ বাবা,আমি মদ খাই–
প্যাটেলের কথা শুনে আমি রেগে গেলাম। রেগে চেয়ার থেকে উঠে পড়লাম। বললাম– আর যার সম্বন্ধেই তুই বলিস আমার জ্যাঠাইমার সম্বন্ধে তুই ওকথা বলিসনি, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না– জানিস জ্যাঠাইমা চল্লিশ হাজার টাকার প্রপার্টি ছেড়ে দিয়েছে একটা সামান্য মিথ্যে না বলার জন্য!
বলে আর দাঁড়ালাম না। সেখান থেকে উঠে সোজা চলে এলাম জ্যাঠাইমার বাড়িতে।
জ্যাঠাইমা তখন পুজো করছিল। জন্মাষ্টমীর পুজো। জ্যাঠাইমার ঘরে তখন অনেক ভিড়। বোম্বের বিধবা মহিলাদের ভিড়। ব্রাহ্মণ পুরুত পুজো করছে। থরে থরে নৈবেদ্য সাজানো।
আমার কেমন জ্যাঠাইমাকে ভণ্ড মনে হল। মনে হল, এতদিন যা কিছু করে এসেছে জ্যাঠাইমা সব যেন লোক দেখানো।
আমি কিছু না বলে তেতলায় চলে এলাম। কিন্তু মনটা ছট্ ফট্ করতে লাগল। জ্যাঠাইমা কিনা মদ খায়! বাইরের এই পুজো, উপোস, একাদশী, বার-ব্রত সমস্ত কিছু তাহলে জ্যাঠাইমার ভণ্ডামি!
বেশিক্ষণ কিন্তু থাকতে পারলাম না। রাত হলে যখন সবাই বাড়ি চলে গেছে, তখন আমি দোতলায় নামলাম। দেখলাম, জ্যাঠাইমা তখন গুরুদেবের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করছে।
আমাকেই দেখে বলল– কিরে প্রসাদ খাবি?
বললাম– জ্যাঠাইমা, একটা কথা বলব, তুমি মদ খাও?
জ্যাঠাইমা হতবাক হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। তারপর বললে– আমি মদ খাই? কে বললে তোকে?
– বলবে আবার কে? আমি পুলিশের খাতায় তোমার নাম দেখে এলুম। পনেরো বোতল মদ তোমার মাসে বরাদ্দ- ডাক্তার সার্টিফিকেট দিয়েছে।
– ও, তাই বল! বলে জ্যাঠাইমা হাসল।
– হাসছ কেন? খওনা তুমি?
জ্যাঠাইমা বললে– হ্যাঁ খাই–
বলে জ্যাঠাইমা একটু থামল! তারপর বললে– তা সে তো সবাই খায়–
– সবাই খাই? সবাই মানে?
– মানে সুরমাও খায়। বাড়িতে যে-যে আছে চাকর-বাকর-ঝি সবাই-ই খায়। সবাই পনের বোতল খায়।
– তার মানে?
জামাই পায় মাত্তোর পনেরো বোতল। পনেরো বোতলে কি চলে? তাই আমাদেরই সকলের নামে পারমিট আছে। পুলিশ এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল– আপনি মদ খান? আমি বলেছিলুম– হ্যাঁ–এই পর্যন্ত! পনেরো বোতলে যে জামাই-এর চলে না রে। তাই তো ওই মিথ্যে কথা বলতে হল আমাকে! চল্লিশ হাজার সম্পতির জন্য একদিন মিথ্যে কথা বলতে পারিনি, কিন্তু জামাই-এর জন্য মিথ্যে কথাটা বেমালুম বলে ফেললুম। কী করবো বল্ বাবা! নইলে যে জামাই-এর আমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে! ও কি বাঁচবে?
জ্যাঠাইমার কথা শুনে বড় কষ্ট হল। ভাবলাম এ কী হল ইন্ডিয়ার। একজন খাঁটি মানুষও রইলনা আর। জ্যাঠাইমার মত মানুষকেও শেষকালে মিথ্যেবাদী বানিয়ে ছাড়লে! আশি বছরের বুড়ো জ্যাঠাইমাও ভেজাল হয়ে গেল। এর চেয়ে যদি জ্যাঠাইমা সত্যি-সত্যিই পনেরো বোতল মদ খেত, সে-ও যে ভাল ছিল।