বিশাল হলরুমের মধ্যে বাজতে থাকা স্পিকারের গমগমে আওয়াজটা কানে লাগার কথা। কিন্তু লাগছেনা। একটা সুন্দর মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এমন সুরেলা পুরুষ কন্ঠস্বর ভেসে আসছে স্পিকার থেকে।
‘প্রিয় সুধী, মেডিটেশনের জাদুকরি ভূবনের আপনাদের স্বাগতম। নিজের মানসিক উন্নতির পথে নিজ উদ্যোগে এগিয়ে আসায় আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আজ আমরা শিখবো মানসিক শিথিলায়ন। অন্তরের শুদ্ধতার জন্য প্রথম ধাপ এটি। তাহলে শুরু করা যাক। আমি একুশ থেকে এক পর্যন্ত উল্টোদিকে গোনার সাথে সাথে চোখ বন্ধ করুন। আমি কিছুক্ষণ পরপর নির্দেশনা দিয়ে যাবো। আপনারা সেই অনুযায়ী কাজ করে যান। আরাম করে বসুন। ধীরে ধীরে দম নিন। ধীরে ধীরে দম ছাড়ুন। আপনাদের সকল মনোযোগ আমার দিকে নিবদ্ধ করুন।’
শেষের কথায় নির্দেশনার সুরে আদেশ দিচ্ছে যেন। আমি এসেছিলাম এক বন্ধুর আমন্ত্রনে। একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে মানসিক স্বাস্থের উন্নতির জন্য ফ্রি তে বেসিক মেডিটেশনের ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। ওদের ক্লাস পছন্দ হলে ইচ্ছুক ব্যক্তি নূন্যতম মূল্যে ফুল মেডিটেশনের কোর্স করতে পারবে ।
কয়েকদিন অফিসের কাজের চাপে মাথা পাগল হয়ে যাবার দশা হয়েছিলো। বন্ধু অনিককে বলায় সে মেডিটেশনের পরামর্শ দিলো। আমি এসবে তেমন বিশ্বাস করিনা দেখে বললো ‘ট্রাই করেই দেখনা। জিনিসটা কাজের। অলৌকিক কিছু তো আর নয়। সিম্পল বিজ্ঞান। যদিও অনেকে মানতে চায়না তবে যারা করে ফল পেয়েছে তারা কোনদিনই ছাড়তেই চাইবেনা। আমি নিজে সংগঠনটার সাথে আছি অনেকদিন। এদের উদ্দেশ্য সত্যিই মহৎ।’
আমি ভাবলাম শুক্র শনি তো অফিস ছুটি। সুযোগটা কাজে লাগাই না কেন। তাই সাতপাঁচ ভেবে শেষমেশ এসে পরেছি। আর সত্যি কথা বলতে এসে ভালোই লাগছে। শুরুর দিকে একটু অস্বস্তিবোধ ছিলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেটা কেটে গেছে।
এখানে যারা এসেছে সবার মুখেই স্মিতহাসি খেলা করছে। কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব চারদিকে। আজকের সেশনে পুরাতন লোকের সংখ্যা বেশি। আমি সহ গুটিকয়েক লোক আছে যার একেবারে নতুন। মেডিটেশনের ‘ম’ ও জানেনা।
স্পিকারে যে লোকটা নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলো তার কন্ঠ সত্যিই আকৃষ্ট করে। চুম্বকের মতন কানের ভেতরে আঁটকে যাচ্ছে তার প্রতিটি কথা। মনে তৈরী হচ্ছে অনবদ্য কথার গাঁথুনি। অনিক আমার ঠিক পাশেই বসেছে। ও চোখ বন্ধ করেই আমার কানে ফিসফিস করে বললো ‘আসল খেলা তো শুরু হবে পরে। তুই কিন্তু মনোযোগ হারাস না।’
বলে আমার পিঠে হাত দিয়ে মৃদু একটা চাপড় দিলো ভরসা দেবার ভঙ্গীতে। ওর হাতটা সম্ভবত কোন কারনে ভেজা। কারন চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আমার পিঠে ওর হাতটা রাখতেই মাথায় একটা উদ্ভট খেয়াল এলো। একটা ক্লেদাক্ত ঈষৎ উষ্ণ শুঁড় যেন কিলবিল করে উঠে আবার শান্ত হয়ে গেলো আমার পিঠেই! আমি হয়তো মেডিটেশনের গভীর স্তরে পৌছে গেছি। প্রথমবার বলেই অমন অদ্ভুতুড়ে চিন্তা আসছে মাথায়।
নির্দেশনায় বলা হচ্ছে যে আমাদের ব্রেনওয়েভ নাকি বিটা স্তর থেকে আলফায় নেমে গেছে। আমরা এখন হৃদয়ঘরে অবস্থান করবো। যে ঘর আমাদের মনের সর্বোচ্চ ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। কোন কমতি নেই যেই ঘরে। সেই ঘরে গিয়ে আমরা মনের সকল দুশ্চিন্তা ভূলে যাবো। পাখির কলতান, সমুদ্রের গর্জন শুনবো। সবার ক্ষেত্রে কি হলো জানিনা। আমার ক্ষেত্রে উল্টোটা হলো। আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলো। অথচ অদ্ভুত ব্যপার হচ্ছে কি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি সে ব্যপারে সম্পুর্ভাবে নিশ্চিত নই। খানিক বাদে বাদে স্পিকারে একটা লোকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে আর বিশাল হলরুমে কমপক্ষে একশোজন মানুষ চুপচাপ চোখ বন্ধ করে তা মেনে চলেছে। আমার ভয়টা ওখানেই। কখনো এত ব্যপক সময় ধরে একটানা চোখ বন্ধ করে থাকিনি আমি। তাই ভুলভাল ভাবা,শোনা বা অনুভব করাটা স্বাভাবিকই বটে। খালি মনে হচ্ছে এই সুযোগে অদৃশ্য কোন নির্দেশনায় সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবো। কোন আততায়ী চরম আক্রোশে হামলা করে বসবে আমাদের ওপর। কেন মনে হচ্ছে তা জানিনা।
চোখের পাতার দুটোর ওপর ভর করেছে রাজ্যের ক্লান্তি। শিথিলায়নের ফলে সত্যি শিথিল হয়ে গেছে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। চোখের পাতা খোলার ক্ষমতা আমার আর নেই। এখন যতক্ষণ পর্যন্ত না স্পিকারের কণ্ঠস্বর চোখ খোলার কথা বলছে আমি চোখ খুলতে পারবোনা। কেমন যেন নিরুপায় বোধ করছি। হাত পা বেঁধে ফেলে রাখা শিকারের মতন লাগছে। যেন কোন এক নরখাদকের দল পেটে রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে পাগলের মতন এগিয়ে আসছে আমারই দিকে! এসব ভাবছি আর অস্থিরতা বেড়ে চলেছে।
ধীরে ধীরে হৃদস্পন্দন বাড়ছে। সারাদেহে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিথর হয়ে পরে আছে। শুধু হৃদস্পন্দনের জন্য কাঁপছে বুকটা। অস্বাভাবিক তার গতি। ধুকপুক ধুকপুক শব্দটা কানে আসছে বেশ স্পষ্টভাবেই। নাহ। এখান থেকে একবার বেরিয়ে নিই । আর ঢুকবোনা এই মেডিটেশনের জগতে। মনের ওপর এমন অদ্ভুত সম্মোহন আমার সহ্য হচ্ছেনা। একবার অনিককে ডাকার চেষ্টা করলাম। মুখে রা নেই। গলা শুকনো খটখটে। ভয়ে ঢোক গিলতে হলো। নীরবতা মাখা পরিবেশটার কথা হুট করে ভাবলে মনে হবে চারপাশের সব লোকজন উঠে চলে গেছে । শুধু আমি অসহায় অবস্থায় একা পড়ে আছি নরম ম্যাটের ওপর! কোনক্রমেই নিজের মন বা দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারছিনা। কখন শেষ হবে এই সেশন?
মনের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে হাতদুটো নাড়াতে চেষ্টা করলাম। কয়েকবারের চেষ্টায় কাজ হলো। কিন্তু একি! আমার হাতের জায়গায় ওসব কি সাপের মতন একেবেকে হিসহিস করে উঠছে! চোখ খুলতে পারিনি কিন্তু অনুভব করতে পারছি আমার হাতের জায়গায় রক্তমাংসের হাতগুলো নেই। তার বদলে শোভা পাচ্ছে অক্টোপাসের শুড়ের মতন একজাতীয় শুঁড়! সেগুলো কাধে চেপে ধরলাম। ধরতেই একধরনের নরম আঠালো পদার্থে ভেসে গেলো কাধটা। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হলো। নিজের সম্পুর্ন দেহটাই যেন হাড় ছাড়া একতাল মাংসপিন্ডে পরিনত হতে থাকলো। আমি নিজের দেহের মাঝেই ডুবে যেতে থাকলাম। এটা কি কোন মারাত্মক দুঃস্বপ্ন!
না। দুঃস্বপ্ন নয় কারণ স্পিকারে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর অদ্ভুতভাবে পালটে গেছে। নরম গলাটা আচমকা একটা পৈশাচিক কন্ঠে বদলে গেছে। ঘড়ঘড়ে গলায় লোকটা বলে চলেছে ‘মাটির সোদা গন্ধটা নাকে যাচ্ছে আপনাদের? এটা কিন্তু নশ্বর পৃথিবীর মাটি নয়। আপনারা যারা আজকের এই মেডিটেশনের সেশনে এসেছেন তারা হবেন আমাদের দুনিয়ার নতুন দাস। আর যে চোখ বন্ধ করেছেন সেগুলো আর খুলবেনা কোনদিন! মেডিটেশনের জগতের কালো জগতটা সম্পর্কে আজ জানবেন আপনারা। যদিও এই মেডিটেশন আপনাদের ঠকানোর জন্য একটা মাধ্যম মাত্র। আর লোকটার কথা বলা শেষ হয়নি। পাষন্ডটার গলার আওয়াজ বেড়ে চলেছে। কানে অনুভব করছি চিনচিনে ব্যাথা। যেন এই মূহুর্তে কানের পর্দায় আঘাত করলো গলিত সীসার স্রোত।
আর কি বললো সেটা আবছা আবছা শুনতে পাচ্ছি কিন্তু আর অবাক হবার বা ভয় পাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। কারণ চোখের ওপর বস্তা সেলাইয়ের মতন ঘসঘস শব্দ হচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত বসে গেলো। কারণ আর কিছুই না। দুটো চোখের পাতা এফোঁড়ওফোঁড় ওঠানামা করছে একটা গরম সুঁই! নির্লিপ্ত অবস্থাটা আর জীবনে কোনদিন কাটবে কি?এই নারকীয় অধ্যায় শুধু মৃত্যুকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বলে চলেছে হে মৃত্যু,দেখো আমার কাছে তুমি কত নগন্য কত ছোট! হলরুমে যারা ছিলো তাদের মুখ থেকে কোন আওয়াজ বের হচ্ছেনা। টুঁ শব্দটি পর্যন্ত নেই। ওরাও বুঝে গেছে অজানা,অনন্ত অভিশাপময় একটা জীবনের শুরু হলো। যার শুরু আছে ঠিকই কিন্তু শেষ নেই!
(সমাপ্ত)